ছবিলা বিবি, ১১ নভেম্বর,রবীন্দ্রনগর, মহেশতলা#
আমার বাড়ি সূর্যপুরে, বারুইপুর থেকে চার স্টেশন পরে। চারটে বাজতে ১০-২০ মিনিটে আমার ছেলে ভ্যানে করে মথুরাপুর স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। ওখান থেকে (ভোর) চারটে চল্লিশের ট্রেন ধরি। আমার বরের হাত দুটো পড়ে গেছে, মুখে ভাত তুলে খেতে পারে না। আগে সন্তোষপুর বাজারে তার সবজির দোকান ছিল। সূর্যপুর থেকে সবজি তুলে এনে এখানে বিক্রি করত। একদিন কী হল, এক কুইন্টাল মাল ঘাড়ে নিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। ঘাড়েতে দশজন মালটা তুলে দিতে গেছে আর পাঁচজন ছেড়ে দিয়েছে। ঘাড়ের বোঝাটা পড়ে যায়। ভালো হয়ে গিয়েছিল। তারপর চাষ করত। কিন্তু জ্বর আসত। ক্যাঁথা বালিশ সব মুড়ে দিতাম। ডাক্তার দেখাতাম। ডাক্তার বলত, ও কিছু হবে না। দু-চারটে বড়ি ওষুধ দিল। আস্তে আস্তে হাতটা যেন খুলে এসেছে, চামড়াটা লাগানো আছে। তিন বচ্ছর হাঁটতে পারত না। হাত তো আর ওঠে না। কাপড় পরিয়ে দিতে হত। ছোটো মেয়েটা কাপড় পরিয়ে দেয়।
ছেলের আশায় আশায় সাতটা মেয়ে, লাস্টে দুটো ছেলে হয়েছে। লাস্টের ছেলে দুটো পড়াশুনো করছে। একটা ছেলে নাইনে পড়ছিল। আর একটা ছেলে এইটে পরীক্ষা দিল, তারপর আমাদের মৌলবি লাইনে পড়ে হাদিসি কোরান কমপ্লিট করেছে। ওরা বলে, বাবা তো পড়ে গেল, আমরা কী করে খাব মা?
আমার হাতের আর কানের মিলিয়ে মামারা এক ভরি ওজনের সোনা দিয়েছিল বিয়েতে। আমার বিয়ের ন-দিন পরে বাবা ওগুলো খুলে মামাকে দিয়ে দিল আর বলল, পরের জিনিস নিতে নেই। আমি বলি, আমার জিনিস দেবে না? আমার ভাবীরা বলতেছে, কেন তুমি ওগুলো ওকে দেবে না? আমার বাবা কী করল, এক টাকার প্যাসেঞ্জার বয়ে বয়ে আর ভ্যান খেটে খেটে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল। বাবা আমাকে বলল, আমি টাকা দিচ্ছি, তুমি করে নাও। তখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি বললাম, আমার ঘৃণা লেগে গেছে, আমি আর সোনার জিনিস পরব না। সেই পয়সা দিয়ে আমি পাঁচ শতক জায়গা কিনে নিলাম। সেই জমিতে একটা নারকেল গাছ আছে, তিনটে কাঁঠাল গাছ আছে আর একটা লিচু গাছ। ওই জমিতে গাছপালা হবে, চাষ হবে না।
ছ-টা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। একটা আছে, নাইনে পড়ছে। ধেমুয়া বনসুদিয়ায় ইস্কুল। সাইকেলে যায়, অনেকটা দূর, এই সন্তোষপুর থেকে ফটক যতটা। কম দামি সাইকেল কিনে দিয়েছি। আমাদের এই বারুইপুর লাইনটায় তো মমতা সাইকেল দিচ্ছে না। ওখানে চাপ দেওয়ার কেউ নেই। সে যা হোক, মেয়ের জন্য সেরকম ছেলে পছন্দ হচ্ছে না। মেয়েটা দেখতে লম্বা চওড়া আর সেরকম পরিষ্কার। বিধানগড়ে একজনের পছন্দ হয়েছিল। আমি বিধানগড়ে গিয়ে তাদের ঘরবাড়ি দেখে এসছি। কিন্তু …
