অলোকেশ মণ্ডল, বাগনান, ৩১ অক্টোবর#
পুজোর ছুটির দিনগুলোতে লেখাপড়া করার জো নেই। সে আপনি শহরে বা গ্রামে যেখানেই থাকুন না কেন? এদিকে ওই দিনগুলোতে সমিতির কোনও প্রোগ্রাম ছিল না। তাই যখন শুনলাম গোপালদা, বিশ্বজিৎদা এবং তুষারদা সপরিবারে ও সবান্ধব সুন্দরবন যাচ্ছেন – লোভ সামলাতে পারলাম না। আমিও সপরিবারে ও সবান্ধব যোগ দিলাম। কাকলি আর দুই মেয়ে তো হাতে চাঁদ পেল। ছোটোটা মাধ্যমিক দেবে। সদ্য টেষ্ট পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত। মন-মেজাজ ভালো থাকলে মাধ্যমিকের রেজাল্টও ভালো হবে বলে মনে করে ওর মা। বললো- চলো ঘুরে আসি।
শিয়ালদা থেকে ট্রেনে ক্যানিং তারপর ট্রেকারে গদখালি। সড়কপথ এখানে শেষ। এরপর লঞ্চে প্রথমে গোসাবা তারপর অন্য দ্বীপ। আমার কাছে ভ্রমণ মানে কেবল প্রকৃতি নয়, যে মানুষজনকে সাথে নিয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করবো তারাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবনের মানববর্জিত দ্বীপগুলো নদীপথে লঞ্চে বা নৌকায় ঘুরিয়ে দেখানো এবং দ্বীপগুলোতে তৈরি ওয়াচ টাওয়ারে উঠে জীবজন্তু পর্যবেক্ষন করা – এছাড়া কোনও কাজ নেই। লঞ্চেই রান্না-খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে।
সুন্দরবন সীমান্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার লঞ্চে আমাদের ঘোরার কথা ছিল। সেটা মেরামত হচ্ছে তাই উৎপলবাবু আমাদের জন্য এম ভি বাবা সুরিন্দর নামে অন্য একটা লঞ্চ ঠিক করেছেন। আমরা মোট পঁচিশ জন ছিলাম তাই আপনজন নামের হোটেলে রাত কাটাতে হয়েছে। নইলে দশজন হলে হোটেলে না গিয়ে লঞ্চেই রাত কাটানো যেত। লঞ্চে খাবার তৈরী করে হোটেলে এনে খাইয়েছেন আমাদের ট্যুর-অপারেটর নিমাইবাবু। সুন্দরবন আর বাঘ সমার্থক।
বাঘের দেখা মেলেনি তাই অনেকেরই মনের মত ট্যুর হয়নি। তারা হয়তো আরো এডভেঞ্চার প্রত্যাশা করেছিলেন। কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার জঙ্গলে কয়েকটা বাঘ থাকলে সব ভ্রমণার্থী বাঘের দেখা পাবেন কি করে? তাও জঙ্গলের ষাট শতাংশ বাংলাদেশের অন্তর্গত। আর আমরা শহুরে মানুষজন হরিণের পাল দেখে যেভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম বাঘ দেখলে কি করতাম তা সহজেই অনুমেয়। জঙ্গলের রীতিনীতি না জেনে সেখানে যাওয়াই বৃথা। আর আমাদের এতবড় লঞ্চ ও তার আওয়াজে বাঘ তো পালিয়ে বাঁচবে। ভাবছিলাম তেলের বদলে যদি সোলার সিস্টেম করা যেত আর লঞ্চগুলোর রঙ যদি জঙ্গলের উপযোগী করা যেত ?
