ওড়িশার জগৎসিংহপুর জেলায় কোরিয়ান কর্পোরেট পস্কোর স্টিল ও বন্দর প্রকল্প হবার কথা হচ্ছিল সেই প্রায় দশ বছর ধরে। গোবিন্দপুর ধিনকিয়া গ্রামের গ্রামবাসীদের সম্মিলিত লড়াইয়ে সেই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ আটকে ছিল অনেকদিন। তারপর সেই প্রতিরোধ আপাতভাবে ভেঙে যায়, সরকার জমি অধিগ্রহণ করে। কিন্তু গতবছর সরকার অধিগৃহিত উপকূলবর্তী জমি, পানবরজের জমি, এবং জঙ্গলের জমির অনেকটাই পুনর্দখল করে নেয় গ্রামবাসীরা। বিনিময়ে পেয়েছিল অজস্র মামলা। গ্রাম থেকে বেরোলেই গ্রেপ্তারি। প্রশাসনের রক্তচক্ষু। অবশেষে হয়ত হার মেনেছে কর্পোরেট পস্কো। ৮ এপ্রিল এনজিটি-র রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের নেতৃত্বদায়ী সংগঠন ‘পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতি’র ১২ এপ্রিলের পস্কো প্রেস বিবৃতি।#
বন্ধুরা
আপনারা সবাই আশা করি শুনেছেন, ৮ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনাল তার নির্দেশে বলেছে,
“তাদের (পস্কো) পরিবেশগত ছাড়পত্র ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত। তারা কোনো কাজ করতে পারবে না, কারণ জমি এখনও তাদের হাতে দেওয়া হয়নি এবং তার ফলে প্রকল্পটি আর এগোতে পারবে না। এই পর্যায়ে তারা (পস্কো) প্রকল্পটি আর করতে পারছে না। তারা যদি পরিবেশগত ছাড়পত্রটির সুবিধা নিয়ে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করতে চাইতো, তাহলে তাদের আবেদনকারী এবং ট্রাইবুনালকে তা জানাতো।”
অনেকেই ভাবছেন, পস্কো প্রকল্পটি থেকে সরে গেছে এবং বিজয়োৎসব পালনের মুহুর্ত সমাগত। আমরা কিন্তু পরিষ্কার করে দিতে চাইছি যে যদিও এই সাম্প্রতিক শুনানিতে ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনাল আমাদের জানিয়েছে যে পস্কো বিভ্রান্ত; কিন্তু আমরা অস্বস্তিতে আছি এই কথা ভেবে — পস্কো কেন প্রকল্পটি এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের অবস্থানটা প্রকাশ্যে বলতে চাইছে না। আমরা বুঝতে পারছি না কেন, পস্কোর ২০১৭ সালের মধ্যে কাজ শুরু করার উদ্দেশ্য না থাকা সত্ত্বেও, ফের ৯ মে ২০১৬ তারিখে শুনানির দিন ফেলা হয়েছে! মামলাটি তো চিরকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া উচিত, যাতে আমাদের উদ্বেগ এবং ঝামেলার শেষ হয়।
(ওড়িশা) রাজ্য পুলিশ তো এই এলাকাটাকে একটা অত্যাচারের উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছে। ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে শারীরিক যন্ত্রণা তো সইতে হচ্ছেই, আমাদের লোকজনগুলোর ওপর কাল্পনিক সব অসংখ্য মামলা দেওয়া হয়েছে। অনেককেই জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। স্থানীয় পুলিশের কাছে গ্রামের কেউ এফআইআর করাতে গেলে তা তো নেওয়া হচ্ছেই না, উপরন্তু পুরুষ নারী নির্বিশেষে অভিযোগ জানাতে গেলেই দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে। বর্তমানে গ্রামের দু-জন জেলে পচছে — গোবিন্দপুর গ্রামের খীরা দাস গ্রেপ্তার হয়েছিল ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর (ওইদিনই ছিল বিশমানবাধিকার দিবস!)