শ্রীমান চক্রবর্তী, হালতু, ২৬ জুন#
১৬ জুন জলাভূমি সংরক্ষণ দিবস পালিত হলো গোটা রাজ্যে। এই তালে দেখে নেওয়া যাক, কসবা-হালতু এলাকার জলাভূমিগুলির কী দশা।
কসবা-হালতু এলাকার জলাভূমির ইতিহাস
গত শতকের আশির দশকে কোলকাতা পুরসভার ‘নতুন সংযুক্ত’ ওয়ার্ডগুলির মধ্যে ১০৩, ১০৪, ১০৫, ১০৬, ১০৭ ছিল অন্যতম।
গড়ফা-কসবা-পূর্বাচল-হালতু-কায়স্থপাড়া-সন্তোষপুর-যাদববপুর-বিবেকনগর-ঢাকুরিয়া-শহিদ নগর নিয়ে গঠিত এই সংযুক্ত পুর এলাকার ওয়ার্ডগুলি। এই ওয়ার্ডগুলির মধ্যে ছিল বেশ কতগুলি উদ্বাস্তু কলোনি, তেমনি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি, যার মধ্যে ছিল অসংখ্য ছোট বড় মাঝারি পুকুর। আবার কতগুলি জলাশয় ছিল কয়েক বিঘের। গত শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক থেকেই বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তের অধীনে থাকা জলাশয় গুলি বোজানো ও বিক্রি হতে থাকে। অনেকেই জলের দামে সেই জলাশয়গুলি কিনে ফেলে রাখে ভবিষ্যতে বিক্রি করার লক্ষ্যে বা বাড়ি তৈরি করার উদ্দেশ্যে। এই অঞ্চলেই অনেকে আবার পুকুর লিজেও নিয়ে মাছ চাষ করতো দীর্ঘদিন ধরে। সাঁপুই পাঁড়া মন্ডল পাড়ায় আগে অনেক জেলেদের বাস ছিল।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব কোলকাতায় ধীরে ধীরে লোকসংখ্যা বাড়তে থাকলে ক্রমশ প্রায় সমস্ত জলাজমিই ছোট ছোট প্লটে বিক্রি হয়ে থাকে, এমনকি বড় বড় ঝিলও প্লটিং করে বিক্রি হতে শুরু করে। বিবেকনগর, পূর্বাচল কসবা অঞ্চলে এরকমভাবে বহু জলাশয় আশির দশকের পর বোজানো হয়েছে বাসস্থানের তাগিদে। আমাদের ছেলে বেলায় এরকম বহু জলাশয় ছিল যাতে আমরা সাঁতার কেটেছি, সেগুলিতে আজ বড় বড় ফ্লাট গজিয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে পুরসভার উদ্যোগে বহু জলাশয় বুজিয়ে গড়ে উঠেছে পার্ক বা খেলার মাঠ। ব্যক্তি মালিকানাধীন খেলার বেশ কিছু মাঠও বিক্রি হয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তদারকিতে।
কিন্তু ১৯৯০-এর দশক থেকেই দক্ষিন-পূর্ব কলকাতা জুড়ে ক্রমাগত জলাশয়গুলি ভরাট হয়ে যাবার ফলে যেমন একটু বৃষ্টিতে জল জমতে থাকে তেমনি গরমও বাড়তে থাকে। সর্বোপরি পাড়ার পর পাড়া শুধুমাত্র ক্রংক্রীট হয়ে যায়, সবুজ বলে, জলাশয় বলে কিছুরই আজ দেখা মেলে না। হাতে গোনা কয়েকটি জলাশয় এখন টিকে আছে যেগুলির মধ্যে বিবেকনগর ঝিল, গাঙ্গুলি পুকুর, রামলাল পুকুর, তারাপীঠ পুকুর, কায়স্থাপাড়ার পুকুর, বাঙ্কপ্লট সুইট ল্যান্ডের বালির ঝিলগুলি অন্যতম। ১০৪, ১০৫, ১০৬ নং ওয়ার্ডের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু জলাশয় রয়েছে যেগুলি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয়দের অবহেলায়। নিয়মিত জলাশয়গুলি পরিষ্কার ও মাছ চাষ হলে সেগুলি ভাল থাকে। কিন্তু অনেক পুকুরেই আজ আগের মতো মাছ চাষ হয় না, ফলে সেগুলির ওপর স্থানীয়দের যেমন নজর নেই তেমনি স্থানীয় পুরকর্তৃপক্ষের তরফেও কোন গরজ নেই।
