শমীক সরকার
সাধারণভাবে রাজনীতিকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক হিসেবে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। তবে একটু ভাবলেই আমরা বুঝতে পারি, ক্ষমতার অনেক প্রকারভেদ আছে। রাজনীতি যে ক্ষমতাটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়, তা রাজনৈতিক ক্ষমতা। তবে এই ক্ষমতাটি খুবই পরাক্রমী, তার সামনে অন্যান্য ক্ষমতা অনেক ম্লান।
রাজনৈতিক ক্ষমতা কী? সামাজিক মানুষের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার ফারাকের ভারসাম্য রক্ষার পরাক্রম। সামাজিক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ফারাক অনেকটাই তৈরি হয় তার অবস্থান দিয়ে। লিঙ্গগত, জাতিগত, জাতগত, শ্রেণীগত, গোষ্ঠীগত, ধর্মগত অবস্থান, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি অবস্থান খুব সুনির্দিষ্ট এবং তা অন্যটি থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা। এই অবস্থানজনিত আশা আকাঙ্ক্ষাগুলির দরকষাকষি এবং তার সমাধানের মাধ্যমে মূলত ওই অবস্থানগুলিকেই আরও দৃঢ় করা এক ধরনের রাজনীতি। এক্ষেত্রে ক্ষমতার আরেকটি অতিরিক্ত ভূমিকা আছে। তা এই ভারসাম্যের দেখভাল করে। ভারসাম্যটি রক্ষার জন্য রয়েছে যে হাতিয়ারগুলি, সেগুলির দেখভাল করে। এটাকেই আমরা বলি রাষ্ট্র। আর ভারসাম্য রক্ষার হাতিয়ারটি কখনও আপাতদৃষ্টিতে খুব উদার হয়, আবার কখনও তা খড়্গহস্ত। যখন যেমন প্রয়োজন তখন তেমন আর কি। এই রাজনীতির পরিসরটি প্রথম পরিসর। এই রাজনীতি সামাজিক বিভাজনগুলিকে দুর্বল করে না, বরং বিভাজনগুলি ঠিকঠাক থাকার মধ্যেই এই রাজনীতির সার্থকতা, কারণ কেবল তাহলেই ‘ভারসাম্য রক্ষা করা’র কাজটি প্রাসঙ্গিকতা পায়।
তবে রাজনীতির এই প্রথম পরিসর স্থিতিমূলক। কিন্তু সমাজ তো প্রাণবন্ত, কম্পনশীল। তাই তা সদাসর্বদা নতুন নতুন অবস্থানের জন্ম দেয়। আবার হয়তো মিলিয়েও যায়। অনেক সময়ই তা চিরাচরিত অবস্থানগুলিকেও এমনকী আড়াআড়ি ভেঙে দিতে পারে। আবার কখনো তা চিরাচরিত অবস্থানগুলির মধ্যেই কোনোটির অনুরূপ কিছু, কিন্তু চিরাচরিত নয়, গজিয়ে ওঠা (যেমন শ্রেণীগত বিভাজনের মধ্যে বিত্তগত বিভাজন বা উপার্জনগত বিভাজন)। নয়া অবস্থান নয়া আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসে। তা প্রথম পরিসরের দরকষাকষিকে প্রশ্ন করে। ফলে ভারসাম্যের চালু রূপটিকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে নয়া রূপ দাবি করতে থাকে। এ এক বিরোধিতার পরিসর। সমাজের প্রাণবন্ততা, কম্পনশীলতার সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী যোগ। চিরাচরিত বিভাজনগুলিকে অস্বীকার করে নয়া বিভাজিকা নির্মাণে এর ঝোঁক। আমরা একে বলছি রাজনীতির দ্বিতীয় পরিসর।
উপরোক্ত দুটি পরিসরই সামাজিক বিভাজন এবং তাদের মধ্যেকার ভারসাম্যের রাজনীতির পরিসর। যেন দুইয়ে মিলিয়ে এক বৃহত্তর পরিসর — বিভাজনের বাস্তবতা বা আবশ্যকতা এবং তাদের মধ্যেকার ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা — এটাই নির্মাণ করে এই রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরটি। তাই এই দুটি পরিসরই বাস্তব পরিসর।
