পর্ণব। ধুবুলিয়া। ৯ অক্টোবর, ২০২০।#
ধুবুলিয়া বাজার থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে জাতীয় সড়ক ধরে গেলেই চোখে পড়বে, বামদিকে গাবরকুলি ঢোকার রাস্তার মুখে কৃষি দপ্তরের একটি সাইনবোর্ড, আতমা ভিলেজ। সেই গ্রামের খোঁজে গিয়ে খানিকে দূরে এক বয়স্ক লোককে জিগ্যেস করতেই তিনি সটান উত্তর দিলেন, ‘জানিনা। আত্মা গ্রাম কী, কাকে বলে, তার ডেফিনিশনই বা কী- কিছুই জানিনা।’ ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকাতেই বুঝলাম ঠিক লোককেই পেয়েছি। বলি, আমি যদ্দুর জানি এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি বা ATMA একটি কেন্দ্রীয় কৃষি দপ্তরের উদ্যোগ, যা প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় প্রাইভেট-পাবলিক পুঁজির যৌথ বিকাশে চাষিকে তথ্য, সংযোগ, ঋণ ইত্যদি নানা কিছু দিয়ে সাহায্য করে। আর ওই যে দু’চারটে গ্রীণহাউস দেখা যাচ্ছে, ওগুলোই বা কাদের? কী চাষ হয়? উত্তরে ভদ্রলোক বললেন, ওগুলো গ্রীণহাউস না, পলি হাউস বলে। ফুল চাষ হয়। চলেন আমার সাথে।
এরপর বাকি কথা ওনার মুখেই শুনুন।
আমার নাম গোপাল দে। বয়স প্রায় তিয়াত্তর। এখানে চারটে পলি হাউস আছে। একটা আমার। একটা আমার ভাই নেপালের। আমরা এখানে ফুল চাষ করি। ফুল বলতে জারবেরা। পাঁচ বছরের স্কিম। তার মধ্যে তিন বছর হয়েছে। এছাড়াও চাষের জমি আছে। সেখানে ধান, সবজি অন্যান্য চাষ হয়। এটা ছেলে যোগাযোগ করে করেছে। কাগজপত্র, জমিজায়গা আমার নামেই। এখানে সবকটা পলিহাউসেই ফুল হয়। নাকাশিপাড়ায় আরো চুয়াত্তরটা পলি হাউস আছে। সেখানে অন্য চাষও হয়। আমরা ফুল প্রথমে বেথুয়াডহরীর কৃষক মান্ডিতেই দিতাম। কিন্তু ওখানে ২% টাকা কেটে নেয়। ওটা নাকি ওদের নিয়ম। লাভ হয়না দেখে আমরা কিছুদিন পর হাওড়ার ফুল মার্কেটে যোগাযোগ করে ওখানে বিক্রি শুরু করি। বাসের মাথায় ফুল লোড করে পাঠিয়ে দিই। কিছুদিন পরপর গিয়ে টাকা নিয়ে আসি। কিন্তু আট-ন’মাস ফুল বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ। একে গাড়ি চলছিলনা। তার উপর মার্কেট বন্ধ। এই দিন তিনেক হল দু লপ্তে মাল পাঠিয়েছি। কিন্তু দাম নেই। অন্যান্য বছর এই সময় ফুলের দাম তিন চার টাকা করে থাকে।এখন দেড় টাকা/ দু’টাকা। কী করে ব্যাঙ্কের কিস্তি শোধ করব বলুন। ফুল তো আপনাকে তুলতে হবেই, বিক্রি হোক আর না হোক। ফুল তুললে তবেই নতুন স্টিক আসে। নইলে ফুলেই সব সার খেয়ে গাছ নষ্ট করে ফেলে। এই চাষে খরচা বিশাল। সারের খরচা কত ভাবতেই পারবেন না। আর ওষুধ তো আছেই প্রতিদিন।
