সমিত বিশ্বাস, মদনপুর, ২৫ অক্টোবর#
দিনটা ছিল বুধবার। ৮ জুলাই ২০১৫। ঘোর বর্ষা। অন্যান্য দিনের মতোই অফিসে যাবার জন্য সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রেলস্টেশনে এসে এক বছর পনেরোর অজানা, অপরিচিত ছেলেকে দেখলাম। তাকে ঘিরে জটলা। সকলের মুখ থেকে জানতে পারলাম, ছেলেটি বাবার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনদিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সেই মালদা থেকে সে কিভাবে কিভাবে এসে পৌঁছেছে এখানে। আজ সে বাড়ি ফিরতে চায়। ছেলেটির কাছ থেকে ওর বাড়ির ফোন নম্বর নিয়ে ওর কাকার সাথে কথা বলিয়ে দিলাম।
স্টেশনের সবাই জানে, আমি অফিস যাই নৈহাটি স্টেশন হয়ে। মালদা পৌঁছতে গেলে নৈহাটি যেতে হবে, তাই সবাই মিলে আমাকেই দায়িত্ব দিল, নৈহাটি স্টেশনে জিআরপি-র হাতে ছেলেটিকে তুলে দেওয়ার জন্য। ওখান থেকে ওর বাড়ির লোক নিয়ে নেবে।
ছেলেটার নাম মঙ্গল মণ্ডল। নাইনে পড়ে।
নৈহাটি স্টেশনে জিআরপি তো নিলই না, উপরন্তু আমাকে বাজে গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দিল। ছেলেটার মা-বাবা তুলে, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে গালিগালাজ করল, কর্তব্যরত মহিলা পুলিশদের সামনেই।
অফিসে যাওয়াটা খুবই জরুরি, তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই ছেলেটাকে টিকিট কাউন্টারের সামনে বসিয়ে রেখে চলে এলাম অফিস। অফিসে গিয়ে পৌঁছেছি, মঙ্গলের বাড়ি থেকে কাকার ফোন আসতে লাগলো ঘনঘন, ঘন্টায় ঘন্টায়। অনুরোধ, ছেলেটিকে যেন একটু দেখে রাখি। ওনারা ছেলেটিকে নিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। মালদা থেকেও বেশ কয়েক কিলোমিটার ভেতরে গ্রামে ওদের বাড়ি (কাকার ভাষায় “চল্লিশ টাকার পথ”)। ওখান থেকে নৈহাটি আসতে সময় লাগবে। পরদিন ভোরবেলা এসে পৌঁছবেন।
বারবার ফোন পেয়ে টেনশন হলো, আর্ধেক অফিস করে বলে কয়ে বেড়িয়ে পড়লাম নৈহাটি স্টেশনের উদ্দেশ্যে। স্টেশনে এসে খুঁজতে লাগলাম মঙ্গল-কে। অবাক হয়ে দেখলাম, আমি যেই জায়গায় বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম, সেখানেই বসে আছে সে। আমাকে দেখে তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগলো। বুঝলাম, ও আমার ওপর ভরসা করেছে। ফের মোবাইলে ওর কাকার সাথে কথা বলিয়ে দিলাম। ওকে সকালে স্টেশনে রেখে আসার সময় একটা দোকান দেখিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ওখান থেকে কিছু খেয়ে নিস। জিজ্ঞাস করে জানলাম, ও দোকানটা থেকে সারা দিনে পাঁচটা রসগোল্লা খেয়েছে। পাশেই ছিল ভাতের দোকান, কিন্তু আমি আঙুল দিয়ে সকালে যে দোকানটা দেখিয়েছিলাম, সেটা মিষ্টির দোকান ছিল যে! যাই হোক, ভাত খাওয়ালাম মঙ্গলকে।
কিন্তু রাতটা কাটাবো কোথায়। কী করব ভেবে না পেয়ে আমার বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম। বাবা ছেলেটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলল। কিন্তু এ শুধু আমার সমস্যা, পরিবারকে জড়ানোটা ঠিক হবে না ভেবে ঠিক করলাম, রাতটা নৈহাটি স্টেশনেই কাটিয়ে দেব ছেলেটাকে নিয়ে। রাতে কতবার তো কত স্টেশনে থেকেছি। কিন্তু সেসব স্টেশনে তো জিআরপি ছিল না, নৈহাটিতে রাত বারোটা বাজলেই তো জিআরপি টহল দিতে আসবে, তখন জেরা করতে শুরু করলে কী জবাব দেব?
