অসরকারি সংস্থা ‘মৈত্রী’ কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত, অনুবাদ তমাল ভৌমিক, সম্পাদনা শমীক সরকার
কলাভবনে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর ওপর যৌন নিগ্রহের ঘটনার তথ্য-অনুসন্ধানের জন্য ‘মৈত্রী’র পাঁচ সদস্যের এক দল ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বর্ধমান সিআর হাসপাতাল ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এই দলে ছিলেন রত্নাবলী রায়, শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত, সোমান সেনগুপ্ত, দোলন গাঙ্গুলী এবং মৌসুমী সরকার।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নিগৃহীতার বন্ধুদের কাছ থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে :
মে মাসের কোনো এক সময়ে নিগৃহীতা কলাভবনের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল এবং জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে সেখানে ভর্তি হয়েছিল। ভর্তি হওয়ার সময় উঁচু ক্লাসের এক ছাত্রের সঙ্গে তার ফোন নম্বর লেনদেন হয়। ওই ছাত্র নতুন ছাত্রীকে সবরকমভাবে সাহায্য করার কথা বলে এবং তারপর থেকে বারে বারে তাকে ফোনে ডাকতে থাকে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ানোর জন্য। তারপরে এই ছাত্রটি আরও দু-তিনজন ছেলের সঙ্গে দল বেঁধে ৫/৬ জুলাই থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত নতুন ছাত্রীটির ওপর বিভিন্ন স্থানে নোংরাভাবে যৌননিগ্রহ চালায়। এবং এই গোটা সময়টা জুড়ে নানারকম ভয় দেখানো ও ব্ল্যাকমেল করা চলতে থাকে যাতে মেয়েটি একদম চুপ করে থাকে।
২৪ আগস্ট ২০১৪, এই নিগৃহীতা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনুষ্ঠান দেখছিল তখন তার দুই বন্ধু (একটি মেয়ে ও একটি ছেলে) তার শরীরের খারাপ হাল দেখে তাকে তার অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করে। অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পরে মেয়েটি তাদের পুরো ঘটনাটা বলে। পরের দিন ২৫ আগস্ট ২০১৪ ওই বন্ধু দুজন কলাভবনের অধ্যক্ষকে এই পুরো ঘটনা জানায়। কিন্তু অধ্যক্ষ নিগৃহীতার বাবা-মাকে এই বিষয়ে কিছুই জানান না। মেয়েটির বাবা-মা তার বন্ধুদের কাছ থেকেই গোটা ব্যাপারটা জানতে পারে। ওই একইদিনে আবার মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে যায় এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। নিগৃহীতার বাবা-মা অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ওই বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলে তাঁদেরকে আশ্বস্ত করেন, কিন্তু কোনোরকম আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব যৌননিগ্রহ সংক্রান্ত কমিটি তখন মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে তার বিবৃতি নেয়। নিগৃহীতার বাবা-মা মেয়েটিকে গ্যাংটকে ফেরত নিয়ে যান এবং সেখানে একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। ২৪ আগস্ট ২০১৪ তাঁরা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখেন কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী, যাঁকে এই পুরো ঘটনা জানানো হয়েছিল, তিনি কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চাপ দেন। তার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে এফআইআর করে এবং তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই এফআইআর করা হয় নিগৃহীতার কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার চারদিন পরে।
