ঋতম সেন
অনধিক দশজন ছেলেমেয়ে এই নাটকটি করবে। সবাই ওপরে কালো জামা এবং নিচে জিন্স পরে থাকবে। তাদের মুখের এক পাশ সোনালি এবং অপর পাশ লাল রঙ করা। চরিত্রগুলির কোনো নাম নেই। নাটকটি মঞ্চের জন্য নয়। খোলা মাঠে, অথবা রাস্তায় করার জন্যেই তৈরি নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল ২০ সেপ্টেম্বরের মহামিছিলের মধ্যে। কথোপকথনগুলি স্লোগানের ঢঙে বলা হয় এবং স্লোগান যে তোলে সে বার বার পরিবর্তিত হয়। প্রত্যেক অভিনেতাকে স্লোগান তুলতে জানতে হবে।
দশজন বিভিন্ন ভঙ্গিতে দর্শকদের মধ্য থেকেই উঠে এসে, দর্শকদের সরিয়ে সরিয়ে একটা গোল ফাঁকা জায়গা তৈরি করে, যেখানে নাটকটি হবে। তাদের মধ্যে থেকে একজন চিৎকার করে স্লোগান দেওয়ার মতো করে বলতে থাকে এবং বাকি সবাই তাকে উত্তর দিতে দিতে ইতস্তত ঘুরতে থাকে।
একজন : পৃথিবীতে লাগিয়াছে বিপুল ঘূর্ণন।
সকলে : অথ যাদবপুর কথা করিব বর্ণন।
একজন : এ ঘোটালা ঘাঁটি যদি, কেউটে বেরোবে।
সকলে : নির্লজ্জ অত্যাচারীর ঠাঁই নেই এ ভবে।
একজন : তো সওয়াল এহি হ্যায় সজ্জনো কে হোয়াট ইজ ফাউন্ড অ্যান্ড হোয়াট ইজ লস্ট।
সকলে : ষোলোই সেপ্টেম্বর এর আগে আঠাশে আগস্ট।
ছড়াটি শেষ হলে দেখা যায়, ন-জন একটি বৃত্ত তৈরি করে। তাদের মধ্যে একজন উবু হয়ে বসেছে। তারা মুখ দিয়ে কষ্টের আওয়াজ করছে, সেই আওয়াজ আস্তে আস্তে বাড়ছে, আওয়াজ বাড়তে বাড়তে চরমে পৌঁছায়, ন-জন ছিটকে ন-দিকে বেরোয়, মাঝের জন শূন্যে লাফিয়ে ওঠে, ন-জন ন-দিকে ছিটকে গিয়ে মাটির ওপর একটু ঝুঁকে আক্রমণ করার ভঙ্গিতে মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়ায়। মাঝের ছেলেটি বা মেয়েটি, যেন ঘুম থেকে জেগে উঠেছে এইভাবে বলতে থাকে —
কীসের? কীসের আওয়াজ? কীসের আওয়াজ? কীসের? জানেন আপনারা জানেন? ষোলোই সেপ্টেম্বর ঠিক রাত দুটোর সময়ে এরকম একটা বীভৎস আওয়াজে জেগে উঠে, আমি, আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু এই আওয়াজটা শুরু হয়েছিল আরও বেশ কিছুদিন আগে। শুনতে চান কবে? ঠিক কবে? তবে শুনুন, শুনুন …
বাকিরা আর স্থির না হয়ে থেকে দর্শকদের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাদের ডেকে বলতে থাকে —
শুনুন শুনুন শুনুন শুনুন …
একটা গুঞ্জন তৈরি হয়, তার মধ্যে থেকে একটা গলা চেঁচিয়ে ওঠে, বাকিরা উত্তর দেয়। তাদের শরীরও কথাগুলো বলে।
একজন : শুনুন শুনুন শুনুন কিছু কথা বলতে চাই আমরা।
সকলে : নির্লজ্জের টেনে খুলে দেব মুখোশ এবং চামড়া।
একজন : মিডিয়া ঠেলছে গোলকধাঁধার বৃত্তে।
সকলে : কে বলেছে সব মিথ্যে?
একজন : হয়েছিলটা কী আঠাশে?
