জিতেন নন্দী
দুদিন আগে ছিল ঈদ-উল-ফিতর। আমাদের এই তল্লাটে রমজানের একমাস উপবাসের পর এই সময় পাড়ায় পাড়ায় প্রতিটি পরিবারে আনন্দ-ফুর্তির ঢেউ লাগে। খাওয়া-দাওয়া, আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া, এদিক-ওদিক বেড়িয়ে আসার জের কাটতে হপ্তা পেরিয়ে যায়। সাহারা বিবির ঘরেও তাঁর বউমার বাপের বাড়ি থেকে কুটুম এসেছিল। বউমার ঘরে বসিয়ে তাদের জন্য চা আর ফুচকা-ঘুগনি এনে নাস্তা করানো হল। সেই দেখে মিমির তিন বছরের ছেলে হাবিব কাঁদছে, সেও ফুচকা খাবে। অগত্যা মিমি ছেলের বায়না মেটাতে স্টেশনের ধারে ফুচকা কিনতে গেল। তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
কসাইখানার গলি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে যেতেই দেখল মাঝরাস্তায় সাদা রঙের টাটা-ম্যাজিক গাড়িটা দাঁড়িয়ে। এই তল্লাটে বজবজ পর্যন্ত এখন খেপ খাটছে এই টাটা-ম্যাজিক গাড়িগুলো। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে এরা প্যাসেঞ্জার তোলে। অটোর মতো রুট স্থির করা নেই। যাই হোক, তাজ এগিয়ে আসে। তাজ কসাইখানার একটা মাংসের দোকানে কাজ করে। মিমির বক্তব্য, সে-ই ওকে ভজিয়ে গাড়িতে তুলেছিল। তারপর … সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
পাল্টা বক্তব্য, মিমি জেনে-বুঝেই তাজের সঙ্গে গাড়িতে উঠেছিল। তাজের সঙ্গে তার নাকি আগে থেকেই জান-পহেচান ছিল। এমন বক্তব্যও শোনা গেছে, মিমি তাজের কাছ থেকে পয়সা না দিয়ে মাংস নিয়ে যেত ঘরে। অতএব …
মিমিকে গাড়িতে তোলার পর খুব জোরে গান চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তা অবশ্য তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেক সময় এখানকার অটো বা গাড়িগুলোতে জোরে গান বাজানো হয়। গাড়িতে পাঁচটা ছেলে ছিল। ডাকঘরের দিকে গাড়িটা গিয়েছিল। মিমির বক্তব্য, ওকে ওরা জোর করে কী একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিল আর সাদা বড়ো বোতল থেকে একটা পানীয় গলায় ঢেলে দিয়েছিল। তাতে ও কিছুটা বেহুঁশ হয়ে পড়ে। তারপর তাকে ধর্ষণ করা হয় এবং ডাকঘর থেকে আকড়া স্টেশনের দিকে যে রাস্তা, তার এক পাশে গাড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়।
মিমিকে ওখানে পড়ে থাকতে দেখে বাইক-আরোহী দুজন মানুষ। তারা ওর পায়ের ক্ষতে জল দেয় এবং দ্রুত বাইক চালিয়ে টাটা-ম্যাজিক গাড়িটাকে ধরার চেষ্টা করে বিফল হয়। ওদের কাছ থেকে সাহারা বিবি জানতে পারেন যে বেড়ারবাগানের একজন মেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে আছে। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, তাঁর মেয়ে বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মিমিকে মহেশতলা থানায় নিয়ে যান ওর মা। থানায় মিমিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু কোনো কাগজপত্র না দিয়েই পুলিশ ওকে বজবজ ইএসআই হাসপাতালে পাঠায়। রাত তখন সাড়ে এগারোটা-বারোটা। ইএসআই হাসপাতাল মিমিকে ফিরিয়ে দেয়, কেননা ওর সঙ্গে কোনো কাগজপত্র ছিল না। ফের থানায় মিমিকে নিয়ে আসেন ওঁর মা। তখন থানা একটা কাগজ ওদের হাতে দেয়। সেই কাগজ নিয়ে বেহালা বিদ্যাসাগর হাসপাতালে যায় ওরা। বিদ্যাসাগর হাসপাতালে মিমিকে ভর্তি করা হয়। মিমি থানায় তার ওপর যৌন নিগ্রহের মৌখিক অভিযোগ করেছিল ৩১ জুলাই রাতে। আর পুলিশ হাসপাতালের বেডে ওর জবানবন্দি লিখিতভাবে রেকর্ড করে ১ আগস্ট দুপুর পৌনে চারটে নাগাদ।
