শমীক সরকার
ছাত্র অবস্থায় হস্টেলে থাকার স্মৃতি কেউ ভোলে না। আমরা যারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে থাকতাম, তারাও ভুলিনি। দিন কয়েক, কি কারোর কারোর ক্ষেত্রে কয়েক মাস লাগত হস্টেল-জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে। আমাদের ব্লকে কার্তিকদা, আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো, কিন্তু অ্যাকাডেমিকালি আমাদের জুনিয়র, ইলেকট্রিকালে ভর্তি হয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার কোনো এক মিশন স্কুল থেকে এসে। হস্টেলে মানিয়ে নিতে ওর লেগেছিল বছর দুয়েক। তারপর হস্টেলের একজন হয়ে কী মজায় যে দিন কাটত, তা যারা হস্টেলে না থেকেছে তারা বুঝতেও পারবে না। পরীক্ষার (ক্লাস টেস্ট বা সেমেস্টার) আগে রাত জেগে দিন জেগে অনেকে মিলে নোটস আর বই পড়া হত। কেউ কেউ যে একলা একলা পড়ত না তা নয়। তবে সবাই মিলে পড়ে, বেশিরভাগ জিনিসগুলোই পরিষ্কার করে নিয়ে, পরীক্ষার কিছুক্ষণ আগে যখন চানটান করে বেরোনো হত, তখন মনে হত পড়াশুনো কত সহজ। উচ্চমাধ্যমিক/মাধ্যমিকে কী গাঁতিয়ে না পড়েছি। তার কোনো দরকারই নেই। দু-একজন পকেটে চোতা নিয়ে যেত, কিন্তু যত না নিয়ে যেত, তার চেয়ে চোতার গল্প ছড়াত বেশি। অনেক ডে-স্কলার পরীক্ষার আগে কম্বল বালিশ নিয়ে হস্টেলের কোনো বন্ধুর ঘরে আস্তানা গাড়ত। পোশাকি নাম, গেস্ট। তবে পরীক্ষা তো ব্যতিক্রম, বেশিরভাগ দিনই মজা। আমাদের হস্টেলে ভাঁড়ু (রাজদীপ) বা পারো (পরিতোষ) বলত, মস্তি। সন্ধ্যেবেলা ক্যাম্পাস থেকে ফিরে অনেকে মিলে জমিয়ে আড্ডা মারা, একসাথে কখনো কখনো সিনেমা দেখতে যাওয়া নবীনা বা নিউ-এম্পায়ারে, টোয়েন্টি নাইন খেলা — এসব করে সন্ধ্যে-রাতটা কাটানো, তারপর দশটা নাগাদ ডাইনিং-এ মিলটা খেয়ে ফের আড্ডা। কখনো বা অন্য ব্লক বা ফ্লোরে গিয়ে আড্ডা। তারপর একটু রাত হলেই কয়েকজন মিলে টিটি (টেবিলটেনিস) রুম। রাত আড়াইটে তিনটে অবধি ঘাম ঝড়িয়ে টিটি খেলে, ভোররাতে হস্টেলের সামনের চায়ের দোকানটা যখন সবে খুলেছে, সেখানে এক কাপ চা-বিস্কুট খেয়ে রুমে ফিরে ঘুম। সেই ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা সাড়ে ন-টা বেজে যেত। তবে অনেকেরই রুটিন এরকম নয়, অনেকেই রাতে খেয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ত। সকালে উঠত। কাগজটা মন দিয়ে পড়ত। একটু বই খুলে বসত। হস্টেল মানে বিচিত্র ধরনের ছাত্রের সমাহার — এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, বিপরীতের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান। মানিয়ে চলার শিক্ষা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের এই চিত্রটায় খানিক চিড় ধরা শুরু হয়েছিল নয়ের দশকের শেষ বছর থেকেই, যখন কম্পিউটার কেনা শুরু করল আবাসিকরা। গোটা ফ্লোরে হয়তো একজনের টেবিলে কম্পিউটার আছে। সেই কম্পিউটারের দুর্নিবার আকর্ষণ। কম্পিউটারওয়ালা ছাত্রটি একটি আকর্ষণের কেন্দ্র অন্য আবাসিকদের কাছে। তার কাছে অনুরোধ করে কেউ সদ্য শেখা সি প্রোগ্রাম কম্পাইল করে নিচ্ছে। আস্তে আস্তে কম্পিউটারের দাম কমতে লাগল। ঘরে ঘরে কম্পিউটার ঢুকল, তারপর প্রতিটি বেড-লাগোয়া টেবিলে কম্পিউটার, অর্থাৎ ঘরে চারটি …। ২০০৫-০৬ সালে শুনতে পেলাম জুনিয়াররা বলছে, যাদবপুর হস্টেল এখন একদম বদলে গিয়েছে। এখন যে যার নিজের কম্পিউটারে ব্যস্ত। আড্ডা কমে গিয়েছে। একসাথে পড়া-খেলাও অনেক কমে গিয়েছে। কম্পিউটারের দুর্নিবার আকর্ষণ। তারপর কর্তৃপক্ষ বন্দোবস্ত করে দিল — প্রতিটি টেবিলে ইন্টারনেট পোর্ট। অবশ্য কর্তৃপক্ষের তোয়াক্কা না করে কেবল সাপ্লায়ারকে ধরে মেন হস্টেলে ইন্টারনেট নেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। কম্পিউটারের চেয়েও আরও আকর্ষণীয় ইন্টারনেটওয়ালা কম্পিউটার। এর মধ্যেই অবশ্য এসে গিয়েছে প্রত্যেকের কাছে একাধিক মোবাইল।
আমাদের সময় ফোন বলতে ছিল হস্টেলের গেটের লাগোয়া দারোয়ানের রুমে একটি ল্যান্ডফোন। সেখানে বাড়ির লোকের ফোন এলে দশ মিনিট পরে ফের ফোন করতে বলে ডেকে দেওয়া হত। তারপর নয়ের দশকের শেষদিকে প্রতিটি ফ্লোরে ল্যান্ডফোন বসানো হল, যেখানে কয়েন/কার্ড দিয়ে ফোন করা যায়। তখন যারা প্রেম করত তাদের খুবই সুবিধে হল। আমরা পুলকিত হয়েছিলাম। হস্টেলেই আমি আমার জীবনের যাবতীয় প্রেমপত্রগুলো পেয়েছি, ডাকযোগে আসা রঙিন খামে প্রেমপত্র — ফ্লোরের ডাক-বক্সে থাকত। আমার বদলে ফ্লোরের অন্য কারোর হাতে পড়লে আওয়াজ খেতে হত খুব। তবে কক্ষনো কেউ খুলত না। অনেকেই ঈর্ষার চোখে তাকাত। তবে ঈর্ষা আরও বেশি হত, আমারও হত, যখন দেখতাম ভাগ্যবান কয়েকজন বিকেলে বা সন্ধ্যেবেলায় গেস্টরুমে প্রেমিকার হাত জড়িয়ে বসে গল্প করত। আমাদের অনেকেরই এটা ছিল স্বপ্ন। আর খোলতাই চেহারার মেয়ে কেউ এলে টোন-টিটকিরিও খেয়ে যেত — বিশেষ করে তার প্রেমিক যদি হস্টেলের একটু ‘ঝাঁটু’ টাইপের কেউ হত। ঝাঁটু অর্থে যে অন্যদের সঙ্গে খোলাখুলি মেশে না খুব একটা, যে রুমে তাস খেলায় বাধা দেয় বিস্তর, যে একটু স্বার্থপর টাইপের। বলাই বাহুল্য, হস্টেলে এই ঝাঁটু টাইপের ছেলের কোনো অভাব হত না কখনো।
