২৮ আগস্ট : কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের হস্টেল সংলগ্ন ওপেন এয়ার থিয়েটারে কলাবিভাগের সংস্কৃতি (ফেস্ট) চলছিল। ফেস্ট চলে বেশ রাত অবধি এবং অনেক ছাত্রছাত্রী এমনকী তাদের বাইরের কলেজের বন্ধুরাও সেখানে উপস্থিত থাকে। সন্ধ্যেবেলা একটা বিশেষ সময়ের পরে সমস্ত বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়, স্বাভাবিক ভাবেই কোনো বাথরুম খোলা থাকে না, বিশেষত মেয়েদের বাথরুম। এইরকম সময় প্রয়োজন পড়লে ‘ওপেন এয়ার থিয়েটার’ নামক মঞ্চের পেছনে গাছপালার আড়ালে গিয়েই কাজ সারতে হয়। এই দিনটাতেও ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী তার বন্ধুকে (ছেলে) নিয়ে বিশেষ প্রয়োজনে বের হয়। ফিরবার পথে কয়েকটি ছেলে তাদের উদ্দেশ্যে আপত্তিজনক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। প্রতিবাদ করায় এই ছেলের দল আরও খেপে ওঠে এবং বাকবিতণ্ডার পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কিও শুরু হয়ে যায়। মেয়েটি তার বন্ধুদের ফোন করতে গেলে তার ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং বন্ধু ছেলেটিকে এরপর মারধর করা হয়। হেনস্থাকারী ছেলেগুলি এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই হস্টেল-নিবাসী ছাত্র এবং বেশিরভাগই ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। মেয়েটি তার বন্ধুর সাথে ওইসময় আপত্তিজনক অবস্থায় ছিল বলে অভিযোগ করে হস্টেলের ওই ছেলেরা। এতেও শেষ হয় না, মেয়েটিকে হস্টেলে নিয়ে গিয়ে প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ ও হেনস্থা করা হয়, যা যৌনহেনস্থা অবধি গড়ায় বলে মেয়েটির অভিযোগ। হস্টেলের সুপার এই ঘটনার সময় হাজির ছিলেন এবং তিনি এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
২৯ আগস্ট : মেয়েটি তার বাবাকে সঙ্গে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। উপাচার্য বলেন যে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন এবং তার জন্য সময় চান। তিনি পরবর্তী পনেরো দিন মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে নিষেধ করেন মৌখিকভাবে। আন্টি র্যাগিং কমিটি বা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল এমনকী আভ্যন্তরীণ অভিযোগ দায়ের করার কেন্দ্র আইসিসি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে এবং সেখানে যে মেয়েটি সরাসরি যেতে পারে, সে কথা তিনি জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি অভিযোগকারিণীকে।
১ সেপ্টেম্বর : মেয়েটি যাদবপুর থানায় এফআইআর করে।
৩ সেপ্টেম্বর : বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েটির বন্ধুবান্ধব সহ কলাবিভাগের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের দাবিতে ছাত্রদের ডিনকে ডেপুটেশন দেবে ঠিক করে। এই কমিটিতে মনোবিশেষজ্ঞ, অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীদের রাখার কথা জানায় তারা। তারা আরও বলে যে সাতদিনের মধ্যে তদন্ত শুরু করতে হবে এবং কীভাবে বিষয়টি এগোচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের বিশদে জানাতে হবে। শুরু হয় আন্দোলন।
৫ সেপ্টেম্বর : যাদবপুর থানায় মিছিল করে যায় ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ অভিযোগ জানানোর সংস্থা আইসিসি (ইউজিসি কর্তৃক নির্ধারিত) এই ধরনের বিষয় নিয়ে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল। এই সংস্থার তরফ থেকে দুজন ভারপ্রাপ্ত মহিলা, বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষিকা জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্দেশ্যে মেয়েটির বাড়িতে যান। যাওয়ার আগে মেয়েটিকে জানানো হয়নি। সেখানে তাঁরা মেয়েটিকে উক্ত ঘটনার দিন তার পোশাক-পরিচ্ছদ কী ছিল, সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিল কিনা প্রভৃতি প্রশ্ন করেন। এতে মেয়েটি মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত বোধ করতে থাকে। মেয়েটি বিধাননগর পুলিশ স্টেশনে একটি জেনারেল ডায়েরি করে এই বিষয়ে।
