রোহিথ ভেমুলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানের ইংরেজি বয়ানটি ফেসবুক সূত্রে পাওয়া। বাংলা অনুবাদ শমীক সরকার। ২২ মার্চ প্রতিবাদী ছাত্র শিক্ষকদের ওপর অকথ্য পুলিশি নির্যাতনের ধারাভাষ্য এটি।#
আমি মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান। আমি হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানববিদ্যা স্কুলের ইংরেজি বিভাগের একজন এমফিল গবেষক, আমি উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ছিলাম। আমি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, একজন সংখ্যালঘু। আমার পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল। এখানে আমি আমার ও আমার সঙ্গীসাথিদের ওপর যে পুলিশি নিপীড়ন হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুলিশ ভ্যানে করে নিয়ে যার সময়, তার বর্ণনা দেব। ২২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে আমাদের মিয়াপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে।
হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে পর্যন্ত আমি সমাজের সমস্যাগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম না। দলিত এবং আদিবাসীদের চরম দুর্বস্থা সম্পর্কে আমার কোনো ধারনা ছিল না। ভারতীয় সমাজের বিপজ্জনক জাত ব্যবস্থার ফলাফল সম্পর্কে আমার প্রায় কোনো ধারনা ছিল না। কিন্তু হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমি জানতে পারি, এই জাত ব্যবস্থা কীরকম এবং তা দলিতদের কী চরম ভেদাভেদ এবং অমানবিক অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। আমি দেখলাম, এই জাত-ব্যবস্থা দলিতদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। একজন চিন্তাশীল এবং স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব কী তা বুঝতে পারলাম — এই জাত ব্যবস্থা অমানবিকতার হাতিয়ার এবং এটাকে শেষ করতে হবে। আমি জাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম, এবং রোহিথ ভেমুলা যে আন্দোলনের মধ্যে ছিল, তার একজন হয়ে উঠলাম।
রোহিথ ভেমুলা একজন দলিত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিপীড়িত, আত্মহত্যার দিকে তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ‘উপাচার্য অধ্যাপক আপ্পা রাও পোডাইল’ সরাসরি হস্তক্ষেপ করে ওই পাঁচ দলিত ছাত্রের প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক বয়কট করিয়েছিলেন, যার মধ্যে একজন রোহিথ। রোহিথের আত্মহত্যার পরে, উপাচার্যকে এসসি/এসটি প্রিভেনশন অফ অ্যাট্রোসিটিস অ্যাক্ট অনুসারে অভিযুক্ত হন, এবং ওই আইন অনুসারে অভিযুক্তের এফআইআর হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়ার কথা। যদিও, এফআইআর করা হয়েছিল ১৮ জানুয়ারি, ২০১৬ আর এখনো পর্যন্ত তিনি গ্রেপ্তার হননি। এটা সংবিধানের চরম অবমাননা। বদলে পোডাইল ২২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকেন এবং তার ‘উপাচার্য’ পদটি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন বেআইনিভাবে।
ওই একই দিনে, ২২ মার্চ ইংরেজি বিভাগের প্রি-সাবমিশন সেমিনার ছিল বেলা ২টোয়। সেখান থেকে বেলা তিনটের সময় বেরিয়ে আসতে গিয়ে আমি দেখি, পুলিশ প্রতিবাদী পুরুষ-নারী, শিক্ষক-ছাত্রদের নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছে। প্রতিবাদীদের তাড়া করে করে লাঠি দিয়ে মারছে। এটা সহ্য করা যাচ্ছিল না, যারা অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো, তারাই মার খাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর পুলিশি নিপীড়নের দিন ছিল ওটা। আমার চোখের সামনে একজন ছাত্র জ্ঞান হারালো, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগছিল ছাত্রী ও শিক্ষকদের নিষ্ঠুরভাবে পিটুনি খেতে দেখে। তাদের গোপনাঙ্গে মারা হচ্ছিল। আমি দেখলাম, একজন শিক্ষিকাকে শ্লীলতাহানি করল পুলিশ। এটা নারী অধিকারের পরিপন্থী কারণ ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের মারছিল পুরুষ পুলিশ। অঙ্কের শিক্ষক তথাগত সেনগুপ্তকেও মারা হলো। আমি জীবনের মতো ভয় পেয়ে গেলাম। চোখের সামনে এই পরিমাণ পুলিশি পেটানি আমি আগে কখনো দেখিনি। আর থাকতে পারলাম না, পুলিশের বিরুদ্ধে চিৎকার করে উঠলাম, ব্যস, এরপরের শিকার আমি।
