রুবাইয়াত বিশ্বাস
সে ছিল একদিন আমাদের
যৌবনে কলকাতা, বেঁচেছিলাম
বলেই সবার কিনেছিলাম মাথা
মাস দুয়েক আগে হঠাৎ করেই এই কবিতাটা মাথায় ঘুরছিল তখন। প্রতি রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে যখনই দেখতাম তিনটে মুষকো লোক বাইক চেপে আসছে পেছনে, তখনই ছ্যাঁৎ করে উঠত বুকটা, মনে পড়ত গত পরশু পুকু বাড়ি ফেরার পথে মার খেয়েছে, মনে পড়ত বারাসাতের উপাসনাকে ওর বাড়িতে আটকে রেখেছে, মেয়ে মাওবাদীদের সাথে ভিড়ে গেছে বলে, মনে পড়ত লোকজন চারধারে বলছে আমরা নাকি স্ক্যানার-এর তলায় আছি, কী বলছি কী ভাবছি কী ভাবছি না সব রাষ্ট্র মাপছে। যখনই এই ভয়গুলো তেড়ে আসত, শঙ্খ ঘোষের কবিতারা চলে আসত ভরসা জোগাতে, আর সাথে আসত ২০ সেপ্টেম্বরের একটা বিকেল, যে বিকেলে শহর কলকাতার মাথা কিনে নিয়েছিল লাখো ছাত্র যুব এবং সাধারণ মানুষের একটা মিছিল, পথ চলতি মানুষ যাকে ‘হোক কলরব’ বলে চিনেছিল।
ঘটনার মূল সূত্রপাত ২৮ আগস্টের রাত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বাৎসরিক ফেস্টের শেষ রাতে। একজন ছাত্রী অভিযোগ করে, তাকে যৌন নিগ্রহ করেছে হস্টেলের কিছু ছাত্র, যখন সে ফেস্টের স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে বাথরুমের খোঁজে যায় তার এক বন্ধুকে নিয়ে। ঘটনাটা কর্তৃপক্ষ চাপা দিয়ে দিতে চায়, এর আগেও এরকম বেশ কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো। কিন্তু যাদবপুর এসব ক্ষেত্রে সবসময়েই রিঅ্যাক্ট করেছে এবং এবারও করে। ২৮ আগস্টের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে। ৩ সেপ্টেম্বর কিছু ছাত্র প্রথম সাধারণ সভা বা জেনারেল বডি মিটিংয়ের ডাক দেয়, যেখানে ছাত্রদের দাবি চার্টার আকারে তৈরি করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর পরবর্তী জিবি-তে এই চার্টার নিয়ে স্টুডেন্টস ডিন-এর কাছে যাওয়া হয় মিছিল করে। ৫ সেপ্টেম্বর আরেকটা মিছিল যাদবপুর থানা অবধি যায় পুলিশের তদন্তের বিষয়ে খোঁজ নিতে। সেই সময় আমাদের জানানো হয় তদন্তের ৭০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে, যদিও পুলিশ তখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যারা ২৮ তারিখ ঘটনাস্থলে ছিল, এমন ২ জনকে নিগৃহীতা চিহ্নিত করার পরও ৬ তারিখ নতুন করে কিছু খবর পাই আমরা। নিগৃহীতা ছাত্রীর বাড়িতে দুজন মহিলা, পরে যাদেরকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি, তারা ৫ তারিখ সন্ধ্যেতে পৌঁছান কোনো আগাম নোটিশ ছাড়াই, নিজেদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্টি-সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেলের সদস্যা হিসেবে পরিচয় দিয়ে। তাঁরা বেশ কিছু আপত্তিকর প্রশ্ন করেন, যেমন, মেয়েটি সে রাতে কী পরেছিল, সে মদ্যপ ছিল কি