২১ অক্টোবর ২০১৪ ‘শামিল’ ছোটোদের পাঠশালায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্যের সঙ্গে ঘরোয়া কথাবার্তায় বলা তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ প্রকাশ করা হল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক পোশাক বিতর্ক প্রসঙ্গে আমি একটা পাল্টা পোশাক সমীক্ষা করছি। মাইন্ডসেটের (মনোগড়ন) বিষয়টা কিন্তু খুব জটিল। আমি বাইরের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করছি, দোকান-বাজারে রাস্তাঘাটে সেখানে আপনারা তো ঘোরাঘুরি করেন, পুরুষদের হাফপ্যান্ট পরা পোশাক আপনাদের কী অনুপাতে চোখে পড়ে আর মেয়েদের হাফপ্যান্ট পরা কিংবা আপত্তিজনক পোশাক আপনাদের কী অনুপাতে চোখে পড়ে? — না, ছেলেদের হাফপ্যান্ট পরে রাস্তায় বেরোনোটা তেমন তো চোখে পড়ে না। আমি দৈনন্দিন সমীক্ষা করছি, দেখাচ্ছিও লোকেদের। কী পরিমাণ অন্ধের বার্তা এটা। দোকান বাজার পোস্টাপিস সর্বত্র আজকাল, আমি বলছি না এটা ইনডিসেন্ট পোশাক, শর্টস। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সব, চোখের ওপর ভেসে চলে যাচ্ছে, অথচ কেউ নজর করছে না। হোক কলরব মিছিলে কয়েক হাজারের মিছিলে একজনের শর্টস থাকলে ক্যামেরাটা সেইদিকে যাচ্ছে। এবং তারপরে সমস্ত আলোচনাটা ওই শর্টসের ওপর কেন্দ্রীভুত। এই যে মাইন্ডসেট!
যাদবপুরে ছাত্রছাত্রীরা শর্টস পরে আসছে, এরকম পোশাক টোটাল ছাত্রীদের মধ্যে কত শতাংশ? দু-নম্বর প্রশ্ন, ক্যাম্পাসে কত শতাংশ, সেটা একটা ব্যাপার। আর ক্লাসরুমে কত শতাংশ। আমার নিজের সমীক্ষা, ক্যাম্পাসে শতাংশটা দুই ছাড়াবে না। আর ছাত্রীরা শর্টস পরে ক্লাসরুমে আসছে, এটা সংখ্যার দিক থেকে অতাৎপর্যপূর্ণ। স্পেসিফিক আড়াইখানা ডিপার্টমেন্টের নাম আছে, যাদের ক্লাসে একজন-দুজন ওই পোশাকে আসে, সম্ভবত তাও কালেভদ্রে। এটা বাড়বার একটা ঝোঁক হয়তো আছে। কিন্তু কিছুতেই এই প্রশ্নটা পরিপ্রেক্ষিতে আনা যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টের বহু কেসে এরকম রিপোর্ট থাকে, অনেকসময় সাক্ষী দিতে এসেছে বা কেসের জন্য, বিশেষ করে মহিলা, যদি এরকম অগ্রহণযোগ্য পোশাকে আসেন, জজসাহেব প্রথমে তাঁকে বলেন, গো অ্যান্ড কাম প্রপারলি ইন ড্রেস, তারপরে শুনব। কাজেই এরকম কেস ঘটে না তা নয়। খেলার মাঠেও ঘটে।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, যাদবপুর সম্বন্ধে এইরকম একটা পাবলিক পারসেপশন (জন ধারণা) আছে, যে যাদবপুর মানেই গাঁজা চরস মদ, মেয়েদের যাচ্ছেতাইপনা। সিগারেট প্রচুর খাচ্ছে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খাওয়াটা ভালো কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। কিন্তু খাচ্ছে। যাই হোক, যাদবপুর মানেই যে ইমেজটা, সেটাকে খুব করে কাউন্টার করবার প্রয়োজন আছে।
