দীপ্যমান চক্রবর্তী
মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন কিশোরের তার নিজস্ব পরিসরের মধ্যেকার গণ-প্রতিরোধ সম্বন্ধে সাধারণত কোনো ধারণাই থাকে না। যদিও পৃথিবী যেভাবে চলছে তা নিয়ে তার আশেপাশের মানুষদের বন্ধুবান্ধবদের সমস্যা ও ক্ষোভ সম্বন্ধে সে উদাসীন নয়। ধরা যাক, যখন কোনো এলাকার মানুষ জল কিংবা স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো খুব মৌলিক কোনো অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সে তার গণতান্ত্রিক বোধ দিয়ে বুঝতে পারে যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ করা দরকার। কিন্তু কীভাবে সেটা করা যেতে পারে তা সে জানে না। আমাদের গণতন্ত্র সম্বন্ধে অনেক বড়ো বড়ো কথা বলার রয়েছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের ভূমিকা আমরা জানি না। জানি না কীভাবে প্রতিবাদ করে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে হয়। বহু বছরের অনভ্যাসের ফলে আমরা ভুলে গেছি কীভাবে লড়তে হয় এবং এই প্রজন্মের এ বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই।
বাংলায় সত্তরের দশকের আন্দোলনের রক্তাক্ত চেহারার গল্প আমাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। যেন একবাক্যে মেনে নিতে বাধ্য করে — রাজনৈতিক কার্যকলাপ করতে গেলেই আমরা যুবকেরা বিফল হব। আন্দোলনের আসল কারণ যে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থা, যার জন্য ছাত্ররা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল, সেসব কারণের কথা আমরা ভাবি না, তাদের প্রতিবাদের ভাষা আমরা পড়ি না, যে শিক্ষা লাভ করতে পারতাম করি না। আমার মনে হয় জনমানসে সত্তরের দশকের আন্দোলন যে রক্তক্ষয়ের স্মৃতি রেখে গেছে, তা আমাদের ভবিষ্যতে লড়বার পথ বেছে নিতে নিষেধ করে।
সময় গড়িয়েছে, ছোটো-বড়ো প্রতিবাদ আন্দোলন হতেই থেকেছে আর রাষ্ট্রও নতুন নতুন রাস্তা খুঁজে বের করেছে তাদের চুপ করানোর জন্য, চাপা দেওয়ার জন্য। এই কিছুদিন আগেও, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাকে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে কিংবা বহিরাগত হিসেবে দেগে দিয়ে মানুষের মনে একটা ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করা হচ্ছিল। কারখানায় হরতাল হোক কিংবা মিছিল অথবা দেওয়াল লিখন, সব ক্ষেত্রেই এই একই কথা বলা হচ্ছিল। কেউ বলতেই পারেন এই কথাটা মোটেই সম্পুর্ণ ঠিক নয়। কই সিপিএমের প্রার্থীরা যখন ভোটের আগে দেওয়াল লিখছিল, কেউ কোনো অপবাদ দেয়নি তো। এই তো সেদিন তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা মিছিল করল ‘মিনিস্ট্রি অফ হিউমান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট’-এর নেওয়া নীতির বিরুদ্ধে। সিপিএমের শ্রমিক ফ্রন্ট মে দিবসে ধরনার আয়োজন করল, তার বেলা? লোক দেখিয়ে প্রতিবাদের বিশেষ একটা ধারণাকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে, কিন্তু এইসব পরিসরগুলো সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তারা কেউ এই রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য নয় এবং ঠিক সেই কারণেই রাষ্ট্র বিরোধী আন্দোলনের দম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
দিনের শেষে তাহলে কী দাঁড়াল? এই সব ক-টা দলই আসলে সেই একই রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ, যার মাধ্যমে একজন নাগরিককে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তার ফলে অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের কোনো প্রশিক্ষণ নেই রাষ্ট্রকে একহাত নেওয়ার। এই সাধারণ মানুষদের তো কোনো দৃঢ় দলীয় আনুগত্য নেই এবং এদের ভোটই নির্ধারণ করে কে ক্ষমতায় আসবে, তাহলে এদের গলা এত মৃদু শোনায় কেন। আমার মনে হয় স্কুল-কলেজ থেকেই আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয় যে গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার একমাত্র উপায় এই রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যম। আর এই দলগুলোই আবার জন-আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে মাওবাদী কিংবা অন্য কোনো বদনাম দিয়ে। যতদূর মনে পড়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথম গণ-প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী পক্ষের নেতা। আর ধর্ষণ ও লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই যে প্রতিবাদ হল তার নেতৃত্ব দিয়েছে পুরোনো বামপন্থী সরকারের দিকে ঘেঁষা কিছু সংগঠন। এই দুই ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ভিড় হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই প্রতিবাদের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, কারণ তার ডাক দিয়েছিল চেনা রাজনৈতিক সংগঠন।
আদতে গণতন্ত্র সম্বন্ধে আমাদের ধারণা শুধু রাজনৈতিক দল এবং তাদের নির্বাচন করা প্রভৃতি কিছু চালু ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। আমরা সংবিধানের মূল কথা এবং মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে গেছি। কিন্তু গণতান্ত্রিক বোধ এত সীমিত নয়, ‘উই দ্য পিপল’-এর ধারণা জনমানসে বিকৃত আকার ধারণ করেছে ‘আমরা …’। রাজনৈতিক দলগুলোই একমাত্র মঞ্চ যা যুবকদের ক্ষোভ প্রকাশের একটা পরিসর দেয়। পার্টি অফিসগুলোর আনাচে কানাচে এই দলগুলোই তাদের বলে দিতে থাকে ‘শিখিয়ে’ দিতে থাকে প্রতিবাদের ভাষার নিয়মকানুনগুলি। সে কথা মাথায় রাখলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন এবং ২০ তারিখের মিছিল আমার মতে গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমার জ্ঞানত এখানকার কোনো প্রতিবাদের কথা মনে পড়ছে না যেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের পতাকা ব্যবহৃত হয়নি।
ছাত্ররা জানত যে ২০১০ আর ২০১৪-এর মধ্যে আদতে কোনো ফারাক নেই। আসলে ভেতরে ভেতরে নির্দল অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও যুবকেরা এই আন্দোলন করেছে, ছাত্রসমাজের হাত ধরে, যে ছাত্রসমাজের এই ধরনের আন্দোলন সম্বন্ধে বিশেষ অভিজ্ঞতাই নেই। কেউ আমাদের বলে দেয়নি কী করতে হবে। কেউ ওপর থেকে শিখিয়ে দেয়নি কিছু। আমরা যা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে পথে এগিয়েছি তা সম্পূর্ণতই আমাদের ভেতর থেকে আমাদের ইতিহাসবোধ ও জীবনযাত্রার ভেতর থেকে উঠে এসেছে। সাধারণ সভাতে সবাই মিলে আলোচনা করে প্রতিটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, প্রচুর ভেবেচিন্তে পা বাড়ানো হয়েছে। আমরা যা করলাম তার জোর বা সাফল্য সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণাই আমাদের নেই। পরবর্তীকালে তা কোনো ছাপ রেখে যাবে কিনা জানি না, সেসব তো ইতিহাসই নির্ধারণ করে দেয়। কীভাবে আমাদের মনে রাখা হবে জানি না, পরবর্তী প্রজন্মেরা কি আমাদের পথ ধরে এগোতে চাইবে আরও উৎসাহিত হয়ে নাকি ইতিহাস বইয়ের পাতার এক কোণে ‘এরকম করতে নেই’ হয়েই থেকে যাব আমরা?
Leave a Reply