না ইত্যাদি। আমরা এই জাতীয় প্রশ্ন করার মানসিকতাকে এক ধরনের ভিক্টিম ব্লেমিং বা যার ওপর অপরাধটি সংগঠিত হয়েছে তাকেই দোষ দেওয়া হিসেবে দেখি। ৮ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা মিছিল করে যায় উপাচার্যের অফিসের সামনে। ভেতরে তখন উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং কিছু আইসিসি অর্থাৎ ইন্টারনাল কমপ্লেন্টস কমিটি-র সদস্যরা বসে। ছাত্ররা দাবি জানায় যে ভেতর থেকে কাউকে এসে কথা বলতে হবে এবং খানিক বাদে দশজন মতো গার্ড এসে জোর করে বের করে নিয়ে যেতে চান আইসিসি-র সদস্যদের। কিন্তু দুশো জন মতো ছাত্র থাকার ফলে তা সম্ভব হয় না। ধস্তাধস্তি হয় এবং আমাদের বেশ কিছু বন্ধু স্রেফ ব্যারিকেড করতে গিয়ে মার খায়। পরদিন এক কাগজে দেখি সর্বাণী গাঙ্গুলি, আইসিসি-র এক সদস্য বলেছেন, ছাত্ররা তাঁকে মারধোর করেছে, গলা টিপে ধরেছে ইত্যাদি ৮ তারিখের অবস্থানে। আমরা যখন প্রমাণ স্বরূপ সিসিটিভি ফুটেজ চাই, তখন অবশ্য কর্তৃপক্ষ বা প্রফেসর, কেউই আর আওয়াজ করেন না।
এত কিছুর মধ্যেও উপাচার্য মশাই নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে একবারও কথা বলেন না ছাত্রদের সাথে, ক্যাম্পাসে মিটিং-মিছিলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১০ সেপ্টেম্বর অরবিন্দ ভবনের সামনে অবস্থান শুরু হয় ছাত্রদের। সেই সময়গুলো অদ্ভুত ভাবে কাটত, হাতে গোনা পঞ্চাশটা ছেলেমেয়ে হয়তো রাতে ঘাঁটি আগলে পড়ে থাকত, সকালে আরও একশোজন হয়তো যোগ দিত। এই মুষ্টিমেয় কয়েকজন মিলে আমরা মোটমাট ১৫০ ঘন্টা ধরে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটার সামনে বসে থাকি, ভরসা বলতে তখন ছিল সাথে গান, স্লোগান, পোস্টার, আর ছিল বন্ধুরা। আমরা জানতাম যে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম সিদ্ধান্ত নির্ণায়ক বৈঠক সামনেই ছিল এবং সেই দিনটাকে আমরা বেছে নিই উত্তর পাওয়ার দিন হিসেবে। ১৬ সেপ্টেম্বর ইসি মিটিংয়ের দিন পড়ে এবং আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ছাত্রদের সাধারণ সভা থেকে, যে, সেদিন আমরা উপাচার্য এবং ইসির থেকে একটা পাবলিক স্টেটমেন্ট না পাওয়া অবধি বসে থাকব বন্ধ কোলাপসিবলের সামনে। দিন শুরু হয়। মিটিং শুরু হয়, আমাদের অবস্থা ঘেরাওয়ের দিকে চলে যায়। এখানে অনেকেই ঘেরাওয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। আমার তাদের কাছে এটুকুই প্রশ্ন যে ১৫০ ঘন্টা হাপিত্যেশ করে বসে থাকার পরও যদি উপাচার্য, যিনি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষক, তিনি একবারও ছাত্রদের সাথে দেখা না করেন, উল্টে বলে বসেন যে ছাত্রদের অভিযোগ শোনার জন্য তিনি মোটা টাকার মাস মাইনে পান না, তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারতাম আর?