যেমন, কমিটির সদস্য শিক্ষকরা মেয়েটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি সেদিন কী পোশাক পরেছিলে? তুমি সেদিন মদ খেয়েছিলে কি না। এই প্রশ্ন করা যায় কি যায় না সে প্রশ্ন আগে আসছে। কিন্তু ভেবে দেখো, যিনি নিগৃহীতা, তাঁকে এই প্রশ্ন না করে যারা নিগ্রহকারী তাদেরও তো এটা জিজ্ঞেস করে নেওয়া যেত। অন্য কারোর কাছে জিজ্ঞেস করে সেটা কনফার্মও করে নেওয়া যেত। কিন্তু একটা নীরব মাইন্ডসেট কাজ করে, যদি তুমি ‘সোসালি আনঅ্যাক্সেপ্টেবল’ (সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য) পোশাক পরো, তাহলে এই এই ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। তোমার তার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। এই যে বার্তাটা সমাজের দিক থেকে দেওয়া হল, এইটাতেই তো প্রশ্ন তুলতে হবে, যে, না একেবারেই তা নয়। সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে, কেউ যদি ‘সোসালি আনঅ্যাক্সেপ্টেবল’ পোশাক পরে থাকে, তাকে বলা, তুমি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য পোশাক পরে এসো। এবং সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য পোশাকের কোনো আঁটোসাটো সংজ্ঞা হবে না। ওটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হবে। আজকে যে সালোয়ার কামিজের পোশাক, আমরা যখন পড়াতে আরম্ভ করি, তোমরা কি মনে করো যে তখন ছাত্রীদের সেই পোশাক স্বাভাবিক ছিল? ছিলই না। আমরা যখন পড়াতে আরম্ভ করেছি তখন কোনো কলেজের ছাত্রী শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো পোশাকে যাচ্ছে, ছিলই না।
মাস্টারমশাইদেরও পোশাকের পরিবর্তন হয়েছে। আমরা যখন ছাত্র বা যখন পড়াতে আরম্ভ করি, তখন মাস্টারমশাইদের একদম ধুতি পাঞ্জাবি, সঙ্গে ওইরকম ব্যাগ। আমি নিজে যখন যাদবপুরে পড়াতে এলাম, তারপর আমার বেশ কয়েকবছর শিক্ষকতা হয়ে গেছে। ততদিনে শিক্ষকদের মধ্যেও ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে প্যান্ট শার্ট পড়ার চল হয়েছে। আমিও প্রথমে ধুতি পাঞ্জাবি, পরে প্যান্ট শার্ট পরে পড়িয়েছি। সঙ্গে সাইডব্যাগ। একদিন আমাদের হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট, আমাকে ডেকে খুবই ভদ্রভাবে বললেন, তুমি এখন তো আর ছাত্র নও, ফলে ওই ব্যাগ … আসলে তখন শিক্ষকদের মধ্যে ছোটো ব্যাগ, যাকে আমরা এখন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ব্যাগ বলি, তা নিয়ে আসার চল ছিল। তখন আমাদের ওখানে আরেকজন খুব পণ্ডিত মানুষ ছিলেন, প্রভাতবাবু। তিনি এই ব্যাগও আনতেন, ওই ব্যাগও আনতেন, রেশনের ব্যাগও আনতেন। গোটা সংসারটাই নিয়ে ঘুরতেন। খুবই পণ্ডিত, কিন্তু আধপাগলা গোছের মানুষ ছিলেন। তা বিভাগীয় প্রধান বললেন, তবে তুমি বলতে পারো প্রভাতবাবুর কথা। তাঁকে মানা করা, … তাছাড়া তাঁকে আমি কিছু বলতেও পারি না … তো আমি তো শেষ দিন পর্যন্ত ওই সাইডব্যাগেই চালিয়ে গেছি।