ঘটনাটা ঘটেছিল ৩১ জুলাই ২০১৪। ৪ আগস্ট বেহালা বিদ্যাসাগর হাসপাতালের বেডে আমরা কয়েকজন মিমিকে দেখতে যাই। ও তখনও বেশ কিছুটা অসুস্থ। হাঁটুতে পায়ে কাটা ঘা। ওর মা আমাদের ওর ছেঁড়া জামাটা দেখালেন, যেটা ঘটনার দিন ওর পরনে ছিল। হাসপাতাল চত্বরে বেশ কয়েকটা খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক-ফটোগ্রাফাররা উপস্থিত ছিল। হাসপাতালের সুপারের নির্দেশ ছিল, মিমির সঙ্গে যেন কেউ দেখা করতে না পারে। মিডিয়া-বুদ্ধিজীবী সমীর আইচ ওখানে গেলে তাঁকে সুপারের ঘরে কায়দা করে বসিয়ে রাখা হয়। আমরা কিছুটা লুকোচুরি করেই মিমির সঙ্গে দেখা করি এবং ওর মুখ থেকে ঘটনাটা জানার চেষ্টা করি। কেন যে মেয়েটা তার কথা খোলাখুলি অন্যদের জানাতে পারবে না, তার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি।
১ আগস্ট শেখ সফি ছাড়া বাকি অভিযুক্তদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। শোনা যায়, শেখ সফি বাইরে পালিয়ে গেছে। আলিপুরে টিআই প্যারেডে দোষীর শনাক্তকরণের সময় মিমি জানায়, এদের মধ্যে আসল দোষী নেই। অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে সফি ধরা পড়ে দিল্লি থেকে। ওখানে নাকি ওর বোনের বাড়ি, বউও আছে। লোকে বলছে, ওর বউ নাকি দিল্লিতে মেয়ে বিক্রি করে। ‘বিয়ে করব’ বলে নিয়ে যায় এখান থেকে। ওরা নাকি মেয়ে পাচার করে। এখানে সফির ঘর ভাঙিপাড়ার কিলখানায়। ঘরে ওর মা, ভাবী আছে। ফের টিআই প্যারেডে নিয়ে যাওয়া হয় মিমিকে। সেখানে ও সফিকে শনাক্ত করে।
ঘটনার পরে আকড়া অঞ্চলে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ গৃহস্থ পুরুষ ও মহিলা এবং মিমির আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেছি। একজন মহিলা লোকের বাড়িতে ঝাড়া-মোছার কাজ করেন, নাম প্রকাশ করতে ভয় পান, তিনি প্রথমে কিছু বলতে চাইলেন না। বললেন, ‘পাশের হোটেলের আব্বাস মিঞাকে জিজ্ঞেস করো না, সে বলেছে, মেয়েটা ঠিক না’। আমরা নাছোড়বান্দা, অনেক অনুরোধ করাতে বললেন, ‘ন-টা রাত্রিতে কেউ ডাকবে আর আমি গাড়িতে উঠে চলে যাব? ওখানে তো আরও পাঁচটা দোকানদার ছিল, আরও পাঁচটা লোক ছিল, তারা তো বলবে, কেন মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছ? তোমার মুখ চেপে ধরে থাকুক আর যাই হোক, তুমি তো গাড়ির মধ্যে ছটফট করবে নাকি? হাত-পাও তো ছুঁড়বে দুমদাম করে নাকি? কিছু তো ব্যাপার আছে। ছেলেগুলো তো বাজেই ছিল। তো পাঁচদিন মুখটা দিয়ে রেখেছ, তবে তো একদিন মুখটা কাটবে? হাত যদি মুঠো করি জবরদস্তি কেউ খুলতে পারে না। আমি খুলে রেখেছি, তবেই না হাত ধরবে। লোকে বলে, ও মেয়ে আর মা কেউ ভালো না। নাহলে দুটো বাচ্চার মা, ওকে ওর সোয়ামি ছেড়ে দিল কেন?’
আমরা ঠিক বিপরীত বক্তব্যও মিমির মায়ের কাছ থেকে শুনেছি। মিমির ছোটো ছেলেটা যখন পেটে, তখন স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। অগত্যা সাহারা বিবি মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে চলে আসেন। সাহারা বিবির ছয় ছেলের মধ্যে বড়োগুলোর বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটো তিনটে তখন ঘরে লেখাপড়া করত। স্বামী পরিত্যক্তা মিমি যখন দুটো বাচ্চা নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে এল, সাহারা বিবি দুটো ছেলের পড়া ছাড়িয়ে দিলেন। ওদের কাজ করতে পাঠালেন পাড়ার কাছেই প্রিন্টিংয়ের কাজে (পোশাকের ওপর সিল্ক স্ক্রিনের কাজ)। নাহলে সংসার অচল হয়ে যেত।
পরস্পর বিরোধী এইসব কথা সম্পূর্ণ যাচাই করার উপায় আমাদের ছিল না। তবে আমাদের এই এলাকায় কিছু ছেলেকে দেখি, একাধিক মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করে, ঘনিষ্ঠতাও হয়। এমনকী, ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়ের সঙ্গে রাত কাটায়। ছেলেরা এরকম আচরণ করলে লোকে তেমন সরব হয় না। কিন্তু মেয়েরা করলে যথেষ্ট নিন্দা করা হয়, এমনকী মেয়েদের পক্ষ থেকেও সমালোচনা শোনা যায় : ও তো বাজে মেয়ে।
একজন সমাজকর্মীও বললেন, ‘দাদা, আপনার আমার বাড়িতেও তো মেয়েরা আছে। তাদের কি এরকম হচ্ছে? এসব বাজে মেয়ে।’
