দোন্থা প্রশান্ত, রহিতের সঙ্গে এই ছেলেটাও বিতাড়িত হয়েছিল হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল, ক্যান্টিন, কমনরুম, প্রশাসনিক ভবন, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি থেকে। ছেলেটা বর্ণনা দিচ্ছে — কী ঘটেছিল, ২২ জানুয়ারি#
২০১৫ সালের জুলাই মাসে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুজফফরনগর বাকি হ্যায়’ নামে একটি তথ্যচিত্র দেখানোয় বাধা দিয়েছিল এবিভিপি (হিন্দুত্ববাদী আর এস এস বিজেপির ছাত্র শাখা)। এরপর ২ আগস্ট দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আম্বেদকর রিডিং গ্রুপ’, মুম্বই-এর টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোস্যাল সায়েন্সেসের আম্বেদকর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, চেন্নাই আই আই টি-র আম্বেদকর পেরিয়ার স্টাডি সার্কেল, এবং হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আম্বেদকর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে সমাজের ওপর এবিভিপি ক্যাডারদের বেড়ে চলা হুজ্জোতির নিন্দা করে বিবৃতি দেয়। পরদিন ৩ আগস্ট আম্বেদকর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (এ এস এ) এই ঘটনার নিন্দা করে একটি প্রতিবাদসভা সংগঠিত করে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তা নিয়ে এখানকার এবিভিপি নেতা সুশীল কুমার একটা কমেন্ট পোস্ট করে ফেসবুক-এ — এ এস এ গুণ্ডারা আবার হুজ্জোতি নিয়ে কথা বলছে! আমরা তখন সিকিউরিটি অফিসারের সামনেই সুশীল কুমারকে এই ধরনের কমেন্ট ফিরিয়ে নিতে বলি। কারণ এটা আমাদের আত্মমর্যাদার বিরুদ্ধে। সুশীল কুমারের ক্ষমা চাওয়ার বয়ানে সিকিউরিটি অফিসারও সই করেন।
এরপরেই নাটক শুরু হয়। সুশীল কুমার হাসপাতালে ভর্তি হয়, এই কথা বলে যে আমরা তাকে বেধড়ক মেরেছি এবং তার ইন্টারনাল ইনজুরি হয়েছে। এবং সে আমাদের আরেকটি প্রতিবাদের ঘটনাকে (মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে) এর সঙ্গে জড়িয়ে আমাদের অ্যান্টি-ন্যাশনাল এবং টেররিস্ট বলে দেগে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে গোটা মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিজেপি নেতা রাম সুন্দর রাও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। সে উপাচার্যকে বলে, এই ছেলেগুলোকে উচিত শিক্ষা দাও, নাহলে বাইরের লোকেই এদের উচিত শিক্ষা দিয়ে দেবে। পুলিশ আমাদের ধরে রাখে পাঁচটা পর্যন্ত। ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করে। আমরা তখন উপাচার্যকে বলি একটা এক্সটেন্ডেড প্রকটরিয়াল বোর্ড কমিটি গঠন করতে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
এরপর একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং তদন্ত হয়। তদন্ত কমিটির কাছে ডিপোজিশনে আমি পরিষ্কার বলি, এই ঘটনার সঙ্গে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির বিরোধিতার কোনো সম্পর্ক নেই। তদন্ত রিপোর্টেও তা বলা হয়নি। ১২ আগস্ট ওই কমিটির রিপোর্ট আসে। তাতে আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়, কেন আমরা সুশীল কুমারের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার বয়ান নিয়েছি তার জন্য, এবং সুশীল কুমারকেও সতর্ক করে দেওয়া কেন সে ওই ধরনের কমেন্ট করেছে তার জন্য।
দোন্থার বক্তব্যর ভিডিও (৩ মিনিট থেকে দেখুন)
এর একমাসের মাথায় আমাদের সাসপেন্ড করা হয়। আমরা দু-দিন ধরে প্রতিবাদ করি, সাসপেনশনের বিরুদ্ধে এবং ঘটনায় রঙ চড়ানোর বিরুদ্ধে। উপাচার্য এই সাসপেনশন তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং একটি নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করেন। প্রফেসর আর পি শর্মা এমনকি এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যদের একথাও বলেছিলেন যে নতুন তদন্ত কমিটি আবার নতুন করে ঘটনাক্রম যাচাই করবে।
কিন্তু এরপর কী ঘটল আমাদের মাথায় ঢোকেনি। তিন মাস পর, কোনো নতুন তদন্ত রিপোর্ট ছাড়াই, প্রফেসর আপ্পারাও উপাচার্য হিসেবে আসার ঠিক পরেই তিনি আমাদের হোস্টেল থেকে সাসপেন্ড করেন, কমন রুম ক্যান্টিন প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদিতে ঢোকা বন্ধ করে দেন। এবং ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন প্রক্রিয়াতেও আমাদের অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেন। এটা শুধু অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তই নয়। এটা তার এক্তিয়ারেও পরে না। তাহলে ১১ সেপ্টেম্বরে আমাদের সাসপেনশন তুলে নেওয়ার নির্দেশের কী হলো? সেখানে তো পরিষ্কার বলা ছিল — একটা কমিটি তৈরি করা হবে। কোথায় তার রিপোর্ট, কে দোষী সাব্যস্ত হলো, কি শাস্তি ধার্য হলো আমরা কিছুই জানতে পারলাম না। কোথায় সেগুলো? কেন সেগুলো প্রকাশ করা হলো না? কেন এইভাবে রোহিত-কে ঠেলে দেওয়া হলো মৃত্যুর দিকে?
