দীপক মাহাত। সিঙ্ঘু সীমান্ত, দিল্লি। ৮ ফেব্রুয়ারি,২০২১।#
আমরা ৪ ফেব্রুয়ারি জামশেদপুর থেকে বেরিয়েছি, ৫ তারিখ দিল্লি পৌঁছাইছি। মোট ১০৬ জন লোক এসেছে। জামশেদপুর থেকে, রাঁচী থেকে। সবাই গ্রামেরই বটে। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ লোকের ঘরে খেত আছে, যেমন আমাদের — ৪০ একর খেত আছে, বেশি ধান হয়। বেশিরভাগ আদিবাসী, সানতাল আছে, হো আছে।
প্রথমে এসে আমরা গেছি গাজীপুর সীমান্তে। ওখানে রাকেশ টিকায়েত বসে আছে। দ্বিতীয় দিন সিঙ্ঘুতে এসেছি। এখানেই মূল আন্দোলনটা চলছে। গাজীপুরে তো মিডিয়া টিকায়েতকে হাওয়া দিয়ে বাড়াইঞ্ছে। ৩২টা সংগঠনের বেশি এখানেই আছে, মিটিং-সিটিং এখানেই হয়। গাজীপুর দিল্লির পাশে। কনট প্লেসের ৬-৭ কিলোমিটারের মধ্যে গাজীপুর সীমান্ত। আর সিঙ্ঘু সীমান্ত থেকে কনট প্লেস ৫০ কিলোমিটার। হরিয়ানায় টিকায়েত যে নেতৃত্ব করে, তা আমরা বাইরে থেকে এসে যতটা বুঝতে পারছি, ও নিজে জাঠ বটে আর জাঠ ক্ষেত্র হরিয়ানা। জাঠরা এখন পুরাপুরি ভাজপার সঙ্গে নাইছে, আগে কংগ্রেসে ছিল এরা, ধীরে ধীরে ভাজপায় আইঞ্ছে। আমরা যতটা বুঝতে পারছি, ভাজপাওয়ালারা টিকায়েতকে দাঁড়াইন করে হরিয়ানার জাঠ-বিরোধী মানুষকে ম্যানেজ করছে। গাজীপুরে গিয়ে পুছো, ‘কে বড়ো নেতা’? — ‘টিকায়েত বটে’। কিন্তু তুমি যদি সিঙ্ঘু বর্ডারে যাবে, টিকরি বর্ডারে যাবে, ওখানে বড়ো নেতা কেউ নাই বটে। ক্যানে কি, আন্দোলনকে ভাঙবার আছে, নেতাকে পেলে সুবিধা। বলবে, ও অ্যায়সা করতা থা, ভাজপা কো সাথ দেতা থা … এইজন্য টিকায়েতকে দাঁড় করাচ্ছে এরা। টিকায়েত এখন আন্দোলনের পক্ষেই আছে। ২৬ তারিখ গাজীপুরের ঘটনা যখন হল, পুলিশের ইয়া ছিল ইসকো হটা দেনা হ্যায়। প্রথম স্টেটমেন্ট ছিল ওর, ওর ভাই রাজেশ টিকায়েতের — ‘হিঁয়াসে হমলোগ নিকলেঙ্গে, ঘর যায়েঙ্গে’। তারপর অচানক জনতার দাবাও হইল — আমরা যেটা বুঝতে পারছি — ও নিজের কথাটা পালটে নিল — ‘কুছ ভী হো যায়ে হম এঁহী রহেগা’। কেননা তুমি যদি দাঁড়াবে না, জনতা তোমাকে হটাইন দেবে। সুপ্রিম কোর্ট যে চারজনের কমিটি বানাইছিল, আরএসএস-এর ভারতীয় কিষান সংঘের যে আছে, ও নিজের নাম ওয়াপস নিল। জনতার দাবাও আছে তাই।
পাঞ্জাব হরিয়ানায় জনতা মোদির খিলাফে আছে, কওমের লড়াই। সিঙ্ঘুতে এখন আমরা যা দেখছি, মুখ্য যে মঞ্চ আছে হরিয়ানার দিকে, লগভগ ৪০ কিলোমিটার চারচাক্কা গাড়ি, ট্রাক্টর, ট্রলি আছে, দুয়ো সাইডে দাঁড়িয়ে আছে। তুমি হিসাব করে লাও, কত ট্রাক্টর হবে। ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাশাপাশি তিনটে-চারটে করে ট্রাক্টর, তারপর ১০ কিলোমিটার একটা করে। মনে হয়, যত গরম বাড়বেক, ঠান্ডা কমবেক, তত লোক বাড়বেক।