যদিও পুলিশের আসল নিপীড়ন শুরু হয়েছিল, যখন একজন শিক্ষক, একজন ছবিনির্মাতা এবং ১৬ জন ছাত্র, যার মধ্যে আমি একজন, আমাদের টেনে হিঁচড়ে পুলিশ ভ্যানের মধ্যে নিয়ে আসা হলো। আমি গুডউইল ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যা উপাচার্যের লজের থেকে আড়াইশো মিটার দূরে। ওই লজের সামনে প্রতিবাদ করা হচ্ছিল। ওইখানে দাঁড়িয়েই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, ছাত্র শিক্ষকদের টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তোলা হচ্ছে। কিন্তু কখনো ভাবিনি, এর শিকার হবো আমি। হঠাৎ একজন পুলিশ আমাকে তাড়া করল, কলার চেপে ধরল। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, শুধু জাস্টিস ফর রোহিথ আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছি এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে ছাত্রআন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। আমার মনে হয় আমাকে টার্গেট করা হলো, কারণ আমি সরাসরি পুলিশটাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনমাস হয়ে গেল, রোহিথ কী বিচার পেল? রোহিথের হত্যাকারীরা কেন শাস্তি পেল না? উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্জ নিতে এলো কী করে? বদলে আমাকে পিটিয়ে ভ্যানে তোলা হলো।
এই নিষ্ঠুর অত্যাচার চলতেই লাগলো, প্রায় পঞ্চাশ মিনিট ধরে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিয়াপুর পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত। ভ্যানে তুলে পুলিশ আমাকে জোর করে এক কোনের দিকে বসিয়ে দিল। ফের মার খাওয়া শুরু হওয়ার আগে আমি আড়চোখে দেখে নিলাম, পাশে আরেকজন গ্রেপ্তার ছাত্র শুভদীপ কর্মকার। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এবার কী হবে, কারণ আমি এই প্রথম পুলিশ ভ্যানে উঠ্লাম। সে আমাকে আশ্বস্ত করল, কিচ্ছু হবে না, কারণ আমি তো অন্যায় কিছু করিনি। আমি ভ্যানে অন্যান্য ছাত্র শিক্ষকদের দিকে না তাকিয়ে পারলাম না। ফের পুলিশ আমার কাঁধে মারল। আমি অনুরোধ করলাম, না মারতে। পুলিশ আমার চুল ধরে টেনে আমার পিঠে ঘুঁষি মারল। আর একজন পুলিশ তেড়ে এসে আমার মোবাইল এবং চশমা ছিনিয়ে নিল। আমি যখন বললাম, আমার চোখের হাল খুব খারাপ, চশমাটি দিয়ে দিন, তখন এক পুলিশ আমার চোখে ঘুঁষি পাকিয়ে বলল, চোখে কানা তো পুলিশের প্রতিবাদ করতে এসেছিলি কেন? যখনই আমার সহযাত্রীদের পুলিশ পেটাচ্ছিল আর আমি চোখ তুলে তাকাতে যাচ্ছিলাম, পুলিশ এসে এক গোঁত্তা দিয়ে আমার মাথা নিচু করিয়ে দিচ্ছিল। আমার সহযাত্রীদের পুলিশ এত পেটাচ্ছে যে তারা যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। যাদের দাঁড়ি ছিল এবং মুসলিমদের মতো দেখতে, পুলিশ তাদের সন্ত্রাসবাদী মনে করে আরো বেশি পেটাচ্ছিল। সেই কিল চড়ের আওয়াজ আজও আমাকে তাড়া করে, ব্যথিত করে।
একজন চিত্রনির্মাতা, মোজেস অভিলাষ, দুর্ভাগ্যবশত এর মধ্যে পড়ে গেছিল। অভিলাষ কেবল পুলিশি পিটানির ছবি তুলছিল, আর পুলিশ চায়নি এই ছবিগুলো পাবলিক হোক, তাই। পুলিশের মারে আমার শরীরে দাগ পড়ে গেল। আমি জল চাইলে জল দিল, ফের যাতে মারতে পারে তার জন্য। শারীরিক নির্যাতনটি করা হচ্ছিল ভীষণ ব্যাকরণ মেনে এবং নিষ্ঠুরভাবে। কখনও কখনও আমার সন্দেহ হচ্ছিল, আমি মানুষ তো!