আমাদের দাবি ছিল একবার উপাচার্য মশাই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শুধু ছাত্রদের সাথে কথা বলুন, তাদেরকে একটা লিখিত আশ্বাস দিন যে তদন্ত হবে নিরপেক্ষভাবে। যখন উপাচার্য মশাই অবশেষে বেরোন অরবিন্দ ভবন থেকে, তখন তাঁকে শোনার মতো কোনো ছাত্র অবশিষ্ট ছিল না। সেখানে যারা তখনো সোজাভাবে হাঁটতে পারছে, তারা তখন অন্যদের শুশ্রূষায় ব্যস্ত।
১৬ সেপ্টেম্বরের রাত, যে রাতটা কখনো ভুলব না, আবার যে রাতের বেশিরভাগ ছবি, শব্দই মাথার মধ্যে কোথাও হারিয়ে গেছে। কোনো বড়োসড়ো ট্রমার ধাক্কার ফলে মনের ভেতর চাপা পড়ে যায় স্মৃতিগুলো, একেই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হিসেবে চিহ্নিত করেন মনস্তাত্বিকরা। বোধহয় আমাদের সাথেও সেরকম কিছুই হয়। খবর ছিল, পুলিশ আসবে সে রাতে, কিন্তু পুরোটা জেনেও কোথাও বিশ্বাস করিনি। এর আগেও ঘেরাওতে অংশগ্রহণ করেছি আমরা, প্রাক্তন উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য ৪৮ ঘন্টা শান্তিপূর্ণ ঘেরাওয়ের মধ্যে ছিলেন, তবু একবারের জন্যও পুলিশ ডাকেননি। সেই ভরসাটা ছিল যে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের দাবি নিয়ে যদি লড়ি, তাহলে অন্তত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে আমাদের সেই লড়াইয়ের অধিকারটুকু থাকবে। সেই ধারণাটা প্রথমেই আঘাত খায় সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ, যখন শিক্ষাবন্ধু সমিতি, তৃণমূলের অশিক্ষক কর্মচারীদের সাথে ধস্তাধস্তি হয় অরবিন্দ ভবনের সামনে। তারা এসেছিল গায়ের জোরে উপাচার্যকে বের করে নিয়ে যাবে বলে, কিন্তু ব্যারিকেড বানানোর শিল্প ছাত্রদের অনেক বেশি সহজাত হওয়ার ফলে তারা পিছু হটে যায়, যাওয়ার আগে দুজন ছাত্রকে আহত করে অবশ্যই। এই ধস্তাধস্তির খবর পেয়েই ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র ইউনিয়ন ফেটসু, এবং হস্টেলের বাসিন্দারা চলে আসে, আর হঠাৎ করেই আমাদের সংখ্যাটা বেড়ে তিনশো ছুঁয়ে যায় প্রায়। এরপর অরবিন্দ ভবনের গেটে গেটে ছাত্র পাহারা বসে, আমরা তখন নিশ্চিত, এই রাতটা লম্বা রাত হবে। ৯টা নাগাদ ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকে এক গাড়ি, চক্কর মেরে খবর নিতে বোধহয়। ততক্ষণে বাইরে থেকে খবর আসা শুরু হয়ে গেছে, চার নম্বর গেটের বাইরে সারি দিয়ে পুলিশ ভ্যান বিদ্যমান, দরকার পড়লে জল কামানও নামবে। আমি তখন অরবিন্দ ভবনের পেছনের বড়ো গেটে, সঙ্গে আরও কমরেডরা। উপাচার্য বেরোতে চাইলে কীভাবে কোলাপসিবল আটকানো যায় সেই প্র্যাক্টিস করছি লোহার গেটের ফাঁকে হাত পা গলিয়ে দিয়ে। খবর আসে পুলিশ নাকি ছাত্রদের আর উপাচার্যের মধ্যে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে, শুনে একচোট হেসে নিই আমরা। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে যায় পুলিশ জিপটা, যাওয়ার আগে আশ্বাস দিয়ে যায় যে ছাত্রদের গায়ে পুলিশ হাত তুলবে না কোনোভাবেই। আমরা খাবারের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অরবিন্দ ভবনের গাড়ি বারান্দা তখন থিকথিক করছে কুড়ি বছরের স্পর্ধায়, গান চলছে, স্লোগানে সঙ্গত দিচ্ছে স্যাক্সোফোন, ভায়োলিন, গিটার। ৩৫০ জনের জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা হয়। এক পুলিশকর্মী যখন বলেন যে আমরা নিজেদের