সৌম্য সেনগুপ্ত, ৪ জুলাই#
৩০ জুন, ২০১৬, বৃহস্পতিবার বাঁকুড়ার অবন্তিকা গ্রামে মানিকলাল সিংহ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (উঃ মা) এ পরিবেশিত হল কলকাতার নাট্য দল “স্বভাব” এর নাটক “হাত ঘোরালেই গল্প”। আমাদের অনেকেরই ধারণা আছে নাটক মানেই অনেক আয়োজন, মাইক্রোফোন, আলো, ড্রপ সিন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ধারণাকে ভেঙ্গে দিয়ে এসব ছাড়াই, এককথায় নিজেদেরই আনা সামগ্রী ব্যবহার করে, অনাড়ম্বরে ৩৫ মিনিটের এই নাটক ক্ষুদে থেকে বড় সকলকেই কখনও হাসিয়েছে, কখনও চমকিয়েছে, কখনও অবাক করেছে আর সর্বোপরি মগজ ব্যবহার করতে শিখিয়েছে। মানুষের মাঝে, বিশেষত শিশুদের পাশে বসিয়ে রেখে তাদেরই সুখ-দুঃখ-আনন্দ-যন্ত্রণার কথা বলার পিপলস থিয়েটারের ঘরাণার এই রূপ রস গন্ধ বর্ণ, মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করল লাল মাটির শিশুরা।
দুটি লোককথার মিশ্রণে জারিত তিনটি গল্পের “না-মানুষ” চরিত্ররা নেচে গেয়ে পুরো শরীর দিয়ে অভিনয় করে চোখের সামনে ঘটে চলা “সাধারণ” ঘটনাকে যে “অসাধারণ” গল্পের আকারে বলে মুগ্ধ করে মাতিয়ে রাখল দর্শকদের তা এককথায় অভাবনীয়। নাটকের শেষে ছিল শিশু দর্শকদের সাথে আলাপচারিতা। তাতে দুপক্ষই আপ্লুত। অভিনয়ে ছিলেন অঙ্কুর -পাপিয়া -বাপ্পা –কুনাল- বর্তিকা ও সহযোগিতায় হরেকৃষ্ণ।
৮ বছর ধরে সারা ভারত জুড়ে পিপলস থিয়েটার ঘরানার এই নাট্য দলের কুশীলবরা নিজেদের কেরিয়ার অপশন ছেড়ে, কেবল নাটকের মধ্যে দিয়ে মানুষকে কিছু বলার আন্তরিক তাগিদে মানুষের কাছে হাজির হয়ে চলেছেন। এছাড়াও ওনারা ছোটদের নিয়ে নাট্য গ্রুপ বানানোর কাজও করেন যেখানে নাটকের আকারে ছোটরা ছোটোদের সামনে নানা সমস্যা ঘাত প্রতিঘাত তুলে ধরে। ওনারা মনে করেন নাটক, বিকল্প শিক্ষা প্রদানের এক অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। তাকে কত সহজ সরল অথচ আনন্দদায়ক করা যায় তা নিয়েই ওনাদের চর্চা, যাতে তাঁরা রীতিমত মুন্সিয়ানার দাবী রাখেন। নাটককে কেন্দ্র করে কারিকুলাম বানানোও ওনাদের অন্যতম লক্ষ্য। আলাপচারিতায় অঙ্কুর জানালেন অভিবাসন সমস্যার মত এক গোটা বিশ্বের সমস্যা নিয়ে “স্বভাব” প্রজোজনা “মোদের কোনও দেশ নাই” এর সাফল্যের কথা ।
আবার কিছু সমস্যার কথাও অকপটে জানালেন। নাটক –এই নেশাকেই পেশা করাটা ওনাদের কাছে রীতিমত চ্যালেঞ্জ। “এমনও স্কুল আছে, যেখানে একটা পয়সাও আমরা পাইনি” আক্ষেপের সুরে জানালেন অঙ্কুর। বললেন “অনেক কষ্টে কোনওমতে এগিয়ে চলছি আমরা, সাথে আছেন কিছু শুভানুধ্যায়ী যারা কিছু চাঁদা দেন, কিন্তু এভাবে চলতে পারা মুশকিল। আমাদের দলে যে ২৪-২৫ এর ছেলেমেয়েদের দেখছেন, তাঁদের কাছে কিন্তু আরো বেটার ক্যারিয়ার অপশন ছিল, কিন্তু সেসব ছেড়েই ওরা এসেছে। কিন্তু পথ চলতে ন্যুনতম একটা খরচ তো লাগে তাই না? দেখুন স্কুল কলেজে নানা অনুষ্ঠানে বহু খরচ হয়, তাঁরা যদি এগিয়ে আসেন, ধরুন গোটা ৫০ স্কুল আমাদের জানালেন, ঠিক আছে আপনারা নতুন নাটক বানান, আমাদের স্কুলে আপনাদের ডাকব, তাহলে নতুন নতুন নাটক বানানোর চিন্তা আমরা নিশ্চিন্তে করতে পারি” একটু থেমে প্রত্যয়ের সাথে জানালেন “তবে আমরা আশাবাদী”।
