‘স্বতন্ত্র তিব্বত’কে কবজা করেই খুলতে পারে ভারত-চীন সমস্যার সমাধান সূত্র
তেনজিন সুনদু ও সন্দীপ পান্ডে।
ভারতের ঘাড়ের কাছে হিমালয়-কন্ঠে একটা কর্কট-ক্ষত আছে বস্তুত যা গলায় ব্যথা হয়ে বিঁধে আছে ১৯৬২’র যুদ্ধে চীনা আক্রমণের মুখে ভারতের হাস্যকর পরাজয়ের পর থেকে। সাম্প্রতিক গালোয়ান উপত্যকার হত্যাকান্ড সেই ক্ষতে একটু বাড়তি নুন মাত্র। রোগটা এই পর্যায়ে আসার কারণ, চীন যখন ১৯৫০ -এ প্রতিবেশী দেশ তিব্বত আক্রমণ করেছিল, তখন চীনে রক্তাক্ত বিপ্লবের পর মাও জেদং এর নেতৃত্বে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট শাসকের সাথে ভারতের গভীর প্রণয়। তিব্বতের সাথে ভারতবর্ষের সভ্যতার শেকড়-সম্পর্ককে ভুলে গিয়ে ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ বলে নাচতে নাচতে ভারত তখন আশা করেছিল উদীয়মান শক্তি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের তোষণে আখেরে লাভই হবে। যে অঞ্চলকে নাকি বলা হয় ষাটটা মাত্র ভারতীয় পুলিশের চৌকি, সেই ৪,০৮৫ কিলোমিটার হিমালয়ান সীমান্ত বরাবর তিব্বতিদের সরিয়ে দিয়েছিল চীনা সেনা, পিপলস লিবারেশন আর্মি। চীনের সাথে তার আগে অবধি ভারতের কোনো সাধারণ সীমানা ছিলনা।
তিব্বত যদি আজ একটি মুক্ত ও স্বাধীন দেশ হত, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০০ মিটার গড় উচ্চতায় দাঁড়িয়ে, পৃথিবীর ছাদ নামে খ্যাত, বিশ্বের বৃহত্তম ও উচ্চতম মালভূমি হওয়ার ভৌগোলিক একক নিয়ে এবং পঁচিশ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের বিস্তার নিয়ে তিব্বত বিশ্বের দশম বৃহত্তম দেশ হতে পারত। গোটা পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ, প্রায় ৩৭,০০০ হিমবাহের আশ্রয় এই তিব্বতি মালভূমি। চিরপ্রবাহিনী স্বচ্ছ জলের মূল উৎস। এশিয়ার উল্লেখযোগ্য কিছু বিশাল ও দীর্ঘ নদীর উৎস – এমন অজস্র হ্রদের ফুটকি তিব্বতের মানচিত্র জুড়ে। সিন্ধু, সতলুজ, ব্রহ্মপুত্র, সালউইন, মেকং, ইয়াংসি এবং হলুদ নদীর মত উল্লেখযোগ্য নদীগুলি চীনসহ পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, বার্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া, লাওস প্রভৃতি দেশগুলির বিস্তীর্ণ জনগোষ্ঠীর (যা গোটা চীনের মোট জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি) আহার যুগিয়ে চলছে। খুবই মর্মান্তিক যে এশিয়ার এমন একটা প্রাকৃতিক সম্পদ আর জলের ভান্ডার চীন দখল করে রেখেছে আর এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদের স্বর নেই।
ভারতবর্ষীয় ও তিব্বতি ইতিহাস আর সংস্কৃতির শরিকানার কারণেই আজো প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ সংস্কৃতি তিব্বতে বাঁচিয়ে রাখা হয়। ভারতীয় গণমানসে কৈলাশের মানস সরোবর তো ছিল ভারতবর্ষেরই অঙ্গ। তিব্বতিরাও ভারতের বৌদ্ধ তীর্থগুলি যেমন- সারনাথ, বোধগয়া, নালন্দা এবং অমরাবতীতে ঘুরতে আসত। ভারত-তিব্বতের সীমান্ত ছিল অবান্তর। লোকজন হামেশাই এপার ওপার হত। এখন সেখানে দু’দেশের সেনা, সীমানা পেরনোর প্রশ্নই নেই। তিব্বত যেতে ভারতীয়দের এখন নেপাল দিয়ে ঢুকতে হবে। গালোয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষের পর আপাদমস্তক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে দু’দেশের সেনাই এখন একে অপরকে চোখে চোখে রাখে।