তাছাড়া তোমরা কি জানো যে যাদবপুরে শঙ্খ ঘোষের পোশাক নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। তোমরা ভাবতে পারো? কেন প্রশ্ন উঠেছিল বলো তো? তোমাদের পরিপ্রেক্ষিতগুলো একটু জানা থাকা প্রয়োজন। শঙ্খ ঘোষ, বরাবরই তোমরা তাঁকে যে পোশাকে দেখো — সাদা ধুতি পাঞ্জাবি, কিন্তু পাঞ্জাবির হাতাটি একটু গোটানো। ওঁকে ওঁর মাস্টারমশাই, বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক, তিনি ডেকে বলেছিলেন সস্নেহে, শঙ্খ ঘোষকে সবাই খুব স্নেহ করে, শ্রদ্ধা করে ছোটোরা, বলেছিলেন, তুমি এভাবে এসো না। উনিও খুব মিষ্টি স্বরেই বলেছিলেন, তাহলে তো স্যার, এখানে আমার বোধহয় চাকরি করাই হবে না। উনিও ওই হাতা গুটিয়েই সারা জীবন চালিয়েছেন। এ ব্যাপারগুলো ছিল। পরিপ্রেক্ষিতটা বলছি কারণ বুঝতে সুবিধা হবে। ব্যাপারটা কেবল এই নয় যে তোমরা সিগারেট টিগারেট খাচ্ছো বলে তোমাদের পেছনে লাগা হচ্ছে। লাগার একটা প্রেক্ষাপট আছে সমাজে। তোমরা সিগারেট খাচ্ছো, তোমাদের সিগারেট বলবে। যারা সিগারেট খায় না, তাদের অন্য কিছু বলবে।
আমাদের সময় আর্টস ফ্যাকাল্টি প্রথম শুরু। তার আগে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি ছিল, সায়েন্স ফ্যাকাল্টিও ছিল। তবে তাতে ছাত্রীরা ছিল না বললেই চলে। এক আধজন। ক্যাম্পাসে ছাত্রী, তখন এরকম একটা আবহাওয়া ছিল, যে মরুভূমিতে সজল বৃষ্টিধারা। ছাত্রী প্রথম কিন্তু আর্টস বিল্ডিংয়ে। যেটা এখন পদ্মদীঘি হয়েছে, তার ওপার থেকে ছাত্ররা এপারে আসত দু-একজন ছাত্রী দেখার জন্য। আমাদের বিভাগে তখন একজন মহিলা শিক্ষিকা ছিলেন, যিনি তখন একটু ধূমপান করতেন। বস্তুত তিনি খুব ধূমপান করতে পারতেন না। কিন্তু দেখানোর জন্যই তিনি একটু স্মোক করতেন। একদম শুরুতে, মাস্টারমশাইরা সকলে ইঞ্জিনিয়ারিং মাস্টারমশাইদের সঙ্গে বসতেন, এখন তোমাদের ফিনান্স অফিসার এবং রেজিস্ট্রারের যে ঘর, ওই যে কর্নারটা, ওখানে একটা পার্টিশন দেওয়া ঘরে একপাশে ছিল ভিসি, একপাশে রেজিস্ট্রার। রেজিস্ট্রারেরই ঘরে একপাশে, আর্টস বিল্ডিংয়ের মাস্টারমশাইদের বসার জায়গা ছিল না বলে ওরা ওখানে বসতেন। তখন এই আর্টস বিল্ডিংও ছিল না। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ছড়িয়ে ক্লাস। আমাদের এই দিদিমণি, তিনি খুব স্মার্ট ছিলেন। ওঁর পিতা ছিলেন ফরেন সার্ভিসের লোক। ফলে তিনি অল্প বয়সেই সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। পরে পিতা মারা যান, হরিয়ানার রাজ্যপাল ছিলেন। ইনি, খানিকটা দেখনাইপনা, খানিকটা তাঁরও অল্পবয়স — পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়স। বাকি মাস্টারমশাইদের মধ্যে বেশিরভাগই বয়স্ক এবং রক্ষণশীল মানসিকতার। ফলে তারা যে রেগে রক্তবর্ণ হবে, কেউ পিঙ্ক বর্ণ হবে — সেটা তো অস্বাভাবিক না। ওই একজনই ছিলেন তখন। তিনিও সিগারেটের গল্প যত বলতেন, তত খেতেন না। আমাদেরকে তিনি খাইয়েছেন সে সময় — কিন্তু তিনি নিজে খুব কমই খেতেন, দু-তিনটান দিলেই তাঁর কাশি আসত। ওটা হচ্ছে ইন্ডেক্স অফ স্মার্টনেস। কে না জানে যে স্মোকিং একটা ইনডেক্স অব স্মার্টনেস। সে তো ছেলেদের মধ্যেও ছিল। অবশ্যই ছিল। এবার স্মোকিং ইজ ইঞ্জুরিয়াস টু হেলথ সেটা নিয়ে কেউ যদি বলে, সেটা এক জিনিস। …
