শ্রী পর্ণব, শান্তিপুর, ৩০ মে#
একটি সাক্ষাৎকার (কাল্পনিক, কারণ কালনায় নৌকাডুবিতে মৃত্যু হয়েছিল তার)
মেলার মাইক থেকে ভেসে আসছিল ভবা পাগলার গান……
“এপার হতে ভাসতে ভাসতে যা রে ওই পারে/মনহংস তুই সাঁতার দে রে কালীসায়রে”…
ঘাটে আসতেই বুঝলাম আজ হয়তো সাঁতার দিয়েই ফিরতে হবে শান্তিপুর। তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। জেটী থেকে প্রায় তিনশ মিটার এত ভিড় যেন সূঁচ গলানো যাবেনা। শুনলাম প্রায় পাঁচটা থেকে এইরকম লাইন পড়েছে। ফেরী বন্ধ,তাই। কেন? কে জানে, ছাড়ছে না তো। এগিয়ে দেখি ফেরীঘাটের মাঝি-মাল্লারা মালিক সহ মিটিং করছে ভাড়া বাড়ানো নিয়ে…কিন্তু বাড়িয়ে ভাড়ার অঙ্ক ধার্য্যের ঐকমত্য তৈরি হচ্ছেনা। এ তো মহাফ্যাসাদ।
চারিদিক খুঁজে দেখি ফাঁকে ফোকরে দু’একটা লাঠিধারী পুলিশ আত্মমগ্ন, জিরিয়ে নিচ্ছে। ভাবছি ওরা কী করছে এখানে?
এই মাত্র ঝড়বৃষ্টি থামলো। চারিদিক পিছল। ঘাটেও পরিস্কার আলো নেই…ওদিকে ভীড়ের মধ্যে অবস্থান-দুর্নীতি নিয়ে চুলোচুলি লেগে গ্যাছে মেয়েদের মধ্যে…থেকে থেকেই অজ্ঞাত পশ্চাৎ থেকে চটুল ধাক্কা আর তারপরেই গালাগালি… মেলায় সাধুসঙ্গের গঞ্জিকা যে কীভাবে বোধের পর্দায় সমস্ত কথার কোরাসকে করে তুলেছে কলরব ভাবতে ভাবতে রাত সাড়ে দশ।
অবশেষে ভাড়া ধার্য্য হল মাথা পিছু পাঁচ টাকা। ঘাট খুলে দিতেই ভাগ মিলখা ভাগ ব’লে লাইন ভেঙ্গে ছুট দিল সবাই। আমায় আর ছুটতে হয়নি। গুপি বাঘার জুতোর মত নিমেষে পৌঁছে গেছিলাম নৌকোর খোলার মধ্যে। নৌকা থেকে দেখি ঘাটের ভাসমান জেটি থেকে ভিড়ের চাপে বাচ্ছারা টপাটপ পড়ে যাচ্ছে জলে। ঘাটের ধারে ভিড় কাটাতে ঘাটমালিকের রক্ষীবাহিনী তখন মোটা মোটা বাঁশখুটি নিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছে যাকে পাচ্ছে সামনে। সঙ্গে যোগ দিয়েছে কালনা থানার সিভিক ভলেন্টিয়াররা।
এদিকে নৌকায় তিলধারনের জায়গা নেই। কোলেকাঁখে বাচ্চা নিয়ে মায়েরা কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে নৌকার পাটায়। আমার বন্ধু তখনো জেটিতে। উঠতেই পারেনি। আর উপায়ও নেই। ভাবছি,থাক,পরের নৌকায় আসুক। ঘাটে না হয় অপেক্ষা করব ওর জন্য। জেটী থেকে সবে দড়ি খুলেছে মাঝি। টলমল করছে নৌকা। ওদিকে সেই ফোকরবাসী পুলিশেরা ততক্ষণে ঘাটে এসে এমন লাঠিপেটা করছে যে বাঁশবেড়া ভেঙ্গে লাফিয়ে গড়িয়ে যে পারছে যেদিকে পালাচ্ছে। নৌকায় মাঝি মরিয়া হয়ে ভিড় ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে ইঞ্জিনে স্টার্ট দেবার পথ খুঁজছে।
