পরিমল আদক। কলকাতা। ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০।
(উক্তিগুলি “গাঁও কানেকশন”ওয়েবসাইটে মিথিলেশ ধর-এর ১৮ সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট থেকে নেওয়া।)
লোকসভায় পাশ হওয়া বিতর্কিত তিনটি নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সেই জুন মাস থেকেই পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা আন্দোলন করছে। রাস্তা রোকো, ট্র্যাক্টর র্যালি, বিক্ষোভ ইত্যাদি সত্ত্বেও লোকসভায় পাশ হয়েছে এই তিন আইন। রাজ্যসভায় পেশ হচ্ছে আজ। এই আইন তিনটির বিরুদ্ধে ২৪ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ‘রেল রোকো’ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাব জুড়ে। এছাড়া ২৫ সেপ্টেম্বর সারা ভারত বনধ্-এর ডাক দিয়েছে অনেকগুলি কৃষক সংগঠন।
দেখে নেওয়া যাক, এই আইনগুলি নিয়ে কৃষক নেতা-রা কী বলছেন।
ফসল বাণিজ্য আইন ২০২০ নিয়ে
অখিল ভারতীয় কিসান সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি-র সর্দার ভিএম সিংহ বলেন — “সরকার এক রাষ্ট্র, এক মার্কেট বানানোর কথা বলছে। কিন্তু সে এটুকু জানে না যে কৃষক নিজের জেলাতেই নিজের ফসল বিক্রি করতে পারে না। সে অন্য রাজ্যে বা অন্য জেলায় কীভাবে বেচবে ফসল? চাষির কি এত ক্ষমতা আছে? দূরের মান্ডিতে ফসল নিয়ে যেতে তো খরচা আছে। …”
” … এই আইনের ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, কৃষক-কে ফসলের দাম তিন দিনের মধ্যে দেওয়া হবে। কৃষক সঙ্গে সঙ্গে পয়সা না পেলে তাকে বার বার যেতে আসতে হবে তার গ্রামের থেকে দূরে কোথাও। দু-তিন একর জমির মালিক কৃষকের না আছে লড়াই করার ক্ষমতা, না তারা ইন্টারনেটে বেচাকেনা করতে পারবে। এই জন্যই কৃষকরা এই আইনের বিরোধিতা করছে।”
উনি আরো বলেছেন, “বিহারে ২০০৬ সাল থেকে এপিএমসি (রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত সবজি বাজার) নেই। ব্যবসায়ীরা তাই বিহার থেকে সস্তা দরে চাষিদের ফসল কেনে এবং সেই ফসল পাঞ্জাবে বিক্রি করে দেয় ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে। কারণ পাঞ্জাবে এপিএমসি সবজি মান্ডির জাল বিছানো আছে। সেখানে কম দামে ফসল বেচাকেনা হয় না। কেন্দ্রীয় সরকার যদি চাষির ভালোর কথা এতটাই ভাবে, তাহলে আরেকটা আইন আনুক। বাধ্যতামূলক ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন। যাতে বলা থাকবে, কোনো ফসল ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের চেয়ে কম দামে বেচাকেনা করা যাবে না। তবে চাষির ভালো হবে। ”
মধ্যপ্রদেশের রাষ্ট্রীয় কিসান মজদুর সংগঠনের নেতা রাহুল রাজ বলেন, “এই আইনগুলির ফলে মান্ডি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। এর ফলে কৃষকদের লোকসান হবে আর কর্পোরেট ও ফড়েদের লাভ হবে। ফসল বাণিজ্য আইন ২০২০ তে ‘এক দেশ এক বাজার’ -এর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সরকার এই কথা বলে ‘কৃষি ফসল বিপণন সমিতি’ (APMC)-র নিয়ন্ত্রণ ধ্বংস করতে চাইছে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের দাপাদাপি বাড়বে। কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাবে না।”
চুক্তি-চাষ আইন ২০২০ নিয়ে