আগের দিন বাঁকুড়ার পাঁচাল ও লোখেসোল এ এলাকার বন্ধু হরেকৃষ্ণ-র আহ্বানে মানুষের মাঝে নাটক করতে এসে মানিকলাল সিংহ স্মৃতি মাধ্যমিক স্কুলের হঠাৎ এই আয়োজনে স্কুলের ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক শিক্ষিকা থেকে “স্বভাব” নাটক দলের সকলেই খুব খুশি। স্কুলের টি আই সি শুকলাল হাঁসদা আপ্লুত কণ্ঠে জানালেন “আমার পড়ার বিষয় নাটক ছিল। নাটকের প্রতি ভালোবাসা আমার মননে। গ্রামের শিশুরা তো এখন সেভাবে নাটক দেখার সুযোগ পায়না, তাই এ আমাদের এক অনন্য পাওনা। ছাত্র ছাত্রীরা যে আনন্দ পেয়েছে, তাতেই আমরা খুশি। আগামী দিনে আবার ওনাদের আমাদের স্কুলে আমন্ত্রণ জানাবো”। স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষিকা রেখা ঝারিমুণ্যা বললেন “বিনা মাইকে, বিনা কৃত্রিম আলোকে, বিনা সাজ সরসঞ্জামে, বিনা আড়ম্বরপূর্ণ মঞ্চ সজ্জায়, বিনা যান্ত্রিক আবহ সঙ্গীতে দিনের ঝলমলে আলোয় একটা গল্প কে ফুটিয়ে তোলাই শুধু নয় তার সাথে বেশ কিছু বার্তা যে এত সুন্দর ভাবে পৌঁছান যায় সেটাই অবাক হয়ে দেখলাম। গ্রীন রুম ছাড়াই, পর্দা বিহীন মঞ্চের মধ্যে একই ব্যাক্তি বিভিন্ন চরিত্রে কীভাবে আসতে পারে তার সহজতম অথচ নিখুঁত কৌশল দেখলাম। নাটক দেখতে দেখতে মনে হল, এটা যেন সঙ্গীত-নৃত্য –মাইম এবং নাট্যাভিনয়য়ের এক অপূর্ব মিশ্রণ”। স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র অনুপ জানালো –“এরকম নাটক আমি বা আমার বন্ধুরা কখনও দেখিনি। আবার এমন নাটক দেখার সুযোগ পেলে আমাদের ভালো লাগবে”। মঞ্চ সজ্জা ছাড়াই এমন নাটক খুব ভালো লেগেছে জানিয়ে দশম শ্রেনির রোহিত জানালো “পরিবেশ ও সমাজের নানা বিষয় সম্পর্কে আমরা সচেতন হলাম ”।
সংস্কৃতের শিক্ষক গুরুপদ মানিক জানালেন –“পশু পাখির মুখ দিয়ে গল্প বলে আমাদের কয়েকটা বার্তা ওনারা দিতে চাইলেন। যেমন মানুষে মানুষে কোনও বিভেদ থাকা উচিৎ নয়, কেউ বড়, কেউ ছোটো কিংবা কেউ উঁচু কেউ নীচু, সমাজে এমন বিষয় থাকা ঠিক না। প্রকৃতির সব কিছুর উপর সবার সমান অধিকার থাকা উচিৎ এই সব। আবার কৃষি কাজে রাসায়নিক প্রয়োগে ফসল আমরা বেশি পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর তার কী ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে, প্রকৃতি কিভাবে ধ্বংসের দিকে চলছে তা তো সবারই জানা দরকার, জানানো দরকার, তাই না? এই সব বার্তা এইভাবে নাটকের মধ্যে দিয়ে শেখালে শিশুরা অনেক ভালোভাবে শিখবে”। উনি আরো বললেন –“আমার মনে হয় প্রতিটা স্কুলে, কী প্রাইমারী কী হাইস্কুল, এই নাটকটির প্রদর্শন করা উচিৎ। আসলে এই নাটকটি না দেখলে বোঝাই যাবে না এটা কী সুন্দর একটা অনুষ্ঠান। আর একবার হলেই মনে হবে আরো হোক। এর প্রচারটা কিন্তু খুব ভালোভাবে হওয়া দরকার, এ ব্যপারে আমি আমার সাধ্যমত সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত”।
“স্বভাব” এর যোগাযোগঃ- অঙ্কুর-৯৮৩১৭৯৪৯১০
Leave a Reply