সোহিনী রায়, কলকাতা, ৫ জুন#
কালিকাপুর থেকে বাইপাস ধরে হাইল্যান্ড পার্ক যাওয়ার সময় বাঁ হাতে পরে সত্যজিত রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় শান্ত নিরিবিলি একটি ক্যাম্পাস। কিন্তু সেটা যে নয় তা আমরা এ কদিনে বুঝে গিয়েছি। খবরে প্রকাশিত হয়েছে যে ঐ প্রতিষ্ঠানের কিছু ছাত্রী প্রতিষ্ঠানের তিন জন প্রফেসরের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে এসেছিলো গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। অভিযোগকারীদের চাপে প্রায় দু মাস পরে কর্তৃপক্ষ একটি অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (আই সি সি) তৈরি করেন। কমিটি গত এপ্রিলে তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় যেখানে তারা ঐ প্রফেসরদের বিরুদ্ধে কঠিনতম শাস্তির নির্দেশ দেয়। আই সি সি -র নির্দেশ অমান্য করে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয় নি এখনো পর্যন্ত্য। এমনকী অভিযোগকারীদের ঐ রিপোর্টের কোনো কপিও (প্রতিলিপি) দেওয়া হয় না। ইতিমধ্যেই এইধরণের অভিযোগ করার জন্য অভিযোগকারীরা ক্যাম্পাসে প্রায় নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকেন। তারা সাহায্যের জন্য শহরের কিছু নারী-সংগঠনের দ্বারস্থ হন। সেই নারী সংগঠনকে এক অভিযোগকারী যে চিঠিটি লেখেন তার-ই কিছু কিছু অংশ বাংলা অনুবাদ করে এখানে তুলে দেওয়া হল। শেষ খবর অনুযায়ী আই সি সি র রিপোর্ট অভিযোগকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার এবং ডিরেক্টর পদত্যাগ করেছেন।
============================================
” বারবার আপনাদের মেল করে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমার মাথার অপর যে লড়াই-এর চোখ রাঙানি আছে তা হেরে যাওয়ার ভয়ে আমি এ ক’দিন কোনো বিশ্রাম নিতে পারি নি। এই ইন্সটিটিউট আমার জন্য কত বড়ো সমস্যা হয়ে উঠেছে সেটা জানিয়ে আমি মন্ত্রকে (তথ্য ও সম্প্রচার) আবার চিঠি লিখেছি আর সেই চিঠি মহিলা কমিশনকে পাঠিয়েও দিয়েছি। যত রকমভাবে যা যা করা যায় সবকিছুই করে চলেছি কারণ নিজেকে একটি ডুবন্ত জাহাজ বলে মনে হচ্ছে। আমি জানি না আমার এই চিঠিগুলো আদৌ মন্ত্রকে বা মহিলা কমিশনে পৌঁছাচ্চে কিনা কিন্তু একটা চেষ্টা করছি কেবলমাত্র।
ধন্যবাদ ও অভিনন্দনসহ,
……………………
( মন্ত্রকে পাঠানো চিঠিটি এই চিঠির সাথে জুড়ে দিয়েছিলো। তারই কিছু অংশ এখানে দেওয়া হল। )
প্রিয় কর্তৃপক্ষ,
……… আমি এর আগে ইন্সটিটিউটের ডিন, ডিরেক্টর আর চেয়ারপার্সন কে লিখেছিলাম। কোনো লাভ হয় নি। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, আমি জরুরিভিত্তিতে আপনাদের হস্তক্ষেপ দাবি করছি।
র্যাগিং
