বারো দিন আগে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল থেকে বিতাড়িত হয়েছিল রহিত ভেমুলা সহ পাঁচ গবেষক, প্রত্যেকেই আম্বেদকর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বা ASA সংগঠনটির সদস্য। সেই থেকে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকছিল ওরা। আর এস এস-এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপির অভিযোগের ভিত্তিতে এবং বিজেপি নেতা বঙ্গারু দত্তাত্রেয়র হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল বলে অভিযোগ। দিন পাঁচেক আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিহিত চাইতে গেলে এবিভিপির সঙ্গে মারপিট হয়। অন্যান্য কিছু ছাত্রসংগঠনের কিছু সদস্য এই পাঁচ গবেষকের সঙ্গে রিলে অনশন আন্দোলনও শুরু করেছিল। তারই মাঝে ১৭ জানুয়ারি রবিবার রাত্রে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে রহিত ভেমুলা। রহিতের সুইসাইড নোটটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন শমীক সরকার #
সুপ্রভাত,
তুমি যখন এই চিঠিটা পড়ছ, তখন আমি আর কাছেপিঠে নেই। রাগ কোরো না আমার ওপর। জানি আমি, তোমাদের কারোর কারোর সত্যিই আমার প্রতি দরদ ছিল, আমাকে ভালোবাসতে, আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতে। কারোর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার চিরকালের সমস্যা হলাম আমি নিজে। আমার আত্মা আর দেহের মধ্যে ফারাক বেড়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি। আর আমি হয়ে উঠছি এক দৈত্য। আমি সবসময় লেখক হতে চেয়েছি। বিজ্ঞান লেখক, কার্ল সাগানের মতো। অবশেষে এই একমাত্র চিঠি যা আমি লিখে উঠতে পারলাম।
আমি বিজ্ঞান ভালোবাসতাম। নক্ষত্র, প্রকৃতি ভালোবাসতাম। কিন্তু তারপরেও আমি মানুষ ভালোবাসতাম এটা না জেনেই যে মানুষ দীর্ঘকাল হলো প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাদের অনুভবগুলি হাত-ফেরতা। আমাদের ভালোবাসা নির্মিত। আমাদের বিশ্বাসগুলি রাঙানো। আমাদের নিজস্বতার প্রমাণ হলো কৃত্রিম শিল্পকলা। ঘা না খেয়ে ভালোবেসে যাওয়া খুব কঠিন হয়ে গেছে।
মানুষের মূল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আপাত সত্ত্বায় এবং আশু সম্ভবনায়। একটা ভোটে। একটা সংখ্যায়। একটা জিনিসে। কখনোই তাকে একটা মন হিসেবে নেওয়া হয় না। নক্ষত্রের কণা দিয়ে গড়া এক মহান সৃষ্টি বলে নেওয়া হয় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে, কি পড়াশুনা, কি রাস্তাঘাট, কি রাজনীতি, কি বাঁচা-মরায়।
আমি এই ধরনের চিঠি এই প্রথম লিখছি। প্রথম লেখা শেষ চিঠি। ক্ষমা করে দিও আমাকে যদি কিছু না বুঝতে পারো।
হতে পারি আমি ভুল — এই পৃথিবীকে বুঝতে ভুল করলাম। ভুল বুঝলাম ভালোবাসা, যন্ত্রণা, জীবন, মরণ। কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না। কিন্তু সবসময় আমি দৌড়ে গেলাম। একটা জীবন শুরু করতে হবে যে ভাবেই হোক। আর কিছু মানুষের কাছে জীবনটাই হলো একটা অভিশাপ। আমার জন্মটাই হলো আমার প্রাণসংশয়ী দুর্ঘটনা। আমি কখনোই ছোটোবেলার একাকীত্ব থেকে বেরোতে পারিনি। আমার অনাদরের শৈশব থেকে।