হস্টেলের আড্ডার একটি প্রিয় বিষয় ছিল, মেয়ে। মেয়েদের চেহারা, চলন, বলন। অনেকসময় আর্টসের মেয়েরাও বিষয় হয়ে উঠত। আদিরসাত্মক আলোচনায় এতটুকু জড়তা ছিল না বেশিরভাগের। আড্ডায় একটু খোলতাই চেহারার, অথবা স্মার্ট দেখতে মেয়েদের সম্বোধনে মাল, মাগী শব্দগুলো আকছাড় ব্যবহার হত। আমাদের সময় প্রায় সমস্ত ছাত্র মাস্টারবেট করত, লুকিয়ে ফ্লোরের চানঘরে গিয়ে। কেউ কেউ যে বিছানায় লেপ কম্বল বা চাদরের মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বা ঘরের আলোগুলো সব নিভে গেলে করত না, তা নয়। অনেকেরই তাও নাইট-ফল্স হত। তাপস বলে একজন সকালে ঘুম থেকে উঠে একপাটি দাঁত বার করে ‘এই যাঃ কাল রাতেও নাইট ফলস হয়ে গেছে’ বলে উঠেছিল একদিন সবার সামনে। অনেক রুমেই রুমমেটদের মধ্যে এইটুকু খোলামেলা ব্যাপার থাকত। কেউ কেউ হস্টেলের ফ্লোরেও ঘুরত অন্তর্বাস পরে। রুমমেটদের সামনে নগ্ন হয়ে প্যান্ট-অন্তর্বাস বদলাতেও কারোর কারোর বাধত না। সেসময় হস্টেলের বেশিরভাগ ছাত্রেরই কোনো প্রেমিকা ছিল না, বা থাকলেও তার দেশ-গ্রামে বা মফস্বলে। হস্টেলের কোনো ছেলে কলকাতার কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে, এমনটা কমই হত। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেমিকা জুটলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েটিও মফস্বলের, মেয়েদের হস্টেল বা মেস-এ থাকে। কিন্তু কলা বিভাগে পড়া দক্ষিণ কলকাতার মডার্ন মেয়েদের প্রতি হস্টেলের ছেলেদের চোরা টান ছিল বেশ। আবার তাদের ভয়ও পেত ছেলেরা। নয়ের দশকের শেষ ভাগে মেয়েদের মধ্যে টাইট জিন্স এবং টাইট গেঞ্জি পরার চল শুরু হয়ে গেল। এদের প্রতি আমাদের যৌন আকর্ষণ হত বেশি, তেমনি এদের পোশাকজনিত অ্যাটিচুডকে সমঝেও চলতাম। মনে মনে একধরনের রাগও কি হত না? হত। ততদিনে আর্টসে ইতিউতি প্রকাশ্যেই মেয়েদের সিগারেট খাওয়া শুরু হয়ে গেছে। হস্টেলের প্রায় সমস্ত ছেলেরা তাতে বাঁকা চোখে তাকাত, পছন্দ করত না। যদিও তাদের বেশিরভাগই নিজেরা সিগারেট, বিড়ি খেত। আমরা তর্কাতর্কি করে-টরে নারী-সাম্যে মেয়েরাও যে ছেলেদের মতো চাকরি-বাকরি করবে — এতদূর অবধি ভাবতে পারতাম। আমরা হস্টেলের ছেলে, গ্রাম মফস্বলের ছেলে। টাইট জিন্স টপ পরা সিগারেট খাওয়া মেয়ে, আমাদের মধ্যে, তার থেকে অ্যালিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করত। আর একটা কথা, আমাদের ফ্লোরেই একজন গে বা সমকামী ছাত্র ছিল। ফ্লোরের সবচেয়ে সুন্দর দেখতে ছেলেটিকে সে বার তিনেক ‘অ্যাপ্রোচ’ করার পর সুন্দর দেখতে ছেলেটি আমার কাছে এসে কেঁদে ফেলে বলেছিল, আমি খুব ফ্রাস্টেটেড হয়ে পড়ছি। এই ছেলেটি মোটেই গে ছিল না এবং সে বলাই বাহুল্য ওই ‘অ্যাপ্রোচ’ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। আমরা ফ্লোরের মধ্যেও যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারা ওই গে বন্ধুটির বিষয়ে কানাঘুঁষো করতাম, কিন্তু খোলাখুলি এ নিয়ে কথা কখনো হয়নি, এমনকী নিজেদের মধ্যেও না। আমরা বাকিরা বুঝতে পারলেও, মনে মনে স্বীকার করতাম না যে একজন গে হয়েও বাঁচতে পারে, জীবন কাটাতে পারে। সে হয়তো নিজেও ভাবত না। তবে তার প্রতি আমাদের সহানুভূতি ছিল। আমাদের সময় পর্ণোগ্রাফিক ছবি/গল্পের বই লুকিয়ে লুকিয়ে বেডের তলায় রেখে দিত কেউ কেউ। পর্ণোগ্রাফিক ভিডিও দেখা মানে পুজো বা গরমের ছুটির মধ্যে যখন হস্টেলে ছেলেপুলে কম থাকে, তখন হস্টেলের কমন রুম থেকে তালা খুলে টিভিটা ফ্লোরে কোনো ঘরে নিয়ে এসে ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে অনেকে মিলে দেখা — তা ওই বছরে এক-দুদিন। কিন্তু ব্যাপক উৎসাহ ছিল এসবে। পরে রুমে রুমে কম্পিউটার আসার সঙ্গে সঙ্গে পর্ণোগ্রাফিক ভিডিও দেখা অনেক সহজ হয়ে গেল। মোবাইল টোবাইল আসার পর ছেয়ে গেল। আমাদের সময় একা একা পর্ণোগ্রাফিক ভিডিও দেখার চল ছিল না। হস্টেলে একা একা এই ভিডিও দেখা বা মদ/গাঁজা খাওয়াকে খারাপ চোখে দেখত ছাত্ররা। একা একা কেউ এসব করছে মানে সে আসক্ত, এবং সেটা খারাপ — এই রকম একটা ধারণা ছিল।
প্রেম নিয়ে হতাশা ছাড়াও হস্টেলের সিনিয়র ছাত্রদের মধ্যে, বিশেষ করে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রদের মধ্যে চাকরি না পেলে হতাশা তৈরি হত। এমনিতেই প্রথম দিকে ক্যাম্পাসিং-এ আসা কোম্পানিগুলোতে পেত ডে-স্কলাররা, যারা চলনে বলনে আমাদের হস্টেলারদের থেকে অনেক স্মার্ট, বেশিরভাগ সময়তেই যাদের অ্যাকাডেমিক রেকর্ডও ভালো, ইংরেজি বলতে পারে গড়গড় করে। পরের দিকে হস্টেলাররা চাকরি পেতে শুরু করত। ফ্লোরে কেউ চাকরি পেলেই মোচ্ছব লাগত, সকলে মিলে যাওয়া হত ঢাকুরিয়া স্ন্যাক্স বা উষা কারখানার (অধুনা সাউথ সিটি) উল্টোদিকের ধাবায়, কখনো একটু দামি দোকান ‘রানা’য়। খরচ, যে চাকরি পেয়েছে তার — বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেস যে চালাচ্ছে তার কাছ থেকে ধার করে। সেদিন মেস-এ আমরা কেউ খাব না। তবে হস্টেলের সবাই যে চাকরি পেত ক্যাম্পাসিং-এ, তা নয়। একটু গোঁজ হয়ে থাকত তারা। গুটিয়ে যেত। (এটা অবশ্য আমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কথা বলছি। আর্টস বা সায়েন্সে পড়া শেষ হতে না হতেই চাকরি পাওয়ার এত চল ছিল না)। খেয়াল করে দেখেছি, র্যাগিং-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ করত তাদের কেউ কেউ। অনেকেই হস্টেলের সহজ জীবনযাপন ছেড়ে দিয়ে ‘সিরিয়াস’ হয়ে যেত। তারপর যদি চাকরিটা পেয়ে যায়, আর পায় কে!