কাজেই ওই যে প্যাকেজটা — স্মোকিং, শর্টস, যেভাবে তারা চলে বা কথা বলে, ডিকশন, এই সমস্তটা মিলিয়ে রক্ষণশীল সমাজের একটা মনে ধাক্কা লাগে। রক্ষণশীল সমাজ তার আগ্রাসন দিয়ে, ম্যাচো আগ্রাসন দিয়ে সেটা প্রত্যাখ্যান করে। এই জায়গাটাকে অ্যাড্রেস করা, সেটা কিছুতেই যাচ্ছে না। তথ্যের নিরিখে তুমি যতই বলো, যাদবপুরের ছেলেমেয়েরা কত সিগারেট খায় আর কত সিগারেট খায় না, সেটা প্রশ্ন নয়। আগের থেকে আজকাল বেশি খায়, সেটা সবাই জানে। বেশি খাওয়াটা ভালো না, খাচ্ছে, কী করা যাবে। বিষয়টা তা না। বিষয়টা হচ্ছে, তোমার আপত্তিজনক ব্যবহারকে একজন আগ্রাসী ব্যবহার দিয়ে মোকাবিলা করছে। যে গল্পেরই আরেকটা পরিচ্ছেদ হচ্ছে, স্কুলে যে শিক্ষিকারা সালোয়ার কামিজ পরে যাচ্ছে, তার মধ্যে যাকে আমরা গ্রামের রাজনীতি বলি সেগুলো জড়িয়ে থাকে, ছাত্রীদেরকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে বলানো হচ্ছে অনেকক্ষেত্রেই। …
যাই হোক, সন্তোষ ভট্টাচার্যের একটা খুব ভালো সংলাপ আছে, জানো তো? উনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, তখন তো হোক কলরব আসেনি, কোলাহল তখন করত সিপিএম ছাত্রছাত্রীরা। তার চার বছরের একটা বড়ো সময় ওঁকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয়নি। শেষের এক বছর উনি প্রায় বাড়ি বসেই দপ্তর চালাতেন। সন্তোষ ভট্টাচার্য তো তোমাদের চেয়েও অনেক স্মার্ট। উনি পুরো রাজনীতি-টাজনীতি করে তারপর ওইসব করতে গেছেন। উনি তো বিটিআর জমানার অ্যাকটিভিস্ট। বড়োসড়ো চেহারা, সুদর্শন। সিনেমায় নামিয়ে দিলে খুব ভালো হত। উনি যখন উপাচার্য, তখন একটা বিয়েবাড়ি উনি গেছেন। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে বলেছি যে তাহলে তো উনি এক্ষুণি ঘেরাও হবেন। চলো আমরা খেয়েদেয়ে নিচে নেমে বাড়ি চলে যাই। আড্ডা-টাড্ডা যা দিচ্ছি, সব খেয়েদেয়ে নিচে নেমে গিয়ে। তো একজন গিয়ে বলেই দিয়েছে, আপনি এখানে আছেন, তা আমরা তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে চলে যাব ভাবছি — কখন কে ঘেরাও করে ফেলবে। তখন কলেজ স্ট্রীট ক্যাম্পাসে রোজ স্লোগান, এক আধটা হাতবোমা ফাটানো। তা উনি অত্যন্ত মোলায়েম হেসে কী উত্তর দিলেন জানো? ‘কী আর হবে। ঘ্যাস্তাঘ্যাচাং হবে।’ তা আমার তোমাদের কাছে একটা প্রশ্ন এই — এই যে ব্যাপারটা, পুলিশের বা উপাচার্যের, এটা নিয়ে কিছু একটা ঘ্যাস্তাঘ্যাচাং হবে, মানে কিছু একটা মিটমাট হবে। জগৎসংসার তো আর থেমে থাকবে না। কিন্তু এই প্রশ্নটা খুব দীর্ঘমেয়াদী প্রশ্ন, কার্পেটের কয়েক ধাপ ধূলোর নিচে থাকে — সোসাইটির মাইন্ডসেট (সমাজের মনোগড়ন)।
এবার এই লিঙ্গ-প্রশ্ন যেটা, যে জায়গা থেকে প্রশ্নটা শুরু হওয়া উচিত, কখনোই প্রায় তা হয় না। বাপি সেন-এর ব্যাপারেও তা হয়নি। কোনো জায়গাতেই তা হয় না। এইটা কিন্তু তোমরা যারা হোক কলরব, যাদবপুর, অগ্রসেনানী — তোমরা তো অন্তত তুলবে, নিগৃহীতাকে প্রশ্ন করার আগে তো নিগ্রহকারীদের প্রশ্ন করা উচিত। যদি প্রশ্ন নিগৃহীতাকে করতেই হয়, সেটা কয়েকদিন পরেও তো করা যেতে পারে। যারা নিগ্রহ করছে তারা যদি এই কারণের জন্যই নিগ্রহ করে, তাহলে তারা আগে বয়ান দিয়ে তা জানাক। এই পোশাক ছিল। এই পোশাকের জন্য আমি তাকে নিগ্রহ করেছি। তখন তুমি একটা জায়গা পাবে এটা বলার, যে, এই পোশাক পরলেই তোমাকে যে তাকে আক্রমণ করতে হবে, এটা কোথা থেকে এল?
