উপাসনা চক্রবর্তী, কলকাতা, ২৮ সেপ্টেম্বর#
‘ফেমেন’ সংগঠনের দুজন প্রতিবাদীকে ২০-২৫ জন পুরুষ নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে ১৪ সেপ্টেম্বর প্যারিসে। তাদের অপরাধ, তারা একটি ‘মুসলিম কনফারেন্স’-এর স্টেজের ওপর শরীরের ঊর্ধাঙ্গে কোনো জামা কাপড় না পড়েই উঠে পড়েছিল। ওই দু-জন মহিলা, একজনের বয়স ২৫, আরেকজনের ৩১; পরে তাদের পুলিশ গ্রেফতার করে — কনফারেন্সে তারা সাবোতাজ করার চেষ্টা করছিল — এই অভিযোগে।
যে ‘বিতর্কিত’ সম্মেলন চলাকালীন এই ঘটনাটি ঘটে, সেটি হচ্ছিল প্যারিসে, কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠনের ডাকে। বিষয় ছিল — ‘মেয়েদের ভূমিকা’। ফেমেন সমাজকর্মী ইনা শেভচেঙ্কোর কথায়, ফেমেন-এর মেয়েরা সম্মেলনের মঞ্চে উঠে পড়ে এবং মাইক টেনে নিয়ে বলতে শুরু করে। ইনার অভিযোগ, তখন মঞ্চে দু-জন আলোচনা করছিল — ‘বৌ-দের পেটানো উচিত কি না’ — এই বিষয়ে।
ফেমেন-এর দু-জন সমাজকর্মী শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন বোরখা পরে। সেই বোরখা খুলে রেখে, ঊর্ধাঙ্গের পোশাকও খুলে রেখে তারা মঞ্চে উঠে পড়ে। একজন মহিলা নিজের শরীরের ওপরের অংশে স্লোগান লিখে নিয়ে গিয়েছিল, ‘আমিই আমার নিজের প্রফেট’। আরেকজন মহিলার ঊর্ধাঙ্গে লেখা ছিল, ‘কেউ আমাকে দমাতে পারবে না।’
তারা মঞ্চে উঠে মাইকে তাদের মতামত আরবী এবং ফরাসীতে বলতে শুরু করেছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাদের দৃষ্টির বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় টানতে টানতে। একজনকে তো এলোপাথারি লাথি ঘুঁষি মারতে দেখা যায় স্পষ্ট।
শেভচেঙ্কো মিডিয়াকে আরো বলেন, দর্শকরা ওই মহিলাদের কাঁচা গালাগাল করতে শুরু করে, ‘নোংরা বেশ্যা’ ইত্যাদি বলে, এবং তাদের ‘খতম’ করার ভয় দেখায়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তারা মহিলাদের চিরাচরিত ভূমিকা আলোচনা করছিল এবং তাদের মেয়েলি দিকগুলোর প্রশংসা করছিল, যেমন রান্নাবান্না করা, ঘরের জন্য শপিং করা।
ফেমেন একটি ইউক্রেনিয়ান ফেমিনিস্ট গোষ্ঠী, তাদের প্যারিসেও শাখা আছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বহুল প্রচলিত যৌন-পর্যটন এবং পুরুষ-প্রাধান্যবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ফেমেন-এর সমাজকর্মীরা মিছিল করে, ফ্ল্যাশ-মব বা হঠাৎ-প্রতিবাদ সংগঠিত করার জন্য বহুল প্রচলিত।
এই ঘটনায় যা খুব তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, কেন মানব শরীর, আরো নির্দিষ্টভাবে বললে একজন মহিলার শরীরকে ঘৃণাভরে নিচু নজরে দেখা হবে? নিজেদের স্পর্শ করাও কখনও ভালোভাবে নেওয়া হয় না। একজনকে সবসময় অন্যজনের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে হয়। অন্যকে স্পর্শ করতে হয়। অন্যকে ভালোবাসতে হয়। আমরা কি আমাদের শরীর থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি যে আমরা নিজেদের শরীরকে কোনো সন্ত্রাসবাদী প্রপাগান্ডার অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে পারি? কারণ, যা একজনের কাছে সন্ত্রাসবাদী কাজ বলে মনে হয়, তা হয়ত আরেকজনের কাছে উচ্ছ্বসিত প্রতিবাদ। তা নাহলে প্যারিসের সম্মেলনে দুটি মেয়ের মঞ্চের ওপর ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত অবস্থায় উঠে পড়ার এহেন হিংসাত্মক পাল্টা-প্রতিক্রিয়া কেন? আমি তো আর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
একজন মহিলার অনাবৃত শরীর খুব সন্ত্রস্ত হওয়ার মতো দৃশ্য কেন? মহিলাদের পেটানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে হওয়া একটি সেমিনারের মঞ্চের ওপর দাপিয়ে বেড়ানো স্বেচ্ছায় ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত করা মহিলাদের শরীর খুবলে নিতে উপস্থিত পুরুষদের প্রবল ইচ্ছা কেন? কেন নগ্ন স্তন এত বিকার বলে মনে হয়? স্বল্প আবৃত স্তন যদিও একটা দেখার মতো জিনিস। অনাবৃত শরীরের কথা কেউ কল্পনাও করতে চায় না, কেউ আবার তা মোটেই দেখতেও চায় না। কারণ দেখলেই তা যদি ধ্বংস করে দিতে সাধ হয়? তাই আমরা আমাদের নগ্ন শরীরের দৃশ্য সহ্য করতে পারি না।
আমার মনে হয়, এ আমাদের বিকাশের ধারায় গড়ে ওঠা। আমরা বিকশিত হয়েছি এমনভাবে যাদের পোশাকের দরকার হয়। যতই কম হোক, পোশাক থাকতেই হবে, যদি শরীরকে কামনাযোগ্য হতে হয়।
তাহলে অ্যানার্কিস্ট বিপ্লব কি হবে নগ্নতাবাদী?
হতে পারে। কারণ,
নগ্ন হওয়ার জন্য কিচ্ছুটি লাগে না,
এবং নগ্নতার মতো সন্ত্রস্ত করতে আর কিছুই পারে না।
Leave a Reply