……২০১২ র নভেম্বরে আমি যেদিন প্রথম এখানে এলাম সেদিনই বুঝলাম যে এটি একটি র্যাগিং-এর কেন্দ্র। সিনিয়ররা সমস্ত নতুন ছাত্রদের ‘র্যাগিং টেরেস’ নামে ইন্সটিটিউটের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় র্যাগ করে। জায়গাটির নাম-ই ‘র্যাগিং টেরেস’ হয়ে গিয়েছে কারণ বছরের পর বছর ধরে ঐখানেই র্যাগিং করা হয়ে থাকে। আমি ছাত্রদের বিভিন্ন নোটিস দেখাতে পারি যেখানে ঐ জায়গাটিকে ‘র্যাগিং টেরেস’ বলা হয়েছে …..। আমি কর্তৃপক্ষ-র কাছে র্যাগিং-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাই। সিনিয়ররা পিছনে লাগে। তদন্ত কমিটি সিদ্ধান্তে আসে যে র্যাগিং হয়েছে ও ছাত্রদের শাস্তি দেওয়া হয়। অর্ধেকের বেশি ছাত্র আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আমি ইন্সটিটিউটে একঘরে হয়ে যাই। …
মাদকদ্রব্য ও মদ
এখানে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এটি গাঁজাখোর আর মাতালদের রাজত্ব। ……………… যে কোনো এক বছরের নোটিশ দেখলেই দেখা যাবে যে অন্তত দশটা নোটিশ রয়েছে আবাসিকদের পক্ষ থেকে যেখানে তারা ছাত্রদের বলছে যে গান-বাজনার আওয়াজ কম করতে ও ইন্সটিটিউটের আবাসিক অঞ্চল থেকে দূরে গিয়ে ‘পার্টি’ করতে। হোস্টেলে আমার রুম-মেটই একসময় গাঁজা খেত আর ঘরের মধ্যে গ্রাম থেকে আনা গাঁজা এক স্যুটকেস ভর্তি করে রেখে দিয়েছিলো। যৌন হেনস্থার অভিযোগে অন্যতম অভিযুক্ত যে প্রফেসর সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন তিনি ছিলেন ছাত্রদের মদ ও গাঁজার অবিরাম যোগানদার। ইন্সটিটিউটে এইরকম একটা কথা চালু আছে যে ওনার কাছে কলকাতার সবচাইতে ভালো গাঁজা পাওয়া যায়। আমি কি এখানে এক মাদক বিক্রেতাকে শিক্ষক হিসেবে পেতে ও যৌন হেনস্থার শিকার হতে ভর্তি হয়েছি ? একজন প্রফেসরের ক্লাসে নিয়মিত অনুপস্থিতি ও হোস্টেলের ঘরে মদ ও গাঁজা সহ ‘প্রকৃত ক্লাস’ করানোর রীতির বিরুদ্ধে আমরা অনেকবার অভিযোগ করেছিলাম। এখানে একটি ভিডিও আটাচ করা হল যেখানে দেখা যাচ্ছে যে ‘ প্রকৃত ক্লাস’এর নামে ঐ প্রফেসর কী করতেন।
https://www.youtube.com/watch?v=IIbOOqTwLLE
চেয়ারপার্সনকে একাধিকবার জানানো সত্বেও কোন প্রকার পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। উপরন্তু, এই ভিডিওটা দেখার পর কর্তৃপক্ষের দিক থেকে বলা হয়েছে যে এই সব বিষয় ‘এস আর এফ টি আই পরিবারের’ মধ্যেই রাখতে, বাইরে বের না করতে।
আবার র্যাগিং
ক্যাম্পাসে যখন আবার র্যাগিং শুরু হল … আমরা দুজন মেয়ে আর একজন ছেলে মিলে আটকাতে যাই। যারা র্যাগিং করছিলো তারা আমাদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। অবস্থা এতটাই হিংসাত্মক হয়ে ওঠে যে আমাকে পুলিশ ডাকতে হয়। আমি আবারো অভিযোগ করি। …………… কর্তৃপক্ষ আমার অপর চাপ তৈরী করে অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য। কারন এর ফলে নাকি কিছু ছাত্রের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে পারে। আবারো তদন্ত কমিটি বসে, র্যাগিং হয়েছে প্রমাণিত হয়, একটা বড় অংশের ছাত্র দোষী সাব্যস্ত হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেন না। র্যাগিং চলার সময় আমি একটি ভিডিও তুলি। সেটা এইখানে অ্যাটাচ করা দেওয়া হল। https://www.youtube.com/watch?v=DkPOnPwKVew …
গোটা ‘র্যাগিং-উৎসব’ সাধারণত রাত ১০ টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত্য চলে।
প্রফেসরদের করা যৌন হেনস্থা