আমাদের সময় অনেকেই কোর্স কমপ্লিট হওয়ার পরেও হস্টেলের বেড দখল করে থেকে যেত দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। যাদের চাকরিতে জয়েনিং দেরিতে, তারা তো এভাবেই থাকত। কলকাতায় চাকরি হলে, জয়েন করার পরও অফিসে যাওয়া আসা করত হস্টেল থেকেই। বিনিময়ে মাঝেমধ্যেই দাশগুপ্ত থেকে মদ এনে খাওয়াত রুমের বাকিদের। তারপর একদিন হস্টেলের মায়া কাটিয়ে ঘর ভাড়া নিয়ে চলে যেত। মাঝেমধ্যে চাকরি পেয়ে যাওয়া সিনিয়াররা এলে মদ খাওয়ার ধূম লাগত। পোশাকি নাম পার্টি দেওয়া। হস্টেলের ছাদে হত পার্টি। হস্টেল ছেড়ে চলে যাওয়া সিনিয়রদের প্রতি জুনিয়রদের ভালোবাসা আমার হস্টেল জীবনের একটা দাগ কেটে যাওয়ার মতো ব্যাপার।
আর হ্যাঁ, হস্টেলে প্রচুর পার্মানেন্ট গেস্ট থাকত। অর্থাৎ যারা বোর্ডারশিপ পায়নি, বাড়ি ততটা দূরে নয় বলে তারা হস্টেলেই থাকতে চায়। আমি আর রাজদীপ সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে সি ফরটিনে আমার খাটটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, আমাদের বন্ধু ওই রুমের বোর্ডার সুমিতের বদান্যতায়। তারপর টানা একবছর ওই একটি সিঙ্গল খাটে গায়ে গা লাগিয়ে শুয়েছি আমরা দু-জন। পরে একটি বেড ফাঁকা হতে রাজদীপ সেখানে চলে গেল। হস্টেলে নতুন ছাত্রদের রুম অ্যালোকেশনে হস্টেলের মেস কমিটির (প্রতি ফ্লোরের এক বা দু-জন বোর্ডার প্রতিনিধি নিয়ে তৈরি, এই কমিটিই মেস চালাত) সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। যে রুমে পার্মানেন্ট গেস্ট আছে, তার অফিসিয়ালি খালি বেডটি দেখানো হত না-খালি বলে। পার্মানেন্ট গেস্টরা গেস্ট কুপন কেটে মেসে খেত, বোর্ডারদের চেয়ে একটু বেশি দাম দিয়ে। বেড চার্জ, ইলেকট্রিসিটি চার্জ এত কম ছিল যে গেস্টরা যে সেগুলো শেয়ার করছে না তা নিয়ে বোর্ডারদের মাথাব্যথা থাকত না। নিরানব্বই সালে আমরা পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর শুনেছি আস্তে আস্তে পার্মানেন্ট গেস্ট প্রথা উঠে যায়। পরে এমনকী টেম্পোরারি (পরীক্ষার সময়) গেস্ট প্রথাও উঠে যায়। ততদিনে ছাত্রদের ‘লাগেজ’ অনেক বেড়ে গেছে। কম্পিউটার, মোবাইল …। হয়তো একটা রুম চারজনের জন্যেই অপ্রতুল হয়ে উঠেছে। বেড চার্জ, ইলেকট্রিসিটি চার্জও একটু বেড়েছে ২০০০ সাল থেকে। তবে আমাদের সময় প্রতিটি ফ্লোরেই এক-দুটি রুম ছিল এরকম গেস্ট ভর্তি — যাকে বলে বারোভূতের জায়গা। আমাদের ফ্লোরে ছিল আমাদের রুম সি ফোরটিন আর সি টেন। আমরা সি ফোরটিনে একসময় পাঁচটা বেডে আটজনেও থেকেছি। গেস্টরা মেসে না খেলে বোর্ডারদের কেউ কেউ আওয়াজ দিত বটে, তবে ওইটুকুই। মেস চালাত মেস কমিটি মনোনীত ব্লকের কোনো দু-জন বোর্ডার, এক মাসের জন্য এক-জোড়া বোর্ডার। হিসেবে কারচুপি হলে তা ধরা পড়ত, মাসিক মেস চার্জ বেড়ে যেত — তখন হস্টেলে জিবি বা সাধারণ সভা বসত কমন রুমে। একবার একজন হাতে-নাতে ধরা পড়ায় তার জরিমানা হয়েছিল বেশ কয়েক হাজার টাকা। আমাদের হস্টেলবাসের শেষ দিকে হল কি, কোনো বোর্ডার মেসের দায়িত্ব না নিতে চাওয়ায় মেস স্টাফরা মেস চালানো শুরু করল। আসলে মেস চালানো বেশ শক্ত কাজ — ব্লকের দু-চারজন সেটা ঠিকঠাক পারত। বাকিদের ঠকিয়ে দিত দোকানদাররা, অনেকসময় মেস স্টাফরাও (এরা কিন্তু কেউই পার্মানেন্ট স্টাফ নয়, ক্যাজুয়াল হিসেবে চিরস্থায়ী)। ওই যারা ঠিকঠাক পারত, তারা হিসেবে কারচুপিও করত অনেক সময়। মাসে একদিন হত আইডি, অর্থাৎ ইমপ্রুভড ডায়েট, বাংলায় ভুরিভোজ। সারা মাসের গেস্ট কুপনের টাকা এভাবে খরচ করা হত। অন্যান্য দিন খাবার যথেষ্ট সাধারণ, সকালে ডাল, একটা তরকারি আর ছোট্ট রুই মাছের একটি টুকরো দিয়ে ঝোল। রাতে ডাল, তরকারি, প্রায় দেখা যায় না এরকম দু-টুকরো মুরগির মাংস দিয়ে ঝোল। বৃহস্পতিবার রাত্রে নিরামিষ, দই। রবিবার রাত্রে ডিম। বিশেষ করে সকালের খাবারটা খেতে বসে মুখ দিয়ে ওয়াক উঠে আসত আমার। রোজ।
হস্টেলের মজা আরও বেড়ে যেত ছুটির সময়। পুজোতে এবং সেমেস্টার পরীক্ষার পরে আমাদের অনেক দিন ছুটি থাকত। এখন সে সব ছুটি অনেক কমে গেছে। তো সেই ছুটিতে হস্টেলের অনেকে বাড়ি চলে যেত। কয়েকজন থেকে যেত। কেউ থাকত, বাড়ি যেতে ভালো লাগত না বলে, বা বলা ভালো, হস্টেলে থাকতে বেশি ভালো লাগত বলে। কেউ থাকত বাধ্য হয়ে, আগের সেমেস্টারের কোনো কোনো পেপারে হয়তো পাশ করতে পারেনি, সাপ্লি পরীক্ষা দিতে হবে। তার প্রস্তুতির জন্য। অনেকে আবার দু-তিন দিনের জন্য বাড়ি গিয়ে ফিরে আসত। আমি ছিলাম এই শেষ দলে। যাই হোক, ছুটি শেষ না হলে তো মেস চালু হবে না। তাই আমরা তখন নিজেদের রুমে হিটার লাগিয়ে রান্না করতাম। হয়তো একটা ফ্লোরে একটা কি দুটো ঘরে রান্না হচ্ছে — ফ্লোরে যারা আছে, তারা সবাই সেখানে খাচ্ছে। কেউ বাড়ি থেকে আনত বাড়ির ধানের চাল, হস্টেলের পুকুর থেকে মাছ ধরা হত ছিপ কিনে এনে — তেলাপিয়া উঠত বেশি। সেগুলো ভাজা করা হত। আরও কত উদ্ভাবনী পদ। প্রতিদিন পিকনিক। এই ছুটির সময় হোস্টেলে যারা থাকত, তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও অনেক গাঢ় হয়ে উঠত। নতুন বন্ধু-গ্রুপ তৈরি হয়ে যেত। মনে আছে, চাকরি পাচ্ছে না বলে প্রস্তুতির জন্য ছুটিতে বাড়ি না গিয়ে হস্টেলে থেকে গিয়ে ভালো ছেলে, অ-মিশুকে, গাঁতু ফাদার সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল ফোর্থ ইয়ারের শুরুর দিকে।