সাতপাঁচ ভেবে ফের গেলাম জিআরপি-র কাছে। কিছু ভালো মানুষ এখনো আছে। সেই সময় ডিউটিতে ছিলেন যে এস আই, তিনি সব ঘটনা শুনলেন। তারপর কোনো ফর্মালিটিতে না গিয়ে রাতটুকুর জন্য ছেলেটিকে রাখতে রাজি হলেন, কারণ ভোরবেলাতেই ওর বাবা এসে পৌঁছবে নৈহাটিতে। কাস্টডিতে না নিয়ে কেবল ঘরের মধ্যে রাখার নিশ্চয়তা পেয়ে আমি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি চলে এলাম।
কিন্তু ছেলেটার বাড়ির লোক না আসা পর্যন্ত কী আর চিন্তা যায়? সারারাত ঘুমোতে পারিনি। পরদিন সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নৈহাটি স্টেশন। পৌনে পাঁচটাতেই পৌঁছে গেছেন মঙ্গলের বাবা আর কাকা। ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ছেলে ভেতরে আছে। সমস্ত রকম ফরম্যালিটি করতে সময় লাগছে। তারপর ছেলেকে ফেরত পাওয়া যাবে। সমস্ত ঘটনার জন্য ওনারা খুবই কৃতজ্ঞ আমার কাছে। মঙ্গল ভেতরে আছে, আমি আর ভেতরে গেলাম না।
নৈহাটি লঞ্চঘাটে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ফোন এল জিআরপি থেকে। ‘ছেলেটাকে ছেড়ে দিচ্ছি।’ ‘আমি যাবো?’ ‘আসুন’। মঙ্গলকে সকালে দেখতে পাইনি। একবার দেখবার ইচ্ছে হচ্ছিল। তাছাড়া বৌ বলেছিল, মোবাইলে একটা ছবি তুলে আনতে ছেলেটার।
নৈহাটি স্টেশনে জিআরপি ঘরে ঢুকতে ফের তুমুল খিস্তি। যে ফোন করে ডেকেছিল, সে চুপচাপ বসে আছে। পাশের জন বিচ্ছিরি গালিগালাজ করছে। ‘ডিউটি ঠিকঠাক করছি কি না দেখতে এসেছেন? … এবার আপনাকে দায়িত্ব দিয়ে দিই বাড়ি পৌঁছে দেবার?’ আমি আর কি করব, হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম মঙ্গল পাশেই চেয়ারে বসে আছে। কাঁচুমাচু মুখ। আমি ওরকম গাল খাচ্ছি শুনে ওর মুখ চুন হবে না তো কি?
৯ টা ২০ তে অফিসে ফোন মঙ্গলের কাকার। ‘আমরা ছেলে পেয়ে গেছি। ব্যাণ্ডেল লোকালে বসে আছি ব্যাণ্ডেল যাবো বলে।’
মঙ্গলের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে এখনো আমার ফোনে যোগাযোগ আছে। ওরা আমাকে কুটুম পাতিয়েছে। বারবার যেতে বলে ওনাদের বাড়ি।
জিআরপি-র ব্যবহারে প্রথমে আমি নিজেকে দুষছিলাম, কেন যে এই বাঁশটা নিতে গেলাম সাধ করে। এখন চরম একটা তৃপ্তি হয়।
Leave a Reply