৩১ মার্চ ২০১৫ মন্থন সাময়িকীর পক্ষ থেকে আমরা লিট্ল ম্যাগাজিনের পরিসর সম্বন্ধে কয়েকটা প্রশ্ন সামনে রেখে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে কথা বলি। পরে সেই কথাবার্তার ভিত্তিতে তিনি তাঁর বক্তব্য লিখে পাঠিয়েছেন। এখানে তা প্রকাশ করা হল।
আজকের দুনিয়ায় শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির স্বাধীন পরিসরের খোঁজ চলছে নানানভাবে। আমাদের বাংলায় লিট্ল ম্যাগাজিনের একটা সজীব পরিসর অনেকদিন থেকেই রয়েছে। যেমন রয়েছে লিট্ল থিয়েটারের একটা পরিসর। আপনার অভিজ্ঞতায় লিট্ল ম্যাগাজিনের এই পরিসরকে কেমন দেখছেন? কেমন দেখছেন এর অদলবদলকে?
অদলবদলের বিশেষ একটা চেহারা দেখছি সরকারের মুখাপেক্ষিতায়। প্রকাশ্যে না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে স্বাধীন পরিসর কমতে থাকে এর ফলে। লিট্ল ম্যাগাজিনের মূল চেতনায় একটা বিদ্রোহ থাকবার কথা, সেটা যত ছোটো আকারেই হোক না কেন। আর সে-বিদ্রোহ তো সমস্তরকম স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে, সমস্তরকম প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে। সেখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষণ কোনো-না-কোনোভাবে পিছুটান তৈরি করে। কিছুটা আর্থিক নিরাপত্তা অথবা নিশ্চয়তা হয়তো মেলে তাতে, কিছুটা প্রচার বা প্রসারেরও সুযোগ বাড়ে, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে মুখাপেক্ষিতা বাড়তে থাকে বলে চারিত্রভিতটা দুর্বল হতে থাকে। খুব বেশি মাত্রায় প্রচার বা প্রসার যে ঘটবে না, লিট্ল ম্যাগাজিনকে সে-কথা তো মেনে নিতেই হয়।
আরেকরকম নিরাপত্তার সন্ধান আমাদের পৌঁছে দিয়েছে ঘন ঘন বা একাদিক্রমিক বিশেষ সংখ্যা তৈরি করার ঝোঁকে। লিট্ল ম্যাগাজিনের সংখ্যাগুলি তখন সংগ্রহযোগ্য বই হয়ে দাঁড়ায়, অ্যাকাডেমিক জগতের আশ্রয় আর প্রশ্রয় হয়ে ওঠে। এই কদিন মাত্র আগে একজন তাঁর পত্রিকার একটি সংখ্যা হাতে তুলে দিয়ে বললেন : ‘এবার এঁকে নিয়ে করেছি, আগের সংখ্যাটা ছিল অন্য একজনকে নিয়ে।’ জিজ্ঞেস করেছিলাম : ‘কত বছর চলছে আপনাদের পত্রিকা?’ ‘পঁচিশ বছর।’ ‘এই পঁচিশ বছর জুড়েই কি বিশেষ সংখ্যা বার করছেন?’ ‘না না, প্রথম দিকে এম্নিই বেরোত, ত্রৈমাসিক হিসেবে।’ ‘আর বিশেষ সংখ্যা? সেটা কবে থেকে?’ ‘গত দশ বছরে। একটাই সংখ্যা বেরোয় বিশেষ সংখ্যা হিসেবে।’ একটু হেসে, পরে আবার বললেন ‘নইলে আর পারা যাচ্ছিল না।’
‘নইলে আর পারা যাচ্ছিল না’ — এই স্বীকারোক্তিটাই অনেকখানি বুঝিয়ে দেয় আমাদের। নিরুপায়তাটা বুঝতে পারি, কিন্তু ফলে যেটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার সীমাবদ্ধতার দিকটাও তো ভাবতে হবে!