হস্টেলে র্যাগিং হত বেশ ভালো পরিমাণে। প্রতিটি ফ্রেশারকে র্যাগিংয়ের মুখোমুখি হতে হত। সবচেয়ে কমন এবং নির্বিষ র্যাগিং ছিল রুমের চারটে খাবার জলের বোতল একাধিক বার ভরে আনতে মেস সংলগ্ন পানীয় জলের কলে পাঠানো। এছাড়া ছিল সিনিয়রদের ওয়ার্কশপ/ল্যাবের খাতা লিখে দেওয়া, ড্রইং লাইট ট্রেসিং। কখনও কখনও অনেকে মিলে কথার প্যাঁচে ফেলে তেড়ে বকে জুনিয়রকে মানুষ করা হত। এমনকী গায়ে হাতও তোলা হত অনেক সময়। তবে সিনিয়রদের মধ্যেই কেউ কেউ জুনিয়রকে কোনো কোনো দিন বাঁচিয়ে দিত অন্য সিনিয়রদের র্যাগিং থেকে, ছলে বলে কৌশলে। একজন জুনিয়রকে হস্টেলের কেবল একজন সিনিয়রই র্যাগিং করত না, হ্যাঁ, নীতিগতভাবে — সে হল ওই জুনিয়রের হস্টেলের ‘বাবা’। ফ্রেশাররা হস্টেলে প্রথমে ঢুকত সাধারণত কোনো আগে থেকে চেনা সিনিয়রের হাত ধরে গেস্ট হয়ে। সে হত ‘বাবা’। অফিশিয়ালি বোর্ডার হতে সময় লাগত কয়েক মাস। আগে বোর্ডারশিপ নিয়ে তারপর যারা হস্টেলে আসত, তাদের কোনো ‘বাবা’ থাকত না। তাদের ওপর অত্যাচার অসহযোগিতা হত একটু বেশি। তবে হস্টেলের ঝাঁটু ছেলেটা কোনো ‘বাচ্চা’ নিয়ে এলে তার ওপর র্যাগিং হত একটু বেশি। হস্টেলে হিন্দু-মুসলমানে কোনো দ্বেষ-মনকষাকষি আমার নজরে পড়েনি। কাউকেই হস্টেলে খুব একটা ধর্ম-পালন করতে দেখিনি, ক্কচিৎ এক-দুজন ছাড়া। তবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য, এমনকী দার্জিলিং থেকেও যারা আসত, সোজা কথায় যারা মঙ্গোলয়েড ছিল বা আমাদের ভাষায় চ্যাং — তাদের সঙ্গে হস্টেলের বাকিদের খুব একটা বন্ধুত্ব হত না। প্রতিটি ফ্লোরেই একটা-আধটা রুম নিয়ে তারা থাকত নিজেদের মতো। একবার তো এ ব্লকে চ্যাং-দের সদলবলে মারতে গেল বাঙালিরা। ইউনিয়নের প্রাক্তন এজিএস সুগৌতম বাঙালিদের ওপর রঙবাজি করে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করেছিল, তাই নিয়ে তার ওপর সকলের সে কী রাগ! আমরা ইউনিয়ন করতাম যারা, তাদের বেশিরভাগই হোস্টেলে র্যাগিংয়ের বিরোধিতা করতাম সোজাসুজি। তবে বেশিরভাগ সময়েই হস্টেলের সিনিয়ররা আমাদের মতো ইউনিয়ন নেতাদেরও খুব একটা পাত্তা দিত না, সোজা মুখের ওপর বলে দিত, ওসব নেতাগিরি ক্যাম্পাসে করবি, এখানে না। তবে সাধারণভাবে হস্টেলে একটা ব্যাপারে ঐকমত্য ছিল, জুনিয়রদের ওপর একটু আধটু র্যাগিংও যদি না হয়, তাহলে তারা সিনিয়রদের পাত্তাটুকুও দেবে না। অনেকে আমাদের মতো ইউনিয়ন নেতাদের দোষারোপ করত কোনো জুনিয়রের জুনিয়রত্ব কাটতে না কাটতেই পাখা গজিয়ে যেতে দেখলে। তবে আমরা ইউনিয়ন নেতারা কি এক্কেবারেই কোনো র্যাগিং করতাম না? আমার ধারণা আমরা প্রত্যেকেই করতাম। সচেতনতা তার মাত্রাটাকে খুব কমিয়ে দিতে পারে, কিন্তু অভিভাবকত্বের সমাজলালিত অভ্যেসটা থাকে চামড়ারও নিচে। তাকে ডলে তুলে ফেলা প্রায় অসম্ভব। অনেক সময় হয়তো বুঝতেও পারতাম না যে, আমাদের কোনো একটা আচরণ আসলে র্যাগিং। র্যাগিংয়ের মুখে পড়ে হস্টেল থেকে চলে গেছে, আমাদের সময়ের এরকম উদাহরণ আমার মনে পড়ছে না। তবে র্যাগিংয়ের ভয়ে হস্টেলে বোর্ডারশিপের অ্যাপ্লাই করেনি, বাড়ি ভাড়া করে থেকেছে, এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি রয়েছে।
আমরা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই র্যাগিং নিয়ে অনেক হইচই হয় সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। কেন্দ্রীয় সরকার একটি কমিশন তৈরি করেছিল, তারপর সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে বলে দেয়, র্যাগিং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রথম কয়েক বছরেই দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জানিয়ে দেয়, র্যাগিংয়ের কেসে শাস্তি না দিলে বিশ্ববিদ্যালয়টিই শাস্তি পেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়ো বড়ো ফ্লেক্স টাঙানো হয় একথা জানিয়ে যে র্যাগিং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ তৈরি করে অ্যান্টি র্যাগিং সেল — পদাধিকার বলে ইউনিয়নের নেতারা তার সদস্য। রাজ্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তৎকালীন ধামাধরা ছাত্র সংগঠন এসএফআই (যারা কলা বিভাগে বেশ ক্ষমতাশালী ছিল), আমাদের সময়ে পোস্টার লিখত, ‘র্যাগিং একটি সামাজিক ব্যাধি’, পরে লিখতে শুরু করল, ‘র্যাগিং একটি সামাজিক অপরাধ’। কর্তৃপক্ষও নড়েচড়ে বসে, র্যাগিং প্রসঙ্গে খুব কড়া হয়ে যায়। এমনকী একবার ২০০৬-০৭ নাগাদ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিয়ন, যাদের র্যাগিং বিষয়ে দীর্ঘকালীন অবস্থান ছিল — র্যাগিং খুবই খারাপ জিনিস, কিন্তু র্যাগিংয়ে অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়ার যোগ্যতা নেই কর্তৃপক্ষের, কারণ সেটাও র্যাগিং, আরও বড়ো র্যাগিং, তাকে শাস্তি দেবে হস্টেলের ছাত্ররাই — তারা অবধি র্যাগিংয়ে দোষী প্রমাণিত একজন আবাসিকের কর্তৃপক্ষীয় শাস্তির বয়ানে সই করে চলে আসে। তা হস্টেলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল বলে শুনেছি। তারপর থেকে প্রায় বছরই দু-একজন করে হলেও ছাত্র র্যাগিংয়ের দায়ে কর্তৃপক্ষীয় সাজা পায় বলে শুনি। ২০১৩ সালে একবার তার প্রতিবাদ হয়েছিল, উপাচার্য ঘেরাও অবধি হয়েছিল। কিন্তু সাজা আটকানো যায়নি। তাছাড়া, ওই ঘটনাটিতে উত্তর-পূর্বের একটি ছাত্রের ওপর চড়াও হয়েছিল বাঙালি ছাত্ররা, অর্থাৎ যার অভিঘাত র্যাগিংয়ের চেয়েও গুরুতর। সে সময়টাতেই দার্জিলিংয়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে ক্ষণস্থায়ী হলেও জোয়ার এসেছে, আর কলকাতা থেকে মিডিয়া ও বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলগুলো সকাল সন্ধ্যে মুন্ডুপাত করছে তাদের।
উপাচার্য ঘেরাওয়ের কথা থেকেই আসি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন এবং তাতে হস্টেলের অংশগ্রহণের কথায়। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, গত দু-তিন দশকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষবিরোধী গণ ছাত্র আন্দোলন যত হয়েছে, সম্ভবত তার দশ শতাংশও দেশের আর কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। প্রতি বছর অন্তত একবার করে উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্থা এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল (সংক্ষেপে ইসি। উপাচার্য রেজিস্ট্রার ছাড়াও এই সংস্থার সদস্যদের সিংহভাগ জুড়ে থাকত নির্বাচিত বা মনোনীত শিক্ষক শিক্ষিকা কর্মচারী ও অফিসাররা। তৃণমূল জমানা আসার আগে ছাত্র ও গবেষকদেরও নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকত।) এর সামনে স্মারকলিপি প্রদান, বিক্ষোভ, ঘেরাও, অনশন, এমনকী সারারাত ঘেরাও পর্যন্ত হয়েছে। হস্টেল অংশগ্রহণ করত ওই সারারাত ঘেরাওয়ের প্রসঙ্গ উঠলে। হস্টেলের অংশগ্রহণ মানে সাধারণত আবাসিকদের দশ শতাংশের শারীরিক অংশগ্রহণ, আর বাকিদের মানসিক — হস্টেল থেকে যারা গেল, তারা ঠিকঠাক আছে তো! আর তাতেই রাতের ঘেরাও সরগরম। তবে আন্দোলনের চেয়েও হস্টেল-জীবন ছিল অনেক বেশি প্রাণবন্ত। হস্টেলের অংশগ্রহণে আন্দোলন সেই প্রাণ পেত। সংঘবদ্ধতার আঁতুড়ঘর হস্টেল ছিল ছাত্রশক্তির প্রাণভোমরা।