আমি বলছি না যে তাকে এক্ষুনি মারধোর করো, তাকে ধরে জেলে পুরে দাও। তারপর চারদিকে আরেকটা পাল্টা কলরব শুরু করো। এটা একেবারেই ভুল চিন্তা। এপ্রসঙ্গে বলি, আমি কিন্তু কারোরই প্রাণদণ্ড চাই না। এমন এমন কেস আছে। বড়োদের হয়তো মনে আছে — গড়িয়াহাটের কাছে বড়ো একটা বাড়ি, গরিব পরিবার, সেই বাড়ির একটি বউকে মার্ডার করা হয় এবং দু-দিনের বেশি সময় ধরে মৃতদেহটি বক্স খাটের মধ্যে রাখা ছিল। তারপরে তো পুলিশ টুলিশ আসে। আমি প্রাণদণ্ড চাই না বললে অনেকে তখন আমাকে ওই বণিক বাড়ির কেসটা তুলে বলত, এই কেসেও কি আপনি প্রাণদণ্ড চান না? ওটা তাজা কেস ছিল। আমি তখন এই উত্তরটা দিয়েছিলাম, আমাকে প্রশ্ন করলে আমার পক্ষে এই কেসটায় বলা প্রায় দুঃসাধ্য যে না চাই না, কিন্তু তবু আমি বলব যে না চাই না। কারণ ওখানে প্রাণদণ্ড দিয়ে তো কিছু হবে না। ওখানে প্রাণদণ্ড দিয়ে দ্বিতীয় এরকম নৃশংস হত্যা আরেকটা হবে না, এটা কেউ সুনিশ্চিত করতে পারবে না। আমরা তো দিল্লির ব্যাপারটাতেও প্রাণদণ্ড চেয়েছিলাম। এই তিন বছরে তিরিশটা অন্তত এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তাই ডেটারেন্স বলে যেটা বলা হয় — তা এক্কেবারেই কিছু না। এতে ডেটারেন্স হয় না। হয় না তার কারণ মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও বলা যায়, যারা এই অপরাধগুলো করে, তারা এমন একটা মানসিক অবস্থায় পৌঁছে যায়, সেটা একটা ডেসপারেশন তৈরি করে। প্রায় আমি কাউকে মেরে মরব, এমন। এই যে ব্যাপারটা — তার কাছে তখন প্রাণদণ্ডের ডেটারেন্স-এর প্রশ্নই নেই। সে কী তখন লাটসাহেবের মতো কেস ধরে বিচার করছে যে কোন কোন কেসে প্রাণদণ্ড হয় না। এক্কেবারে বাজে। কাজেই ওটা নয়। ওটা রাষ্ট্রের তরফে আগ্রাসন। ইত্যাদি।
এইভাবে বরং প্রশ্নটা তোলা যেতে পারে, একজনকে দেখতে পাচ্ছ — সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন একটি পোশাক পরে আছে। তাহলে সমাজ তখন কী করবে? তখন তুমি কী করবে?