সকলে : অস্থিরতার মেঘ ভেসে আছে আকাশে।।
একজন কথা বলতে বলতে অস্থিরভাবে চলাফেরা করতে শুরু করে। সে প্রত্যেককে ছুঁয়ে দেয় এবং সবাই নেতিয়ে মাটির ওপর পড়ে যায়। শুধু নির্দিষ্ট অন্য আরেকজনকে সে ছুঁলে সে তার কথার উত্তর দেয়, আর সেও যাদের ছোঁয় তারা নেতিয়ে পড়ে।
প্রথমজন : জানি না কী হয়েছিল, তবে তার সূত্র ধরে তো অবস্থা আরও খারাপ হল। প্রথমত তো আইসিসি কমিটির শিক্ষিকা নিগ্রহের ঘটনা। এটা তো উচিত নয়, যে ইস্যুতেই হোক না কেন?
দ্বিতীয় : তাই? কী করা হয়েছিল ওই শিক্ষিকাকে?
প্রথম : খবরের কাগজ পড় না?
দ্বিতীয় : ও আচ্ছা, তাহলে ওনাকে টিউবলাইটের জ্বলজ্বলে আলোয়, কিছু আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রী গলা টিপে ধরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এই তো?
প্রথম : হ্যাঁ।
দ্বিতীয় : আর আঠাশে আগস্ট? আমাদের বান্ধবী? সে কী অবস্থায় ছিল? কী করছিল?
সঙ্গে সঙ্গে নেতিয়ে পড়া দেহগুলি রাস্তায় বসে, হেসে, গল্প করে, নেচে, গাইবার বাজাবার ভঙ্গি করে একটা উৎসবের মেজাজ তৈরি করে। যেখানে এরা দুজন মিশে যায়। একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ায়, সে ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি যাচ্ছে, সবাইকে বিদায় দিয়ে, এই অভিনয় করেই পরক্ষণে সে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলে —
মেয়েটি : সে আনন্দে ছিল, উৎসবের মেজাজে ছিল, সে ভাবতেই পারেনি।
বাকিদের দেহগুলি আরেকটু ওপরে ওঠে —
সকলে : কী ভাবতে পারেনি?
মেয়েটি : ভাবতে পারেনি তাকে তার ইউনিভার্সিটির ভেতরেই এরকম একটা অবস্থায় পড়তে হবে।
বাকিরা পুরোটা উঠে দাঁড়ায়।
সকলে : কোনটা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া?
মেয়েটি : হ্যাঁ কোনটা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া? এই আন্দোলন? না তক্কে তক্কে থেকে অতর্কিতে আক্রমণ? চোদ্দো পনেরোজন মিলে দু জনের ওপর অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়া?
সকলে : তার পর?
বাকিরা সকলে তারপর? তারপর? তারপর? জিজ্ঞাসা করতে করতে উত্তেজিত আমোদ করে জনতার রূপ নেয় এবং মেয়েটির চারপাশে ঘুরতে থাকে, আর ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে দর্শকদের দিকে তাকাতে থাকে। মেয়েটি সবাইকে চেঁচিয়ে চুপ করাতে বাধ্য হয়।
মেয়েটি : তার পরের ঘটনা নিয়ে অনেক শব্দ খরচই তো হল। আমি বলতে চাই এই ঝাঁপিয়ে পড়াটাই অপরাধ।
যে যেখানে ছিল পেছনে ঘুরে গিয়ে সমস্বরে বলে —
সকলে : এটা নীতিশিক্ষা।
মেয়েটি : নীতিশিক্ষা? তার দায়িত্ব কে ওদের দিয়েছে? আমাদের বান্ধবী কেন বাধ্য হবে জবাবদিহি করতে?
প্রত্যেকে প্রশ্ন করার ভঙ্গীতে মেয়েটিকে ঘিরে ঘোরে, তাকে ঘিরে বৃত্ত ক্রমশ ছোটো হয়ে আসে। সে মাথা চেপে ধরে ক্রমশ কুঁচকে যায়। তিনটি প্রশ্ন বিভিন্ন ভাবে তাকে কেন্দ্র করে ঘোরে —
প্রশ্ন ১ : তুমি কী পরেছিলে?
প্রশ্ন ২ : তোমাদের কী অবস্থায় পাওয়া গেছিল?