দলাই লামা ভারতে আশ্রয় নেবার পর প্রায় এক লাখ তিব্বতি ভারতে এসেছে, যাদের বেশিরভাগই কর্ণাটক আর ভারতীয় হিমালয় অঞ্চলে থাকেন। নির্বাসিত সরকারের ঘাঁটি হিসেবে দলাই লামার আসন, ধরমশালাকে, তিব্বতিদের রাজধানী মনে করা হয়। অনেক তিব্বতি এখনো স্বাধীন তিব্বতের স্বপ্ন দেখলেও বিগত বছরগুলিতে ভারতের চীন-প্রীতি তিব্বতিদের স্বাধীনতার সম্ভাবনাকে দিয়েছে বিশ বাঁও জলে। ভারতে উদবাস্ত হয়ে দলাই লামা ভারতের ‘এক-চীন’ নীতির প্রেক্ষিতে বরাবর তিব্বতিদের স্বায়ত্বশাসনের কথা বলে আসছেন।
সত্তর বছরের চীনা আক্রমণে দশ লাখের বেশি তিব্বতি মারা গেছেন। ছ’হাজার গুম্ফা ধংস করা হয়েছে। তিব্বতের জঙ্গল সাফ করে চীনে কাঠ পাচার করে দক্ষিণ এশিয়ার নীচু অঞ্চলগুলিকে ভয়ঙ্কর বণ্যার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বোমা দিয়ে পর্বত ভেঙে সোনা, তামা, লিথিয়াম আর দুষ্প্রাপ্য পাথরের খোলামুখ খনি বানানো হয়েছে। তিব্বতি যাযাবর আর চাষীদের পারম্পরিক চারণভূমি কেড়ে নিয়ে মার্কিনি সংরক্ষণের কায়দায় কৃত্রিম গ্রামে দেশলাই বাক্সের মত ঝুপরি ঘরে ভরে দেওয়া হয়েছে। মোদ্দা কথা, তিব্বত যে গণহত্যার সাক্ষী হয়েছে, চীনের সাথে ব্যবসার লোভে গোটা দুনিয়া সে বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছিল। তিব্বতি প্রতিরোধের সহনশীলতার মুখে পড়ে চীনের নজর এখন তিব্বতি ভাষা, সংস্কৃতি আর বৌদ্ধ পন্থায়, যা তিব্বতিদের একজাত করে চীনা ক্ষমতাতন্ত্রে ‘সংখ্যালঘু’ বানিয়ে রেখে দেওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
বিশ্বায়ন ১৬০টির ওপর দেশকে ব্যবসা করতে চীনের কাছাকাছি এনেছিল। পশ্চিমী “লিবারাল ডেমোক্র্যাটস” কার্যত অন্ধের মত “এক-চীন” নীতিকে মেনে নিয়েছিল এবং তিব্বতকে চীনের অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই ব্যবসায়িক পার্টনাররাও তিব্বতিদের তকলিফের মূল্যে সরাসরি মুনাফা করেছিল। এমন আন্তর্জাতিক চাপের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে তিব্বতিরা এতটাই অবদমিত যে তিব্বতে দলাই লামার সামান্য একটা ছবি সঙ্গে রাখার কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদে প্রশ্রয়ের দায়ে আপনাকে জেলেও পাঠানো হতে পারে। যদিও তিব্বতি যুবকরা কাশ্মীর, প্যালেস্তাইনের মত প্রতিহিংসা নেয় না, বরং বহু তিব্বতি তরুণ-তুর্কী আত্মঘাতী হয়েছেন, যার সংখ্যা শুধু তিব্বতেই ১৫৫ ছাড়িয়ে গেছে।
তিব্বতিরা বিশ্বাস করেন যদি স্ব-ভাবে (spirit) মুক্ত থাকা যায় চীনারা কখনোই তাদের বিজিত করতে পারবেনা। আবার, এককালে যে চৈনিক সমাজে কনফুসিয় ও বৌদ্ধ ধর্মের শক্ত ঘাঁটি ছিল, সেখানে ভোগবাদী চীন এখন একটাই ধর্মের ভজনা করে –টাকা।। অন্যদিকে, তিব্বতিরা এখনো কিন্তু বৌদ্ধ সংস্কার মেনে চলে এবং সেকারণেই তাদের বিশ্বাস, চীনের শাসনের বাইরে একদিন তারা বেরবেই।
চীনের প্রেসিডেন্ট বা ভারতীয় পুলিশের কোনো হত্তাকত্তার সফরকালে নিয়মমাফিক সমস্ত তিব্বতি অ্যাক্টিভিস্টকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হয় শুধুমাত্র চীনকে তুষ্ট করতে। একালের তিব্বতি প্রজন্ম তাও ভারতের দু”শ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে অনুপ্রেরণা পায়। ১৯৪২ পর্যন্ত তো ভারতীয়রাও ভাবতে পারেনি যে আর পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের দেশ স্বাধীন হতে চলেছে। গান্ধীজীর ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গণ-সমর্থন আদায় করা যখন খুব সহজ ছিল না, ওদিকে লন্ডনের অবস্থা তখন এমন যে নিজেরই ভারে ওখানকার রাজত্ব ভেঙে পড়ার জোগাড়। সেরকম তিব্বতীরাও মনে করে, এমন একটা দিন আসবে যখন চীনারা নিজের মাটি বাঁচাতে তিব্বত ছেড়ে পালাবে।