সর্দার ভিএম সিং বলেন, “৩০ বছর আগে পাঞ্জাবের কৃষক পেপসি কোম্পানির সাথে আলু আর টমাটো যোগান দেবার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। এই আইনের ১০ নম্বর ধারা দেখলে বোঝা যায়, এই আইন কাদের স্বার্থে আনা হয়েছে। কৃষক সংস্থা ও কৃষি পরিষেবা সংস্থা-কে একইসাথে কৃষক বলা হয়েছে এবং কৃষক ও ব্যবসায়ীর মধ্যে বিবাদ ঘটলে তাকে দালাল বা ফড়ে হিসেবে ঢোকানোর কথাও বলা আছে। এর ফলে বিবাদ হলে লোকসান হবে চাষির।”
“বিবাদ মেটানোর জন্য ৩০ দিনের মধ্যে মীমাংসা অফিসে যেতে হবে। ওখানে না মিটলে, ১৩ নং ধারা অনুযায়ী সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের (এসডিএম) কাছে মামলা করতে হবে। এই মামলার সওয়াল-জবাব জেলা শাসকের অফিসে হবে। সেখানে জিতলে তবে কৃষক ক্ষতিপূরণ পাবে। দেশের ৮৫ শতাংশ কৃষকের জমি ২-৩ একরের বেশি নয়। বিবাদ হলে তার সমস্ত পুঁজি উকিল পুষতে আর অফিসে অফিসে চক্কর কাটতে কাটতে শেষ হয়ে যাবে।”
ভারতীয় কিষাণ মহাসঙ্ঘের নেতা অভিমন্যু করোড় বলেন, “এই ধরনের আইনের মধ্যে দিয়ে কৃষক নিজের জমিতেই লেবার-এ পরিণত হবে। এই আইনের মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চাষের পশ্চিমী মডেল আমাদের এখানে চাপিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু সরকার ভুলে যাচ্ছে, আমাদের এখানকার কৃষকরা পশ্চিমী দেশগুলির কৃষকদের মতো নয়। আমাদের এখানে বেশিরভাগ চাষি ছোটো জোত-এর মালিক। আমাদের এখানে চাষ হল জীবনযাপন করার উপায়। পশ্চিমী দেশগুলিতে চাষ হল ব্যবসা।”
অভিমন্যু করোড় আরো বলেন, “চুক্তি চাষে কৃষক-কে শোষণ করা হয়। গত বছর গুজরাতে পেপসি কোম্পানি কৃষকদের বিরুদ্ধে কয়েক কোটি টাকার মামলা করেছিল। পরে কৃষক সংগঠনগুলো বিরোধিতা করলে তবে কোম্পানি মামলা তোলে। চুক্তি চাষ-এ চাষ শুরু করার আগেই কোম্পানি চাষির সঙ্গে চুক্তি করে। তারপর চাষির ফসল তৈরি হয়ে যাবার পর কোম্পানি চাষিকে বলে, কিছুদিন অপেক্ষা করো। তারপর কোম্পানি চাষির ফসলের মান খারাপ বলে সেই ফসল রিজেক্ট করে দেয়।”
অত্যাবশ্যক পণ্য সংযোজনী ২০২০ নিয়ে
অভিমন্যু করোড় অত্যাবশ্যক পণ্য সংযোজনী ২০২০ নিয়ে বলেন, “যেটা বুঝতে হবে, আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ ছোটো চাষি। কৃষকের কাছে অনেকদিন ধরে ফসল মজুত করে রাখার কোনো উপায় নেই। এই সংযোজনী আনা হয়েছে, যাতে বড়ো বড়ো কোম্পানি কৃষিজ ফসলের কালোবাজারি করতে পারে, তার জন্য। কোম্পানি এবং সুপার মার্কেটগুলি কৃষিজ ফসল তাদের বড়ো বড়ো গুদামে মজুত করে রেখে দেবে। পরে যখন দাম বাড়বে, তখন বেশি দামে বিক্রি করবে সেসব।”
ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের নেতা ধর্মেন্দ্র মলিক বলেন, “এই আইনের ফলে খাদ্যশস্যের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আর থাকবে না। সবচেয়ে বড়ো আশঙ্কার কথা এটা। অত্যাবশ্যক পণ্য সংযোজনী ২০২০ র মাধ্যমে সরকার খাদ্যশস্যের মজুতদারির ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। করোনা সঙ্কটের সময় এই নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকার ফলে মানুষকে অন্ততঃ খাবারের ব্যাপারে চিন্তা করতে হয়নি। এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে কৃষির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও চৌপাট হয়ে যাবে। “
Leave a Reply