সোহিনী রায়
নিগৃহীতা মেয়েটি তার বয়ানে বলেছিল, সে ঘটনার সময় ওপেন এয়ার থিয়েটারের পাশে গাছতলায় টয়লেট করতে গিয়েছিল। তাই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কোনো টয়লেটে না গিয়ে সে কেন গাছতলায় গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ও বর্তমান গবেষক সোহিনী রায়ের অভিজ্ঞতায় মেয়েদের টয়লেটের সমস্যা।
বিভিন্ন কলেজে মেয়েদের টয়লেটের অবস্থা খুব খারাপ। বিশেষ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মেয়েদের টয়লেটের অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ। এবং মোটামুটি সন্ধ্যে হয়ে গেলে টয়লেট পাওয়াই যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে থাকলে একেবারে এইটবি বাসস্ট্যান্ডে এসে যে সুলভ শৌচালয়, সেখানে পয়সা দিয়ে টয়লেটে যেতে হয়। আমি আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমি যখন জিওলজি বিভাগে এমএসসি পড়তাম, বছর কয়েক আগের কথা। তখন চারতলা একটা বিল্ডিং, সেখানে একতলায় মেয়েদের একটা টয়লেট ছিল। প্রচণ্ড নোংরা। এবং সেটা সবসময় তালা দেওয়া থাকত। তার চাবি ডিপার্টমেন্টের যে লাইব্রেরি, সেখানে একটা পেরেকের মধ্যে টাঙানো থাকত। এবার ডিপার্টমেন্টাল লাইব্রেরি খুলত বারোটার সময়। ক্লাস শুরু হত দশটা কুড়িতে। দুপুর বারোটার আগে কোনো ছাত্রীর যদি টয়লেট পায়, তাহলে তাকে অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে, নাহলে তাকে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যেতে হবে। আর নিয়মটা ছিল, চাবি নিয়ে বাথরুম করে ডিপার্টমেন্টাল লাইব্রেরিতে রেখে তবে সে মুক্ত। কিন্তু প্রত্যেক তলায় একটা করে ছেলেদের টয়লেট আছে। এবার আমাদের সবসময় পরীক্ষা হত চারতলাতে। দশটা থেকে পরীক্ষা শুরু হত। পরীক্ষা দিতে দিতে মাঝখানে একবার বাথরুমে যদি যেতে হয়, তাহলে কী করব ভেবে আমার টেনশন হত। এবার একটা পরীক্ষার সময় টয়লেট পেয়েছে। দু-ঘন্টার পরীক্ষা। সেখানে আমি চারতলা থেকে দোতলায় নামব, সেখান থেকে চাবি সংগ্রহ করব, করে একতলায় যাব, সেখানে চাবি খুলে বাথরুম করে চাবি দিয়ে উঠে দোতলায় এসে লাইব্রেরিতে চাবি টাঙিয়ে রাখব, তারপর চারতলায় উঠে পরীক্ষা হলে ঢুকব। এই গোটা প্রক্রিয়াটাতে পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট সময় নষ্ট হত। একটা দু-ঘন্টার পরীক্ষায় এটা জাস্ট বিলাসিতা। এবার আমি যেটা করি, চারতলায় করতে করতে চারতলায় ছেলেদের টয়লেটে ঢুকে যাই, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিই। একদিন বাথরুমে থাকাকালীনই আমি শুনছি ভেতর থেকে, বাইরে দরজায় ধপধপ ধপধপ আওয়াজ। তারপর যখন আমি বেরোচ্ছি, ওখানে যারা ছিল, প্রায় ভূত দেখার মতো। জেন্টস টয়লেট থেকে মেয়ে বেরিয়ে