সৌম্য সেনগুপ্ত, বিষ্ণূপুর, ৩ অক্টোবর#
২ আগস্ট ২০১৪ — দাওয়ায় বসে ছিলেন ৬০ বছরের মালতী লোহার। তখন রাত ৯ টা। ইঁদুরের পিছনে তাড়া করতে করতে একেবারে কাছে চলে এসে ভয় পেয়ে পেটে ও হাতে ছোবল মারে একটি পূর্ণবয়স্ক কেঊটে সাপ। বাড়ীর লোক সাথে সাথে সাপটিকে মেরে বিষ্ণুপুরের দলমাদল রোডের ৩ নং ওয়ার্ড এর বাড়ি থেকে মোটর সাইকেলে করে মালতী দেবী কে নিয়ে যান ২-৩ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে। মোটামুটি ২০ মিনিটের মধ্যে।
অভিযোগ -১ : এমারজেন্সির কর্তব্যরত চিকিৎসক রগীর সামনেই বলে বসেন — রোগিণীর অবস্থা শোচনীয়! ডাক্তারের মুখে এই কোথা শুনে মালতী দেবী ভয়ঙ্কর ভাবে মৃত্যুর আশঙ্কায় একেবারে ভেঙ্গে পড়েন।
অথচ সাপের কামড়ের চিকিৎসায় প্রথম পাঠই হোল রোগীকে আশ্বস্ত করা — কারণ রোগী অত্যন্ত আতঙ্কে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১০ সালের গাইডলাইনে এ কথার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
অভিযোগ -২ ও ৩ : ইনডোরে ভর্তি করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ১০ ভায়ালের পরিবর্তে ৫ ভায়াল এভিএস দিয়ে ও এভিএস-এর সাথে অ্যাট্রোপিন ও নিওস্টিগমিন এই দুটি অবশ্য দেওয়া দরকারি ইঞ্জেক্সন না দিয়ে বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রেফার করেন। অথচ, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা প্রোটোকল, যা প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টাঙানো থাকে, অন্তত থাকার কথা, তাতে স্পষ্ট লেখা আছে — দশ ভায়াল এভিএস না দিয়ে কিছুতেই রেফার করা যাবে না। এবং সাপে কামড়ানো রোগীকে যে নিওস্টিগমিন ও আট্রোপিন অবশ্যই দিতে হবে।
এই ভাবে চিকিৎসা হওয়ায় পথেই মালতী দেবীর মৃত্যু ঘটে। তখন সময় সাড়ে এগারো টা। ওনার মৃতদেহ বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে ফিরিয়ে আনলে তার ময়নাতদন্ত করা হয়।
৬ আগস্ট ২০১৪ — ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির রাধানগর শাখার পক্ষ থেকে প্রতিবেদক ও স্থানীয় শিক্ষক গোরাচাঁদ রানা মালতী দেবীর বাড়িতে গেলে পুত্র চণ্ডী লোহারের কাছ হতে বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের প্রদেয় রেফার কাগজ দেখে চিকিৎসক ডাঃ দয়াল বন্ধু মজুমদারের সাথে আলোচনা করে জানতে পারেন মালতী দেবীর মৃত্যুর কারণ অপ-চিকিৎসা এবং সাথে সাথে বিষ্ণুপুর থানায় কর্তব্যরত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান মালতী দেবীর ছেলে চণ্ডী লোহার।
সংগঠনের পক্ষ থেকে স্থানীও মানুষদের সাথে নিয়ে ওই দিনই ডাঃ সুরেশ দাশের সাথে দেখা করে পুরো বিষয়টি জানানো হয়।
অভিযোগ -৪ : বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে কেন ‘স্নেক বাইট ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল’-টি টাঙানো নেই তা জানতে চাইলে ডাঃ দাস বলেন : – ওই রকম কত প্রোটোকলই তো আছে, টিবির প্রোটোকল, ডায়রিয়ার প্রোটোকল! … কত আর টাঙাবো !!!