মারতে মারতে পুলিশ আমাদের ভীষণ গালিগালাজও করছিল। খুব খারাপ ভাষায়। ‘মাদারচোত’, ‘বহিনচোত’, ‘চুতিয়া’, ‘ভোসডিকে’ — এগুলো তো খুব সাধারণ গালি। আমাদের বলছিল, পাকিস্তানি আইএসআই দালাল। দেশের খায় পাকিস্তানের গুণ গায়, পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেব ইত্যাদি। আমাদের পুলিশ বলছিল, অ্যান্টি-ন্যাশনাল। বলছিল, আমরা ‘বিফ-ফেস্টিভ্যাল’ করি, ‘কিস-অফ-লাভ’ করি, ‘আফজল গুরু’ নিয়ে, ‘ইয়াকুব মেমন’ নিয়ে অনুষ্ঠান করি। পুলিশ বলছিল, এই কদিন আমরা তাদের খাটিয়েছি খুব, তাই তারা প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রয়াত বন্ধু রোহিথ ভেমুলাকেও ছাড়লো না তারা, বলল, ও তো একটা ‘বাস্টার্ড’, ‘নষ্ট বাচ্চা’, এবং লোকে শুধুমুধু ওর আত্মহত্যা নিয়ে শোর মাচাচ্ছে।
পুলিশের ভাষা ছিল ভীষণ নোংরা, মহিলা-বিদ্বেষী, লিঙ্গবাদী। ওরা বলছিল, ওরা আমাদের মা বোনেদের রেপ করবে, এবং তাদের এখানে নিয়ে এসে তাদের ন্যাকেড ভিডিও বানাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মহিলা বন্ধুদেরও একই হাল করবে বলে ভয় দেখালো। এইসব শুনে আমি আমাদের মহিলা বন্ধুদের নিরাপত্তার বিষয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ পোস্টিং যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, মহিলা কর্মচারী এবং ছাত্রীদের ওপর সরাসরি হুমকি, তাও বুঝলাম। সমাজের মহিলাদের নিরাপত্তার দিক দিয়ে দেখলে এদের এইসব বক্তব্য মারাত্মক খারাপ। পুলিশ এইভাবে মেয়েদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, ভাবতেই কেমন লাগে।
পুলিশ ভ্যানে এইরকম নিষ্ঠুর অত্যাচার হওয়ার পর মিয়াপুর পুলিশ স্টেশনে ফের অত্যাচার শুরু হলো। মিয়াপুরে যাওয়ার পর আমাদের থানার মধ্যে মেঝেতে একটা নোংরা ছোট্ট জায়গায় বসতে দেওয়া হলো। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কে ওয়াই রতনমকে ওই একই মেঝেতে বসতে দেওয়ায় খুব খারাপ লাগলো। পুলিশ আমাদের নৈতিকতা নিয়ে জ্ঞান দিতে লাগলো। ব্যবহার খুব বাজে। আর আমাদের ছবি ও ডিটেল তথ্য নিতে লাগলো। কখন ছাড়া পাব জিজ্ঞেস করাতে বলল, সব ‘ওপরওয়ালা’র হাতে, এবং গাচিবৌলি পুলিশ আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। ওরা সারারাত আমাদের জাগিয়ে রাখলো আমাদের চোখের সামনে আলো জ্বালিয়ে রেখে এবং গান ও ভিডিও চালিয়ে। যখন আমরা অনুরোধ করলাম, একটু ঘুমোতে দিন, ওরা হাসতে লাগলো।
পরদিন মিয়াপুর থানার সাব ইন্সপেক্টর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকলো এবং আমার সমস্ত তথ্য জানলো, আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন ইত্যাদি নিয়ে। আমার প্যানকার্ডের নাম্বার, আধার, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড — সব তথ্য। আমার মোবাইল ঘেঁটে পরিবারের তথ্যও নিল। খুব নোংরা গালিগালাজ করল। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হয় তাহলে আমাকে দেখে নেবে বলেও জানালো। বলল, আমি আর কিছু না করলেও আমি টার্গেট হয়ে গেছি।
তারপর আমাদের গোপনে বালানগর থানায় নিয়ে যাওয়া হলো, সেখানেও আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালানো হলো। পুলিশ আমাদের একটি নোংরা এবং দমবন্ধ ঘরে বসিয়ে রাখলো। অধ্যাপক রতনমকে আবার এক পুলিশকর্মীর পায়ের কাছে বসিয়ে রাখা হলো, আর পুলিশটা আমাদেরকে জাতীয়তাবাদ এবং শিক্ষা দীক্ষা ও সমাজের উন্নতি নিয়ে জ্ঞান দিতে লাগল। এই সেই মিয়াপুর থানার সাব-ইনসপেক্টর, যে আমাদের কদর্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল, আর বারবার মিথ্যে কথা বলছিল আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তরে। সে আমাকে উপহাস করতে লাগলো, আমাকে ‘টিম লিডার’ এবং ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলে বলতে লাগল। সে কেন আমাকে এসব বলতে লাগলো, তাও জানি না। কিন্তু বুঝলাম, আমি মুসলিম, তাই আমাকে টার্গেট করা হচ্ছে। আমার উদ্বিগ্ন পরিবারের সাথে কথা বলতে চাইতে, তাও নিষিদ্ধ হলো।