যাদবপুরে চিরকালই ছেলেমেয়েদের মেলামেশা যথেষ্ট খোলামেলা। এবং আমাদের শিক্ষকতার সময়ে ‘গোলমেলে’ কাজের কথা বেশি আমরা শুনিনি। আমার শিক্ষকতার সময়ে একটা কেস আমার মনে পড়ে। আমাদেরই ছাত্রছাত্রী। সেটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, সেটাকে তারা ক্যাম্পাস ইস্যুই হতে দেয়নি। এমনকী আর্টস ফ্যাকাল্টির ইস্যুও হতে পারেনি। একেবারে ক্লাসে মেটানো হয়েছিল। আমাদের এসে বলেছিল, স্যার, এই ক্লাসটা এখন আপনি নেবেন না, আমরা একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। এখন যাকে তোমরা আর্টসের লবি বলো, সেখানে একটি ছেলে একটি খারাপ কাজ করেছিল, তাও এখন যেসব খারাপ কাজ হচ্ছে, তার তুলনায় অনেক নিরামিশ খারাপ কাজ। তো সেটা তারা ওইভাবে সেট্ল করেছিল। তো এটাও তো একটা নর্ম হতে পারে ইস্যুগুলো সেট্ল করবার। কিন্তু তোমাদের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল বা ইন্টার্নাল কমপ্লেন্টস্ কমিটি একেবারে অকেজো। ইন্টার্নাল কমপ্লেন্টস্ কমিটি, প্রথমত সেটা সুপ্রিম কোর্টের বিশাখা গাইডলাইন অনুযায়ী হয়নি। তার মধ্যেও আবার দু-জন শিক্ষিকা, যাদের মধ্যে একজন আবার আমাদের খুবই কাছের, তারা মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে প্রশ্ন করেছে, সে সেদিন কী পোশাকে ছিল এবং সে মত্ত ছিল কিনা। এবার ছাত্ররা দাবি করেছে, ওই শিক্ষিকাকে কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে।
আচ্ছা যেদিন রাত্রের পুলিশের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে, তার অন্তত সাতদিন আগে আমি নিজে দেখেছি, ক্যাম্পাসে পুলিশ ছিল। অরবিন্দ ভবনেই ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল, ভেতর থেকে বলা হচ্ছিল — এতজন মিলে ভেতরে থাকাটা ঠিক না, একটু বাইরের দিকে থাকুন, দরকার হলে ডাকব। যারা আন্দোলন করছিল তারা হয়তো জানতোই না যে পুলিশ ভেতরেই আছে। আমি নয়, দশ, এগারো তারিখের কথা বলছি। আন্দোলন যেদিকে হচ্ছিল, তার থেকে অন্য দিকে পুলিশ বসেছিল। তাই ১৬-১৭ তারিখে অভিজিত পুলিশ ডেকেছেন কথাটা, এই ক্রিয়াপদটা ঠিক না। পুলিশ ছিল। উনি বলেছেন, আমাকে তোমরা ত্রাণ করো। তোমরা সুকুমার রায়ের কবিতার কথা ভাবো — লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল।
যাই হোক, অনেকদিন পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ের সম্পর্ক, সেই অর্থে জেন্ডার রিলেশন ইন দ্য ক্যাম্পাস, আমাদের বিচারে এমন হতেই পারে যে সবটা আমরা জানতাম না। কিন্তু তোলপাড় হওয়ার মতো ক্যাম্পাসে ঘটনা প্রায় নেই। যা আমার মনে পড়ে, একটা তো আপনারা সবাই জানেন, অধ্যাপক আর ছাত্রী — এসকেসি কেস, বাংলা বিভাগের। খুব বড়ো ঘটনা। বাংলা বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যৌন হেনস্থার। তিনি ক্যাম্পাস রেসিডেন্ট ছিলেন। তিরানব্বই চুরানব্বই-এর ঘটনা। ঘটনাটা গড়িয়েছিল কোর্ট পর্যন্ত। ছাত্র শিক্ষক তদন্ত কমিটি সিপিএম বিরোধী সব মিলে জল যত ঘোলা হওয়া সম্ভব, সমস্তটাই হয়েছিল। পরে যে মূষিকটা প্রসব হয়েছিল, কোর্ট থেকে সুনীলবাবু এ টু জেড সম্পূর্ণ খালাস। ছাত্ররা ফাইটিং ফান্ড তুলেছিল। কিন্তু তারা মামলার