খাবার ব্যবস্থা করে নিলেও তাঁদের সারা রাত অভুক্ত থাকতে হবে, তখন তাঁদের জন্যও আন্দোলনের খিচুড়ি আনা হয়। দুঃখজনক, পুলিশ সেই খাবার প্রত্যাখ্যান করেন, কর্মরত অবস্থায় তাঁদের নাকি খাওয়া বারণ। রাত বারোটা নাগাদ প্রেমিকাকে জানিয়ে দিই আর জেগে না থাকতে। পুলিশ কোনোভাবেই ওই রাতে আর কিছু করবে না। রাত একটা পনেরো নাগাদ হঠাৎ করে খবর আসে, মিনিট পাঁচের মধ্যেই পুলিশ ঢুকবে ক্যাম্পাসের সব গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কোলাপসিবল গেটের এপারে তখন আমরা, আর ওপারে দাঁড়িয়ে ‘মাননীয়’ উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী, ‘মুক্তি’র অপেক্ষায়, খানিকক্ষণ আগেই গ্রীলের ফাঁক দিয়ে মিডিয়াকে বাইট দিয়েছেন। বন্ধু দিব্যকমল, পৃথ্বু ও পুকু নেমে আসতে চলা আঘাতের উদ্দেশ্যে ‘পুলিশ জ্যাজ’ বাজায়, বাজিয়ে বাদ্যযন্ত্র গোটানোর সময়েই হঠাৎ করে দেখি অরবিন্দ ভবনের উল্টোদিকের এক নম্বর গেটটা খুলে যায়, আর দুটো লাইনে, তার একটা ঊর্দিধারীদের লাইন, অন্যটা গেঞ্জি পুলিশের, রাষ্ট্রের ‘নিয়মরক্ষকরা’ ক্যাম্পাসে পা রাখেন। গাড়ি বারান্দার একদিক দিয়ে গেঞ্জি-বাহিনী ঢোকে, আর অন্যদিকে ঊর্দিধারীরা ভিড় জমায়। ছাত্রদের ব্যারিকেড এবার আর আটকাতে পারে না এই সাঁড়াশি আক্রমণকে, খানিক বাদেই দেখতে পাই চেনা পরিচিত মুখগুলো কেমন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। একদিকে রণিতা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আপ্রাণ চেঁচাচ্ছে, ও জানেও না খানিক বাদে এক গেঞ্জিধারী ওকে মাটিতে ফেলে পেটটা কচলে দিয়ে চলে যাবে বুট দিয়ে। অন্যদিকে শুভজিৎ পুলিশের সাথে তর্ক করতে গিয়ে বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। দেখলাম পুকুকে ছিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একজন, পুকু তারস্বরে ‘আজাদি’ চেঁচাতে চেঁচাতে একটা ফুলের টব আঁকড়ে ধরে আছে। আমায় দু-জন, একজন ঊর্দি এবং অন্যজন গেঞ্জি পাকড়াও করে। তাদের হাত ছাড়াতে গিয়ে পড়ে যাই, তারপরেই মনে পড়ে চারজন চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে আমায়। মুখটা কংক্রীটের মেঝেয় ছেঁচড়ে যাচ্ছে, এবং দীপ্ত আর শাওন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার ওপর, দুজনেই মার খায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনজনের কাউকেও পাকড়াও করতে পারে না পুলিশ।
হয়তো গোটাটাই ভীষণ সিনেম্যাটিক আর মেলোড্রামাপূর্ণ শোনাচ্ছে, কিন্তু ওইটুকু সময়টাও তো আর রোজকার স্বাভাবিক জীবনের অংশ নয়, ফলত খানিক সিনেম্যাটিক হওয়াটাই বোধহয় স্বাভাবিক। সেই রাতে পুলিশ পেটানোর সময় আলো নিভিয়ে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। আর হয়তো তাই অন্ধকারে কী ঘটেছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু চিৎকারগুলো আজও পিছু তাড়া করে মাঝেমধ্যেই। পুলিশ ৩৬ জন ছাত্রকে অ্যারেস্ট করে। তার মধ্যে সুধন্যাও ছিল। এদেশের আইন মোতাবেক কোনো মেয়েকে রাত দশটার পর অ্যারেস্ট করতে পারে না পুলিশ। ঠিক যেভাবে পুলিশের কোনো অধিকার নেই মেয়েদের যৌন নিগ্রহ করার, যেটা সেদিন হয়। পরদিন সকালে পনেরোজন এফআইআর করতে যায় যাদবপুর থানায়, যৌন নিগ্রহের অভিযোগ জানাতে, কিন্তু পুলিশ এফআইআর না নিয়ে জিডি হিসেবে নেয় অভিযোগগুলো।