প্রথমে জমির কাগজপত্র নিয়ে জেলার হর্টিকালচার ডিপার্ট্মেন্টে যাই। ওরা সব দেখেশুনে, ট্রেনিং দিয়ে প্রজেক্ট স্যাঙ্কশান করিয়ে দেয়। আমাদের লোন করিয়ে দিয়েছে কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের থেকে। দশলাখ টাকার লোন। পাঁচ লাখ এই পলিহাউস বানানোর খরচ আর পাঁচ লাখ চারা কেনা ও চাষের অন্যান্য খরচ। ওরাই ঠিক করে দেয় কোথা থেকে চারা কিনতে হবে, কোন কোম্পানি পলি হাউস বানাবে। ব্যাঙ্গালোর থেকে চারা আনতে হয়েছে। আর যে কোম্পানি পলি হাউস বানিয়েছে, তাদের কথা আর কী বলব, নিজেই দেখুন এসে। সব নিম্ন মানের জিনিসপত্র দিয়েছে। ওই যে ওপর থেকে সব তারে জং ধরে খুলে পড়ছে। সবে তো তিনবছর চলছে। পাঁচ বছরের চাষ। তালে বুঝুন। স্টিলের তার দেবে বলেছিল। স্টিল হলে জং ধরে? এই পলিশীট নাকি ইসরায়েল থেকে আনা হয়েছে। আমফানে আমাদের কিছু না হলেও পাশের দুটো পলিহাউসের বেশ ক্ষতি হয়েছে।
লোনের ইন্টারেস্ট রেটটা ঠিক মনে পড়ছেনা। বারো পার্সেন্টের কাছাকাছি। এযাবৎ তিনটে কিস্তি দিতে পেরেছি। তাতে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার শোধ হয়েছে হয়তো। আর দুবছরে শোধ না হলে কী হবে জানিনা। ব্যাঙ্ক যা ভালো বুঝবে করবে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ফলনটা বেশি হয়। আমার পলিহাউসটায় পাঁচশ স্কোয়ার ফুটের উপর চাষ। তিন চারদিন অন্তর ফুল তুলে ফেলতে হয়। শীতের সময় টা বাদ দিলে দিনে গড়ে আড়াই তিনশ টা ফুল পাওয়া যায়। জলের লাইন সব গাছের মধ্যে দিয়েই। খাটনি বলতে গাছ পরিষ্কার রাখা, শুকনো ও রোগ লাগা পাতা কেটে ফেলা, ফুল তোলা – এসবই। গরমের সময় ওপরের পাইপ লাইন দিয়ে স্প্রিংক্লারের মাধ্যমে জল স্প্রে করতে হয়। ওষুধও ওখান দিয়েই। আমাদের সব লিকুইড সার, ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। সাধারণ সারের থেকে এসবের দামও বেশি। হাওড়ার ফুল বাজারে ব্যবসায়ীরা যা লাভ করছে, আমরা সারাবছর চাষ করে, বিদ্যুৎ খরচ, সার-ওষুধ কিনে তা করতে পারিনা। আরো খরচ আছে। ফুল পাঠানোর সময় প্রতিটা ফুল প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে, দশটা করে বান্ডিল বেঁধে, বড় বড় পিচবোর্ডের পেটিতে ভরতে হয়। এসব প্যাকেট কলকাতা নয়তো রানাঘাট থেকে কিনে আনতে হয়। ওরা যেমন বলছে বাজারদর, আমাদের তাই মেনে নিয়ে দাম নিতে হচ্ছে। এটা তো আর অত্যাবশ্যক পণ্য নয়, যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থাকবে। যাদের পয়সা আছে তারা শখে কেনে, নয়তো অনুষ্ঠান বাড়িতে যায়।
আমাদের পূর্বপুরুষ বরিশালের লোক। জাতিতে কায়স্থ। বাপ-ঠাকুর্দারা চাষ করতেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। তখন সার লাগত না চাষ করতে। এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে তো ওভাবে চাষ করলে চলবেনা। মানুষের প্রয়োজনও বেড়েছে। তাই আধুনিক ব্যবস্থাকে তো মানতেই হবে। আমরা ষাটের দশকে দুর্ভিক্ষও দেখেছি। তখন পঞ্জাব থেকে মাইলো, ভুট্টা আসত। ওসব কি এখানকার মানুষের পেটে সয়? মাইলো সেদ্ধ, ভুট্টার রুটি খেয়ে কত মানুষ আমাশা হয়ে মরে গেছে। এই ফুলচাষে একটা ব্যাপার কি, মন টা ভালো রাখে। অন্যান্য চাষের মত খাটনিটাও নেই। আমায় তো এখন কেউ ধান চাষ করতে বললেও শরীরে পারবেনা।
Leave a Reply