১৯৯৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইনিল্যান্ড ফিশারি অ্যাক্ট, ১৯৯৩ (এ) নামে একটি আইন পাশ করেন কোলকাতায় জলাভূমি বোজানো আটকাতে। কিন্তু সেই আইনকে বিগত দুই দশকের বেশি সময় ধরে সবরকম ভাবেই অমান্য করেই হালতু-কসবা-পূর্বাচল অঞ্চলের জলাভূমি ভরাটের প্রক্রিয়া চলেছে। সরকারে যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন মোটা টাকার ইমারতি ব্যবসার কাটমানির জন্য সকলেই জলাভূমি বোজানোর প্রক্রিয়ায় নানাভাবে মদত দিয়ে চলেছে। কখন সরাসরি, কখনো পরোক্ষ ভাবে। তবে বেশ কয়েকটি জলাশয় আবার নাগরিক সচেতনতার জন্য রক্ষাও পেয়েছে। ১০৫ নং ওয়ার্ডের আশুতোষ কলোনির ঢাকুরিয়া ইস্ট ক্লাব সংলগ্ন পুকুরদুটিকে স্থানীয় নাগরিকের আন্দোলনের চাপেই পুরকর্তৃপক্ষ সংস্কারে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এখন এই অঞ্চলে জলাশয় বোজানোর প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি।
১০৬ নং ওয়ার্ডের জলাশয়গুলির সংরক্ষণ ও সংস্কার প্রয়োজন
বর্তমানে ১০৬ নং ওয়ার্ডের এরকম বেশ কয়েকটি জলাশয় স্থানীয়দের অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে। জলাশয়গুলি নিয়মিত পরিষ্কায় না হওয়ায় আশ-পাশের লোকজন তাতে ময়লা ফেলছে। স্থানীয়দের ত্রফে পুর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোন সুরাহা হয়নি।
১) রামলাল বাজার শনি মন্দিরের উল্টোদিকে পূর্বাচলের দিকে যে রাস্তা চলে গেছে সেই রাস্তায় যেতে পরোনো হালতু পোস্ট অফিসের পড়ে একটি জলাশয় সংস্কারের অভাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রামলালদের এই জলাশয়টির মালিকানা এখন কার হাতে তা সঠিক জানা নেই। তবে রাস্তার ধারে কয়েকটি গুমটি বসিয়ে জলাশয়টিকে নষ্ট করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
২) আবার পূর্বাচল মেইন রোড ধরে এগোলে পুরোনো রঙ কারখানার গলি বা রজনীকান্ত দাস রোড পেরিয়ে এলাকার অন্যতম দীর্ঘ মৈত্রদের কয়েক বিঘার পুকুরটি প্রায় এখন প্রায় অর্ধেক হতে বসেছে। স্থানীয়দের অবহেলায় এবং কর্তৃপক্ষের মদতে জলাশয়টির সব দিক থেকেই কোন না কোন অংশ বোজানো হয়েছে বাসস্থানের জন্য অথবা অন্য কোন স্বার্থে। বর্তমানে এই অঞ্চলে হাতে গোনা কিছু জলাশয় টিকে আছে। যেগুলির ওপর নজর স্থানীয় প্রোমাটারি ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের।
৩) ১০৬ নং ওয়ার্ডের মধ্যে হালতু-কায়স্থপাড়ার মিলনায়ন ক্লাবের পিছনে অপরূপা জুয়েলার্সের পাশ দিয়ে একটা ছোট গলির ভিতরে প্রায় দশ কাঠা মাপের একটি জলাশয় এভাবেই বোজানোর প্রক্রিয়া চলছে। এলাকাবাসীর তরফে লিখিতভাবে গণস্বাক্ষর সহ অভিযোগ বোরো অফিস এমনকি পুরসভার কেন্দ্রীয় দপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ জানিয়েও কোন সুরাহা মেলনি। অথচ পুরসভার তরফে সারা কোলকাতায় হোডিং টানিয়ে ১৬ই জুন পালিত হচ্ছে জলাভূমি সংরক্ষণ দিবস। অবিলম্বে কায়স্থপাড়া মিলনায়তন সংলগ্ন জলাশয়টির পরিষ্কার করে উপযুক্তভাবে সংস্কার করা প্রয়োজন।
