করোনার বাজারে কাজের খোঁজে পেশাবদলের স্কেচ আঁকছেন সুমিত
সুমিত দাস। শান্তিপুর। ১২ অক্টোবর, ২০২০।#
এখন বেশ ভালো আছি। প্রতিদিন তো আর মহাজনের কাছে কথা শুনতে হচ্ছে না। গায়ে গতরে একটু বেশিই পরিশ্রম করতে হচ্ছে তবে ভালো আছি বুঝলে। বুড়োদার দোকানে বসতে বসতে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে রথিন দা। রথিন দা আগে তাঁত বুনতো। পাওয়ারলুম। তারও আগে হ্যান্ডলুম বুনেছে। বেশ জোরের সাথেই বলে পাওয়ারলুম শিখতে আমার আধ ঘন্টা সময় লেগেছিল। এক মহাজনের কাছে কয়েক বছর কাপড় বুনেছে। পাঁচ হাজার টাকা জমিয়েও ফেলেছিল কোন একটা সমস্যায় সেকাজ চলে যায়। কাজ থেকে বেরিয়ে আসার সময় বলেছিলো – যে তাঁতি মহাজনের কাছে পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেছে তাকে ছাড়িয়ে দিলেন !! সেদিন এখন অতীত। লকডাউনের ফাঁপড়ে রথিন দা এখন চা বিক্রেতা।
তাহলে প্রথম থেকেই বলি- লকডাউনে যখন কাজ নেই তখন একদিন আমার বন্ধু গৌতম বললো চা বিক্রি করবি? তাহলে আমি একটা বড় ফ্লাক্স কিনে দিচ্ছি। আমার কাছে সে সময় একদম পয়সা নেই। সে কথা আমি গৌতমকে বলি যে, পয়সা কিন্তু এখন দিতে পারবো না। এর পরই চা বিক্রি শুরু করি। প্রতি রবিবার, বৃহস্পতিবার রাত দু’টোর সময় ঘুম থেকে উঠে চা করে তৈরী হতে আমার এক ঘন্টা সময় লাগে।সাড়ে তিনটের মধ্যে হাটে পৌঁছে যাই। তিন তলায় উঠে গিয়ে যারা চা খেতে চাইবে তাদের আগে চা দিই। তারপর দোতলায় আসি। বেশ কয়েকবার উপর নীচ করতে হয়। মোটামুটিভাবে সাড়ে ছ’টার মধ্যে দুটো চায়ের ফ্লাক্স শেষ হয়ে যায়। তারপর বাড়ি এসে চা তৈরী করে আবার হাটে যাই। কিছু চা বিক্রি হয়। ন’টা সাড়ে ন’টা বাজলে টিফিনের ব্যাগ নিয়ে আসি।
আবার বাড়িতে যাও ? না না, জলের বোতল , টিফিনের ব্যাগ, সিগারেটের বাক্স আগের দিন রাতে কারোর চালায় রেখে আসি। টিফিনের পর অনেকেই চা খায়। সাড়ে দশটার মধ্যে আবার সব চা শেষ হয়। কোন কোন দিন অবশ্য চা থেকে যায়।
আচ্ছা রথিন দা এগুলো তো হাট বার। অন্য দিন গুলোতে কী করো? অন্য দিন গুলোতে নতুনহাটে সব্জি বাজারে থাকি। সেখানেও মোটামুটি বিক্রি হয়। আগে আরো বেশি বিক্রি হত। তখন তো অনেকেই অন্য কাজের ধান্দায় বাজার নিয়ে বসতো। তারা চা নিত। অনেকেই পুরোনো কাজে ফিরে গেছে। তাই চা বিক্রি আগের মত নেই। বিকেলেও সূত্রাগড়ে যাই। যা বিক্রি হয়। না হলে লাইব্রেরির মাঠে আসি। সেখানে কিছু অল্প বয়সী ছেলে গল্প করে। তারা আমার কাছে আট দশ কাপ চা খায়। রথিন দা চা কোনদিন নষ্ট হয় ? খানিক চুপ করে থাকার পর রথিন দা বলে, প্রথম প্রথম কেঁদে ফেলেছিলাম। বিক্রি হয়নি, বাড়িতে এসে চা ফেলে দিতে হয়েছে। সে সময় অনেকে সাহস দিয়েছে হাটের কয়েকজন বলেছেন, লেগে থাকো ঠিক হবে। কয়েক দিন আগেই আমার আর বৌ এর শরীর খারাপ করেছিলো। প্রায় এক হাজার টাকা ওষুধ কিনতে চলে গেছে। শুধু এটুকু চাই ভগবান যেন সুস্থ রাখেন। ইদানিং হাঁটুর একটা সমস্যা হচ্ছে। আসলে হাঁটু মুড়ে বসে চা দিতে হয়।চোদ্দ বার উপর নীচ করতে হয় হাটের একতলা থেকে তিন তলা। অল্প বয়সে খেলতে গিয়ে হাঁটতে চোটও পেয়েছিলাম।
আরো একটা কাজ করতাম। সেই কাজও তো করোনার জন্য নেই। জানতে চাই, কী কাজ ? মডেল সাজবার কাজ। করোনার কারণে অনুষ্ঠান বন্ধ। অনুষ্ঠান বন্ধ থাকলে মডেলের কাজও বন্ধ। ওঠার সময় রথিনদার যে ছবিটা এঁকেছিলাম সেটা দেখাই। রথিন দা বলে ঠিক ভালো হয়নি ছবিটা বুঝলে। একটু ভারী হয়ে গেছে। আমিও স্কুলে পড়ার সময় ভালো ছবি আঁকতাম। ব্যাঙ, আরশোলা অনেকেই আমাকে দিয়ে আঁকিয়ে নিত। জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত মানুষটার মুখে সৃজনশীল হয়ে থাকতে না পারার আক্ষেপ ফুটে ওঠে। সাইকেল নিয়ে ক্লান্ত শরীর টা আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
Leave a Reply