সমাজে রাজনীতি বলতে মূলত এই দুটি পরিসরকেই বোঝায়।
তবে রাজনীতির আরেকটি পরিসরও রয়েছে। আমরা তাকে তৃতীয় পরিসর বলছি। মানুষ তার সৃষ্টিশীলতার কারণেই নতুন নতুন অবস্থান তৈরি করে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সেই নতুন অবস্থানগুলি তার যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা, বাসনা নিয়ে হাজির হয়। এই অবস্থানগুলি বিভাজনগুলিকে গুরুত্ব দেয় না। সমস্ত রকম সামাজিক বিভাজনের মধ্যে মধ্যে উজিয়ে ওঠা এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, কিন্তু অসীম সংখ্যক অবস্থান সামাজিক বিভাজনগুলিকে আবছা করে। তার ফলশ্রুতিতে ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তাকেও লঘু করে। কিন্তু এগুলি নিজেরা এতই ক্ষুদ্র যে কিছুতেই সেগুলি নিজে কোনো বিভাজিকা হয়ে ওঠে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একক ক্ষুদ্র অবস্থান ক্ষণস্থায়ী এবং তা মিলিয়ে যায়। কখনো কখনো প্রথম পরিসরের মধ্যে এসে যায় তার কুশীলবরা। কখনো কখনো কোনো কোনো ক্ষুদ্র অবস্থান কম্পনশীল সমাজের বদান্যতায় দ্বিতীয় পরিসরের অবস্থানে সরে যেতে পারে। তখন আর তাকে পৃথক অবস্থান হিসেবে দেখা যায় না। আবার অন্য কোথাও গজিয়ে ওঠে আরেকটি একক অবস্থান। কিন্তু দুনিয়া জুড়ে এইরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য অবস্থানই তৈরি করে রাজনীতির তৃতীয় পরিসরটি — যার একক অবস্থানগুলি সতত জন্মাচ্ছে আবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিসরটি এতই বিচিত্র এবং এর একক অবস্থানগুলি এতই দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী, যে এর কোনো প্রতিনিধিত্ব হয় না (কিন্তু অন্য দুটি পরিসরে হয়, কারণ তা বিভাজনমূলক অবস্থানের পরিসর)।
বিভাজন না থাকা, ভারসাম্য না থাকা, প্রতিনিধি না থাকার কারণে প্রায়শই এই পরিসরটিকে রাজনীতির পরিসর বলে মনে হয় না। সমাজও একে রাজনীতির পরিসর হিসেবে বুঝতে পারে না। রাজনীতির সামাজিক ধারণার প্রকোপে এই পরিসরের অবস্থানগুলিও নিজেদের রাজনীতির পরিসর বলে বুঝতে পারে না। কিন্তু যেহেতু এই পরিসরটি সামাজিক বিভাজনকে ঝাপসা করে দেয় বা হালকা করে দেয়, ভারসাম্যর প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়, প্রতিনিধিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় — তাই এই পরিসরটি অবশ্যই একটি রাজনীতির পরিসর।
তবে এই পরিসরটি সম্পূর্ণভাবে কল্পিত বা বানিয়ে তোলা পরিসর নয়। মানুষের সৃষ্টিশীলতা এই অবস্থানগুলির উৎস হলেও সমাজের স্থিতি এবং কম্পনশীলতা নিরপেক্ষ নয় এ পরিসর। যত দিন যাচ্ছে, তত বোঝা যাচ্ছে, এই পরিসর একটি ঘোরতর বাস্তবতা। এই পরিসরটির আত্মোপলদ্ধির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ অন্য পরিসরগুলোতে বা অন্য কোনো কিছুতে উপনীত হওয়ার নয়, বরং বিভাজনগুলি থেকে মুক্তির।
