প্রত্যুষা জানা
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী প্রত্যুষা জানার টুকরো টুকরো কথায় আন্দোলনে তার অংশগ্রহণের বৃত্তান্ত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সংহতিতে খুবই সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীদের একটা অংশ। কাকতালীয় কি না কে জানে, তারপরেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্দেশ জারি করে, ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের পঁচাত্তর শতাংশ উপস্থিতি থাকতেই হবে।
যৌন নিগ্রহের ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন প্রেসিডেন্সিতে জেন্ডার অ্যাওয়ারনেস মান্থ (লিঙ্গ সচেতনতা মাস) চলছে। সেখানে একটা দাবি উঠছিল, সমস্ত সংগঠন থেকে, আইসি থেকেও, একটা জিএস নির্বাচন হোক। একটা লিঙ্গ সচেতনতা সেল তৈরি করা হোক। একটা ছাত্র-কর্তৃপক্ষ তৈরি হোক। সেটা ছাত্র ইউনিয়নের নয়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের। লিঙ্গ সচেতনতা মাসে কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়, দুটো বিষয়ে — কলাভবন ও যাদবপুর। ওই মিটিংটায় প্রাথমিকভাবে কলাভবনের ঘটনাটাতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এবং কলাভবনে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। পরে যাদবপুর যাওয়ার কথা ছিল। সেই দিনই রাত্রিবেলা যাদবপুরে পুলিশ মারধোর করে ছাত্রছাত্রীদের। প্রেসিডেন্সি থেকে আইসি একটি বিবৃতি বের করে — সেটা এইরকম কয়েকটা মিটিং চলার মধ্যে। আইসি-কে প্রশ্ন করেছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা — কেন আইসি এখনও বিবৃতি দেয়নি, ইউনিয়ন তার অবস্থানটা পরিষ্কার করুক। তারপর আইসি থেকে যাদবপুরের ঘটনা এবং বিশ্বভারতীর ঘটনার নিন্দা করে বেরোনো বিবৃতিটা আমার চোখে পড়ে।
বিবৃতিতে সরাসরি ঘটনাটার নিন্দা করা হয়েছিল। তার কারণ ওই সময় মিটিংগুলোতে এগুলো খোলাখুলি আলোচনা হয়েছিল — আমরা তো মূলত মানসিকতাটাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছি। একজন মেয়ে যখনই মলেস্টেড হচ্ছে বা যাই হচ্ছে, যখন সে বলছে, তখন ওই ঘটনাটার থেকে বেশি মেয়েটা কী-কেমন-কীভাবে হয়েছে, আসল সত্য জানতে হবে, এই ব্যাপারটা করছ। অথবা, সেই মেয়েটা কেমন জামা পরেছিল, সেটা নিয়ে তোমরা মাথা ঘামাচ্ছো। এই যে মানসিকতাটা — তার মানে আসলে ব্যাপারটা মেয়েটারই। একটা একপাক্ষিক মানসিকতা। তো সেই মানসিকতাটাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই ওই মাসটা (লিঙ্গ সচেতনতা) চালু করাও হয়েছিল। ওই একমাস ধরে বিভিন্ন লোকের সাথে কথা বলা হয়, কিছু ছোটোখাটো অনুষ্ঠান হয়। আমাদের কলেজের হয়তো সবারই এই মানসিকতাটা আছে ভেতরে। সুতরাং কথা না বললে … আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, লোকজন এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু কথা বলতে গেলেই সরে যায় গোল গোল কথা বলে — হ্যাঁ হ্যাঁ মলেস্টেশন হওয়া উচিত নয়। কিন্তু যখন হচ্ছে — তখন কেন হচ্ছে কথাটা আসে না। কলাভবনেও যে তদন্ত কমিটিটা তৈরি হয়েছিল — তাদের ম্যান্ডেট ছিল, রেপ হলে বা মলেস্টেশন হলে তার তদন্ত করব। কিন্তু কেন হচ্ছে এগুলো? সেটা যাতে না হয় — সে জন্যই ওই লিঙ্গ সচেতনতার কর্মসূচি। … এটা যারা সংগঠিত করেছিল — তারা সত্যিই স্বাধীন ছাত্রছাত্রী। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই একটা অংশ — যারা মনে করে, এরকম ঘটনা ঘটলে তা ঘটে যাওয়ার পরে তো করে কিছু লাভ নেই। কারণ, আমাদের নিজেদের কলেজেও এরকম ঘটনা ঘটে। এবং সেগুলো সামনে আসে না। যারা সোশিওলজি বা ইংলিশ বা ফিলোজফি পড়ছে — ধরে নেওয়া হয় তাদের অনেকেরই এরকম একটা সচেতনতা আছে। যারা ফিজিক্স বা ম্যাথ পড়ে, তাদের এরকম কোনো সচেতনতা নেই — কারণ তাদের বেশিরভাগই এই ধরনের কোনো সচেতনতার উদ্যোগে যোগ দেয় না। সেটা তো কোনো কাজের কথা নয়। একটা দল সারাক্ষণ সচেতনতা বহন করবে, আর বাকিরা কিছুই জানবে না, তাই জন্যই বেকার ল্যাব বা এইসমস্ত জায়গায় (যেখানে ফিজিক্স বা ম্যাথ-এর ছেলেরা ঘোরাঘুরি করে) বিভিন্ন লোককে ডেকে ডেকে কথা বলা। সিনিয়র দিদি-রা, যাজ্ঞসেনী মিত্র, হৃশিকা — এরা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলে — আমাদের সঙ্গেও এসে কথা বলেছিল এবং আমাদেরও বলেছিল অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে। এই উদ্যোগটা মূলত মেয়েদের। ছেলেদের রোলটা আমি যতদূর দেখেছি — ‘আমরা তোমাদের সমর্থন করি’ গোছের।
কলাভবনের ঘটনাটা যখন ঘটে তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রেশার্স (নবীনবরণ) চলছিল। খুব উৎসবের মেজাজ। তখন আমি একদিন কলেজে ঢুকে দেখলাম, আমাকে অপালাদি এসে বলল যে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমরা কেউ কিছু করব না? কারণ ওটা শান্তিনিকেতন বলে, কলকাতা নয় বলে? মিডিয়া আলটিমেটলি ওটা কিছু করবে না। কারণ প্রেসিডেন্সি যাদবপুরের জন্য মিডিয়ার একটা স্লট থাকে। নিয়ে এসো যা খুশি পাবে। ওদের জন্য কোনো স্লট নেই। তো সেদিন নবীনবরণে ‘আনপ্লাগড’ বলে একটা অনুষ্ঠান ছিল — বিভিন্ন ব্যান্ড এসে গান গাইবে। লিফলেট তো অত দ্রুত ছাপানো যাবে না, তাছাড়া এখন এমন উৎসবের মেজাজ লিফলেট করলে লোকজন ওটাই হাতে নিয়ে নাচবে। ওটা পড়বে না। সেই জন্যই আনপ্লাগড-এ দুটো ব্যান্ড-এর মাঝখানে দশ মিনিট নিয়ে মাইকে বলা যায় কলাভবনের ঘটনাটা নিয়ে। আমরা আনন্দ করছি, নিশ্চয়ই করব, কারণ আনন্দটা খুব প্রয়োজনীয়। কিন্তু তার মাঝখানে আমরা যেন ভুলে না যাই ব্যাপারটা। ওটা যেন আমাদের হন্ট করে (তাড়া করে) কোনো না কোনোভাবে। ফেস্ট-এ বা ফ্রেশার্স-এ যেটা হয়, লোকজন আত্মহারা হয়ে যায়। অনুভূতিগুলোই চলে যায়। ওইটাই সচেতন করার চেষ্টা। ইউনিয়ন বলেছিল হ্যাঁ খুব ভালো কথা। তোদের মাইক দেব। কিন্তু আলটিমেটলি ওটা কেউ করে উঠতে পারেনি। কারণ যারা বলবে ভেবেছিল, তারা সবাই ইতস্তত করছিল — আমরা কি এরকম বলব? হন্ট করাব? হন্ট করালে আমরা ভিলেন হয়ে যাব না তো?