হস্টেল মানে সংঘবদ্ধতা এবং তার প্রকাশ। হস্টেলের কারোর গায়ে হাত পড়লে প্রয়োজনে সারা হস্টেল বেডের লোহার রড খুলে বেরিয়ে আসবে। আমাদের সময়ে একবার ট্যাক্সি করে এসে বাইরের দু-জন গুণ্ডাপ্রকৃতির যুবক এ ব্লকের একজনকে মেরে ট্যাক্সি নিয়ে পালাচ্ছিল। গেটে দারোয়ান ট্যাক্সি আটকালে চালক ও ওই দুজন পালিয়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়িটা আক্ষরিক অর্থে টুকরো টুকরো করে ফেলে হস্টেলের জনতা। এই সংঘবদ্ধতার মাশুলও দিতে হয়নি কখনো তা নয়। একবার হস্টেলের এক্কেবারে পাশের পাড়া পোদ্দারনগরের তিনচারতলা ফ্ল্যাটের কোনো যুবতী মহিলাকে উদ্দেশ্য করে হস্টেলের কোনো ছাত্র ফ্লোর থেকে লিঙ্গ দেখানোর প্রতিক্রিয়ায় পোদ্দারনগরের বাসিন্দাদের কয়েকজন হস্টেলের কয়েকজন ছাত্রকে বাইরে চা খেতে গেলে মারধোর করে। ব্যস্, শুরু হয়ে যায় আমাদের হস্টেল লাগোয়া যাদবপুর থানা ঘেরাও এবং তার সামনে পথ অবরোধ, সকালবেলা অফিসটাইমে। কমবেশি হস্টেলের অনেকেই উপস্থিত। মধ্যস্থতা করতে এসেছেন রেজিস্ট্রার রজতবাবু এবং তাঁর অফিসের কয়েকজন কর্মচারী। কিন্তু মিটমাট হল না। আমাদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করল পুলিশ, ভালোরকম আহত হল বহু আবাসিক, পা কেটে মাংস বেরিয়ে গিয়েছিল আমাদের ফ্লোরের সৌমেনের। আমরা সবাই কমবেশি পুলিশের মার খেয়েছিলাম সেদিন। পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলাম হস্টেলের মধ্যে। গেট আটকে তালা দিয়ে দিয়েছিল দারোয়ান, রেজিস্ট্রারের পারমিশন ছাড়া পুলিশ কেন, পুলিশের বাবারও অধিকার ছিল না হস্টেলে ঢোকার। এবং বলাই বাহুল্য রেজিস্ট্রার পারমিশন দেননি। বরং তাঁর অফিসের কর্মীরা পুলিশের আক্রোশ থেকে আমাদের কাউকে কাউকে বাঁচিয়েছিল, আড়াল করে হস্টেলের গেটের মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। না ঢুকতে পেরে, পোদ্দারনগরের জনতার সমভিব্যাহারে হস্টেলের তালা দেওয়া লোহার গেটে ভুঁড়ি ঠেকিয়ে যাদবপুর থানার ওসি রিভলবার বের করে আমাদের দিকে তাক করে তুই তোকারি করে শাসিয়ে চলল, গুলি ঠুসিয়ে দেব। আর থাকতে না পেরে তার দিকে তেড়ে গেল এ ওয়ান ব্লকের হুলো, মার্ দেখি! আমি, দারোয়ান, রেজিস্ট্রার অফিসের লোকজন মিলে তাকে সামলাতে পারি না। ২০০৫, ২০১০ বা এবারের মতো প্রশাসনের ‘ফোর্সফুল রিমুভাল’ নয়, ওই মারে ছিল যাদবপুর থানার লাঠি-বন্দুকধারী পুলিশদের প্রতিহিংসার আক্রোশ। সময়ে সময়ে হস্টেল থেকে পুলিশ কোয়ার্টারের যুবতীদের দিকেও চোখাচোখা যৌন গালাগাল ভেসে যেত যে! বেকায়দার বিষয়, তাই ইউনিয়ন থেকে ওই মারের কোনো প্রতিবাদ-টতিবাদ আর আমরা করতে যাইনি। ক্যাম্পাসও সরগরম হয়নি। পরেরদিন প্রিন্ট মিডিয়া ধুয়ে দিয়েছিল আমাদের (তখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তেমন রমরমা ছিল না, থাকলে কী যে হত!)। ডে স্কলারদের অনেকেই কাগজে পড়ে ঘটনাটা জেনে পরদিন আমাদের কী হয়েছে জিজ্ঞেস করেছিল — মোবাইল ছিল না, তাই খবর চালাচালি অত সহজে হত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ/শাসকদলের ক্যাডারদের মারের প্রসঙ্গ আসলেই ১৯৯৪, ১৯৯৮-৯৯, ২০০৫, ২০১০ এবং এবারের কথা — এমনকী সেই কোন যুগের ১৯৭৮-এর কথাও, আসে বা আসবে। কিন্তু ১৯৯৯-এর ওই ঘটনার কথা কখনো আসে না বা আসবে না। কারণ ওটার বিষয়টা প্রগতিশীল কিছু ছিল না, না জানা বা ভুলে যাওয়াই নিরাপদ।
পরে দু-এক রাত কলেজ স্ট্রিটের হিন্দু হোস্টেলে বা কয়েক সপ্তাহ খড়্গপুর আই আই টি-র হস্টেলেও থেকে দেখেছি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের সঙ্গে সেগুলোর মিল যেমন আছে, থাকারই কথা, তেমনি ফারাকও আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ‘মস্তি’ অনেক বেশি। চাপ নেই।
চাপ নিতে নেই — এটা বোধহয় ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আমাদের সময়ের এবং তার পরবর্তী বছরগুলির মূল জীবন দর্শন। এখনও মনে হয় তাই আছে। চাপ না নেওয়ার মানসিকতা — ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (সবচেয়ে বড়ো ফ্যাকাল্টি) সবচেয়ে বেশি, সায়েন্সে (সবচেয়ে ছোটো ফ্যাকাল্টি) সবচেয়ে কম। হস্টেল যেমন গ্রাম মফস্বলের ছেলেতে ঠাসা, ক্যাম্পাস তেমনি শহর কলকাতা ও তার আশেপাশের ছাত্রদের বিচরণভূমি। সাউথ পয়েন্ট, সেন্ট জেভিয়ার্স, পাঠভবন প্রভৃতির নেতৃত্বে শহর কলকাতার নামি নামি সব স্কুল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের রমরমা। আমার পর্যবেক্ষণ, চাপ না নেওয়ার মন্ত্র পড়াত এরা। ‘যাদবপুরে ঢোকা কঠিন, বেরোনো সহজ’, ‘পাশটা করলেই হল, ভালো চাকরি পেতে কোনো অসুবিধে নেই’ — এসব কথা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, সায়েন্সে প্রায়শই শুনতাম। ‘হোম ইউনিভার্সিটি’, তাই সায়েন্স, আর্টসে একবার গ্র্যাজুয়েশনে ঢুকলে রেজাল্ট যাই হোক, মাস্টার ডিগ্রি করা যাবে। অন্যান্য কলেজের বন্ধুরাও বলত, ‘তোদের তো সিকিওর লাইফ, বিশাল সব ব্যাপার’।
ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির সহজ জীবনের অন্যতম কারণ ছিল তার পরীক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের সময়ে — যথেচ্ছ ক্লাস ফাঁকি দিতে পারি। পরীক্ষায় ছড়াতে পারি। কোনোক্রমে পাশ করে গেলেও চলে। বা কোনো বিষয়ে ফেল করলে সাপ্লি দেওয়া যায়, ফের ফেল করে ফের সাপ্লি, যতবার খুশি (পোশাকি নাম ছিল ওয়ান প্লাস এন)। সর্বোচ্চ ছ-টা সাপ্লি রাখা যায় (মোদ্দায় বাংলাটা হল, সর্বোচ্চ ছ-টা বিষয়ে ফেল থাকা যায় চারটে সেমেস্টার মিলিয়ে) — ইয়ারব্যাক হয় না, অর্থাৎ পরের ইয়ারে উঠে যাওয়া আটকে যায় না। বছরে দুটো সেমেস্টার। এক সেমেস্টারে যা পড়ানো হয়, তা সেই সেমেস্টারের পরে আর মনে রাখার দরকার পড়ে না। এক সেমেস্টারে তিনটে ক্লাস টেস্ট। তার মধ্যে যে দুটোতে বেশি নম্বর পেয়েছি সে-দুটোর গড় যোগ হবে সেমেস্টারে প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে। সেমেস্টারের থেকে পঞ্চাশ, আর ক্লাস টেস্টের গড় থেকে পঞ্চাশ (একটু ভুল হল মনে হয়, ক্লাস