সমস্ত জনপরিসর যখন দখল হয়ে চলেছে, লিট্ল ম্যাগাজিন কি স্বাধীন থাকতে পারছে?
পারছে না যে, তারই একটা ইঙ্গিত তো ছিল আমার আগেকার কথাগুলিতে। নানারকম আপোশের দিকে তাকে এগোতে হচ্ছে। তবে, এরই মধ্যে মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বলবার সাহস কোনো কোনো পত্রিকায় — অন্তত কিছুদিনের জন্যেও — দেখা যায়। ওই ‘কিছুদিন’টাই আমার কাছে অনেকখানি মনে হয়। দু-চার বছর যদি স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন নিয়ে বার করা যায়, তারপর যদি বন্ধও হয়ে যায় কোনো পত্রিকা, তাতে আমি ক্ষতি দেখি না। কেননা, সেই আদর্শটা ধরে আবার কোনো নতুন পত্রিকা তৈরি হতে পারে অল্প কয়েক বছরের জন্য, আর এইভাবেই একটা ধারা বয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, একটা মাত্র ম্যাগাজিনেই লিট্ল ম্যাগাজিনের সমাপ্তি নয়, সব মিলিয়ে যে প্রবাহ, সেটাতেই তার জোর — এভাবেও ভাবা চলে।
আমরা যেখানে থাকি, সেই মেটিয়াব্রুজ-মহেশতলায় এবং সুন্দরবন পর্যন্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বহু ছোটো সাহিত্য পত্রিকা এবং স্থানীয় সংবাদপত্র রয়েছে — এর অনেকগুলো একটু অগোছালো, এলোমেলো এবং অনিয়মিত। ঈদ বা পুজোর সময় কিছু বেরোয়। নববর্ষ, বইমেলা উপলক্ষ্যেও বেরোয়। আবার এই দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে ‘লোক’, ‘পরিকথা’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’-এর মতো সংগঠিত ও পরিকল্পিত পত্রিকা বেরোয়। আপনি এগুলোকে কেমনভাবে দেখেন?
যেসব পত্রিকার কথা উঠল, তার প্রায় সবগুলিই আমি দেখেছি, কখনো-না-কখনো। আমার ইচ্ছে বা প্রবণতার কথাটা বোধহয় এরই মধ্যে বোঝাতে পেরেছি যে ‘অগোছালো, এলোমেলো এবং অনিয়মিত’ হওয়াটাকে কোনো লিট্ল ম্যাগাজিনের পক্ষে দোষের বলে আমার মনে হয় না, বরং সেটাকেই তার পক্ষে স্বাভাবিক লাগে। একটি পত্রিকার নাম এখানে বলি : ‘প্রতিবিম্ব’। বহুকাল ধরে পত্রিকাটি চলছে, কিন্তু বেরোচ্ছে অনেক দিন পর পর।একবার তো বেরোল বারো বছর পরে। কিন্তু তবুও তার আকর্ষণ আর সজীবতা আজও আছে। এ-রকম হয়, হতে পারে। ‘কৃত্তিবাস’ শুরু হয়েছিল ত্রৈমাসিক হিসেবে। প্রকৃত ‘কৃত্তিবাস’-এর সময় যেটা, সেই প্রথম পনেরো বছরে ষাটটা সংখ্যা তো বেরোয়নি, বেরিয়েছিল মাত্র পঁচিশটা। তাতে ক্ষতি হয়নি কিছু।সংগঠিত/পরিকল্পিত হলে যে কোনো দোষ আছে তা নয়, তবে অতি-সংগঠন অতি-পরিকল্পনা প্রায়ই একটা প্রাতিষ্ঠানিকতার দিকে এগিয়ে নেবার ঝোঁক তৈরি করে।
লিট্ল ম্যাগাজিন বা লিট্ল থিয়েটারের সঙ্গে অনেকসময় একটা ‘আন্দোলন’ শব্দ যোগ করা হয়। লিট্ল ম্যাগাজিন কোন অর্থে আন্দোলন?