প্রশ্ন ৩ : তুমি কী খেয়েছিলে?
মেয়েটি এবার ফেটে পড়ে, আর সেই ঝাপটায় তাকে ঘিরে বৃত্তের শরীরগুলি বিভিন্ন দিকে ছিটকে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।
মেয়েটি : তাতে তোমাদের কী? এর মধ্যে কোনটা অপরাধ? কোনটা তোমরা নিজেরা করো না? তোমরা কে শাস্তি দেওয়ার? শোনো তোমরা যা করেছ সেটাই অপরাধ। ভেবে দেখো কী করেছ তোমরা?
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর একজন বলতে শুরু করে। সবাই উত্তর দেয়।
একজন : নানা মুনি, নানা মতবাদ।
সকলে : বলুন কোনটা অপরাধ?
একজন : অপরাধটা কী?
সকলে : সুরক্ষা চাই, সম্মান চাই, জানি না বাদবাকি।
একজন : অপরাধ কেন হয়?
সকলে : প্রতিবাদ হয় না বলে, বিচার হয় না বলে, শাস্তি হয় না বলে।
একজন : বেশ তবে হোক কলরব, হোক প্রতিরোধ।
সকলে : হোক কলরব হোক প্রতিরোধ, অপরাধ আর নয়। (এটা স্লোগানের মতো বারবার সকলে বলতে থাকে)
পাঁচজন মাটিতে গড়ে তোলা ব্যারিকেডের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে, একটি কালো গোল সানগ্লাস পরে নেওয়া ছেলেকে ঘিরে। আর চারজন মুখে লাল কাপড় জড়িয়ে পুলিশের ভঙ্গিতে যেন হাতে কাল্পনিক লাঠি নিয়ে তাদের ঘিরে টহল দেয়, মাঝে মাঝে দর্শকদের দিকে তাকায়। স্লোগানিং শুরু হয়।
একজন : হাতে হাতে কমরেড।
সকলে : গড়ে তোলো ব্যারিকেড।
টানা স্লোগানিংয়ের মধ্যে চারজন মুখে লাল কাপড় বাঁধা পুলিশ ব্যারিকেড লক্ষ্য করে হাতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে আসে। ছাত্ররা পিছিয়ে গিয়ে ব্যারিকেড জমাট করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ড আওয়াজে তারা বল প্রয়োগের দ্বারা ব্যারিকেডটা ভাঙে, ছাত্রদের টেনে ছুঁড়ে ছিটকে ফেলে দেয়। মাঝের কালো সানগ্লাস পরা ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় এবং একটা কোণে গিয়ে বসে। দু-একটা খিস্তি মাও মাকু নকশাল ইত্যাদি ভেসে আসে। মাটিতে পড়ে থাকা শরীরগুলোর একটা থেকে আওয়াজ বেরোয়। শরীরগুলো ক্রমশ ওঠে। স্লোগানিং শুরু হয় —
একজন : যারা মারছে যারা মারবে।
সবাই : তারা হারছে তারা হারবে।
শরীরগুলি আস্তে আস্তে মাটি থেকে ওঠে। পুলিশ ও আরেকটি ছেলে সেই দলে যোগ দেয়। তারা লাল কাপড় ও সানগ্লাস খুলে ফেলেছে এতক্ষণে। একজন বলে ওঠে — সবাই উত্তর দেয়।
একজন : আমরা চেয়েছিলাম আর অপরাধ হবে না।
সবাই : কিন্তু আবার হল।
একজন : এবার অপরাধী কে?
সবাই : উপাচার্য।
একজন : পুলিশ কী বলছে?
এইবার আর সবাই কথা বলে না। নির্দিষ্ট একজন জবাব দেয়।
জবাব : পুলিশ বলছে তারা সংবেদনশীল ছিল। কোনটা সংবেদনশীলতা? রাতের অন্ধকারে আলো নিভিয়ে কিল চড় লাঠি ঘুঁষি এইটা সংবেদনশীলতা? পুলিশ বলছে উপাচার্যের হুকুমে তারা যা করার তা করেছে। আর উপাচার্য? হাঃ। তিনি আবার বলছেন আমরা, এই আমরাই নাকি তাঁকে মারতে গেছিলাম।
সবাই : কোনটা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া?