টেস্টের গড় থেকে পঁয়তাল্লিশ, ক্লাস অ্যাটেনডেন্স পাঁচ) — এই একশোতে পঞ্চাশ পেলে পাশ। এ গ্রেড ৮০ শতাংশের বেশি, বি গ্রেড ৭০ শতাংশের বেশি, সি গ্রেড ৬০ শতাংশের বেশি পেলে। সব সাবজেক্ট মিলিয়ে পঁয়ষট্টি শতাংশের ওপরে পেলে ফার্স্ট ক্লাস। ক্লাস টেস্ট পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাসের মধ্যে, এক বেঞ্চে তিন-চারজন করে বসে দেওয়া যায়, পাশের বন্ধুর খাতাটা আড় চোখে দেখতে কোনো সাহসও লাগে না। একটি ক্লাস টেস্টের আগে যে কয়েক সপ্তাহ ক্লাস হয়েছে, সেই ক্লাসগুলোর রানিং নোটস (বোর্ডে যা লিখবে স্যার, সেগুলো খাতায় লিখে নেওয়া পর পর) থেকেই আসবে প্রশ্ন। সেমেস্টারে আগের তিন চার বছরের প্রশ্নগুলো থেকেই আসবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে — নিশ্চিত। আগের পাঁচবছরের প্রশ্নপত্র ডিপার্টমেন্টাল লাইব্রেরিতেই পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ না করাই কষ্টকর। চুটিয়ে থিয়োরি ক্লাস ফাঁকি দেওয়া যায়। তবে সেশনাল (ল্যাব, ওয়ার্কশপ) ফাঁকি দিলে একটু মুশকিল, ওখানে পরীক্ষা নেই, কিন্তু ক্লাস না অ্যাটেন্ড করলে ফেল করিয়ে দেবে, আর সেশনালে ফেল করলে সরাসরি ইয়ারব্যাক। তবে কেবল অ্যাটেন্ড করলেই ৭০ শতাংশ নম্বর বাঁধা। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়াশুনো করে আসা, অন্যান্য কলেজের দু-বছরে পার্ট ওয়ানের গুরুতর ধাক্কা খেতে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে তুলনা করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ব্যবস্থা তো স্বর্গ। তবুও আমরা প্রথম যাদবপুরে আন্দোলনের স্বাদ পেয়েছিলাম ফার্স্ট সেমেস্টারে আমাদের অনেকে যখন একটা বিষয়, ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিস, তাতে সাপ্লি পেল, একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন আসায়, তার সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের মাধ্যমে। আমাদের সময় চাপ নেওয়ার কিছু ছিল না।
কিন্তু তখন আমরা পাশ করছি বা করে গেছি, যারা প্রথম বর্ষে ঢুকল, তাদের থেকে পরীক্ষা ব্যবস্থা বদলে গেল। পঞ্চাশ পঞ্চাশের বদলে ক্লাস টেস্টের থেকে পঁচিশ, অ্যাটেনডেন্সে পাঁচ আর সেমেস্টারের থেকে সত্তর — এই নিয়ে একশো। ফলে হল কি, সেমেস্টারের গুরুত্ব বেড়ে গেল। তুলনায় নম্বর তোলা অনেক সহজ ক্লাস টেস্টে, তার গুরুত্ব গেল মারাত্মক কমে। ফলে নম্বর তোলা কঠিনতর হল। সেমেস্টার পরীক্ষা দিতে যেতাম আমরা, ‘আস্কিং’ কত তা জেনে, অর্থাৎ সেমেস্টারে একশো নম্বরের পরীক্ষাতে ঠিক কত পেলে আমি পাশ করে যাব তা ঠিকঠাক হিসেব করে নিয়ে। কারণ তার আগেই ক্লাস টেস্টের গড় আর অ্যাটেনডেন্সের নাম্বার (যাতে বেশিরভাগ শিক্ষকই পাঁচে পাঁচ দিয়ে দিতেন, ক্লাস করি বা না করি) আমরা জেনে যেতাম। আমাদের সময় বেশিরভাগ ছাত্রের পাশের আস্কিং থাকত একশোতে তিরিশের কম, যা পাওয়া প্রায় জলভাত। পঞ্চাশের বেশি আস্কিং থাকত যাদের, তাদের কপালে ভাঁজ পড়ত। সত্তরের কাছে বা তার বেশি আস্কিং থাকলে ধরেই নিত সাপ্লি খাচ্ছে। কেউ কেউ এই পরিমাণ আস্কিং থাকলে সেমেস্টার পরীক্ষা দিতেই যেত না। কারণ সাপ্লি তো পাবেই সে। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে হেসে-খেলে আমরা পঁচাত্তর আশি শতাংশ নম্বর পেয়েছি, সেই স্মৃতিও আমাদের আস্থা দিতে পারত না যে আমরা একশোতে সত্তর পেয়ে যেতেই পারি। আবার কেউ কেউ ঘোরতর বুদ্ধিমান। সেমেস্টারে পঞ্চাশের বেশি আস্কিং থাকলে সাপ্লিতে তা কমে পঞ্চাশ হয়ে যায়। তাই কেন খামখা খাটাখাটুনি করে চাপ নিয়ে সেমেস্টার দিতে যাওয়া? একবারে সাপ্লিই তো দেওয়া ভালো। মার্কশিটে কোথাও লেখা থাকবে না কেউ কখনও কোনো সাপ্লি পেয়েছিল কিনা! কিন্তু এসবও বদলে গেল নতুন পরীক্ষা ব্যবস্থায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেমেস্টারে ন্যূনতম আস্কিং দাঁড়াল তিরিশ। পঞ্চাশ ষাট আস্কিং আকছাড় হতে থাকল। সাপ্লির ওয়ান প্লাস এন-এর বদলে প্রথমে এল ওয়ান প্লাস ওয়ান (অর্থাৎ সাপ্লিতে ফেল করলেই ইয়ার ব্যাক), তারপর চিৎকার চেঁচামেচি হওয়াতে কী যেন একটা জটিল নিয়ম হয়েছিল। আর হ্যাঁ, সাপ্লিতে আস্কিং কমে যে পঞ্চাশ হয়ে যেত, তাও বদলে গেল, এবার যা আস্কিং সেমেস্টারে, সেই আস্কিং-ই সাপ্লিতে। অ্যাটেনডেন্সের নাম্বার দেওয়াতেও কড়াকড়ি শুরু হল। তিনটির মধ্যে সর্বোত্তম দুটি ক্লাস টেস্টের নম্বর গড় করার সিস্টেমও আর থাকল না, হল দুটোই মাত্র ক্লাস টেস্ট আর তার গড়। প্রতি সেমেস্টারের মার্কশিটে আমাদের সময় শুধু সাবজেক্টের পাশে এ বি সি লেখা থাকত। একবারে চার বছর পরের ফাইনাল মার্কশিটে থার্ড ইয়ার আর ফোর্থ ইয়ারের চারটে সেমেস্টারের নম্বর যোগ করে বসানো থাকত। এবার নয়া ব্যবস্থায় বোধ হয় মার্কশিটে গ্রেড পয়েন্ট লেখার সিস্টেম চালু হল যাতে করে কীসে কে কত নাম্বার পেয়েছে তাও বোঝা যাবে। ইউনিয়ন থেকে শিক্ষক-কর্তৃপক্ষকে (ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল) বলার চেষ্টা করা হল, ক্লাস টেস্টের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া মানে চলমান মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে আঘাত করা, ছাত্রদের পরীক্ষার জুজু দেখালেই কি সে শিখবে এইসব কথা — কিন্তু কেউ আমল দিল না। ছাত্র আন্দোলনও গড়ে উঠল না, যেহেতু সদ্য আসা ফার্স্ট ইয়াররা ছাড়া কারোর ওপর এটার অভিঘাত পড়ছে না। কিন্তু দু-এক বছরের মধ্যেই কুফলগুলো বোঝা গেল। সাপ্লি, ইয়ারব্যাকের পরিমাণ হুহু করে বেড়ে গেল। কয়েকজন ছাত্র বছরের পর বছর ইয়ারব্যাক পেতে শুরু করল, পরিভাষায় যাকে বলে লুপে পড়ে যাওয়া। আমাদের ক্যাম্পাসে চাপ চলে এল। কি ডে স্কলার কি হস্টেলার — সবার ওপরে চাপ পড়ল। পড়াশুনার চাপ ঠিক নয়, পাশ করার চাপ। বছর নষ্ট না করার চাপ। ২০০০ পরবর্তী এই বছরগুলোতে চাকরির বাজারেও একটু মন্দা যাচ্ছিল, ক্যাম্পাসিং কমে গিয়েছিল। ক্যাম্পাসিংয়ে পেলেও পড়ে ‘রিগ্রেট’ লেটার পাঠিয়ে সফ্টওয়ার কোম্পানিগুলো (বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টেরই বেশিরভাগ চাকরি হত সফ্টওয়ারে) বলে দিচ্ছিল, প্রজেক্ট নেই, নেবে না। সেটারও একটা চাপ ছিল। তবে এই ওঠানামা আগেও বহু হয়েছে।
আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাম্পাসে ইউনিয়ন রুম, টিটি ক্যারাম রুম, গাছতলা, সিইটি ক্যান্টিন, স্টাফ ক্যান্টিন, মাঠ, বাস্কেটবল কোর্ট, ঝিলপাড়, নাথুদার ক্যান্টিন – যেখানে যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের আড্ডা জমে — সেখানে ওই সময়েই বেশ কয়েক বছর ধরে একটা কথা খুব শুনেছি — চাপ নিও না। আরও কায়দা করে কেউ কেউ যে কোনো কথা কাউকে বলতে গেলেই শুরু করত ‘চাপ না নিয়ে’ বলে। কেউ কেউ আবার এগিয়ে বলে ফেলত, চাপ নেওয়ার জিনিস নয়, দেওয়ার জিনিস। এসব কথা আমরা যখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র ছিলাম, তখন যে খুব প্রচলিত ছিল, তা নয়।
চাপের নয়া পরীক্ষা ব্যবস্থা বদলের দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করেছিল। ঘেরাও টেরাও করেছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কান দেয়নি। ঘেরাও ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার পথে চাপের পরীক্ষা ব্যবস্থার মুখ, খিটখিটে পরীক্ষা নিয়ামকের গায়ে দু চড় চাপড় মেরেও দিয়েছিল কেউ কেউ। তার জেরে কয়েকজন ছাত্রনেতার সাসপেনশনের পর তাদের সাসপেনশন প্রত্যাহারের দাবিতে ২০০৫-এর দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলন, অনশন, ছাত্রছাত্রীদের অভূতপূর্ব এবং অসমসাহসী সেমেস্টার বয়কটের সিদ্ধান্ত এবং তা সফল করা। অবশেষে রাতের অন্ধকারে পুলিশ দিয়ে ঠেঙিয়ে অনশন ভেঙে দেওয়া। আজকের প্রতিবাদী অশোকনাথ বসু তখন যাদবপুরের উপাচার্য। অতঃপর রাজপথে প্রতিবাদ এবং কর্তৃপক্ষের নমনীয় মনোভাবের ফলশ্রুতিতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সাসপেনশন ও আন্দোলন — দুয়েরই প্রত্যাহার। পরীক্ষা ব্যবস্থার অবশ্য ইতর বিশেষ বদল হয়নি বলেই জানি।
তবে ওই আন্দোলনের থেকেই জিবি বা সাধারণসভা করে আন্দোলনের খুঁটিনাটি সিদ্ধান্তগুলোও নেওয়ার চল পাকাপাকিভাবে শুরু হয়ে গেল। গণ ছাত্র আন্দোলনে আগেও সাধারণ সভা হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৬ সালে ওপেন এয়ার থিয়েটার দিচ্ছিল না ফ্রেসার্স ওয়েলকাম অনুষ্ঠান করার জন্য। তা সেই আন্দোলন সন্ধ্যের পর যখন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ইউনিয়নের নেতৃত্বদায়ী সংগঠন, তারপর সাধারণ সভা করে ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন-টশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হয়েছিল। আগে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিত নেতৃত্বদায়ী সংগঠন, আর সাধারণ সভা যদি একান্তই হত, তাতে ছাত্রছাত্রীদের সিদ্ধান্তটা মানিয়ে নেওয়ার জন্য হত। সংগঠন (ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিএসএফ) আগে নিজেদের মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে, তারপর ক্লাস রিপ্রেসেন্টেটিভদের ডেকে মিটিং করে তাদের বোঝাবে এবং ক্লাসে গিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দিতে বলবে — এই ছিল সংগঠন। ২০০০ সালের পর থেকেই এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। এক্কেবারে ছাত্রছাত্রীদের সাধারণসভা থেকেই সিদ্ধান্ত উঠে আসবে, তার রেওয়াজ শুরু হয়। আগেই বলেছি, হস্টেলের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে কমন রুমে বা ফ্লোরে জিবি করার চল তো আগেই ছিল। বলা ভালো, প্রতিনিধিত্বমূলক বন্দোবস্তের বদলে ওই সঙ্ঘবদ্ধতার সহজ চর্চাটি এবার ক্যাম্পাসের আন্দোলনেরও সংগঠন হয়ে উঠল। গুরুত্ব কমল নেতৃত্বদায়ী সংগঠনগুলোর। বেশিরভাগ সাধারণ সভায় মোট ছাত্রছাত্রীদের কয়েক শতাংশও হাজির হত না। মোট ছাত্রছাত্রীদের পাঁচ শতাংশের উপস্থিতিতেই সাধারণ সভাটিকে জনসভার মতো দেখতে লাগত। বাকি ছাত্রছাত্রীদের একটা বড়ো অংশের শরীর না থাকলেও কান থাকত সাধারণ সভায়। ছাত্রদের মধ্যে বেশিরভাগই ফাঁকা মাথায় সাধারণ সভায় অংশ নিতে আসত। আবার ছাত্র রাজনীতি করা ছাত্রছাত্রীরা আগে থেকে সাধারণ সভায় কী বলবে না বলবে, সে বিষয়ে খুব ভেবে-টেবে আসত। সাধারণ সভায় তাদের খুব সিরিয়াস উপস্থিতি থাকত, চেষ্টা করত নিজেদের মতটাকে ‘চ্যাম্পিয়ন’ করার। আরও পরে দেখতাম ইউনিয়নের প্রাত্যহিক ব্যাপারস্যাপারগুলোতেও সাধারণ সভার চল হয়েছে, তবে তাতে ছাত্রছাত্রীদের কতটা উৎসাহ থাকত কে জানে। অতি ব্যবহারে এই বন্দোবস্তটি ক্লিশে হয়ে যাচ্ছে কি না বা বিরক্তির সঞ্চার করছে কিনা, সে সন্দেহও আমার মনে উঁকি দিত। এবারে আন্দোলনেও কলা বিভাগ, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বিজ্ঞান বিভাগ এবং সব ফ্যাকাল্টি মিলিয়ে প্রচুর সাধারণ সভা হয়েছে। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং বাইরের সংহতিজ্ঞাপন করা ছাত্রছাত্রীদের নিয়েও একাধিক দিন সাধারণ সভা হয়েছে। তবে সাধারণ সভা বড়ো হয়ে গেলে ক্যাওস হওয়ার কথা এবং শেষমেশ সাধারণ সভা নয়, সেই গুটিকয় নেতা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে — এমন অভিযোগও শুনছি এবার। ক্যাওস হয়, দুটো কি তিনটে পক্ষ চেল্লামেল্লি করে নিজেদের আরগুমেন্টগুলো করতে থাকে, বাকিরা কথা বলার সুযোগ পায় না, তাই ওখানে যাওয়ার কোনো মানে হয় না, তার বদলে কি সিদ্ধান্ত হল শুনে নিলেই হল — ছাত্রছাত্রীদের কারোর কারোর এরকম মতামতের কথা এবারের আন্দোলনের সময় শুনে আমার মনে পড়ল, হস্টেলের সি ব্লকের সাধারণ সভার কথা — প্রসেনজিৎদা (ব্লকের সবাই তাকে সিনিয়র বলে মানে) কনডাক্ট করছে, তার স্বার্থ হল, মোটামুটি সবাই যারা মতামত জানাতে চায়, তারা যাতে বলতে পারে তা দেখা, কোনো মতামতের প্রতিই তার কোনো বিশেষ পক্ষপাত নেই। স্বার্থ হল হস্টেলের সঙ্ঘবদ্ধতার চর্চাটা সজীব রাখা। হস্টেলের কথা ফিরে আসায় একটা কথা বলে দিই, এই হস্টেল জীবনযাপনের মধ্যে থেকেই আমি বুঝতে শিখেছিলাম আদর্শবাদী রাজনীতির সীমা, সীমাবদ্ধতা, এমনকী অন্তঃসারশূন্যতার ব্যাপারটা। হস্টেলে যাওয়ার আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকেই লিফলেট দেওয়াল লিখন পোস্টার ব্যানার পত্রিকা ইত্যাদি পড়তে পড়তে যে আদর্শবাদী রাজনীতির পাঠ নিয়ে নিয়েছিলাম, সক্রিয় অংশ হয়ে উঠেছিলাম সেই প্রথম বর্ষেই। তখনকার দিনে দৈনিক খবরের কাগজ পড়া যে কোনো ‘ভালো’ ছাত্রের মতো আমারও ধান্দার রাজনীতির প্রতি বিরূপতা তো স্কুল জীবন থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