মানুষের সৃষ্টিশীলতা এই পরিসরের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, যেন বা সমাজের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত, অবাস্তব পরিসর। কিন্তু আদপে এই পরিসর সমাজের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত নয়, বরং সমাজের বৈচিত্র্যের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এটি কোনো শিল্পকলা (আর্ট) নয়। তবে অনেকসময়ই এই পরিসরের একক অবস্থানগুলির ক্ষণস্থায়িত্ব, দুর্বল অবস্থা এবং যে কোনো
জায়গায় গজিয়ে ওঠা, অর্থাৎ সমাজের বৈচিত্র্যের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশকে, ভুল করে শিল্পকলা (আর্ট) অথবা সমাজবিচ্ছিন্নতা বলে মনে হয়।
এই তৃতীয় পরিসর মাইক্রোফ্যাসিজম এবং আত্মঘাতী প্রবণতা মুক্ত নয়। মাইক্রোফ্যাসিজম অর্থাৎ ক্ষুদ্র পরিসরেও যে ফ্যাসিবাদ কাজ করে, ক্যানসারের মতো, দ্রুত ধ্বংস ডেকে আনে। আত্মঘাতী প্রবণতা মাইক্রোফ্যাসিজমের মতোই, আত্মধ্বংসকারী।
সমাজজীবনে অন্তর্লীন রাজনীতির তৃতীয় পরিসর। উল্লেখ্য, পুঁজিবাদও সমাজে অন্তর্লীন একটি ব্যবস্থা।
রাজনৈতিক ঘটনা এবং তার সঙ্গে তৃতীয় পরিসরের সম্পর্ক
ইদানীং এক ধরনের আন্দোলন দেখা যাচ্ছে, যা প্রথাগত আন্দোলনগুলো থেকে আলাদা। যে আন্দোলনগুলো কেউ (রাজনৈতিক শক্তি) ঘটা করে ডাকছে না। কেমনভাবে যেন ঘটে যাচ্ছে। ঘটা করে ডাকা আন্দোলন-জমায়েত হয়ে দাঁড়াচ্ছে নিষ্প্রাণ, আনুষ্ঠানিক, লোকদেখানো। বিপরীতে এই ধরনের আন্দোলনগুলো যেন সমাজের অন্তর থেকে বেরিয়ে আসছে। আবার এই আন্দোলনগুলোর মধ্যে উদ্ভাসিত প্রাণ মিলিয়ে যাচ্ছে অতি দ্রুত। কিন্তু তার স্মৃতি থেকে যাচ্ছে সমাজে। তার অনুরণন থাকছে ব্যবস্থায়। এই আন্দোলনগুলোকে আন্দোলন, জনআন্দোলন ইত্যাদি না বলে ঘটনা বা ইভেন্ট বলছেন সমাজতাত্ত্বিকরা।
আমাদের কাছাকাছি ইদানীংকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট বা ঘটনা হল নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী দখল-আন্দোলন, ২০০৭। ২০০৬ সালের শেষ সপ্তাহে ঈদ উপলক্ষ্যে বাড়ি এসেছিল যে ছেলে-ছোকরার দল, যারা বিভিন্ন জায়গায় দর্জি বা অন্যান্য কাজ কারবার করে। তারা এবং তাদের মায়েরা দিদিরা অসীম শক্তি নিয়ে সারা নন্দীগ্রামে ঢোকার সমস্ত রাস্তাগুলি কেটে দিয়েছিল, যাতে সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী বাইক গাড়ি নিয়ে জমি দখল করতে ঢুকতে না পারে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে রাস্তা কেটে দিয়ে তারপর তারা ধীরে ধীরে দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ওই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল ভূমি অধিগ্রহণ বিরোধী কমিটি। এসইউসি নেতা ছিল, পিডিসিআই নেতা ছিল, পিসিসিএমএল নেতা ছিল, তৃণমূল নেতা ছিল তাতে। এইসব দলগুলিই ঘটনার আগে কিছু দিন ধরে প্রচার-টচারও চালিয়েছিল