তারিখে কোর্টে উপস্থিতই করতে পারেনি। তো আমি তখন তোমাদের যারা কাউন্টারপার্ট, তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমরা যে চাঁদা সংগ্রহ করলে, তাহলে ওই চাঁদাটার এখন কী হবে? তা তো খরচ করতে পারোনি। তাহলে যাদের কাছ থেকে নিয়েছিলে, তাদের ফিরিয়ে তো দেওয়া উচিত। কোর্ট অভিযোগকারিণী ছাত্রী দু-জনকে সামান্য জরিমানা করেছিল, যা সুনীলবাবুকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হবে। সুনীলবাবু কোর্টকে জানিয়েছিলেন, আমি কল্যাণীয়া ছাত্রী দু-জনকে মাপ করে দিচ্ছি, তাদের কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। সুনীলবাবু তখন রিটায়ারমেন্ট হয়ে এক্সটেনশনে। আরেকটা ছাত্রছাত্রীদেরই ঘটনা। তুলনামূলক সাহিত্য। অনেকদূর গড়িয়েছিল। এবং সেটা কোর্ট পর্যন্ত যায়। ক্যাম্পাস অ্যাজিটেটেড হয়েছিল। কিন্তু আগে যেটা বললাম। এটা ততটা না।
যাই হোক, ছাত্রছাত্রীরা এবারের আন্দোলনে যা করছে, তা করুক, কিন্তু যা করেনি, তা নিয়ে আমার বকুনি আছে। তুমি বলছ যে যাদবপুর ক্যাম্পাসে জেন্ডার রিলেশন খারাপ হচ্ছে। তাহলে ছাত্রছাত্রী সহ সকলের মিলিত দায়িত্ব রয়েছে — তাকে কীভাবে অ্যাড্রেস করবে। এইটা আমার বক্তব্য। তোমরা কলরবে যা করছ করো। কিন্তু জেন্ডার রিলেশন খারাপ হওয়ার বিষয়টাকেও অ্যাড্রেস করো।
দ্বিতীয় বকুনি, তোমরা অভিজিতকে অভিযুক্ত করছো। প্রশ্নটা অভিজিতের দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছ। তার পেছনে যাচ্ছ না। আমি মনে করি, এখানে খুব বড়ো রকমের গাফিলতি বা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কারণ, অভিজিত এর আগে দুটো টার্ম অস্থায়ী উপাচার্য ছিল। অর্ডিনারি চাকরিতে আমাদের মোটামুটি একবছর প্রবেশন থাকে। একবছর দেখে নেওয়া হয়, তোমাকে এই জায়গায় চলবে কি না। একবছর বাদে দেখে নেওয়া হয় যে তোমার যা যা গোলমাল, তাতে ওকে দিয়ে একেবারেই হবে না। ওকে একটা ভদ্রভাষায় চিঠি দিয়ে জানানো হয়। যাই হোক, এই প্রবেশনারি পিরিয়ডের রেকর্ড যতটা জানা আছে, একটাও পজিটিভ পয়েন্ট নেই। আমি অন্তত শুনিনি। একটা পজিটিভ আমি ওঁর সম্পর্কে সত্যিই পেয়েছি। সেটার সঙ্গে এই প্রবেশনারি পিরিয়ডের কোনো যোগ নেই। সেটা হচ্ছে, ওঁর কম্পিউটার দক্ষতা খুব খেয়াল করার মতো। শিক্ষকতা সম্পর্কে আমার কাছে যা রিপোর্ট আছে, সেটা বেশ খারাপ। ওর ছাত্র হ্যান্ডলিং … সত্যি কথা বলতে কি, কোনো কিছু হ্যান্ডলিং ওঁকে দিয়ে হবে না। ওঁর জন্যে চাকরি একটা ভেবে দেখা যেতে পারে, সেখান থেকে তো ওঁকে সরিয়ে আনা হল, উচ্চশিক্ষা সংসদ — যেখানে উনি ছিলেন, সুগত মারজিত সরে আসার পরে। ওটায় কিচ্ছু করতেও হয় না। মাঝে মাঝে উপাচার্যদের মিটিং টিটিং ডাকতে হয়। ওখানে একটা মোটা মাসমাইনে আছে। আর একটা গাড়ি আছে। ওখানে কারোর সঙ্গে ডিল করতে হয় না, হ্যান্ডেল করতে হয় না। ওটা ওঁর পক্ষে এক্কেবারে উপযুক্ত জায়গা। … তোমাদের আন্দোলনের প্রসঙ্গে আমার এই কথাটায় তোমরা রেগে যেতে পার। আমি কিন্তু ওঁর সম্পর্কে এখন খুবই সহানুভূতিসম্পন্ন। তোমরা ওঁকে তো প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউনের দিকে নিয়ে গেছ। ওঁকে এখনও ছ-সাত বছর চাকরি