আসছে। আমাকে বলছে, এ কী তুই? আমি বললাম, কী করব, বাথরুম পেয়ে গিয়েছিল, আমার হাতে কোনো সময় ছিল না। তারপর পরীক্ষার পরে আমি ঘটনাটা বললে তখন সবাই বলছে, কিন্তু জেন্টস টয়লেট বন্ধ থাকলে তো মুশকিল। আমি বলি, হ্যাঁ সে তো মুশকিল, কিন্তু মেয়েদের তো কোনো টয়লেটই নেই। তারপর আমরা যেটা করেছিলাম, চারতলার টয়লেটের ওপর চক দিয়ে জেন্টস/লেডিজ লিখে দিয়েছিলাম। ডিপার্টমেন্টাল কর্তৃপক্ষকে অনেকবার বলা হয়েছিল, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
এটা শুধু যাদবপুরের ব্যাপার নয়। আমি গ্র্যাজুয়েশন করেছি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। সেখানেও একই অবস্থা। প্রেসিডেন্সির জিওলজি ডিপার্টমেন্টের মধ্যে আমরা যখন ঢুকেছি, তখন কোনো টয়লেট ছিল না। আমরা তারপর বলাবলি করলাম, তখন একটা ঘুপচি মতো ঘর ছিল, পড়ে থাকত, সেটাকে টয়লেট বানিয়ে দেওয়া হল। এবং সেটা যে খুব নতুন ফর্মে টয়লেট সেরকম না। পুরোনো জায়গা। ভীষণ অন্ধকার। কোনো আলো থাকে না। ছিটকিনি দেওয়া যায় না। এরকম হল একবার, ভেতরে ঢুকেছি। ছিটকিনির ভেতরের নবটা খুলে বেরিয়ে এসেছে। কিছুতেই খুলতে পারছি না। চিৎকার করছি। বাইরে থেকে করাত দিয়ে ওই ছিটকিনিটাকে কেটে দরজা খুলে আমাকে বার করতে হয়েছে। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে একটা গার্জেনস মিটিং হয়েছিল। সেই গার্জেনস মিটিংয়ে আমার এক বান্ধবীর বাবা এটা নিয়ে বলেছিলেন যে মেয়েদের কোনো টয়লেট নেই। হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট তখন বলেছিলেন, দেখুন, একটা তো তবু ঘর করে দেওয়া হয়েছে। মেয়েরা তো পড়তই না। মেয়েদের কোনো টয়লেটও ছিল না। মেয়েদের টয়লেটের কোনো ব্যবস্থাই নেই। যেটুকু যা করতে পারা গিয়েছে, তাই হয়েছে।
কিন্তু এগুলো নিয়ে অনেকবার বলা হয়েছে। আমরা যখন যাদবপুরে এমএসসি পড়ি তখন সবাই মিলে হেড অব দি ডিপার্টমেন্টকে গিয়ে বলেছিলাম, ডিপার্টমেন্টে মেয়েদের অন্তত আর একটা টয়লেট করা হোক। দোতলায় বা চারতলায়। এখন আমি দেখেছি একদিন গিয়ে যে মেয়েদের দুটো টয়লেট হয়েছে এবং সেগুলো মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু সেগুলোরও একই সমস্যা। সন্ধ্যের পর তালাবন্ধ, কারণ লাইব্রেরি বন্ধ। আমি যেটা করতাম, সন্ধ্যে হয়ে গেলে কেমিস্ট্রিতে আমার এক চেনা সিনিয়র ছিল, রিসার্চ করত, তার কাছে টয়লেটের চাবি থাকত, সেখানে যেতাম। তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে সেখানে করতাম। সন্ধ্যের পর কোনো ডিপার্টমেন্টের লেডিজ টয়লেটেই যাওয়া যায় না, কারণ সেগুলো তালাবন্ধ থাকে। সেখানে কেবল নিজেদের ডিপার্টমেন্টের মহিলা রিসার্চ স্কলারদের চাবির অ্যাকসেস থাকে।
যাদবপুরে টয়লেটের সমস্যা বিশাল সমস্যা।
Leave a Reply