আমি সপ্তাহে দু-দিন সন্তোষপুরে আসি। বাকি পাঁচদিন ঘরের কাজ করতে হয়। আমার বরের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। কখনও পার্কসার্কাসে চিত্তরঞ্জনে আসি। সেখানে হচ্ছে না, তখন সেই এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। তার পাঁচশো টাকা ফি আর সাতশো টাকা ওষুধ লাগে। একেকবারে বারোশো টাকা খরচ। বরের এরকম ভুড়ি হয়ে গেছে, বসে ভাত খেতে পারছে না। ওনার কাছে গিয়ে মেশিনটা চেক করি, তবে ভাতটা খেতে পারছে। অসুখটা হল গ্যাস, শুধু গ্যাস। খেলে শুধু মাছের ঝোল ভাত আর নয়তো জল ঢেলে ভাত খাবে। অন্য কিছু মাছ মাংস খেলে এই ঢিউম ঢিউম ঢিউম করবে। একদিন ডিম তুলি আর দু-দিন বেচি। ডিম ছাড়া লঙ্কা আনি। ছোটোটা পাথরের কাজ (মেঝেতে পাথর/টাইলস বসানোর কাজ) শিখছে আর বড়োটা মানি ব্যাগের কাজ করে। ওরা দু-চার পয়সা যা দেয় আর আমি এদিকে ডিম বিক্রি করে কোনোরকমে চালাই।
মেয়েগুলোর বিয়ে ভালোই হয়েছে। জামাইগুলো একটাও অসৎ নয় আমার। চারটে মেয়েকে আমার কিচ্ছু দিতে হয় না। বড়ো মেয়েটা অসুবিধায় পড়ে গেছে। তার জামাই পরের জমিতে খেটেছে। জামাইয়ের হাতটা প্যারালাইস। বড়ো মেয়েটার কষ্ট আর আমার কষ্ট। জামাই সবসময় বসে আছে। আমি গোটাকতক ছাগল কেনার জন্য কিছু পয়সা দিয়েছি। আর আমার দাদাদের কাছ থেকে কিছু পয়সা দিয়েছি। আমাদের তো রোজার সময় লোকে কিছু পয়সা দান করে। আমার ভাইদের বললাম, আমার মেয়েটাকে কিছু দে, আমায় দিতে হবে না। ওরা ওর ঘরটা বেঁধে দিয়েছে। ওর বাবার ভেতরের দিকে কিছু জায়গা ছিল। সেটা বিক্রি করে রাস্তার ধারে টালির ঘর তুলেছে। কোথায় যাবে? ওর একটা মেয়ে আর একটা ছেলে আর ছাগল পোষে। জামাইটা তো বসে আছে, ওইভাবে ওদের চলে যায়।
আমি দুশো করে ডিম নিয়ে আসি। সব এখানে বিক্রি হয়ে যায়। পাঁচ টাকা করে কিনি, সাত টাকায় বিক্রি করি। আমার আপ-ডাউন আসতে কুড়ি টাকা খরচ। এখানে (রবীন্দ্রনগরে) আসতে অটো ভাড়া ছয় ছয় বারো টাকা। কখনও আমার বাপের বাড়ি থেকে খেয়ে যাই, কখনও খাই না। বউদিটা ভালো না, মাকে দেখতে পারে না, ভাত দেয় না। অন্যদিন দুপুরবেলার দিকে চলে যাই। আজকে যাব না। ভাইঝির বিয়ে, বলে এসছে। ছ-টা মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, একবারও জিগেস করল না যে বোন কী করে দিচ্ছে। আজকে ওর মেয়ের বিয়ে, আমায় দাওয়াত দিয়ে এসছে। মাকে দেখে কষ্ট লাগে। ওদিকে নিজের কষ্ট, এদিকে মায়ের কষ্ট।
Murad Hossain says
এরকম লক্ষ লক্ষ মহিলা রয়েছে ভারত বর্ষে , যারা গ্রাম থেকে প্রতিদিন ভোর ৪টায় বাড়ী থেকে বের হয় আর রাত্রি ১২টায় বাড়ী যায়
Editor JN says
সত্যিই। এদেরই একজন ছবিলা বিবি।
Ritabrata Mulhopadhyay says
Ha ei bhabei Chabila bibi Ra Sara jibon sudhu kaj kore jaben bishram bole sabdha tader abhidane nei! “achhe din”eder jannya prajjoya noy!