বালানগর থানা থেকে গোপনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো গভর্নমেন্ট এরিয়া হসপিটালে। আমরা খুব চমকে গেলাম, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে। আগের দিনের পুলিশের মারে আমার ব্যাথা হচ্ছিল। কিন্তু প্রত্যাশাই করিনি যে মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট পাবো। হাসপাতালে আমাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো জোর করে। আমার শরীরের বেহাল দশা হওয়া সত্ত্বেও ডাক্তার কোর্টে হাজিরার জন্য ফিট সার্টিফিকেট দিয়ে দিল আমাকে। দেখলাম অধ্যাপক রতনম-এর রক্তচাপের মাত্রা ২২০ তে গিয়ে পৌঁছেছে। ‘চিকিৎসা’র পর গাচিবৌলি থানার সিআই জে রমেশ আমাকে দিয়ে জোর করে আমার অ্যারেস্ট মেমোয় সই করিয়ে নিল, ২৩ মার্চ রাত ৯টায় নাকি আমায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২২ মার্চ বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। আমি প্রতিবাদ করলাম রমেশের কাছে। সে বলল, অ্যারেস্ট পেপারে সই না করা মানে আরো নানা কেস আমার ওপর দেওয়া হবে। কোনো আইনি বিশেষজ্ঞর সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা বলতে আমাকে দেওয়া হয়নি। যখন আমি খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার আমার কেরিয়ার টা তো খানচুর হয়ে যাবে যদি আমাকে এইভাবে নানা কেস দেওয়া হয়’। তখন সে আমাকে তাড়া মেরে বলল, ‘চোপা বন্ধ রাখো, নাহলে আরো কেস দিয়ে দেব।’ রমেশ যেভাবে আমার মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিল, তাকে ভাষায় কীভাবে প্রকাশ করব আমি জানিনা।
‘কোর্টে হাজির করার জন্য প্রস্তুত’ এই মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়ার পর, আমাকে ফের পুলিশ ভ্যানে ঢোকানো হলো। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আর কী গরম। আমি পুলিশকে অনুরোধ করলাম, যতক্ষণ ভ্যানটা না চলে, ততক্ষণ অন্তত আমাকে বাইরে রাখা হোক। কিন্তু পুলিশ ফের আমাদের হুমকি দিল। খিদে পাচ্ছিল খুব, সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। আমাদের কোনো সমস্যার কথাই পুলিশ শুনছিল না। মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাদের হাজির করানো হলো রাত এগারোটা চল্লিশে। কিন্তু গাচিবৌলি পুলিশ নবীন ও ভূপতি আমাদের ভোগান্তির বর্ণনা করতে দিল না মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে।
ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে আমাকে রাখা হলো চেরাপল্লী কেন্দ্রীয় জেলখানায়। জেল-এ এসে আমার দশা আরো খারাপ হলো। আমি জেলের এক ডাক্তারকে এত্তেলা দিলাম। তিনি আমাকে একটা সাধারণ ব্যাথানাশক ইনজেকশন দিলেন। কিছু ব্যাথানাশক ওষুধ দিলেন। কিন্তু তিনি আমাকে কোনো সাধারণ চিকিৎসা করলেন না, সেটাই আমার দরকার ছিল। আমার এখনও ভাবলে খারাপ লাগে, জেলখানার কুঠুরিতে ডাক্তার প্রবেশ করলেন না, তাই ইনজেকশন নিলাম আমি জানলা দিয়ে। আমি চোখের চিকিৎসাও পেলাম না, ২২ মার্চ পুলিশ ঘুঁষি মেরেছিল আমার ডান চোখে।
পুলিশের এই অত্যাচারে আমার জীবন সংশয়, এবং আমার পরিবারের আশা চৌপাট। আমি এখন আশাহীন, সহায়হীন, এবং নিরাপত্তাহীন। পুলিশ আমাদের ওপর মিথ্যে মামলা দিয়েছে, জোর করে, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ এবং জীবন সংশয়গ্রস্ত হয়। পুলিশ সন্ত্রস্ত করে রেখেছে তেত্রিশ জনকে যাতে আর কোনো প্রতিবাদ না হতে পারে সরকার এবং তার এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে। তারা আমাদের বারবার বলেছে, শুধু পড়াশুনা করো, রাজনীতি ছাড়ো। ওরা আমাদের ভয় ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে, যাতে আবার প্রতিবাদ করার আগে আমরা মনে রাখি, পুলিশ আমাদের কী করেছিল। সারা জীবন ধরে এই স্মৃতি আমাকে কুরে কুরে খাবে।
Leave a Reply