কথাবার্তার মাঝে পরমেশদার মুখ বাঁধাই করলেন রেখাচিত্রে, সুমিত দাস। শান্তিপুর। ৯ নভেম্বর, ২০২০।#
মুন্সীপাড়া ও বারোয়ারীর পেছন দিয়ে যে গলি টা চলে গেছে তার তিন চারটে বাড়ি পর বাঁদিকে পরমেশদার বাড়ি। বাড়ির সামনে পাঁচিলের গা ঘেঁষে বাহারী গাছ লাগানো। হাঁক দিতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন পরমেশ বাবু। ছোট একতলা বাড়ি। ছিমছাম। চারিদিকে যত্নের ছাপ। বাড়ির ভেতরেও অনেক গাছ গাছালি। কথা বলতে ভালোবাসেন ভদ্রলোক। স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রথম অনুপ্রেরণা পান বই বাঁধাইয়ের কাজে। কখনও মামা বা অন্য কারোর দেখে। আবার কখনও বাঁধানো বই দেখেই কাজ শেখা শুরু। তারপর থেকে চলছে পুরনো সখের বই, অফিসের মোটা মোটা দরকারি খাতা বাঁধাইয়ের কাজ। শুরুতে একটু অসুবিধা হত।বাঁধাইয়ের সব প্যাঁচ-পয়জার তো জানতাম না। তখন প্রয়োজন পড়লো একজন গুরুর। যার কাছে কাজটা শেখা যায়। অনেককেই বললাম। একজন বললো ‘দেখো বাপু শেখাতে টেখাতে পারবো না। তুমি ফুলিয়া পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে যাও। ভর্তি হয়েও গেলাম। ওখানে গিয়ে কিছু গুপ্ত জিনিস ছিল সেগুলো শিখলাম। বাকিটা তো আমার জানাই ছিল। খুব ভালো ছাত্র হিসাবেই সেখানে আমি গণ্য হতাম। এইভাবেই মোটামুটিভাবে আমার কাজ শেখা। কাজে নামার পর সকলেরই আমার কাজ পছন্দ হয়।নামও ছড়িয়ে পড়ে। নৃসিংহপুর থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত প্রায় সব লাইব্রেরি আমাকে দিয়ে তাদের বই বাঁধাই করায়। শান্তিপুর পৌরসভার যত মোটা মোটা খাতা ছিলো সেই সব আমাকে দিয়ে বাঁধানোর বরাত আসে। প্রথম শুরু করি ডেট অফ বার্থের খাতা দিয়ে। সেগুলো মূলত লালসালু দিয়ে বাঁধাই করা হত। অগ্ৰণী পাঠাগার, সুভাষ পাঠাগার, আরো অন্যান্য পাঠাগারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন কেউ কেউ। কথা বলতে বলতেই দুটি বাচ্চা ছেলে আসে। একটি পরমেশদার ছেলে, অন্যটি ভাইপো। ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে। যোগ ব্যায়াম শেখে। অনেক পুরষ্কারও পেয়েছে সে। পরমেশদা জানালেন উনিও একটা সময় যোগ ব্যায়াম শিখতেন। পুরষ্কার পেয়েছিলেন সে সময়। বুড়োদা বলল, কথোপকথন শেষ হলে একটা ব্যায়াম দেখাবেন। সহজ সরল মানুষটি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেন। কথা এগোতে থাকে। এরপর কলকাতায় যোগাযোগ হয়। এখন সেখানকার কয়েকটি ব্যাঙ্কে খাতা বাঁধাইয়ের কাজ নিয়মিত করেন পরমেশ দা। রাজ্যপাল বীরেন জে শাহ পরমেশদার বাঁধাই করা খাতা নিজে হাতে দেখেছেন। চোখের চাউনিতে গর্বের ঝিলিক খেলে যায়। আবার চিত্রশিল্পী ললিত মোহন সেনের ১৯৫৭ সালের খাতা বাঁধাই করেছেন। এবং তার জন্যে কোন মজুরি নেননি পরমেশদা। বুড়োদা জানতে চায়, ট্রেন চলছে না, কলকাতায় যেতে পারছেন না, আর্থিক ভাবে অসুবিধা হচ্ছে না?
-অসুবিধা তো হচ্ছেই। বেশি ভাড়া দিয়ে বাসে করে কলকাতায় গিয়ে পরতা হয় নাকি। এবার গিয়ে দশ দিন থেকে এলাম। লকডাউনে অবস্থা বেশ খারাপ গো। কাজ নেই বললেই চলে। অফিস কাছারি বন্ধ, পাঠাগার বন্ধ কাজ হবে কী করে। আফশোস করে বলেন পরমেশদা। আমরা উঠে আসি। বাড়ির পথে আসতে আসতে ভাবি সারা জীবন ধরে কাজটাকে ভালোবেসে বই এর বুক যত্ন করে বাঁধাই করার পরেও নিজের সম্বল টুকু কি ঠিকঠাক বাঁধতে পেরেছেন পরমেশদা ?
Leave a Reply