নন্দীগ্রামের গ্রামগুলোতে। কিন্তু ৩ জানুয়ারি সকাল থেকে এই দানবিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করা ওইসব কোনো দলের কম্ম ছিল না। নন্দীগ্রামের সমাজ যেন নেমে এসেছিল বিদেশি আর হার্মাদদের হাত থেকে গ্রাম আর চাষজমিগুলোকে রক্ষা করতে। তারপর ধীরে ধীরে ওই আন্দোলনের দখল নেয় ভূমি রক্ষা কমিটি — সংগঠক হিসেবে। এরপর বিভিন্ন দলগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকে কমিটি তথা আন্দোলনের ঠিকাদারি নেওয়ার জন্য। স্বাভাবিক নিয়মেই সবচেয়ে সংগঠিত দল, তৃণমূল কংগ্রেস, এই আন্দোলনের ঠিকাদারির বরাত নিয়ে নেয়। মার্চ মাসের সরকারি অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সময়ই তৃণমূলের হাতে চলে গিয়েছিল আন্দোলনের সংগঠন। যদিও ১৪ তারিখের প্রতিরোধের সামনের সারিতে প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল নেতারা যায়নি। ১৪ তারিখে গুলিচালনার পর ১৭ তারিখ মিছিল করে শুভেন্দু অধিকারী নির্ধারকভাবে তৃণমূলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নন্দীগ্রামে। কয়েক মাস নিশ্ছিদ্র কর্তৃত্বের পর নভেম্বর মাসে সিপিএম হার্মাদ বাহিনী নিয়ে পুনর্দখলের চেষ্টা চালালে ফের খুন-খারাবি হয়। মাওবাদীরাও জড়িয়ে পরে। এত ঘটনার মধ্যে দিয়ে নন্দীগ্রামের ৩ জানুয়ারি ও তার পরের কয়েক দিনের ‘ঘটনা’র উত্তরাধিকার বা ঠিকাদারি নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি চেষ্টা করেছে। আপাতদৃষ্টিতে কেউ কেউ সফলও হয়েছে। নন্দীগ্রামের জনপ্রতিরোধই সিঙ্গুরকে ফের একবার জাগিয়ে দিয়েছে, নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ বাতিল হয়েছে সরকারিভাবে, ৩৪ বছরের বাম সরকারের পতন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে, সারা দেশে জমি অধিগ্রহণবিরোধী কৃষক আন্দোলনগুলি জোর পেয়েছে, সেজ গঠনের নীতি জোরে ধাক্কা খেয়েছে, শতাধিক বর্ষ প্রাচীন জমি অধিগ্রহণ আইন পরিবর্তনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে তৎপরতা দেখা দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বরের ঘটনার কুশীলব শত শত যুবকরা এসবের কোনো কিছুতেই নেই। তাদের কেউ ঈদের ছুটি শেষ হতে ফিরে গেছে মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগরের মেশিনে, কেউ হয়তো চলে গেছে দূরে কোথাও কাজের জায়গায়, কেউ চলে গেছে রান্নাঘরে গোয়ালে বা উঠোনের প্রান্তে গেরস্থালীর কাজে। ও৩ জানুয়ারির প্রাণও আর ফিরে আসেনি গোটা নন্দীগ্রাম পর্বে। লোকসমাজের স্মৃতিতে কিন্তু ওই রাস্তা কাটা অমলিন হয়ে আছে জমি অধিগ্রহণ বিরোধী লড়াইয়ের রূপ হিসেবে। এই একই কায়দা আমরা দেখেছি কিছু মাস পরে হরিপুর পরমাণু কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনেও। সিপিএম-তৃণমূল-মাওবাদীরা (এবং রাষ্ট্র ও মিডিয়া) বারবার নিজেকে বা অন্যকে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের রূপকার হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করলেও জনস্মৃতিপটে বিকৃতিটি ঘটাতে পারেনি।
অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটও ছিল এরকম একটি ঘটনা। কী স্পেনে, কী আমেরিকায়। আমেরিকায় অকুপাই আন্দোলন শুরু হয়েছিল স্পেনের বিক্ষুব্ধদের আন্দোলনের অনুপ্রেরণায়। কিন্তু অ্যাডবাস্টার, ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রভৃতি কয়েকটি পত্রিকা যখন আমেরিকার অকুপাই আন্দোলন ও তার স্লোগান (উই আর ৯৯ পারসেন্ট) তৈরি করে সেপ্টেম্বর মাসে জমায়েতের ডাক দিয়েছিল নিউ ইয়র্কের একটি প্রাইভেট পার্কে, তখন তারা ভাবতেও পারেনি, কয়েক মাসের মধ্যে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে কয়েক শো মার্কিন শহরে। আবার শীত জাঁকিয়ে পড়তেই উধাও হয়ে গেল এই আন্দোলন। তখন এই আন্দোলনের ঠিকাদারি দাবি করার লোকেরও অভাব হয়নি। এমনকী অ্যাডবাস্টার পত্রিকার মধ্যেই ভাঙন ধরিয়ে এই আন্দোলনের ঠিকাদারি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল একজন। স্পেনের আন্দোলনও একইভাবে উবে যায়, পরে এই আন্দোলনেরই একটা অংশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে তৈরি হয়ে পোডেমস পার্টি, যা এখন স্পেন সহ ইউরোপ কাঁপাচ্ছে, স্পেনের সামনের সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি হয়ে যেতে পারে এরা। এহেন অকুপাই আন্দোলনের শুরুয়াত এবং বিদ্যুৎবেগে প্রসারটিও একটি ঘটনা।
অনেক দূর থেকে দেখা, অনেকটাই তাই দেখা যায় না। তবু মিশরে তাহরির স্কোয়ারে মুবারক জমানার অবসান চেয়ে যে দখল আন্দোলন ঘটেছিল তাও এক ঘটনা। বা তার আগে মিশরের একটি কারখানা দখল। গুড়গাঁও-তে মারুতি কারখানার দখল নিয়ে নেওয়া শ্রমিকদের কয়েকদিনের লড়াইটিও একই রকম ঘটনা।
দিল্লির ধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে রাইসিনা হিল-এর সামনে বিক্ষোভও এরকম ঘটনা ছিল। কিছুদিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী আন্দোলনও এরকম ঘটনা।
ঘটনাগুলির বৈশিষ্ট্যগুলি এরকম :
১) প্রায় অসংগঠিত ভাবে সংগঠিত। ঘটনা হয়ে যে উঠবে, তা সংগঠকদের ধারণার অতীত।
২) হতচকিত করে দেওয়ার মতো।
৩) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, দ্রুত বিলীন হয়ে যায়।
৪) আপাতদৃষ্টিতে অরাজনৈতিক, সোচ্চারে রাজনীতি বিরোধী, কিন্তু আসলে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ঘটনা।
৫) সমাজে মিশে যাওয়া (পারমিয়েটেড) পুঁজি, সমাজে অন্তর্লীন (ইমানেন্ট) পুঁজিবাদ (এবং তজ্জনিত বিক্ষোভ) সঞ্জাত ঘটনাগুলো।
৬) কুশীলবরা মিলিয়ে যায় — ভুলে যায় নিজেদের যে ভূমিকা ছিল ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার সময়। সংগঠিত শক্তি, যারা ঘটনার মধ্যে কোনো না কোনোভাবে ঢুকে পড়েছিল, তারা ঘটনার ঠিকাদারি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
৭) রাষ্ট্র, মিডিয়া, সিভিল সোসাইটি — ব্যবস্থার সবক-টি থাম্বাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
