জিতেন নন্দী ও অমিতা নন্দী, কলকাতা, ৫ মে#
আমরা ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন তাওয়াঙে গিয়েছিলাম, আমাদের সঙ্গে লোবসাঙ গিয়াৎসোর দেখা হয়েছিল। ড্যাম বিরোধী আন্দোলন নিয়ে জানার উদ্দেশ্যে আমরা ওঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছিলাম। একটা দোকানে গিয়ে একজনকে গিয়াৎসোর কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি আমাদের গিয়াৎসোর পরিচিত একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ঠিক সেই সময়ই রাস্তা দিয়ে গিয়াৎসো আসছিলেন, ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। দু-একটা কথা বলার পর আমরা ওঁর সঙ্গে বিশদে কথা বলব বলে সন্ধ্যায় দেখা করব স্থির হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আসতে পারেননি। কোনো গ্রামে মিটিং করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন।
তাওয়াঙে ওঁকে লোকে বলে আন্না লামা। আন্না হাজারের আন্দোলনের একটা প্রভাব ছিল সেই সময়। তাওয়াঙের অধিকাংশ মানুষই ড্যাম বিরোধী আন্দোলন সম্বন্ধে কমবেশি ওয়াকিবহাল। ২০১২ সালে ওখানে তৈরি হয়েছিল ‘সেভ মন রিজিয়ন ফেডারেশন’। মন রিজিয়ন হল অরুণাচলের মনপা সমাজের মানুষের বসবাসের এলাকা। এদের দীর্ঘকাল ধরে স্বশাসনের জন্য একটা সামাজিক আন্দোলন ছিল। যদিও মনপা ছাড়াও ওখানে আরও সাতটা ট্রাইবের কথা শুনেছি।
বড়ো ড্যামের বিপদটা মন-এলাকার মানুষকে দলীয়তার বাইরে এনে একতাবদ্ধ করেছে। তাওয়াঙে স্থানীয় মানুষের কাছে আমরা জানতে পারি, এখানে বেশ কিছু ছোটো ড্যাম ছিল। সেগুলোর অধিকাংশ অকেজো হয়ে রয়েছে। জল আর বিদ্যুতের বেহাল অবস্থা এখানে। সন্ধ্যাবেলা টিমটিম করে আলো, লোডশেডিংও হয়। পাহাড়ে জলের অন্যতম উৎস হল অসংখ্য উষ্ণ প্রস্রবণ। সেই জল যেমন উষ্ণ-গরম, তেমনি তা পানের উপযোগীও বটে। সাধারণ গরিব মানুষের বোতলের জল কিনে খাওয়ার ক্ষমতা নেই। বড়ো ড্যাম করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটানো হচ্ছে। তাতে পাহাড় ধসপ্রবণ হয়ে উঠছে আর ওই উষ্ণ প্রস্রবণগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নতুন বড়ো ড্যামের যে প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে, প্রাইভেট কোম্পানিগুলো সেই বিদ্যুৎ বাইরে বিক্রি করে। যেমন, গিয়াৎসো বলেছেন, ভিলওয়ারা এনার্জি লিমিটেড যে বিদ্যুৎ তৈরি করছে, সেই বিদ্যুৎ তারা নিয়ে যাবে রাজস্থানের ভিলওয়ারা টেক্সটাইল ফ্যাকট্রিগুলোতে।
নতুন বড়ো ড্যামের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। মনপাদের জমির ওপর এক ধরনের সমাজগত অধিকার আছে, অন্য কোনো জাতের মানুষ সেই জমি কেনাবেচা করতে পারে না। আমরা তাওয়াঙে বাঙালি ব্যবসায়ীও পেয়েছি। তাদের নিজস্ব জমি নেই। এই পাহাড়ি জেলার অর্ধেক জমি মিলিটারি আর সরকারি প্রশাসনের জন্য চলে গেছে। ফলে মনপা এবং স্থানীয়দের মধ্যে একটা বিপন্নতা বোধ বেড়ে উঠেছে।
পাহাড়ের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার প্রশ্নটাও রয়েছে। সর্বত্র রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। কারণ ইদানীং গাড়ির সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। সরকারি কর্মচারীদের গাড়ির জন্য ঢালাও ঋণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ফলে সাধারণ আয়ের সরকারি কর্মচারীরা গাড়ি, মোটরবাইক কিনে নিয়েছে। বড়ো ড্যাম, রাস্তা অতিরিক্ত চওড়া করার প্রকল্প এবং পাহাড় ফাটিয়ে পাথর বোঝাই করে ব্যবসা তাওয়াঙে যাওয়ার পথে চাক্ষুষ দেখেছি। কোম্পানিগুলো ড্যাম তৈরির জন্য সমস্ত দলের নেতাদের টাকা খাইয়েছে। তাই দলীয়তার বাইরে গিয়ে মনপা সমাজ পাহাড়কে বাঁচাতে উদ্যোগী হয়েছে।
ড্যাম বিরোধী আন্দোলন অহিংস উপায়ে (অনশন) করতে গিয়ে লোবসাং গিয়াৎসো তাওয়াং-এর সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন ‘আন্না লামা’।স্থানীয় মানুষ তাঁর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। বড়ো ড্যাম প্রজেক্টের মালিকেরা দলমত-নির্বিশেষে সমস্ত নেতাদের টাকা খাইয়ে দেয়, কিন্তু লোবসাং-কে তারা ওপথে জব্দ করতে পারেনি। আন্দোলনকারী মানুষের সামনে নাকি তিনি গুম্ফায় গিয়ে কসম খেয়েছেন, আন্দোলনের প্রতি বেইমানি করবেন না।
এই গুলি চালনার ঘটনা শুনে আন্দাজ করতে পারছি, পাহাড় কতখানি বিপন্ন, পাহাড়ি সমাজও কতখানি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সেই চঞ্চলতাকে স্তব্ধ করতে নেমে এসেছে দমন।
Leave a Reply