অন্য একজন কথা বলে ওঠে —
একজন : আবার সেই একই ঘটনা ঘটল। এবার আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হল পুলিশ। রাতের অন্ধকারে।
আরেকজন : এবার আসতে চলেছে নতুন নিয়ম code of conduct।
অন্য একজন : আমরা কি নতুন নিয়ম চাই?
সবাই : না।
স্লোগানিং শুরু হয়। যে কোনো একজন শুরু করে, বাকিরা তাকে অনুসরণ করে।
স্লোগান : যাদবপুর দিচ্ছে ডাক/উপাচার্য নিপাত যাক।
স্লোগান : বলতে তোমায় হবে আজ/কেন হল লাঠিচার্জ?
স্লোগানিং শেষ হয়। একজন বলে ওঠে।
একজন : বলুন কেন লাঠিচার্জ করা হল? কেন নিরপরাধ ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ নামবে? তারা তাদের বান্ধবীর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই তো গেছিল? তাদের দাবি কী ছিল?
আবার স্লোগানিং শুরু হয় —
স্লোগান : শাস্তি চাই কমরেড/গড়ে তোলো ব্যারিকেড।
বিচার চাই কমরেড/গড়ে তোলো ব্যারিকেড।
স্লোগানিং চলতে চলতে আরও একটা ব্যারিকেড গড়ে ওঠে। সকলে দর্শকদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে হাতগুলি ওপরে তুলে মানববন্ধন গঠন করে, একটি বৃত্তের মতো। একজন তার ভেতরে ঢোকে, চেঁচিয়ে বলে —
একজন : তাহলে দুটো অপরাধ হল। দুটোই প্রায় একইরকম। প্রথমটা নীতিশিক্ষার নামে, দ্বিতীয়টা শান্তিরক্ষার নামে। দ্বিতীয়টা আরও ভয়ানক, আরও বীভৎস।
সেই প্রথম ছেলেটি যে বৃত্তের মাঝখান থেকে লাফিয়ে উঠেছিল, সে এগিয়ে এসে বলে —
আর সেই মানুষটা যে রাত্রিবেলায়, একটা বিশাল আওয়াজ শুনে চমকে জেগে উঠেছিল, আজ সে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। সে ভেবেছে সে বিপ্লবী। সে আজ মিছিল করছে, সরকারের দিকে, ক্ষমতার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলছে এরাই অপরাধী। সে জানে না, এই নৈরাজ্যের শেষ কোথায়? আমরা কেউই জানি না এর পরের মুহূর্তে কী হতে চলেছে। শুধু জানি —
সবাই : অপরাধীদের শাস্তি চাই। উপাচার্যর পদত্যাগ চাই। চাই ক্যাম্পাসে আর কখনো পুলিশ ঢুকবে না।
বলার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানিং শুরু হয়। দর্শকদের অভিনেতারা হাতে ধরে বৃত্তের মধ্যে নিয়ে আসে। এবং শেষ পর্যন্ত দর্শকরাই স্লোগান দিতে থাকে, অভিনেতারা বেরিয়ে যায় —
গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে প্রান্তরে
জোট বাঁধো তৈরি হও।
কার ঘরে জ্বলেনি দীপ চির আঁধার নিষ্প্রদীপ
জোট বাঁধো তৈরি হও।
কার বাছার জোটেনি দুধ ভুখা পেট শুকনো মুখ
জোট বাঁধো তৈরি হও।।
মাঠে কিষাণ কলে মজুর ছাত্র যুব নওজোয়ান
জোট বাঁধো তৈরি হও।।
এই মিছিল সবহারার সব পাওয়ার এই মিছিল
জোট বাঁধো তৈরি হও।।
শিশুহারা মাতাপিতার চোখের জল এই মিছিল
জোট বাঁধো তৈরি হও।।
ছাত্র আর ছাত্রীদের রক্ত ঘাম এই মিছিল
জোট বাঁধো তৈরি হও।।
এই মিছিল সবহারার সব পাওয়ার এই মিছিল
জোট বাঁধো তৈরি হও।।
জোট বাঁধো তৈরি হও।।
কৃতজ্ঞতা : সলিল চৌধুরির ‘শপথ’-এর কিছু অংশ স্লোগান হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
Leave a Reply