মন্থন পত্রিকার পক্ষ থেকে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সামান্য চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেই চেষ্টা কতখানি কার্যকর হয়েছে? এই প্রশ্ন বারবারই ঘুরে এসেছে আমাদের কাছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে নেপালের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রসঙ্গ যখন এল, আবার সেই প্রশ্ন জীবন্ত হয়ে উঠল। আসলে প্রশ্নটা কখনোই বাতিল বা পুরোনো হয়ে যায়নি। কারণ কখন যে কোথায় কীভাবে এই গ্রহের কোন অংশে এই ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে, তা আমাদের জানা নেই।
পশ্চিম মেদিনীপুরের বন্যায় যখন আমরা সরাসরি গিয়ে একটা গ্রাম ধরে কাজ করেছিলাম, সমস্যা ছিল না। পাকিস্তানের ভূমিকম্পে সাহায্য করতে গিয়ে আমরা বেশ বিপদে পড়েছিলাম। উত্তরাখণ্ডেও বিপর্যয়টার চরিত্র বুঝতে আমরা গুপ্তকাশী-ফাটা সংলগ্ন গ্রামগুলোতে গিয়ে কিছুটা সরেজমিন সমীক্ষা করে সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম আয়লার পর সুন্দরবনে কাজ করতে গিয়ে।
সুন্দরবনে যাতায়াত করতে গিয়ে প্রথমেই আমরা টের পেলাম যে সুন্দরবন জায়গাটাই আমরা চিনি না। এতগুলো দ্বীপ, তাদের অবস্থান, সেখানে কত রকমের মানুষ ও বসতি রয়েছে, তাদের জীবনের ছন্দ, তাদের জীবিকা, তাদের চাষআবাদ, নদীগুলোর অবস্থান ও চরিত্র, নদীবাঁধ — এইরকম সামগ্রিক চেহারাটা সম্বন্ধে একটা ধারণা না থাকলে আয়লায় সেখানকার মানুষের ক্ষতির স্বরূপ বোঝা দুষ্কর। আর সেটা না বুঝে কি তাদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব?
নেপালের সঙ্গে সুন্দরবনের কিছু মিল রয়েছে। দু-জায়গাতেই দারিদ্র্য বেশ প্রকট; সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপগুলোতে কিংবা নেপালের দুর্গম পাহাড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ নয়; সরকার এবং রাষ্ট্রের উপস্থিতি অনেক এলাকায় দুর্বল; দু-জায়গাতেই, বিশেষত যুবকদের একটা বড়ো অংশের জীবিকার খোঁজে দূরে পাড়ি দেওয়ার চল রয়েছে। তাই উভয় ক্ষেত্রেই নিজেরা স্বাধীনভাবে বিপর্যয়ের প্রকৃত অবস্থাটা বুঝে ওঠা খুব জরুরি।
সুন্দরবনে ত্রাণ এবং সরকারি পরিকল্পনাগুলির নয়ছয় মাত্রা ছাড়িয়েছিল। অথচ বাইরের মানুষের মধ্যে একটা তাগিদ সৃষ্টি হয়েছিল যে তারা আয়লা-দুর্গতদের জন্য কিছু করে। কিন্তু কী করবে? কারা সত্যিই বিপর্যস্ত? তাদের দুর্গতির চেহারাটা কীরকম? কী তাদের দরকার, যেটা নিয়ে একটু পাশে দাঁড়াতে পারলে তারা আবার স্বাভাবিক জীবনযুদ্ধে ফিরে আসতে পারে? সেদিন আয়লার ঝড়ের পর যে যুবক-যুবতীরা বেগতিক দেখে দ্রুত সুন্দরবন ছেড়ে বাইরে দূর-দূরান্তরে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল, তাদের কাছে সুন্দরবন পুনর্গঠনের মানেটা কী? এইসব প্রশ্নগুলো আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছিল সেসময়। আয়লার পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। আজও মনে হয়, ফিরে দেখা দরকার, দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর সুদূরপ্রসারী ফলাফলগুলো কী; কেমন আছে নাপিতখালি, দেউলবাড়ি বা পশ্চিম দ্বারিকাপুরের নদীর কোলে বাস করা সেই পরিবারগুলো।
বিপদের দিনে নিজের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে কারো পাশে দাঁড়ানোর বাসনা মানুষের সহজাত। কিন্তু পাশে দাঁড়ানোর সময় সহমর্মিতার গুরুত্বটা সবচেয়ে বেশি। নিজেকে বিপর্যয়-পীড়িতের প্রকৃত অবস্থাটায় দাঁড় করানোর চেষ্টাটাই হল সহমর্মিতা। ভূমিকম্পে যার ঘরটা ভেঙে পড়েছে, সেই বেসামাল একটা পরিবারকে একটা কম্বল, একটা ত্রিপল বা কিছু টাকা দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সেই সহায়তা নিয়ে তারা নিজেদের জীবনের বিপর্যস্ত অবস্থার মোকাবিলা কীভাবে করছে, এই খোঁজটা জারি রাখা জরুরি বলে মনে হচ্ছে।
Leave a Reply