ডিসেম্বর ২০১৫ তে আমরা ৬-৭ জন মেয়ে মিলে প্রফেসর আর ছাত্রদের বিরুদ্ধে যখন ক্যাম্পাসে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলাম আমরা ভাবতেই পারিনি আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে! অভিযোগ করার দিন থেকে আমাকে ক্যাম্পাসের মধ্যে আলাদা ও একঘরে করে দেওয়া হয়েছে। আমার একটি অভিযোগ আমার কোনো অনুমতি না নিয়ে ও আই সি সি কে না জানিয়ে কর্তৃপক্ষ পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। অভিযোগের দিন থেকে…… আমরা সবচাইতে অমানবিক হেনস্থা ও হুমকির শিকার। ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশ্যে মদ খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ার পর ক্ষিপ্ত জনতার হতাশার শিকার হই আমি।
https://www.youtube.com/watch?v=Evjl-KAvq-A
এই ভিডিওটিতে দেখা যাবে আমার হোস্টেলের রুমের সামনে সকাল ৬ টার সময় কি করা হচ্ছে। …. এখানে আমাকে ‘যাকে শুনা দেনা আপ্নে বেহান কা লাউড়ি কো’ কথাটা আমার উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, যখন আমি সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম। এদের মধ্যে তিনজনকে হোস্টেল থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমি যখন এই চিঠিটা লিখছি তখনো তারা আমার কয়েক মিটার দূরে হোস্টেলের একটি ঘরে বসে মদ খাচ্ছে। তিন চারদিন আগে এই এদেরই এক বন্ধু, যার ক্যাম্পাসে মহিলা পেটানোর ‘সুখ্যাতি’ আছে, সে ক্যাম্পাসের বাইরে, পাঁচিলের গায়ে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ‘বেহান কি লাউড়ি’, ……… ‘ওয়াট আ ফাক’ বলেছিলো আমাকে, আরো বলেছিলো ‘আমি ক্যাম্পাসের বাইরে আছি, তুমি কিছু করতে পারবে না ‘। যখন আমি ডিরেক্টর আর চেয়ারপার্সন কে এই ঘটনাটা জানিয়ে অভিযোগ করতে যাই , চেয়ার পার্সন আমাকে জানান যে, ‘তালি এক হাত সে নাহি বাজতা’।
কর্তৃপক্ষ সেসব ছাত্রের পক্ষেই রয়েছে যারা যৌন হেনস্থার আভিযোগকারীদের কোণঠাসা করছে ও আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। …. আই সি সি র চেয়ারপার্সন নিজে হুমকির শিকার। আই সি সি -র এক মহিলা সদস্যকে শাসানো হয়েছে। আই সি সি ঐ দুই যৌন হেনস্থাকারী প্রফেসরদের বিরুদ্ধে কঠিনতম শাস্তির নির্দেশ দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ তো নেয়নি, উপরন্তু আই সি সি-র নির্দেশ অমান্য করে বাইরের উকিলের সাহায্য নিয়েছে।
… আমি জানি না আমার কোথায় যাওয়া উচিৎ সাহায্যের আশায় ? ….
আমার ৯ জুন থেকে ডিপ্লোমার প্রোজেক্ট শুরু হচ্ছে। তাও আমি রাত জেগে এইটা লিখছি কারণ আমি জানি না কাল আমার জন্য কী দুঃখ অপেক্ষা করছে। …..
… এই ইন্সটিটিউটে আমার জীবন ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। আমার ওপর যে কী ঘটে চলেছে তার দলিল হিসেবে আমি এই চিঠিটাকে রেখে দিতে চাই কারণ আমি ভয় পাচ্ছি যে আমাকে বাধ্য করা হতে পারে কোর্স ছাড়তে বা এই ক্যাম্পাসের কোনো গুন্ডা আমাকে খুনও করে দিতে পারে।
দয়া করে এখুনি হস্তক্ষেপ করুন। “
Leave a Reply