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির স্থানীয় শাখা এই ঘটনার তদন্ত করে এবং মেয়েটির ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে। কিন্তু সেখানেও একটা মত এসেছিল, ‘মেয়েটাকে একজন পুরুষ ডাকল আর সে গেল কেন? কোনো সম্পর্ক ছিল বলেই সে গেছে। তারপর বিপদ হয়েছে। সেই বিপদের জন্য ছেলেগুলো নিশ্চয় দায়ী। কিন্তু একই সঙ্গে মেয়েটাও দায়ী।’ এই সংগঠনের সদস্য চিকিৎসক মহব্বত হোসেন বলেন, ‘সাধারণ গরিব মানুষ মেয়েটার বিরুদ্ধে কিছু বলছে না। কিন্তু এখানকার এলিট ক্লাসের শিক্ষিত মানুষ আমাদের সমালোচনা করছেন, আপনারা একতরফা ছেলেদের দোষ দিচ্ছেন। মেয়েটারও দোষ আছে। এখানে যারা সাহিত্যচর্চা করে, তারা কলকাতায় গিয়ে বা অন্যত্র বড়ো বড়ো জায়গায় গিয়ে সভা-সমিতি করে, প্রতিবাদ করে, এখানে এই ঘটনায় তারা কিন্তু মুখ খুলছে না। অথচ তাদের বাড়ির পাশের ঘটনায় তারা নীরব। এটা কেন? আমি কামদুনি, বারাসাত বা যাদবপুরের ঘটনায় প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছি। প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে খুবই উৎসুক। আর আমার পাড়ার ঘটনায় চুপ করে থাকছি। এটা এই এলাকার একটা সামাজিক বৈশিষ্ট্য। যখন হিন্দু-মুসলমান বিরোধের কোনো ঘটনা ঘটে, তৎক্ষণাৎ একটা সক্রিয়তা গড়ে ওঠে। যেমন, কয়েকদিন আগে নোয়াপাড়ায় একজন হাজীসাহেব মোটরবাইকে যাচ্ছিলেন, একজন পথচারীকে ধাক্কা মারেন। শোনা যায়, লোকটা হিন্দু এবং মদ খেয়েছিল। নিমেষে হিন্দু এবং মুসলমানরা পাড়াগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল। তিনটে থানার পুলিশ এসে জড়ো হল। একটা রায়টের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। তার মানে কমিউনিটি বা কৌমসমাজের বিষয় হয়ে উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, অথচ সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের বিষয় হলেই কোনো সামাজিক নড়াচড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এটা একটা সমস্যা এবং বিপদও বটে। আর একটা ঘটনা বলি। তখন ১৯৮৮-৮৯ সাল হবে। আকড়া স্টেশনের কাছে একটা ক্লাব আছে। ওখানে একটা মেয়ের কান থেকে দুল ছিঁড়ে নিয়েছিল একজন সমাজবিরোধী। যে দুল ছিঁড়েছে সে হিন্দু, যার দুল ছিঁড়েছে সে মুসলমান। সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারশো মুসলমান এক হয়ে হাজির হয়ে গেল। ওদিকে হিন্দুরাও এক হয়ে গেল। একটা দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। আমরা যখন ওখানে শান্তির জন্য গেলাম, হিন্দুরা ভাবল, এ তো মহব্বত হোসেন, এ মুসলমান। আমরা যে অন্য একটা পরিচয়ে গেছি, সেটা পিছনে চলে গেল। আমি যে মহব্বত হোসেন হয়েও হক কথা বলতে পারি, সেটা বোঝাতে খুব কষ্ট হল। …’
মিমি একজন মুসলমান মেয়ে, ওর ওপর যৌন নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্ত বা অভিযুক্তরা সকলেই মুসলমান, একমাত্র ওই টাটা-ম্যাজিকের চালকের সহকারী আকড়া স্টেশনের ধাঙড় সম্প্রদায়ের একটি পরিবারের সদস্য। ফলে ঘটনার কোনো সাম্প্রদায়িক মোড় নেওয়ার সুযোগ ছিল না।
একদিন দেখলাম কংগ্রেসের এক পথসভায় এই ঘটনাটা নিয়ে কিছু বক্তব্য রাখা হল। কিন্তু সভার লক্ষ্য ছিল তৃণমূলের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা, সামাজিক অন্যায়ের প্রতিকার নয়। মিমির ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ ছিল নেহাতই একটা উপলক্ষ্য। অতএব সব মিলিয়ে মিমির গল্পটা এক বাজে মেয়ের উপাখ্যান হিসেবেই রয়ে গেল। যদি প্রশাসনিক ও আইনি পথে কোনোদিন প্রমাণও হয় যে মিমির ওপর যৌন নিগ্রহ হয়েছিল, মিমি বড়ো জোর কিছু ক্ষতিপূরণ পেতে পারে। কিন্তু তা দিয়ে মিমির বাজে মেয়ে বদনাম ঘুচবে কি?
Leave a Reply