৪) এই অঞ্চলেই নন্দীবাগান এস ডি এইট বাস স্ট্যান্ডের উল্টোদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে শরত পার্ক-এর ভিতরে শরত সংঘ ক্লাবের পরে রাস্তার উত্তর-পূর্ব দিকে চারদিক দিয়ে ঘেরা বাড়ি-ফ্লাটের মাঝখানে বোজানো চলছে দীর্ঘদিনের সরকার বাড়ীর মালিকানাধীন একটি বড়ো জলাশয়। কায়স্থপাড়া মেইন রোড দিয়েগেলে স্থানীয় তরুণ সংঘ ক্লাবের আগে ডানদিকে কয়েকটি ফ্লাটের পিছনে এই জলাশয়টিকে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। জলাশয়টির চারদিকেই নতুন ফ্লাট গজিয়ে ওঠায় তিন দশক আগের এই বড় জলাশয়টিকে খুঁজেই পাওয়া দুষ্কর।
আশ-পাশ থেকে বোজাতে বোজাতে এটি এখন ছোট ডোবায় পরিণত হয়েছে। আশেপাশের ফ্লাটের বাসিন্দারা প্রতিদিন এই জলাশয়টিতে ময়লা ফেলে সেই বোজানোর কাজে সহযোগীতা করছে। আর এলাকার একটি নামী ক্লাব তরুণ সংঘ পুকুরের ভেস্টেড অংশটিকে বুজিয়ে দখল নিয়ে রেখেছে। জলাশয়ের মালিকরা কয়েক ভাই। এদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ব্যক্তিও আছেন। প্রসঙ্গত এই এলাকায় প্রায় বেশির ভাগই অংশ ছিল সত্তর আশির দশকে জলাশয়ের অধীনে। সেগুলি বুজিয়েই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় আবাসন-ফ্লাট বা বাড়ি। হাতে গোনা পড়ে থাকা কয়েকটি জলাশয়কে বুজিয়ে ফেলার অর্থ নিজেদের ভবিষ্যৎঅকেই অনিশ্চিত করে তোলা। এছাড়া বর্তমান আইন অনুসারে কোনরকম জলাশয় বোজানো বা তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত দেওয়া আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।
এছাড়াও ১৯৯৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ইনল্যান্ড ফিশারি অ্যাক্ট, ১৯৯৩-এ’ আইন অনুসারে কলকাতায় যত্রতত্র জলাভূমি বোজানো আটকাতে আমরাও সক্রিয় হয়ে এগিয়ে আসতে পারি। কিন্তু প্রোমোটারি মুনাফার লোভে অনেকেই জলাশয় বোজানোতে মদত দিচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ক্লাবগুলি এদের পেছনে থাকায় তাতে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। অনেক সময় ফ্লাটের বাসিন্দারাও ক্রমাগত ময়লা ফেলে এই বোজানাতে মদত দিচ্ছেন এই যুক্তিতে যে এতে বড্ড মশা হয়।
আমরা হালতু জলাশয় সংস্কার ও সংরক্ষণ কমিটি, ‘ক্লোরোফিল’, দক্ষিণ কোলকাতা জনস্বার্থ মঞ্চ তরফে এলাকাবাসী ও পুরকর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন রাখছি এই জলাশয়গুলি অবিলম্বে সংস্কার ও সংরক্ষণে সক্রিয় ভাবে এগিয়ে আসতে। এলাকার বাস্তুতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে, গরমের বেহাল অবস্থার থেকে প্রাকৃতিকভাবে নিজ নিজ অঞ্চলের আবহওয়াকে দূষণ মুক্ত রাখতে এলাকার গাছ ও জলাশয়গুলি রক্ষায় আমাদের সক্রিয় হওয়া জরুরি। আসুন আমরা সকলে মিলে নিজ নিজ এলাকায় পরিবেশকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে সক্রিয় হই।
Leave a Reply