৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ছগনলাল চৌধুরি, অখিল ভারতীয় কিসানসভার রাজ্য সম্পাদক
রাজস্থান-হরিয়ানা সীমান্তে শাহজানপুর-রেউরি থেকে
বছর শেষের শীতের রাতে আমাদের তাঁবুর ওপর বরফ জমে গিয়েছিল। রাত একটার পর হাওয়া বইতেই আমাদের তাঁবুর ভিতর ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে লাগল। শাহজাহানপুর সীমান্তে পুলিশের জলকামান চলেনি। ঘরের ভিতর বসে লোকে তা অনুভব করতে পারেনি। ঠান্ডায় অ্যালার্জির জন্য আমার কিছুটা অসুবিধা হয়। হাল্কা সর্দিও লেগেছিল। বেশ কিছু ডাক্তারের ক্লিনিক আমরা এখানে শুরু করেছিলাম, অনেককে টেবিল চেয়ার পেতে তাঁবু খাটিয়ে বসানো হয়েছিল। আজ তাদের চিকিৎসাও কৃষকদের নিতে হয়। রাত সাড়ে তিনটে চারটে নাগাদ মহারাষ্ট্রের রাজ্য সম্পাদক কিসন গুর্জরের সাথে অন্য সাথিরাও চলে গেলেন। মহারাষ্ট্রে স্থানীয় নির্বাচনের জন্য ওঁদের চলে যেতে হল। সকালবেলায় তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ক্যাম্প-অফিসে এসে দেখলাম, পিণ্ড জেলার কাপুরথালার কেবল সিং আর শ্রবণ সিং একটা বড়ো ট্রাকে ওঁদের টিম নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ওতে ছিল রেশন, সবজি, দুধ, জল, গদি আর কম্বল। আমি সাধারণত সোয়েটার আর কোট পরি না। কিন্তু আজ কেবল সিংরা দুটো দারুণ সোয়েটার নিয়ে এসেছে। জোর করে একটা আমাকে, আর একটা কালু থোরি-কে পরিয়ে দিল। কালু হল গঙ্গানগর কিসানসভার জেলা সম্পাদক। প্রথম লঙ্গর ওরাই এখানে খুলেছিল। এসএফআই-এর স্মরণ জয়ন্তী সমারোহে কিছুটা সময় দিলাম। হরিয়ানা, গুজরাত, মহারাষ্ট্রের নেতাদের এখানে অংশ নেওয়ানোর পিছনে এসএফআই-এর বড়ো ভূমিকা ছিল। ওদের সেলাম। প্রসঙ্গত, দুই পরিবারের উল্লেখ করি। রমেশ বেরওয়া কলেজের শিক্ষক এবং তাঁর সাথি রাইসা ওঁদের ছেলে, দেওর ও তাঁর স্ত্রী সহ পুরো পরিবার নিয়ে এই আন্দোলনে এলেন। দু-বছরের একটা বাচ্চাও ওঁদের সঙ্গে আছে। ওকে কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে খেলা করলাম। আমার নাতি লিচ্চির কথা মনে পড়ল। গত আঠারো দিন ভিডিও কলে মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে কথা বলেছি। দ্বিতীয় পরিবারে এসেছে যোধপুরের আইনজীবী কিসন মেঘওয়াল, ওঁর স্ত্রী আর বাচ্চা।
১ জানুয়ারি, দিল্লিতে ‘সংযুক্ত কিষান মোর্চা’র সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়েছে:
- ৪ তারিখ মূল দুটো দাবি সরকার মেনে না নিলে ৫ তারিখ কৃষকরা রিং রোড ধরে দিল্লির দিকে এগিয়ে যাবে।
- ৬-২৩ নেতাজির জন্ম দিন পর্যন্ত সারা দেশে ‘দেশ জাগৃতি অভিযান’ শুরু হবে।
- শাহিনবাগের মতো জমায়েত ভাঙার চেষ্টা করলে তার ফল হবে মারাত্মক।
- আম্বানি আদানিদের পণ্য ও পরিষেবা বয়কট চলবে। ওদের পেট্রল পাম্প বন্ধ করে দেওয়া হবে।
সন্ধে হতে হতে ফের শীত বাড়তে লাগল। শহিদ ভগৎ সিং স্মারক, ভিওয়ানি থেকে কমরেড রামফল দেশওয়াল, কমরেড চন্দ্র ভান, কমরেড সহদেব এক কন্টেনার গাড়ি ভর্তি লেপ নিয়ে এল। এই আন্দোলনে আগত প্রত্যেক আন্দোলনকারীকে ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে তিনটে ক্যাম্প কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে কিসানসভার একটা ক্যাম্প, যারা সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গরম পকৌড়া ভেজে চলেছে। আর সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত সেগুলো শেষ হয়ে যায়। এই হল রোজকার সূচি। এতে বহু কর্মী হাত লাগিয়েছে। এক নওজোয়ান দম্পতি ওদের গাড়ি আমাদের রাজ্য দপ্তরের সামনে থামিয়েছিলেন। কিসানসভার জেলা সভাপতি মোতিলাল শর্মা নিজের ফোন থেকে আমার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দেন। এদের একজন বড়ো ব্যবসায়ী, আর একজন বড়ো পদে চাকরি করে। আমি তাঁবু থেকেই কাজ করি।
আমি ওই দম্পতিকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা ফটো কেন দিচ্ছ না? ওরা বলল, আমাদের বৃদ্ধা মা দাদার সঙ্গে বিদেশে থাকেন। আমরা আন্দোলনে যোগ দিচ্ছি কিংবা এখানে আসছি জানলে মা ভয় পাবেন যে সরকার আর পুলিশ আমাদের জুলুম করবে। মা টিভি, মোবাইল আর খবরের কাগজে এই আন্দোলনের ছবি দেখেছেন।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তাহলে তোমরা এখানে এসেছ কেন? ওরা বলল, আমাদের দাদা-বউদি, মাসি, মামারা বিদেশে থাকেন, তারা প্রবাসী ভারতীয়। তারা বলেছেন, আন্দোলনে যাও আর যা মদত ওখানে কৃষকদের দরকার করো, আমাদের পক্ষ থেকেও কোরো।
আমার তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, বিদেশে যারা থাকে, তাদের এই আন্দোলনে রুচি হয়? ওরা বলল, পাঞ্জাবে অনেক জেলাতেই প্রত্যেক ঘর থেকে একজন বিদেশে থাকে, কিন্তু তাদের জড় খেত আর পাঞ্জাবের সঙ্গে গভীরভাবে জুড়ে রয়েছে। ওরা চায় না যে সেই সেসব ধ্বংস হয়ে যাক। বলা যায় না, ওদের কোনোদিন দেশে আসতেও হতে পারে।
আমার শেষ প্রশ্ন ছিল, মোদির কর্পোরেট সমর্থন, দেশের সম্পদ বেচে দেওয়া, দেশের ভ্রাতৃত্ববোধকে খতম করা আর দেশটাকেই ধ্বংস করার নীতিগুলো তো কয়েক বছর ধরেই চলছে। এতদিন তোমরা তার বিরোধিতা করোনি কেন? — ভয় পেয়েছি। কারণ যেই বিরোধিতা করেছে, তার ওপর খুব জুলুম হয়েছে। কিন্তু এবার কিসান আন্দোলন জিতবে, মোদির নীতির হার হবে। একটা ভালো আশার আলো দেখতে পেয়ে আমরা দেশের ভালো আর শান্তির জন্য সহযোগিতা করতে চাই।
Leave a Reply