ঠিক তক্ষুনি তিনটি ছেলে পুলিশের লাঠির ফাঁক গলে পালিয়ে প্রাণ হাতে ক’রে দড়ি খোলা নৌকায় জেটি থেকে দিল লাফ।নৌকাটা হঠাৎ ডানদিকে কাৎ হয়ে গেল আর নৌকার উত্তরে থাকা মানুষগুলো ছোলামটরের মত গড়িয়ে গেল গঙ্গায়। ভাগ্যিস আমি ছইয়ের খুঁটিটা ধরে ছিলাম… ভাবতে ভাবতেই দেখি বাঁদিকের মানুষগুলো গড়িয়ে ডানদিকে কাৎ নৌকার উত্তরে পড়তেই পুরো নৌকোটাই গেল উলটে আর দমকা দমবন্ধ অন্ধকার আর পাশের বাচ্ছাটা মাকে ধরতে যেতেই জল খেতে খেতে জল খেতে দেখছি একটা আঁচল ভেসে যাচ্ছে… তোড়ে… আর আঁচলের পেছনে ভেসে যাচ্ছে স্বামীসন্তানমায়া আর সাঁতার দিচ্ছে কেউ আর অন্তর্জলীয় রেসোনেন্সে আর্তনাদের ডেন্সিটি বেশি…ভাবছি…আর দাঁত খুলে হাঁ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে শ্বাস…নাভিনাদ… নাক মুখ উপচে বুদবুদ কাদা জামাকাপড়ে জড়াজড়ি ঝটাপটি আর কচুরীপানার মূলের মত মেয়েদের চুল দূরে সরে যাচ্ছে সব দূরে চলে যাচ্ছে আর গভীর অন্ধকার কালীসায়রে আমার চিন্তা চেতনা বোধ সাঁতার দিতেই মাথায় ধাং করে লাগল যেন আর খুঁটি থেকে খুলে গেল আঁকড়ে ধরা হাত…
“এপার হতে ভাসতে ভাসতে যা রে ওই পারে/মনহংস তুই সাঁতার দে রে কালীসায়রে”…
একটি প্রতিবেদনঃ
গত ৩১ বৈশাখ শনিবার ইং ১৪ মে বর্ধমান জেলার কালনায় গঙ্গার ফেরীঘাটে রাত এগারোটা কুড়ি নাগাদ মর্মান্তিক নৌকাডুবিতে মৃত শতাধিক। তবে সরকারি সূত্রে এখনো পর্যন্ত তেইশটি মৃতদেহ উদ্ধার করা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন ষাট ফুট গভীরে উলটে যাওয়া নোকাটি উদ্ধার করা গেলে প্রায় চল্লিশটি মৃতদেহ পাওয়া যাবে। ঘটনার পরদিন কালনার অন্যপারে শান্তিপুরের নৃসিংহপুর ঘাটে স্বজন হারানো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শতাধিক মানুষ। কেউ রাণাঘাট কেউ কৃষ্ণনগর কেউ ফুলিয়া থেকে গতরাতে নিখোঁজ মানুষদের পরিবারের লোকেরা ভিড় করতে থাকেন ঘাটে। গঙ্গার ঘাটে মাথা ঠুকে বুক চাপড়ে কান্নার আর্তসুরে ভরে ওঠে এপার ওপার…পরদিন বেলা বাড়লেও শুরু হয়না উদ্ধারকার্য। অথচ বর্ধমানেই দেড়শো ডুবুরী আছে বলে জানেন স্থানীয় মানুষেরাই।
তাদের আরো অভিযোগ, “একটি নতুন লঞ্চ উদবোধন হয়ে যাওয়া সত্বেও তা পড়ে আছে ঘাটে। কালনাঘাটের মাঝিরা সারাবছরই রাতের ফেরীতে জুলুম ক’রে যাত্রীদের কাছে থেকে বেশি বেশি ভাড়া আদায় করে। এখানে এটাই রেওয়াজ। তার ওপরে ভবা পাগলার মেলায় প্রতিবছরই দূরদূরান্ত থেকে হাজারে হাজারে মানুষ আসেন- জানা সত্ত্বেও কেন প্রশাসন ঠুঁটো হয়ে বসে ছিল? কেন স্থানীয় মানুষরা ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করতে গেলে পুলিশ লাঠি চালিয়ে বাধা দিয়েছিল? কেন দুর্ঘটনার বারো ঘন্টা পরে ডুবুরীরা জলে নামল?”