৮ সেপ্টেম্বর : আইসিসি এবং উপাচার্যের কাছে যায় ছাত্রেরা, ডেপুটেশন দেয় (ডেপুটেশন নেন সহ উপাচার্য) ও অবস্থান করে। আইসিসি-র এক সদস্য অভিযোগ করেন, আন্দোলনকারীরা তাঁকে হেনস্থা করেছে। ছাত্রছাত্রীরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
১০ সেপ্টেম্বর : নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও ইউনিয়নকে আলোচনায় ডাকেন উপাচার্য। সেখানে তিনি তদন্তের বা অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কিছু নজরদারি বন্দোবস্তের প্রস্তাব দেন। এই নজরদারির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, রাত আটটার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আই কার্ড ছাড়া কাউকে না ঘুরতে দেওয়া (যেটা ক্রমশ দিনের বেলাতেও প্রযোজ্য হবে), ক্যাম্পাসে পুলিশের বন্দোবস্ত, সন্ধ্যের পর ছাত্রছাত্রীদের ফেস্ট বা সংস্কৃতির অনুষ্ঠান না করতে দেওয়া, সংস্কৃতির সম্পূর্ণ দায়ভার ছাত্র ইউনিয়নের, আরও সিসিটিভি বসানো প্রভৃতি। এই বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানাতে গেলে উপাচার্য বলেন, ছাত্রদের জানানোর জন্য মিটিংটা ডাকা হয়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ডাকা হয়নি। এছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ছাত্র ইউনিয়নকে তিনি পাশে পাওয়ার চেষ্টা করেন এই কথা বলে যে অভিযুক্ত ছাত্ররা তো সব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের। এই বিভাজনের চেষ্টার প্রতিবাদ জানায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিয়ন।
১২ সেপ্টেম্বর : ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিয়ন সাধারণ সভা করে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের দাবি সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং জমায়েতে শামিল হয়ে যায়।
১৬ সেপ্টেম্বর : বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সংস্থা এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ইসি-র সভায় আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা তাদের চার দফা দাবি পেশ করে : ১) ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। ২) তদন্ত কমিটির দুই শিক্ষিকা সদস্যা মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে মেয়েটিকে আজেবাজে প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁদের তদন্ত কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। ৩) সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত বিশাখা গাইড লাইন মেনে তদন্ত কমিটিতে নারী আন্দোলনের কর্মী, মানবাধিকার কর্মী প্রভৃতিদের রাখতে হবে। ৪) তদন্ত কমিটি থেকে পদত্যাগ করা ছাত্রী-প্রতিনিধির বদলে আর একজন ছাত্রী-প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কর্তৃপক্ষ না মানলে ইসি ঘেরাও শুরু হয়। ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে পুলিশি ব্যবস্থা ও নজরদারির বিধান পাশ হয়ে যায় ইসিতে। উল্লেখ্য, ইসিতে সদস্য হিসেবে কোনো ছাত্র বা গবেষক প্রতিনিধি থাকার প্রথা কয়েক বছর আগেই উঠে গেছে।
