কলরব হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম আমরা। কলরব বললেই যেন মনে হয় একসঙ্গে অনেক পাখির ডাক যা নতুন সকালের খবর এনে দিচ্ছে, ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে। কিংবা ইশকুল ছুটির সুখবর এনে দিচ্ছে শিশুর দল।
পশ্চিমবাংলায় ছাত্রদের তথাকথিত নিষ্ক্রিয়তা, এই প্রজন্মের চুপ করে থাকার প্রবণতা এবং তার সমালোচনাটাই শোনা যায় বেশি। এমন সময় কোথা থেকে কী হয়ে গেল, ২০ সেপ্টেম্বর এক আশ্চর্য মিছিল বেরোল কলকাতা শহরে, যেমনটা অনেকদিন কেউ দেখেনি। কানে হেডফোন গোঁজা আপাত উদাসীন ছেলেমেয়েরা দিনভর তুমুল বৃষ্টির মধ্যে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিল নানাকিছু, যার অনেকগুলোই একবার শুনে বোঝা মুশকিল। অবাক হল বড়োরা, অবাক হল ছেলেমেয়েরা নিজেরাও, এত উষ্ণতা যে তাদের মধ্যে ছিল সে যেন তারা নিজেরাই আগে টের পায়নি।
কলরব তো হল, কিন্তু তারপর? পাল্টালো কি কিছু? ঘুম কি ভাঙল? হ্যাঁ বা না-য়ে বলা মুশকিল, বলার দরকারও নেই। কলরব যে হয়েছিল এইটুকুই নয় থাক। এই এতগুলো বিভিন্ন স্বর যে একসাথে বলে উঠল অনেকগুলো কথা, তাদের মিল-অমিল প্রচুর। সম্পূর্ণ কলরবের নির্ভুল ছবি তুলে ধরার চেষ্টাও করা হল না। বরং অনেকগুলো কোমল স্বর, যা কোমল হওয়া সত্বেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই কিছু কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলার কথা সবাই জানে এবং সে ঘটনা কেউ খুব সহজে ভুলতেও পারবে না। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের মিছিলের কথা, সাধারণ সভার কথাও ভোলা যাবে না। তবে তার আগের যে ঘটনাবলী, সেসব কথা ভুলে যাওয়া কঠিন নয়। ভিসির পদত্যাগ চাওয়া হল, কিন্তু কেন? গবেষণাপত্রে টুকলির জন্য? ছাত্রদের পুলিশ দিয়ে পেটানোর জন্য? কেন মারা হল ছাত্রদের? তাদের দাবি কী ছিল? শুরু হল কীসে? গুলিয়ে ঘোলাটে হয়ে আসছে যেন গোড়ার কথা। আর তার সঙ্গেই মনে করানোর চেষ্টা হল, প্রায় সমসাময়িক বিশ্বভারতীর কলাভবন আর আকড়ার মহেশতলার যৌন নিগ্রহের ভয়াবহ ঘটনা, যা ধামাচাপা পড়ে গেছে। শোরগোল তোলা মিছিল হয়নি, প্রতিবাদ শুরু এবং শেষ হয়ে গিয়েছিল সবার অলক্ষ্যে।
একটা বিশাল ঘরের আনাচেকানাচে খানিক নজর দেওয়া গেল। কলরবের সূত্র ধরে অনেক কথা উঠে এসেছে। একেকজন বলেছেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় তাঁর নিজস্ব দেখার অভিজ্ঞতা। অনেক পুরোনো কথাও ফিরে এসেছে, এমন অনেক কথা যা অন্যান্য কথার ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল। আমরা যেন এসব কথা ছোটো বলে ভুলে না যাই।
—
এই সংখ্যার অতিথি সম্পাদক
চূর্ণী ভৌমিক
মন্থনের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যা হঠাৎ নভেম্বরের শেষে ছাত্রছাত্রীদের কলরব নিয়ে সরব কেন? কেউ বলছেন, যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি তো এলিট-ভদ্রলোক গণ-উৎপাদনের ভালো ব্র্যান্ডের মেশিন ছাড়া কিছু নয়। আমাদের সেই গণ-উৎপাদনে কোনো উৎসাহ নেই। কেউ টুকে পিএইচডি পেয়ে থাকলে আমাদের তা নিয়ে এতটুকুও মাথাব্যথা নেই। এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সমাজ-সংস্কৃতির মন্থন কোথায় কীভাবে ঘটে চলেছে, তা জানতে বুঝতে আমরা আগ্রহী। তলা থেকে উঠে আসা একটা টাটকা আন্দোলন যেভাবে নতুন প্রজন্মকে আলোড়িত করে, নানান সংলাপে উদ্ধুদ্ধ করে, সেই ক্ষণটুকুর ডকুমেন্টেশনের জন্যই এবারের সংখ্যার সীমিত অভিযান।
Leave a Reply