একই প্রশ্নের উত্তর চাইতে গিয়েই পুলিশের হাতে বেধড়ক মার খান শান্তিপুর বিধানসভার এবারের জোটপ্রার্থী অরিন্দম ভট্টাচার্য্য। প্রথমদিকে থানায় নিখোঁজ-ডায়েরী নিতেও অস্বীকার করে বলে অভিযোগ করেছেন মৃত দিলীপ নন্দীর পরিবারের লোকেরা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জনতার ক্ষোভ বাড়তে থাকে। পুলিশ, মন্ত্রীদের সাথে শুরু হয় বচসা। এরপরই স্বজনহারানো উত্তেজিত জনতা পড়ে থাকা লঞ্চ ও নৌকায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পার্শ্ববর্তী থানাগুলি থেকেও পুলিশ নিয়ে আসা হয়। চলে রবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভেসে আসে দু’একটি মৃতদেহ উদ্ধারের খবর। মৃতদেহ গুলি মর্গে পাঠানো হয়। সেখানেও ডাক্তারের দেখা না পাওয়ায় শুরু হয় গন্ডগোল। সোমবার শান্তিপুরের শোকস্তব্ধ রাজপথে শববাহী গাড়িতে যেন মৃত্যুমিছিল।
এরপরে যে সব মৃতদেহগুলি পাওয়া যায় সেগুলির পেট কাটা থাকায় অভিযোগ ওঠে যে ডুবুরি নামিয়ে মৃতদেহের পেট কেটে দেওয়া হয়, যাতে লাশগুলি ভেসে না উঠতে পারে। দুই সন্তান ও স্বামী কে হারিয়ে বেঁচে ফেরা রামপ্রসাদ বিশ্বাসের স্ত্রী বললেন, ‘ঘাটমালিক আর প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে দায়ী এই দুর্ঘটনার জন্য। আমি চাই ঘাটমালিকের ফাঁসি হোক।’
পাদটীকাঃ
শান্তিপুর আগমেশ্বরী তলার বাসিন্দা শ্রী দিলীপ নন্দীর মৃতদেহ পাওয়া যায় রবিবার। উপরে প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারটি আমাদের হাতে তুলে দেন তাঁর বন্ধু, পরিতোষ কর, যিনি সে’রাতে নৌকায় উঠতে না পেরে জেটিতে দাঁড়িয়ে তলিয়ে যেতে দেখেছেন বন্ধুকে এবং সোমনাথ কর, যিনি পাড়ার কাকা কল্যানবাবুকে নিতে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন নৃসিংহপুর ঘাটে। ডুবুরিরা একবার নৌকাটিকে নড়াতে পেরেছিল আর তখনই ভেসে ওঠে দিলীপবাবুর লাশ।
শান্তিপুর মেলের মাঠের বাসিন্দা সুপর্ণা সরকার ও সঞ্জিত সরকার – স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই মারা যান নৌকাডুবিতে। নিঃসন্তান দম্পতির পরিবারে এখন চাপা অসন্তোষ। সঞ্জিতবাবুর বাড়ির লোক দাবী করছেন, তাদের ছেলে ও ছেলের বউ-উভয়েরই সৎকার তারাই করেছে তাই উভয়ের ক্ষতিপূরণের টাকা তাদেরই প্রাপ্য। কিন্তু তারা শুধু সঞ্জিতবাবুর জন্যই মাত্র দু’লাখ টাকা পেয়েছে। আর সুপর্ণা দেবীর বাবা শিবু্রাম ঘোষ বললেন,’টাকা যে পাবে পাক। ওদের দরকার থাকলে ওরাই নিক। আমার মেয়ে নেই। টাকা কী হবে?”
ওদিকে গঙ্গাতীরবর্তী নৃসিংহপুর গ্রামে বেশকিছু ঘরের ছেলেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নৌকা পোড়ানোর অপরাধে তাদের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে। দুর্ঘটনার পরদিন সকালে উত্তেজিত জনতার মধ্যে থেকে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও বাকিদের পাঠানো হয়েছে কালনা কোর্টে।
ডুবুরীরা জানিয়েছে ষাট ফুট গভীরে জলের ভীষণ চাপ ও ঘন অন্ধকারের কারণে এখনই নৌকা তোলা সম্ভব নয়।
Leave a Reply