শ্যামলী কর। শান্তিপুর। ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০।#
নিউ নরম্যালে মেট্রোর চাকা গড়িয়েছে, গড়িয়েছে দূর পাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেনের চাকাও। কিন্তু এখনও অচল-অনড় রয়েছে লোকাল ট্রেন, যে ট্রেনের প্রতিটি কামরাই ভর্তি থাকে নিত্যযাত্রীদের ভিড়ে। সেখানে যেমন থাকে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ, তেমনি থাকে ছোট-বড় সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী। লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকার কারণে কুলি-কামিন, শ্রমিক মজুরের দিন গুজরান শেষ হয়েছে। আর ছোট সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীদের অবস্থা তথৈবচ। এরকমই একটা গল্প বলি। একজন স্ত্রী হয়ে স্বামীর কর্মজীবনের পথের গল্প বলি।
আমার স্বামী কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ এবং হসপিটালের SNCU ডিপার্ট্মেন্টের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। মাইনে সামান্য। কলকাতা থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় ১০০ কিমি। লকডাউনের প্রথম দুমাস বাড়িতেই কাটে। তারপরই আসে অফিসের চাপ। এদিকে ট্রেন বন্ধ, বাস চলছে না। অগত্যা মোটর বাইকই ভরসা। কিছুটা ভয়, কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারকে সঙ্গী করে ভোর ৫টায় রওনা দেয় সে। আর বাড়ির মানুষগুলোর মনে থাকে টেনশন। অফিসে পৌঁছে ফোন তিনঘন্টা পর
—হ্যাঁ, পৌঁছে গেছি।
-রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
-না। ঠিক আছে। কাজের প্রচুর চাপ। রাখি।
ফোনের কথা শুনে নিশ্চিত হয় সকলে। ঠিক আছে, অফিসে পৌঁছে গেছে তো…। বেলা ৩টেয় অফিস থেকে রওনা দেয়। বড় গাড়ির আলোর হাত থেকে বাঁচতে রোদের তাপকে সঙ্গী করে বাড়ি ফেরে সন্ধ্যা ৬টায়। এইভাবে চলে সপ্তাহে একদিন, কোনো সপ্তাহে দুদিন কর্মযাত্রা। এর মধ্যে বাস চললেও মানুষের ভিড়, করোনার আতঙ্ক থাকে সেখানে। আর ৩৪ নং জাতীয় সড়কের যে বেহাল দশা, তাকে তো মানতেই হবে। চতুর্থ দিনেই অফিসে পৌছে ফোন,
-হ্যাঁ পৌঁছে গেছি। বাড়ি গিয়ে বলব সবকিছু।
-কী হয়েছে?
-না। এখন বললে টেনশন করবে। ২০০০ টাকা ড্যামেজ দিয়েছি। পরে বলছি কী হয়েছে।
আমার চিন্তা আমার মনেই রাখলাম। বাড়িতে বয়স্ক শাশুড়ি মা কে আর চিন্তান্বিত করতে চাইলাম না। একবার ঘড়ির দিকে, একবার পথের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অন্যদিনের থেকে আরো ঘন্টাখানেক পরে বাড়ি ফিরল সে। গাড়ির সামনের গার্ডটা ভাঙা, হ্যান্ডেল বাঁকা। অফিস যাবার পথে চাকদহে অ্যাকসিডেন্ট। মনের জোরেই রওনা দেয় NRS এর উদ্দেশ্যে। আবার একই ভাবে বাড়ি ফেরে। রক্তক্ষয় হয়নি, তবে যেটুকু ঝাঁকুনি লেগেছে তাতে দুদিন শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও মানসিক দুশ্চিন্তা কাটেনি আজও। এসবের মধ্যেও বারেবারেই দরবার করেছে স্টেশনে RPF এর কাছে, যদি তারা রেল স্টাফ স্পেশাল ট্রেনে উঠতে দেয় কিন্তু তারা মানবিক হলেও সরকারি নিয়মের কাছে বাঁধা। অ্যাকসিডেন্টের ভয় কাটাতে কেটে গেল দুই-তিন সপ্তাহ। বারংবার অফিসের ফোন, চার্জ। ফলত, বেনিয়মে ট্রেনকেই ভরসা করতে হয়, কারণ বাইক তখন সারানোর জন্য সার্ভিস সেন্টারে। খরচ একমাসের মাইনের কাছাকাছি। বেনিয়মে ট্রেনে ওঠা, মনে ভয়, বুকে সাহস নিয়ে বাথনা থেকে বিধাননগর যাত্রা। ঠিক দুদিন, তৃতীয় দিনে টি.টি.’র নির্দেশমতো বেলঘরিয়ায় নেমে যাওয়া। বাসের ঝক্কি সামলে অফিসে যাওয়া। বাড়ি ফেরার পথে বিধাননগরে RPF এর নিষেধবাণী- ‘ট্রেনে উঠবেননা। আপনি রেলের স্টাফ নন’। একদিকে বাসের সময় অতিক্রান্ত, অন্যদিকে বাড়ি ফেরার তাড়া। কারণ পরপর দু’দিন লকডাউন। তাই জীবনের, সম্মানের ঝুঁকি নিয়ে প্ল্যাটফর্মের শেষে দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় চলন্ত ট্রেনেই উঠে পড়তে হয় ঠিক অপরাধীর মতোই। মধ্যবিত্তের পেটে খিদে থাকলেও মানসম্মানের বড় চিন্তা। তাই আবার বাইকই ভরসা – আবার ভয়- আবার চিন্তা। সকলের হয়ে আমার একটাই প্রশ্ন- এখনো কি সময় হয়নি ট্রেনের লকডাউন ছাড়াবার? কারণ এবার যে রোগের চেয়ে পেটের জ্বালায় মরার সময় এসে গেছে। যারা সর্বময় কর্তা তাদের কাছে আমাদের মত যারা স্বল্প বেতনের নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ, তাদের হয়ে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, সচেতনতা বাড়িয়ে যদি ট্রেনের চাকা গড়ানো যায় তাহলে আমাদের মত অনেককেই জীবন বাজি রাখতে হবেনা। সুস্থ সুন্দর ভাবে জীবন কাটাতে পারবে বা গিয়েও নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবে। বাড়ির মানুষ গুলিরও চিন্তা দূর হয়, স্বস্তি আসে দৈনন্দিন জীবনে।
Leave a Reply