। ধিনকিয়ার প্রফুল্ল জেনা আরেকজন। সে গ্রেপ্তার হয়েছে ২০১৬ র ২ ফেব্রুয়ারি। গ্রামবাসীদের ওপর ৪২০ টার বেশি মিথ্যে মামলা দেওয়া হয়েছে। ২০০০ লোকের ওপর আছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এদের মধ্যে আবার ৩০০ জন মহিলা। পুলিশের পরোয়ানার ভয়ে গ্রামবাসীরা গ্রামের বাইরে বেরোতে পারে না।
পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্থানীয় মানুষ পানবরজের জমিগুলি পুনর্দখল করতে শুরু করে। ওগুলো জোর করে দখল করে নিয়েছিল জেলা প্রশাসন, পস্কোকে দেবার জন্য। ফলত, পস্কো আমাদের লোকেদের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাগুলোর মধ্যে আছে অপরাধ সংক্রান্ত ধারাগুলিতে কেস (ধারা ৪৪৭, ৪২৬) এবং দখল করে রাখার সিভিল কেস। গড়কুজঙ্গ পঞ্চায়েতের গ্রামবাসীদের ওপর ৩০টা ক্রিমিনাল কেস ঝুলছে। আরেক দিকে, গোবিন্দপুরের গ্রামবাসীড়া তথাকথিত সরকারি জমি পুনর্দখল করে। ফলে স্থানীয় প্রশাসন চল্লিশ জনের ওপর সিভিল ও ক্রিমিনাল কেস দেয়। নুয়াগাঁও গ্রামের অধিবাসীরা তথাকথিত সরকারি জমি পুনর্দখল করে ২০১৫। ওই লোকদের ওপরও মামলা করার হুমকি দিয়েছে সরকার।
এরই মধ্যে কান্দাহার সুরক্ষা সংগ্রাম সমিতির সদস্যরা এবং আরো জনআন্দোলনের সাথিরা কান্দাহার জলপ্রপাতের কাছে তিনদিনের প্রতিবাদ ডেকেছিল ২৬-২৮ জানুয়ারি ২০১৬। তারা দাবি করেছিল, নিয়ামগিরির মতো গ্রামসভার সম্মতি ব্যতিরেকে উন্নয়নের নামে কোনো জমি বা খনি সরকার নিতে পারবে না। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়কেই ১৯৯৬ সালের পেসা আইন মেনে চলতে হবে। ২০০৬ সালের বনাধিকার আইন মেনে চলতে হবে। এবং সংবিধানের পঞ্চম শিডিউল অনুসারে গ্রাম সভা আইন বলবৎ করতে হবে। তারা দাবি করেছিল — এই এলাকাগুলোকে ‘জাতীয় প্রাকৃতিক ঐতিহ্য’ বলে ঘোষণা করতে হবে এবং ‘বিশেষভাবে বিপন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী’ (PVTG) পঔদি ভুইনাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
আমাদের দাবি,
১) উড়িশার প্রকল্প থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করুক পস্কো।
২) সরকার পস্কোর জন্য যত জমি অধিগ্রহণ করেছিল, সব গ্রামবাসীদের ফেরত দিক এবং তাদের জমির অধিকার বনাধিকার আইন ২০০৬ অনুসারে স্বীকার করুক।
৩) সরকার এক্ষুনি এলাকার সমস্ত মানুষের ওপর থেকে মিথ্যে মামলাগুলো তুলে নিক, ক্রিমিনাল কেসগুলো প্রত্যাহার করুক।
৪) সরকার উপকূল অঞ্চলে গাছগুলি পুনরায় লাগানোর ব্যবস্থা করুক, কারণ ২ লক্ষের বেশি গাছ কেটে নিয়েছিল সরকার। পস্কোর জন্য।
৫) ২০০৮ ও ২০১৩ সালে আক্রমণের ঘটনায় আহতদের এবং নিহতদের পরিবারবর্গকে যথাযথ ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত করুক পস্কো।
প্রশান্ত পাইকরে
পস্কো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতি
১২ এপ্রিল ২০১৬
Leave a Reply