যথার্থ লিট্ল ম্যাগাজিনকে একটা আন্দোলন তো বলাই যায়। স্বতন্ত্রভাবে কোনো একটা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কোনো-একটা সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে, উঠেছেও সে-রকম। আবার, স্থিতাবস্থা বা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে সমস্ত লিট্ল ম্যাগাজিন জড়িয়ে নিয়েও একটা আন্দোলনের রূপ তৈরি হতে পারে। সচেতন বিরুদ্ধাচরণটাই তো একটা আন্দোলন। হাংরি জেনারেশন থেকে যেসব পত্রিকা বেরোত, তা তো একটা আন্দোলনের চেহারা নিয়েই বেরোত। আবার, তার একেবারে বিপরীতমুখিতায়, শুদ্ধ কবিতা চর্চায়, ‘শ্রুতি’ পত্রিকা কেন্দ্র করেও যা ঘটছিল একদিন, সেও এক আন্দোলন। ‘কৃত্তিবাস’ও একটা আন্দোলন, ‘শতভিষা’ও তাই — যদিও স্বভাবতই ওই দুই আন্দোলনের স্বরবিক্ষেপ আর আত্মঘোষণার মাত্রা বা ধরন পুরোটা আলাদা।
এই সূত্রে একটা কথা মনে রাখা যায়। ‘ম্যাগাজিন’ শব্দটার মূলেই কিন্তু একটা বিরুদ্ধভাব প্রচ্ছন্ন। মূলত বারুদ-রাখার জায়গা (storehouse) হল ম্যাগাজিন, রাইফেলের একটা অংশ হল ম্যাগাজিন।সাময়িক পত্রের জন্য ইংল্যান্ডে এ-নামটা প্রথম ব্যবহার হয়েছিল বোধহয় Gentleman’s Magazine-এর বেলায়, ১৭৩১ সালে। আস্তে আস্তে সবটাই যখন ম্যাগাজিন হয়ে গেল, চলতি ধাঁচের পাল্টা একটা পথ তৈরি করবার জন্য দরকার হয়েছিল লিট্ল ম্যাগাজিনের। সেও এক আন্দোলন।
লিট্ল ম্যাগাজিনের সংগঠিত হওয়া কতটা দরকার?
সংগঠিত হওয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়? যত ছোটো আকারেই হোক, যত নড়বড়েই হোক, কোনো-একটা লিট্ল ম্যাগাজিনের নিজস্ব সংগঠন তো একটা লাগেই। দু-তিনজন মিলেও যদি হয় তো সেও একটা সংগঠন। সেই সংগঠনের ভিত যত দুর্বল হতে থাকে, বিশেষ কোনো একটা ম্যাগাজিনের লুপ্তিসম্ভাবনা ততই প্রকট হতে থাকে। আবার, সংগঠন কথাটার এখানে আরেকটা মানে হতে পারে, সমস্ত লিট্ল ম্যাগাজিনকে জড়িয়ে নিয়ে একটা সংগঠনের রূপ দেওয়া। সেটার খুব দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না, এমনকী তা সম্ভব বলেও মনে হয় না আমার।কখনো কখনো একত্রবদ্ধভাবে বিশেষ কোনো ভূমিকা হয়তো পালন করা যায়, করা উচিত। যেমন ঘটেছিল সরকারি লিট্ল ম্যাগাজিন মেলার সমান্তরাল ভিন্ন একটা মেলার আয়োজন প্রেসিডেন্সি কলেজ চত্বরে, কিংবা কলেজ স্কোয়ারে। এ-রকম সময়ে একটা সাংগঠনিক তৎপরতার দরকার হয় ঠিকই। তবে একে স্থায়ী করবার বিশেষ কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না।
Leave a Reply