এই মুহুর্তে আমি আহত নই। দুঃখিত নই। কেবল ফাঁকা। নিজের প্রতিই কোনো দরদ নেই। এটা দুর্বিষহ। আর তাই আমি এই কাজ করছি।
জানি চলে গেলে লোকে আমায় বলবে ভীতু। বলবে স্বার্থপর, অথবা বোকা। কে কী বলল তাতে আমার কিস্যু এসে যায় না। মৃত্যু-পরবর্তী গালগল্পে, ভূত-প্রেত এ আমার বিশ্বাস নেই। যদি কিছুতে বিশ্বাস থাকে, তা হলো, আমি নক্ষত্রে যাত্রা করতে পারি। এবং অন্য দুনিয়াগুলোকে জানতে পারি।
যারা আমার চিঠিটা পড়ছ, যদি তোমরা আমার জন্য কিছু করতে চাও, তাহলে আমার সাত মাসের ফেলোশিপের টাকা, এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা আমার পাওনা রয়েছে; দয়া করে দেখো তা যেন আমার পরিবার পায়। রামজীকে আমার চল্লিশ হাজার টাকার মতো দেওয়ার কথা। সে কখনো ফেরত চায়নি। কিন্তু ওই থেকে তাকে সেটা দিয়ে দিও।
আমার শেষকৃত্য যেন খুব নীরব ও মসৃণ হয়। যেন আমি এসেছিলাম আর চলে গেছি। কান্নাকাটি কোরো না আমার জন্য। জেনে রেখো বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গিয়ে আমি বেশি সুখী।
“ছায়া থেকে নক্ষত্রে”।
উমা আন্না, এই কাজে তোমার ঘরটা ব্যবহার করলাম, দুঃখিত।
ASA পরিবারের সকলে, তোমাদের সবার আশাভঙ্গ করলাম, দুঃখিত। তোমরা আমাকে খুব ভালোবাসতে। তোমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করি।
আর শেষবারের জন্য,
জয় ভীম।
ওহ্ আমি ভুলেই গেছি রীতিমাফিক কথাগুলো বলতে। আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়।
কেউ আমাকে উসকানি দেয়নি, কারোর কোনো কথা বা কাজ আমাকে এই কাজে ঠেলেনি।
এটা আমার সিদ্ধান্ত এবং কেবল আমি নিজে এর জন্য দায়ী।
আমি চলে গেলে তার জন্য আমার বন্ধু বা শত্রুদের বিব্রত কোরো না।
Ani Dutta says
Ekhane uni je Dalit chhilen ebong sheta unar mara jaowar pechhone ekta gurutwopurno factor chhilo sheta mone hoy headline-e ullekh kora uchit.
Shamik Sarkar says
কীভাবে ওর দলিত সত্ত্বাকে আনব হেডিং-এ বুঝে উঠতে পারিনি। নোটটা পড়ে যতদূর বুঝলাম, ওর নিপীড়িত সত্ত্বা নিয়ে কোনো আদিখ্যেতা ছিলনা। নিদারুন ক্ষোভ ছিল। সে ‘দলিত’ হিসেবে পরিচিত হতে চায়নি — “মানুষের মূল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আপাত সত্ত্বায় এবং আশু সম্ভবনায়।” আমি যতটা বুঝি, যে কোনো নিপীড়িত সত্ত্বার আন্দোলনে একজন নিপীড়িত সত্ত্বার মানুষ অংশ নিতে পারে দুটো জায়গা থেকে — ১) সেই সত্ত্বাকে গৌরবান্বিত করার মাধ্যমে একটা পালটা শভিনিজম তৈরির জায়গা থেকে (কাশ্মীরিয়ত, দলিত ভারত নির্মাণ প্রভৃতি …) ২) সেই সত্ত্বাকে সামাজিকভাবে অস্বীকার করার জায়গা থেকে। রহিত এই দ্বিতীয়টায় পড়ে। তার এই চিঠিটিতে কোথাও বাঙ্ময় নেই তাই নিপীড়িত সত্ত্বার কথা, কিন্তু ছেয়ে আছে গোটাটা জুড়ে — তাই এটি একটি অসামান্য রাজনৈতিক নোট। তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই।
Chinmay Biswas says
Inhumanity never be supported . All Indian should stand against it.