টাকরি করতে হবে। ওঁর আত্মবিশ্বাসকে তোমরা যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছ, এরপর তো উনি কিছুই করতে পারবেন না। উনি তো ঘর থেকে মুখ নিচু করে ছাড়া বেরোতে পারবেন না। … তোমরা অভিজিত সম্বন্ধে যা করছ করো। চমৎকার স্লোগান একটা করেছ, ভিসি তুমি দুষ্টু লোক তোমার মাথায় উকুন হোক। অভিজিতকে যা বলছো বলো। কিন্তু অভিজিতের পেছনে, অর্থাৎ কি না …। দেখো, সেটাই কিন্তু মেঘের আড়ালে বসে কাজ করে। এবং অনেক রকম দেবতাদের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র তাদের হাতে আছে। তার একজনের নাম সরকার। একজনের নাম পার্টি। একজনের নাম উচ্চশিক্ষা দফতর। একজনের নাম রাজ্যপাল। তারই তিনজনের নাম সার্চ কমিটির মেম্বার। যে সার্চ কমিটির একজনের নাম হচ্ছে সুগত মারজিত। তিনি কোন ক্যাপাসিটিতে সার্চ কমিটির সদস্য? জানো তোমরা? তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের নমিনি। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের যে মিটিংয়ে ওঁকে নমিনেট করা হয়েছিল, সেই মিটিংটা প্রিসাইড করেছিলেন তৎকালীন অস্থায়ী উপাচার্য অভিজিত চক্রবর্তী। উনি সুগত মারজিতকে সার্চ কমিটিতে নমিনেট করলেন। সুগত অন্য ঘরে গিয়ে অভিজিতকে স্থায়ী উপাচার্যের লিস্টে এক নম্বর করল। এবং রাজ্যপাল সেই স্থায়ী উপাচার্যের সুপারিশকে শিলমোহর দিলেন, যখন আন্দোলনটা এক্কেবারে চূড়োয়। তুমুল ব্যাপার হয়ে গেছে। হোক কলরবের মিছিল হয়ে গেছে। ছাত্ররা রাজ্যপালের বাড়িতে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছে। … একথাটা আমি খুব সিরিয়াসলি তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এবং সুপ্রিম কোর্টের একটা রায়ের কথা বলতে চাই। রায়টার রেফারেন্স দিতে পারছি না, কোনো আইনের লোক হলেই বলে দিতে পারবে, কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মন্ত্রী বা আমলা, তাদের কয়েকটা জটিল গোলমেলে কেস — বেশ কয়েকবছর আগের। এখন যেমন কোল ব্লক ইত্যাদি হচ্ছে। এইরকম কেস নিয়ে ফাইলে নোটিশ ইত্যাদি। তা সুপ্রিম কোর্ট এই কথা বলেছিল, ইট অ্যাপিয়ার্স হি ডিড নট অ্যাপ্লাই হিজ মাইন্ড। অর্থাৎ তুমি শুধু নিয়ম দেখলে, কাজ করলে, এটা করাই যথেষ্ট নয়। মন্ত্রীর সই থাকল, এটাও যথেষ্ট নয়। সুপ্রিম কোর্ট মনে করে, সই করার আগে, তোমাকে তোমার মাথা ঘামাতে হবে। বিবেচনা প্রয়োগ করতে হবে। এবার এই প্রশ্নটা আমি মনে করি তোমাদের সরাসরি তোলা উচিত। যে যাঁরা এই উপাচার্যকে দু-বার অস্থায়ী পদে নিয়োগ করেছেন, তাঁরা কি তাঁদের বিবেচনা প্রয়োগ করেছিলেন? সুগত মারজিতের তো বিবৃতি আছে, আমরা কেন ওকে লিস্টে এক নম্বরে রাখলাম? না দেখলাম, একমাত্র ওরই এই কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। তাই। আচ্ছা ওঁর অভিজ্ঞতা বলতে দু-বার অস্থায়ী। এটা দেখার জন্য সুগতবাবুর মতো বিবেচক বুদ্ধিমান লোকের দরকার নেই। ওটা তো লেখাই আছে, উনি দু-বার অস্থায়ী হিসেবে ছিলেন। কাজেই তোমরা এই প্রশ্নটা যে কেন তুলবে না তোমাদের হোক কলরবের পার্ট হিসেবে, সেটা আমি বুঝলাম না।
মূলত আমার তোমাদের এই দুটো পয়েন্টে বকুনি দেওয়ার ছিল। সেগুলো বললাম। …
Leave a Reply