তবুও কবে কখন কারা বাঘের দেখা পেয়েছেন তার একটা তালিকা দেখলাম সজনেখালির ট্যুরিস্ট স্পটে। বাঘ দেখার গল্প না থাকলে গোটা পর্যটন ব্যবস্থাই লাটে উঠবে তাই হয়তো এই প্রচেষ্টা। এখনও পাখিরালায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন হোটেল।
একজনের পোষাকে সঙ্গতিসম্পন্ন অথচ কানে সুতো বাঁধা দেখে যেচে আলাপ জমালাম। সপরিবারে ঘুরছেন। মেদিনীপুরে গিয়ে হাড়ভাঙার চিকিৎসা হিসেবে কান ফুঁড়িয়ে শিকড় বেঁধেছেন। আপনিও এই কুসংস্কারের শিকার?- প্রশ্ন রাখলাম। আমার টিমের কেউ ফোড়ন কাটলেন- এখানেও যুক্তিবাদী কথাবার্তা? আমরাও বাগনান থেকে এসেছি শুনে খুশি হলেন। আর কান ফোঁড়ানোর অজুহাতে একটা প্রবাদ শোনালেন – হাতি যখন_ __ __ _। আমি কেবল ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ আর নাপিতের ব্লেড কেন পাল্টাতে হয় তার কারণগুলো স্মরণ করতে বললাম।
ওঁর সঙ্গী গাইড জানালেন যে উনি পাখিরালায় নতুন হোটেল বানাচ্ছেন। এদিকে সারাক্ষণ মুভি ক্যামেরায় ফটো তুলতে ব্যস্ত ছিলেন গোপালদা। কাছে দূরে যাকেই পাচ্ছিলেন দাঁড়াতে বলে জুম করছিলেন। তুষারদার অধীনে শিক্ষানবিস হিসেবে আছেন বলে জানালেন। শেষ পর্যন্ত কি ছবি হবে কে জানে? সাথে সর্বক্ষণ মুখ চলছিল হয় খাওয়া নয়তো কথা বলাতে ব্যস্ত ছিলেন। শুধু গোপালদা নয় আসলে সবাই যে যার ক্যামেরা বা মোবাইলে সময়কে ধরে রাখতেই ব্যস্ত।
গাইড, নিমাইবাবু, লঞ্চ মালিক কাম চালক বাপিদা ও তাঁর সহকারীর থেকে যাবতীয় জ্ঞাতব্য জানছিলাম। আর নীচে সারাক্ষণ যিনি রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি যে একজন স্কুলশিক্ষক তা গোপালদা না বললে অজানাই থাকত।
লাহিড়ীপুরের জেমসপুরে যাবার ইচ্ছে হয়েছিল। ওখানেই চলে একটা ক্লিনিক। মাঝে মাঝে পুণ্যব্রত গুণ বা অন্য কোনও ডাক্তার কলকাতা থেকে আসেন। বাকি সারা বছর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরাই সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ভরসা। হেঁটে যাওয়া আসা সময়সাপেক্ষ বলে যাওয়া হল না। তবে নদীপথে চলতে চলতে মনতোষদা এইখানে থাকতেন বলে আঙুল তুলে দেখালেন।
মনতোষ মন্ডলের হাত ধরে শুরু হয়েছিলো এই সীমান্ত এলাকার চিকিৎসা পরিষেবা। ক্যানসারে তাঁর জীবনাবসান হলেও স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজ চলছে। উৎপলবাবু এখন দেখাশোনা করেন। প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে প্রশাসনের নোটিশ দেখে ভালো লাগলো। সমস্ত লঞ্চেও সতর্কতা রয়েছে। লঞ্চে বা হোটেলে ডাস্টবিনের ব্যবস্থা আছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার আছে তবে যত্রতত্র ফেলতে মানা। তবুও আমরা মানুষ – জ্ঞানপাপী দুপেয়ে জীব। নদীতে দু’একটি বোতল ভেসে যেতে দেখলাম।
আমাদের লঞ্চের চেয়ে বড় লঞ্চ দেখা গেল। এয়ারকন্ডিশন এবং সোলার ওয়াটার হিটারের ব্যবস্থা সহ। বোঝা গেল- সব শ্রেণীর মানুষের জন্যে ব্যবস্থা আছে। সবগুলো টুরিস্ট স্পটে একটা করে বনবিবির মন্দির আছে। সরকারি এই মন্দিরে গ্রামের মানুষ আসেন না। কিন্তু দানবাক্স আছে। হয়তো বাৎসরিক অনুষ্ঠানও হয়। আমজনতার ঈশ্বর বিশ্বাসকে জাগিয়ে রাখতে সরকার কত সজাগ।
ফেরার সময় নিমাইবাবু জানালেন সুন্দরবন ঘুরতে হলে তিথি মেনে ঘোরা উচিত। আপনারা এসেছেন পূর্ণিমার কোটালের সময়। এখন নদীতে জল বেশি। জীবজন্তুরা এখন জঙ্গলের ভিতর। শীতকালে পঞ্চমী ষষ্ঠী তিথি হল সঠিক সময়। নদীর খোলে জল থাকে। জীবজন্তুরা নদীর ধারে আসে। দেখার সুযোগ মেলে। আমাদের তো ভুল হল। আপনারা এই ভুল করবেন না যেন।
Leave a Reply