সিঙ্ঘুতে যারা টেন্ট লাগায়ে আছে, ওরা তো সম্পন্ন চাষি বটে। তাদের ট্রাক্টর আছে, চারচাক্কা গাড়ি আছে। ওরা লঙ্গর বসাইছে, খাবার বাঁটছে। যাদের কম জমি, যাদের জমি নাই, তারা তো ওদের খেতেই কাম করে। ওদের সঙ্গে এরাও আছে। আমরা যত লোকের সঙ্গে গল্প করি, সবার সঙ্গে কথা হয়। জাঠদের দেখলাম, মুসলমানও আছে হিন্দুও আছে। দলিতদের ঝান্ডা আছে, আদিবাসী আছে, সর্দার আছে, সবাই আছে এখানে। তামিলনাড়ু, ত্রিপুরার লোক এসেছে। লোক আসছে দূর দূর থেকে। বাংলার একজনকে দেখলাম ভাষণ দিচ্ছে। বাংলা থেকে একসঙ্গে অনেক লোক দেখলাম না। আমাদের ঝাড়খণ্ড থেকে আগেও লোক এসেছিল সিঙ্ঘুতে — পাঁচ লোক, সাত লোক। সংগঠিত আকারে আমরাই প্রথম এসেছি ঝাড়খণ্ড থেকে।
পাঞ্জাব হরিয়ানার হরিৎ ক্রান্তি যে বলে, এই ক্ষেত্রেই হয়েছিল। এই ক্ষেত্রের লোকের যখন কৃষি কানুনটা এত অসুবিধা হচ্ছে — আমাদের ঝাড়খণ্ডে যার দশ একর জমি আছে, এখানে তারা জমিনদার বটে। আমাদের যদি বিশ একর জমি থাকে, আমরা এদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারি না। ক্যানে কি আমাদের খেতে তো জল পৌঁছায়নি। এদের খেতে জল আছে, কারো পাঁচ একর জমিন আছে তো সে রাজা বটে! মানে সে বড়ো চাষি, আমাদের বিশ একর জমিন থাকলেও বড়ো চাষি নয়। তো এদের যখন এই কানুনে এত অসুবিধা হচ্ছে, আমরা ছোটো ছোটো চাষি, চাষিও নয় এদের গুনতিতে, আমাদের তো বেশি অসুবিধা হবে। যেমন, বিহারে যখন থেকে এমএসপি হটাইঞ্ছে, বিহারের আদ্ধেকের বেশি মজদুর পাঞ্জাব হরিয়ানা দিল্লিতে কাম করছে। নিজের খেতে কাজ না করে এখানে এসে কাজ করছে। এমএসপি নাই থাকার জন্য। আমাদের কী হবে? আমাদের দিল্লি পাঞ্জাব হরিয়ানায় মজদুরি করতে আসতে হবে। তাই এই কানুনটা রদ হোক, কৃষক-কেন্দ্রিক কানুন হোক। এমএসপি ধানে আছে, গমে আছে, অন্য সবজিগুলাতে নাই ক্যানে? যেমন আমাদের জামশেদপুরের পাশে পটমদায় গেলে দেখা যাবে, বিলাতি টমাটোর অনেক চাষ হয়। যখন রেট থাকে, তিরিশ টাকা চল্লিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকাও পাই। কিন্তু যখন চাষিরা বিলাতি ফলায়, এক টাকা দু-টাকাতেও লোকে কেনে না। কোল্ড স্টোরও নাই, রাখবেক কোথায়? আমাদের ক্ষেত্রে যে কোল্ড স্টোর আছে, ওতে সব ফলওয়ালারা রাখে। চাষিদের কোল্ড স্টোর তো নাই আমাদের। আমরা চাই, হর ক্ষেত্রে, হর প্রখণ্ডে কোল্ড স্টোর হোক। তাই এই কানুনটা রদ হোক, আরও ভালো কানুন বানানো হোক। আমরা সমর্থন করব মোদি সরকারকে।
Leave a Reply