চল্লিশজন ছাত্র ছোটো বড়ো আঘাত পেয়ে কেপিসি হাসপাতালে যায়। তাদের মধ্যে দু-জনকে ক্রিটিকাল অবস্থায় ভর্তি করা হয়। শেষজন হাসপাতাল থেকে ছুটি পায় দেড় সপ্তাহ পর।
মনে আছে, কীভাবে ছাত্রদের সরিয়ে পথ করে দেওয়ার পর অভিজিৎ চক্রবর্তীকে ব্যারিকেড করে বার করে গেঞ্জিধারীরা ও শিক্ষাবন্ধু। কীভাবে লোকটা পালায় এবং কীভাবে তার পথে দাঁড়িয়ে ভাঙা গলায়, কাঁদতে কাঁদতে স্লোগান দিতে গিয়ে শেষ থাপ্পড়টা খাই পুলিশের হাতে। এরপর আর না পেরে আমি অরবিন্দ ভবনের পেছন দিকে চলে যাই জল খেতে। ফেরত আসি যখন, তখন শুনতে পাই শৌনক, দেবযান, আরও অনেকের সাথে অ্যারেস্টেড। আমাদেরকে বারবার বলা হচ্ছে ক্যম্পাস খালি করতে, নইলে এরপর বাকি যারা পড়ে আছে, তাদের আদর করতে তৃণমূলী গুণ্ডা আসবে।
নিজের ক্যাম্পাস, নিজের বাড়ি হিসেবে যাকে চিনেছি গত তিন বছর, হঠাৎ করে সেই থেকেই পালাতে হয় যখন, তখন কোথাও প্যালেস্তাইনের ঘরছাড়াদের সাথে একটু বেশি মেলাতে পারি নিজেকে।
পুলিশি আক্রমণ শুরু হয় রাত একটা তিরিশ। আমরা ছেড়ে বেরোই যখন, তখন রাত তিনটে তিরিশ। দু-ঘন্টার মধ্যে আমাদের প্রত্যেকের বয়স বেড়ে গেছিল কয়েক ঘন্টা, আর এই বাড়তি বয়সের বোঝা নিয়ে আমরা যাদবপুর থানার মোড় অবরোধ করতে যাই। এই অবরোধ সকাল ৮টার মধ্যে উঠে যায় অবশ্য, র্যাফ-এর দুটো গাড়ি আর থানার পুলিশের ধমকানির চোটে। আমি নিজে অবশ্য সাড়ে চারটে নাগাদই বেরিয়ে যাই, আমার ল্যাপটপে যেহেতু রাতের ঘটনার কিছু ফুটেজ ছিল। যখন আবার বেলা এগারোটায় ফিরি ক্যাম্পাসে, ততক্ষণে অবশ্য চালচিত্র বদলে গেছে। সারা দেশের মিডিয়া তখন ‘হোক কলরব’ কী, কেন, কীজন্যে পুলিশি সন্ত্রাস, তা জানতে ব্যাকুল।
এরপর বাকিটা ইতিহাস, ১৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ কলকাতা পাঁচ হাজার মানুষের মিছিল দেখে। ১৮ সেপ্টেম্বর মিছিল দেখে দশ হাজার মানুষের। ক্যাম্পাসের মধ্যে আট হাজার মানুষের সাধারণ সভা হয়। আর ২০ সেপ্টেম্বর, ইতিহাস দেখে দলীয় পতাকাবিহীন স্বতঃস্ফূর্ত একলাখি মিছিল। এখানেই থেমে থাকেনি। ছাত্ররা পাশে পায় শিক্ষকদের, প্রাক্তনীদের, কর্মচারীদের (যারা ঘাসফুল কানে গোঁজেননি, তাদেরকেই অবশ্য), শহরের বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত বাঙালি গর্জে ওঠে খবরের কাগজে, টিভিতে, ইন্টারনেটে। কিন্তু আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে আশা জুগিয়েছিল ট্যাক্সি এবং অটোচালকদের সংহতি, তাঁরা তখন এবং এখনও নিজেদের লড়াই লড়ে চলেছেন, আরও নানান জায়গা থেকে লোকে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেয়, বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাড়ার চেনা মুদিওয়ালা কাকু।
দু-মাস পেরিয়ে গেছে, উপাচার্য মশাই বহাল তবিয়তেই আছেন, অবশ্য ক্যাম্পাসে কম আসেন আজকাল, বোধহয় শরীর খারাপ করেছে ওঁর, আমরা আমাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি শান্তিপূর্ণ ভাবে। এই লড়াই এখন শুধু আর উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে লড়াই নয়। এটা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াই, এবং যদিও আপাতত সেমেস্টার চলে এসেছে বলে একটু থিতিয়ে গেছি আমরা, তবু, বিশ্বাস রাখি, #হোক কলরব চলবে আগামীদিনেও। কারণ আন্দোলনের থেকে বড়ো নেশা হয় না। এটা যাদবপুর জানে।
Leave a Reply