এবিষয়ে যে তদন্ত চলেছে তার জন্য পুলিশ ২ সেপ্টেম্বর বোলপুর থানায় নিগৃহীতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরের দিন, অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর মেয়েটিকে ১৬৪ ধারা মোতাবেক বিবৃতিদানের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার কথা। কিন্তু ২ তারিখ রাত্রে মেয়েটি খুব অসুস্থ বোধ করায় তাকে কর্তৃপক্ষ সিয়ানে এক হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে, ৩ সেপ্টেম্বর রাত দুটোয় তাকে বর্ধমান সিআর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে ডাক্তাররা মেয়েটির শরীরের ভিতরে কোথাও আঘাত লেগেছে কিনা তা বোঝার জন্য সিটি স্ক্যান করার সুপারিশ করেন। কিন্তু, যে কোনো কারণেই হোক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই সিটি স্ক্যান করা জরুরি বলে মনে করেন না। বিশ্বভারতীরই কিছু ছাত্র, যারা উত্তরবঙ্গ ও সিকিম থেকে এখানে পড়তে এসেছে, তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে গিয়ে ধরে। তারপর কর্তৃপক্ষ সিটি স্ক্যান করে এবং ৩ তারিখ সন্ধ্যেবেলা মেয়েটির সুচিকিৎসার জন্য পাঁচ সদস্যর একটা মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে।
মেয়েটির বন্ধুরা, যারা হাসপাতালের অবহেলায় নাস্তানাবুদ হয়েছিল ও নিগৃহীতার চিকিৎসার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল তারা ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে ‘মৈত্রী’র সদস্য শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্যের আবেদন করে। তখন ‘মৈত্রী’র পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয় যে তাদের একটা দল আপৎকালীন ভিত্তিতে দ্রুত পরিদর্শন যাবে এবং সেই অনুযায়ী তারা ৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে উপস্থিত হয়।
বর্ধমান সিআর হাসপাতালে যেসব তথ্য জানা গেল :
> মেয়েটির সাইকোথেরাপি ও ট্রমা কাউন্সেলিংয়ের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, যদিও মেয়েটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে খুব ত্রাসের মধ্যে আছে।
> তখন পর্যন্ত কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি।
> আগের দিন কিছু রক্ত পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান ও ইউএসজি হয়েছে।
> মূত্র পরীক্ষা হয়নি।
> লালা পরীক্ষা বা ‘সোয়াব টেস্ট’ হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলে যে মেয়েটি ‘সোয়াব টেস্ট’ করাতে রাজি হয়নি।
> নিগৃহীতার বাবা-মা, যাঁরা সিকিমের অধিবাসী, তাঁদের হাসপাতালের কাছাকাছি থাকার উপযুক্ত কোনো জায়গা দেওয়া হয়নি।
> ক্রিমিনাল কোডের ১৬৪ ধারা মোতাবেক মেয়েটির কোনো বিবৃতি নেওয়া যায়নি তার শারীরিক অবস্থার কারণে।
… … …
মেডিক্যাল বোর্ডের একজন গায়নোকলজিস্ট সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিগৃহীতা সোয়াব টেস্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। উনি আরও বলেন, শারীরিক হেনস্থার জন্যই নিগৃহীতার তলপেট সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ডের এক সদস্য, সাইক্রিয়াটিস্ট অসীম মল্লিক জানান, আগের রাত্রেই নিগৃহীতার জন্য উদ্বেগ কমানোর ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছেন তিনি, কিন্তু তা তখনও নিগৃহীতার কাছে পৌঁছোয়নি। পরে সুপার ও ডেপুটি সুপারের নির্দেশে নিগৃহীতাকে ওই ওষুধ দেওয়া হয়। মৈত্রী সদস্যদের তৎপরতায় নিগৃহীতার বাবা-মা বর্ধমান শহরের একজন আইনজীবীর যোগাযোগ পায়। নিগৃহীতা মায়ের পাশাপাশি বাবার সঙ্গেও যাতে থাকতে পারে, তার ব্যবস্থাও হয়।
মেয়েটির বাবা-মা নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে এফআইআর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন :
ক) দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে, কারণ তাঁদের বিশ্বাস, যে এফআইআর বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছে, তাতে সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হয়নি।
খ) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। কারণ তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেরি করেছেন অর্থাৎ তাদের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে।
গ) ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ নামক সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে, কারণ তারা তাদের পত্রিকায় নিগৃহীতার মুখের সামনাসামনি ছবি ছেপেছে।
Leave a Reply