ক্যাম্পাস জীবনেরও অনেক নিজস্বতা রয়েছে। হস্টেলে যত না নেশা (মূলত গাঁজা খাওয়া) করা হত, তার থেকে অনেক বেশি এসবের চল ছিল ক্যাম্পাসে। খুব ধীর কিন্তু একমুখী গতিতে আমি তা বাড়তেই দেখেছি, যদিও মোটের ওপর তা এক শতাংশেরও কম। বেশিরভাগই কিছুদিনের মধ্যেই নেশা ছেড়ে দিত। কিন্তু হাতে গোণা কয়েকজনের থেকে যেত। প্রতি ব্যাচে দু-একজনকে গাঁজা খাওয়া ছাড়ানোর জন্য তাদের বাপ-মায়ের রিহ্যাবে পাঠাতেও দেখেছি। রিহ্যাব থেকে ঘুরে আসার পর হয়তো সে নেশা ছেড়ে দিত, কিন্তু শুকনো নেশার অভিঘাত তার শরীরে থেকে যেত অনেকদিন।
আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির সামান্য কিছু সংখ্যক ছেলে কলাবিভাগের মেয়েদের টোন টিটকিরি করত নিয়মিত। সেই টোন টিটকিরি কলা বিভাগের মেয়েদের মধ্যে (এবং ছেলেদের মধ্যেও) এত গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত যে সেটাই এসএফআই-এর বছরের পর বছর আর্টসের ইউনিয়ন ধরে রাখার অন্যতম পুঁজি ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এসএফআই-এর শক্তি ছিল খুবই সামান্য। সায়েন্সেও তাই। ২০০৫ সালের আন্দোলনের অভিঘাতে ওই বছর আর্টসের ইউনিয়নটিও হারিয়েছিল এসএফআই। তখনও সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম শুরু হয়নি। কংগ্রেস বিজেপি বা টিএমসির কোথাও কোনো সংগঠন ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। অধুনা শুনছি টিএমসির কিছু সংগঠন হয়েছে। এই ফাঁকে বলে রাখি — ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ছেলেসঙ্কুল, মেকানিকাল প্রভৃতি কিছু কিছু ডিপার্টমেন্ট আছে, যেখানে একটিও ছাত্রী পড়ত না বছরের পর বছর। কলা বিভাগে আবার মেয়েদের সংখ্যা বেশি, তবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো এতটা গুরুতর নয় ব্যাপারটা। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছেলেদের হস্টেল ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যুষিত।
এবারের আন্দোলনটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এক বড়ো বদল। প্রথমত, এই আন্দোলন প্রাথমিকভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তুলনায় কলাবিভাগের ছাত্রছাত্রীরা কোনো আন্দোলনে বেশি অংশগ্রহণ করছে, নিবিড়ভাবে অংশগ্রহণ করছে, তা আমি কখনও দেখিনি বা শুনিনি। এছাড়াও এই আন্দোলনের অনেক অত্যন্ত ভালো দিক রয়েছে। আবার, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তুলে তুলকালাম করে দেওয়ার মতো রাজা-উজির মারতে যাওয়ার স্পর্ধা বা মুরোদও কখনো হয়নি আগে। গালমন্দ করা হত স্লোগানে — ওই পর্যন্তই। এত বড়ো ‘মহামিছিল’ও কখনো হয়নি। যথেষ্ট পাতি ছিল ব্যাপারস্যাপারগুলো। ২০০৫ সালের ছাত্র আন্দোলনটা বেশ বড়ো হয়েছিল, নিবিড় হয়েছিল। এমনিতেই মিডিয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় বেশি আলোকপাত করে। সেবার মিডিয়াতে প্রশংসা করে আর্টিক্লও বেরিয়েছিল। (মনে আছে কল্যাণ সান্যাল আনন্দবাজারে উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, সাসপেন্ড হওয়া সহছাত্রদের দিকে তাকিয়ে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের সেমেস্টার বয়কটের মতো সিদ্ধান্তকে কুর্ণিশ করে)। একটা ভিডিও করা হয়েছিল — বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সেটা। ‘লাঠির মুখে গানের সুর দেখিয়ে দিল যাদবপুর’। এমনিতেই গ্ল্যামারের ঠিকানা, ছাত্র আন্দোলনের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও যে একটা বেশ গর্ব করে দেখানোর মতো ব্যাপার — সেটাও পাঁচকান হয়ে উঠল। ওই আন্দোলনের পর, অটোতে একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যাচ্ছি আমি আর ওই আন্দোলনের অন্যতম নেতা অরিজিত, আন্দোলন-জিবি এইসব বিষয়ে আলোচনা করতে করতে। একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, সরকারি অফিসের কর্মী এবং সম্ভবত কো-অর্ডিনেশন কমিটি করেন, আমাদের বিনীতভাবে প্রশ্ন করলেন, জিবি বা সাধারণ সভা করে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অসুবিধার বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তুলে। এমনিতে অত্যন্ত নম্র স্বভাবের অরিজিতের উদ্ধত শুনতে লাগা উত্তরটা আমার চিরকাল মনে থাকবে — ‘ওই যে পাঁচিলটা দেখছেন, তার ওপারে অনেক অন্যরকম ব্যাপার হয়। যা অন্য কোথাও পারা যায় না, তা এর ভেতরে করা হয়’। এবারে তো বিভিন্ন স্লোগানে ‘যাদবপুরের ক্ষমতা’-ও ভালোমতো জাহির করা হয়েছে রাজপথে। ছাত্রশক্তি যাদবপুরের-ক্ষমতা হয়ে শোরগোল তো ফেলেছেই, গোল বাধিয়েও ফেলেছে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলবে। পুরোনো কথা ভাবতে বসে একথাও মনে হয়, সেদিনের আমাদের চাপ না নিয়ে থাকার সাথে এখনকার কর্পোরেট ইউথ-ব্র্যান্ডিং ‘কুল ক্যাজুয়াল কনফিডেন্ট’ খুব কাছাকাছি নয় তো!
পুনশ্চ : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল, ক্যাম্পাস, সাধারণ সভার বিবর্তন নিয়ে আমাকে লিখতে বলা হয়েছিল। ভেবেছিলাম প্রাক্তন নতুন অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে খাটাখাটুনি করে বেশ ভালোমতন একটা যাকে বলে কম্প্রিহেনসিভ লেখা লিখব। এমনিতেই ক্যাজুয়ালি কিছু করা অনেককাল ছেড়ে দিয়েছি, ছাত্রদশা পেরিয়ে যেতে না যেতেই। কিন্তু যাদবপুর নিয়ে লিখতে বসে ওই পুরোনো হাওয়া যেন পেয়ে বসল। কলাবিভাগ বিজ্ঞানবিভাগের ক্যাম্পাস মেয়েদের হস্টেল এসবের বিবর্তন, ক্যাম্পাসে ছেলেমেয়েদের মেলামেশার বিবর্তন, নেশার বিবর্তন, আগে পিছে আরও বড়ো সময়পরিসরে দেখা, সেসব নিয়ে না হয় অন্যরা লিখুক। আমার আন্ডারগ্র্যাজুয়েট হস্টেল আর ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাম্পাস যাপন (১৯৯৫-২০০১) এবং তারপর কয়েক বছর জুনিয়রদের সাথে একটু আধটু যোগাযোগ — তার যতটুকু যা মনে আছে, সেটুকু নিয়েই থাক না হয় এই লেখাটা, যাকে বলে, চাপ না নিয়ে …।
Leave a Reply