১৮ ডিসেম্বর রোহিত ভেমুলা উপাচার্যকে একটি চিঠি দেয়। সেখানে সে পরিষ্কার বলেছিল, এবিভিপির কথায় আপনি আমাদের সামাজিক বয়কটের রাস্তায় ঠেলে দিয়েছেন। তাহলে আমাদের ১০ গ্রাম বিষ দিন আর একটা দড়ি দিন, আত্মহত্যা করব। এই চিঠি লিখেছিল সে ১৮ ডিসেম্বর; আর ১৭ জানুয়ারি রাত্রে সে আত্মহত্যা করে; উপাচার্য কী করছিলেন? এই একমাস?
তিনি ইচ্ছে করে একমাস ধরে চুপচাপ ছিলেন। কারণ এই দলিত গবেষকদের সঙ্গে নেমে এসে কথা বলতে তার বাধছিল। দলিত শিক্ষকরা আমাদের নিজেরাই এসে বলেছেন, ওই উপাচার্য একজন জাতকুলীন — ওঁর মাথায় সেই ঔদ্ধত্যটা গেঁড়ে বসে আছে। ও তোমাদের সঙ্গে এসে কথা বলবে না। এই ঔদ্ধত্য নিয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয় চালানো হয় তাহলে সেই ছাত্রদের কী হবে যারা টিঁকে থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে?
রহিত নেই। আমরা চারজন আছি। আমরা উপাচার্য বা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো সহানুভূতি চাই না। কাল তারা বলেছেন, তারা আমাদের সাসপেনশন তুলে নিচ্ছেন। কিন্তু এখনো তারা আমাদের দোষী বলে মনে করেন। যদি এই উপাচার্য সাসপেনশনটা কয়েকদিন আগে তুলে নিতেন, তাহলে রহিতকে এভাবে মরতে হতো না। কেন আপনি জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে আগে কথা বলেননি। একজনকে মরতে লাগে আপনার একটু নরম হতে, এত আপনার দম্ভ? আপনারা শিক্ষকরা মিলে বসে ঠিক করুন — এই উপাচার্য কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর যোগ্য কি না।
আরেকটু সংযোজন। আমরা বারবার না বলা সত্ত্বেও আমাদের কীভাবে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সঙ্গে এই ঘটনাকে জড়ানো হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা কানে তোলেনি। বিজেপি নেতা বন্দারু দত্তাত্রেয় চিঠি লেখেন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রককে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সে চিঠি ফরোয়ার্ড করে দেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বন্দারু দত্তাত্রেয় কী বলল, তা অনেক বেশি বশ্বাসযোগ্য, ছাত্ররা কি বলল, তার থেকে। এবার আপনারাই ঠিক করুন এই উপাচার্য থাকতে পারেন কি না।
তৃতীয়ত, কেন পরবর্তী তদন্তটা গোপনে করা হলো? আগের তদন্ত রিপোর্টটিকে পুরোপুরি নাকচ করে দেওয়া হলো কেন?
রহিত নেই। আরেকটা রহিত যাতে এই ক্যাম্পাস থেকে না চলে যায় তার জন্য কিছু করুন। ঠিক করুন, এই স্বৈরাচারী প্রশাসন থাকতে পারে কি না ঠিক করুন।
Tapan Chanda says
likes