চীন শুধু তিব্বতই দখল করেনি। ১৮ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের মুসলিম দেশ, উইঘুর পূর্ব তুর্কিস্তান ১৯৪৯ থেকে দখল করে আছে। ওই একই বছর দক্ষিণ মোঙ্গলিয়ার ১২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এবং মাঞ্চুরিয়ার ৮৪,০০০ বর্গকিলোমিটার গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে জুড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে চীনদেশের ছিয়ানব্বই লক্ষ বর্গকিলোমিটার ভূমির ৬০ শতাংশই অধিকৃত অঞ্চল। কিন্তু চীনের এই জমি দখলের নক্সা এখানেই থেমে থাকেনা। চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড’ প্রজেক্ট গোটা দুনিয়ার শিল্পবাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার ছক।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি, বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক পার্টি, যারা শুধু কমিউনিজমের নামে চীনে নির্লজ্জ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই চালায়না, সেনাবাহিনীর জিম্মাদারি, মিডিয়া-বিচারব্যবস্থাকে চালানো এবং দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন মাও এর উত্তরসূরীও নিয়োগ করে। তাই, ৪.৭ কোটি চীনা মারা যাবার পরও তিয়েনআমেন স্কোয়ারে মাও-এর ছবি শোভা পায়। চীনের বেশিরভাগ লোক তিয়েনআমেন স্কোয়ারের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কিছুই জানে না- এটা চীনের ‘ওপেন সিক্রেট’।
গালোয়ান উপত্যকার হত্যাকান্ডের পর এবং সাম্প্রতিক কাশ্মীর নিয়ে চীনের মাথা গলানোয় ভারতকে জাতিপুঞ্জে টানাটানি করাই একটা বড় প্রমাণ যে, ভারতের প্রাদেশিক অখন্ডতার প্রতি চীনের কোনো সম্মান নেই। যেহেতু চীন এখন কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এবং আমেরিকার সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে গোটা বিশ্বের সাথে বিচ্ছিন্ন, এই সময় ভারত অবশ্যই চীনের হুমকির মুখোমুখি দাঁড়াক এবং তিব্বতীদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে ‘এক-চীন’ নীতিকে ওঁচলা গাদায় টান মারুক। স্বাধীনতার জন্য দলাই লামার অহিংস আন্দোলনে ভারতের সমর্থন সারা দুনিয়া জুড়ে রণন তুলবে।
তাই, প্রত্যেক ভারতবাসীর প্রথম কাজ হল ‘চীনা সীমান্ত’ কে ‘তিব্বতি সীমান্ত’ বলা। তাছাড়া ভারত তো তিব্বতের সাথে হিমালয়ান সীমান্ত রক্ষা করার জন্য ইন্দো-টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশ তৈরি করেইছে। ভারত তিব্বতিদের নির্বাসিত সরকারকে এবং এর মসীহ দলাই লামাকে সমস্ত তিব্বতের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিক। শান্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক এবং অহিংস আন্দোলনের নেতার স্বীকৃতি দিয়ে ভারতের উচিত এই ৮৫ বছরের বৃদ্ধকে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক নাগরিক সম্মান, ‘ভারতরত্ন’ উপাধি দেওয়া।
(২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তে মেইলে পাঠানো লেখাটির বাংলা তর্জমা করেছেন পর্ণব)
তেনজিং সুনদু একজন তিব্বতি কবি ও অ্যাকটিভিস্ট, যিনি ধরমশালায় থাকেন এবং সন্দীপ পান্ডে ভারতের সোশালিস্ট পার্টির ভাইস-প্রেসিডেন্ট
Leave a Reply