১৬-১৭ সেপ্টেম্বর : রাত পৌনে ন-টার সময় উপাচার্য জানিয়ে দেন, পনেরো মিনিটের মধ্যে ঘেরাও তুলে না নিলে তিনি যে কোনো ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারেন। ছাত্রছাত্রীরা অনড় থাকে। রাত পৌনে দুটোর সময় আলো নিভিয়ে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর বলপ্রয়োগ করে ঘেরাও তুলে দিয়ে ভিসি এবং অন্যান্য ইসি সদস্যদের বার করে নিয়ে যায় পুলিশ। ছত্রিশজন ছাত্র এবং একজন ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে প্রিজন ভ্যান থেকে ছাত্রীটিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও ছাত্রদের লালবাজার নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। লাঠিচার্জে তিরিশের বেশি ছাত্রছাত্রী আহত হয়। কয়েকজনের চিকিৎসা হয় পাশের কেপিসি হাসপাতালে। প্রসঙ্গত, আন্দোলন শুরুর থেকেই পুলিশের উপস্থিতি ছিল প্রশাসনিক ভবনের আশেপাশে।
১৮-১৯ সেপ্টেম্বর : পুলিশের বলপ্রয়োগের কথা, ছবি, ভিডিও মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়া মারফত ছড়িয়ে পড়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী মিছিল করে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। গবেষক ও শিক্ষকরাও মিছিল করে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও মিছিল করে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বয়কট শুরু হয়।
২০ সেপ্টেম্বর : বৃষ্টির মধ্যে এক অভূতপূর্ব বিরাট মিছিলে বহু হাজার ছাত্রছাত্রী উপাচার্যের ইস্তফার দাবি নিয়ে রবীন্দ্রসদন থেকে রাজভবন অভিমুখে মিছিল করে ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাজ্যের রাজ্যপালের কাছে ডেপুটেশন দেয়। শুধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নয় — এই মিছিলে হাজির ছিল কলকাতার আরও অনেক কলেজ, এমনকী বেশ কিছু স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। প্রাক্তনীদের উপস্থিতিও ছিল। রাজ্যপাল কয়েকদিন সময় চান। সরকার একটি কমিটি তৈরি করে ২৮ আগস্টের ঘটনার তদন্তের জন্য। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা এই কমিটিতে সন্তুষ্ট হয় না। এই মাসের শেষের দিকে পুলিশ দুই জন হস্টেল আবাসিক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের এক মাসের জেল হাজত হয়। পরে আরও একজন গ্রেপ্তার হয়। অভিযোগকারিণী তাদের শনাক্ত করে।
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ : দুর্গাপুজোর ছুটির মধ্যে রাজ্যপাল সার্চ কমিটির প্রস্তাবের সাথে তাল মিলিয়ে উপাচার্যকে — যিনি তখনও অবধি অস্থায়ী ছিলেন — এবার স্থায়ী উপাচার্য মনোনীত করেন। ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ চলতে থাকে।
১৬-১৭ অক্টোবর : পুলিশি বলপ্রয়োগের একমাস পূর্তিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন ব্যাপী গণ-অনশনে প্রায় সাড়ে পাঁচশো ছাত্রছাত্রী যোগ দেয়।
৩০-৩১ অক্টোবর : ছাত্রছাত্রীদের আয়োজনে গণভোটে আর্টস ফ্যাকাল্টির ছাত্রছাত্রীরা অংশ নেয়। ২৯৭০ জন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ২৬০২ জন (৮৭ শতাংশ) অংশগ্রহণ করে। উপাচার্যের পদত্যাগ করা উচিত — এই প্রশ্নে ২৪৯৭ জন (৯৬ শতাংশ) ‘হ্যাঁ’ বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আভ্যন্তরীণ অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র’ পুনর্নির্মাণ করা উচিত — এই প্রশ্নে ২৫১৭ জন (৯৭ শতাংশ) ‘হ্যাঁ’ বলে। ১৬ সেপ্টেম্বরের পুলিশি নির্যাতন এবং যৌনহেনস্থার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবিতে ২৫৫৩ জন (৯৮ শতাংশ) ‘হ্যাঁ’ বলে। ২৮ আগস্ট যৌনহেনস্থার ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবিতে ২৫২৭ জন (৯৭ শতাংশ) ‘হ্যাঁ’ বলে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সমস্ত ধরনের নজরদারি বন্দোবস্ত প্রত্যাহারের দাবিতে ২৩৫৯ জন (৯০ শতাংশ) হ্যাঁ বলে।
১০-১১ নভেম্বর : গণভোটে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ। ভোটদানের হার এবং ফলাফলের শতাংশ প্রায় আর্টস ফ্যাকাল্টির অনুরূপ।
Leave a Reply