৮ আগস্ট ২০১৪ — ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির রাধানগর শাখার পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি জানিয়ে ডাইরেক্টরেট অফ হেলথ সার্ভিসেস, পশ্চিমবঙ্গ কে উক্ত চারটি অভিযোগ সহ ফ্যাক্স করা হয় এবং দোষীদের বিরুদ্ধে আইপিসি ৩০৪ এ এবং ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিল (প্রফেশনাল কনডাক্ট এটিকেট এন্ড এথিক্স) রেগুলেশনস, ২০০২, সেকশন ১.১.২, ১.২.১, ২.১.১ এবং ২.৪ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। প্রতিলিপি প্রেরণ করা হয় জেলা ও মহকুমা শাসক সহ স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে।
এত কিছুর পর মালতী দেবীর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এ মৃত্যুর কারণ দর্শানো হয় “অজানা কামড়”।
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ — মৃত্যুর কারণ “সাপের কামড়” এই মর্মে একটি মেডিকেল সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য চণ্ডী লোহার একটি আবেদন জানান বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এর কাছে, কারণ পশ্চিমবঙ্গের ডিসেস্টার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে সাপের কামড়ে মৃত ব্যাক্তির পরিবারের প্রাপ্য এককালীন ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আর বাধ্যতামূলক নয় (অর্ডারের কপি দেখুন এবং জেনে রাখুন সান স্ট্রোক, বজ্রপাত ও হাতি আঘাতে মৃত ব্যক্তির পরিবার-ও এই ক্ষতিপূরণের অধিকারী)।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ — বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতাল থেকে একটি লিখিত দেওয়া হয় (মেমো নং ১৯০৯, তারিখ ১২।৯।২০১৪) যাতে ওই হাসপাতালের অটোপ্সি সার্জেন লিখিত ভাবে জানান যে মৃত্যুর কারণ সাপের কামড়।
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ — সমস্ত নথি জমা দেওয়া হয় বিষ্ণুপুর পৌরসভায়। প্রথমে কর্তব্যরত অফিসার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চান, কিন্তু উক্ত অর্ডারের কপি দেখে তিনিও স্বীকার করেন — বিষয়টি তিনিও নতুন জানলেন!
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ — প্রায় এক বছর পর ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেন মালতী দেবীর পরিবার।
শেষের কথা : – ঘটনা পরম্পরা থেকে আমরা আবারও উপলব্ধি করতে পারি — “অধিকার কেড়ে নিতে হয় ’’!!
কিন্তু মালতী দেবীর, মালতী দেবীদের বাঁচার অধিকার ?
আমরা যারা সাধারণ শিক্ষা-বঞ্ছিত মানুষদের বোঝানোর চেষ্টা করি – সাপে কামড়ানো রোগীদের ওঝা-গুণিন-পীর-ফকির-মনসার থানে নয় যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে চলুন। তাদেরও উপলব্ধি করার সময় এসেছে — এতটুকু বলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয় না।
হাসপাতালে যাতে সাপে কাটা রোগী সহ সমস্ত রোগীর সঠিক চিকিৎসা হয় তার দাবীও জানাতে হবে।
তাই আসুন আমরা সম্মিলিত ভাবে দাবি জানাই
১। সাপের কামড়ের চিকিৎসা একটি অবহেলিত গ্রামীণ সমস্যা। এটিকে এমবিবিএস পাঠক্রমে আরও বেশি গুরুত্ব সহ স্থান দিতে হবে।
২। এই মুহূর্তে প্রতিটি হাসপাতালে ‘স্নেক বাইট ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল’টি টাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। প্রতিটি চিকিৎসককে সাপে কামড়ের চিকিৎসার আদর্শ চিকিৎসা বিধির ট্রেনিং নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪। সর্বোপরি সকলের সমস্ত চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
Leave a Reply