যাদবপুরের আন্দোলনের মূল দাবি যে ‘ভিসির পদত্যাগ চাই’ হয়ে উঠল — সেটা ঠিক নয়। আমাদের কয়েকজনের কাছে, একটা মেয়ের ওপর নির্যাতন হয়েছে, সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আন্দোলনটা। … এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কেউ কোনোরকম কথা বলছে না। যাদবপুরের আর্টস ফ্যাকাল্টি ছাড়া আর কারোর কোনোরকমের হেলদোল নেই। কিন্তু আমরা পরে দেখলাম, আমি অনেককেই ওই সময় সাধারণ সভা চলাকালীনও বলার চেষ্টা করেছি, সাধারণ সভায় যখন বক্তব্য রাখছে, তখন প্রত্যেকের কথা বলার ধরনটা হচ্ছে এরকম — হ্যাঁ ওটা হয়েছিল (যৌন নির্যাতন), বলে পরের ব্যাপারগুলো নিয়ে বিস্তারিত কিছু। ওই ব্যাপারটা নিয়ে কেন বিস্তারিত কথা হবে না? তার কারণ, ওই মানসিকতাটা এখনও আছে, এবং ওটা নিয়ে কথা বলা স্বস্তিদায়ক নয়।
[সম্পাদকের সংযোজন — ওই সময় যে ক-টা সাধারণ সভা হয়েছে — আর্টস ফ্যাকাল্টির সাধারণ সভা বা সব ফ্যাকাল্টির মিলিত সভা — সবগুলোতেই প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা হয়েছে এটা নিয়ে যে কেন ওই ঘটনাটা থেকে কথা শুরু করা হচ্ছে না।]
সে সময় আমাকে অনেকে এটাও পাল্টা প্রশ্ন করেছে, তার মানে তুই বলতে চাইছিস, পুলিশে মেরেছে এটা কোনো ব্যাপার না? আমি বলেছি, এটা কোনো ব্যাপার নয় তা না, আসলে আগেরটা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।
আন্দোলনটা যখন প্রথমদিকে চলছিল অরবিন্দ ভবনের সামনে, তখন আমি দেখেছি দেবারতি সরকার এবং আরেকজনকে একটা ক্যামেরা নিয়ে জনে জনে ডেকে জিজ্ঞেস করছিল — র্যানডামলি জিজ্ঞেস করছিল — কেন এসেছ এখানে ইত্যাদি প্রশ্ন। তখন একদম ফ্রেশ। ওদের প্রশ্নগুলোও খুব ভালো ছিল, যেমন, তুমি কেন এসেছ? তোমার মতটা কী? তোমার কি মনে হচ্ছে, এই আন্দোলনটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে? যাতে বিলীন না হয়ে যায় তার জন্য কী করা উচিত বলে তোমার মনে হয়?
শুনেছি স্কটিশ চার্চ কলেজে ফ্রান্সিস মণ্ডল নামে একটি ছেলে এই হোক কলরবের সমর্থনে ওখানে কিছু সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। তাকে কলেজে কিছু করেনি। সে থাকে ওই ক্যালকাটা বয়েজ-এর ওখানে, তালতলায়। সেখানে তাকে একটা গলিতে নিয়ে গিয়ে খুব মেরেছিল নাকি তৃণমূলের লোকেরা। তার পায়ের ওপর দিয়ে নাকি বাইক চালিয়ে দেয়। ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছিল — তাকে এনআরএস-এ নিয়ে যায়। এনআরএস থেকে উডল্যান্ডে শিফ্ট করা হয়েছিল। আমাদের দু-জন বন্ধু দু-দিন বাদে সেখানে যায়। কিন্তু গিয়ে তাকে সেখানে দেখতে পায়নি। হয়তো ডিসচার্জ করে দিয়েছে। ওই ছেলেটার বান্ধবী যাদবপুরে পড়ে।
সেন্ট থমাস কলেজ থেকেও অনেকে এসেছিল। ওই কলেজের একজন বক্তব্যও রেখেছিল। পরে শুনেছি ওই কলেজের এলাকা খিদিরপুরে ওই ছেলেটার গায়ে ব্লেড টেনে দেওয়া হয়েছে।
আমার কলেজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, দলে দলে লোক যাদবপুর যাবে। সেই মতো ‘প্রেসিডেন্সি অংশ নিচ্ছে’ — এইভাবে দলবেঁধে যাওয়া হত। অবশ্য কেউ কেউ ব্যক্তি ছাত্রছাত্রী হিসেবেও গেছে। আমিও এইভাবে গেছি। পরে এটা বদলে দাঁড়ায়, যাদবপুরে যা অনুষ্ঠান হবে, তার সমর্থনে প্রেসিডেন্সিতেও সে রকম প্রতীকী অনুষ্ঠান হবে। আমার কাছে সেটা সমস্যা হচ্ছিল, কারণ, আমি কোথায় যাব? যাদবপুর না আমার নিজের কলেজে? এখানে অংশগ্রহণ কম। স্পিরিটটাও আলাদা। একটাই সংগঠন আয়োজন করছে, ফলে বাকি দলগুলো আসছে না। …
Leave a Reply