৮) সমাজের স্মৃতিতে থেকে যায়।
৯) নির্দিষ্ট কোনো দাবি থাকে না। ভাসাভাসা কিছু কথা থাকে।
১০) সমাজের উপরিতল এবং দৃশ্যমান যা কিছু, তার মধ্যে এর আগাম হদিশ মেলে না।
গণ আন্দোলন/জন আন্দোলন থেকে আলাদা তো বটেই, রাজনৈতিক ঘটনাগুলি সেভাবে দেখলে কোনো আন্দোলনই নয়। আন্দোলনের শুরু ও শেষ আছে — এবং সে দুটোই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এগুলি বাস্তব ঘটনা মাত্র। তার শুরু শেষ ঠিক বোঝাও যায় না। খুব একটা প্রয়োজনীয় বিষয়ও নয়। বামপন্থী/দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বয়ানে এগুলো সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ওইসব বয়ানে অনেক সময় এগুলোকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু কোনো একটা কিছুকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ বলার মধ্যে দিয়ে তাকে সচেতন উদ্যোগের বিপরীতে হাজির করানো হয় এবং তা যেন সচেতন নেতৃত্বের অপেক্ষায় আছে — এভাবে ভাবা হয়। প্রথমত, এই ঘটনাগুলো পুরোটা স্বতস্ফুর্ত নয়, এগুলো আলগাভাবে সংগঠিত। দ্বিতীয়ত, ঘটনাটিতে ‘পরিকল্পনা’ বা কয়েকজনের মস্তিষ্কপ্রসূত বা কগনিটিভ সচেতনতা নিশ্চয়ই নেই, কিন্তু কুশীলবদের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা, অভ্যাস, এবং বোধ সঞ্জাত (ব্যবহারিক) চেতনার ভীষণরকম ভূমিকা আছে। উদাহরণে ফের নন্দীগ্রামের কথা আসে : কুশীলব যুবক যুবতীরা ভালোই বুঝেছিল, কয়েক ঘন্টার মধ্যে নন্দীগ্রামে ঢোকার সমস্ত রাস্তা কেটে দিতে না পারলে, লক্ষণ শেঠের বাহিনী যে কোনো সময় গ্রামে ঢুকে গ্রাম দখল করে নেবে, টিভি-মার্কা তর্ক-টর্ক করে সে যাত্রা জমি অধিগ্রহণ আটকানো যাবে না।
প্রথম ও দ্বিতীয় পরিসর ক্ষমতার পরিসর। বিভাজনের পরিসর। তারা ‘ঘটনা’কে ভয় পায়। অস্বস্তিতে পড়ে। যত দ্রুত সম্ভব ঘটনার দখল নিতে চেষ্টা করে। কারণ জানে, ঘটনাগুলির দখল নিতে পারলেই ঘটনাগুলি আর ঘটনা থাকবে না। বরং ঘটনাটি সমাজ ও প্রশাসনে যে অনুরণন তৈরি করেছে, ঘটনার ঠিকাদার হয়ে উঠতে পারলে তার সুবিধা নেওয়া যাবে। তৃতীয় পরিসরের ভিতর থেকে কোনো একক অবস্থানের প্রথম বা দ্বিতীয় পরিসরে যাওয়ার যাত্রাবিন্দু হতে পারে এই ঘটনাগুলি।
তৃতীয় পরিসর ঘটনাকে খুবই পছন্দ করে, কারণ ঘটনার চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে তৃতীয় পরিসরের খুব মিল। তৃতীয় পরিসর ঘটনাগুলি থেকে শেখে। এমনকী কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটনাগুলিকে প্রভাবিতও করে। ঘটনাগুলি নিজের আলোতেই আলোকিত ও দৃশ্যমান। (প্রসঙ্গত, আন্দোলনের দৃশ্যমানতার জন্য আলাদা করে মিডিয়ার আলোর প্রয়োজন হয়)। ঘটনাগুলি নিজেরা এতটাই আলো বিচ্ছুরণ করে যে তার আলোতে অনেকসময় সমাজে অন্তর্লীন স্তরের তৃতীয় পরিসরটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে কিছু সময়ের জন্য।
কিছু উদাহরণ দিয়ে ওপরের বক্তব্যগুলো একটু পরিষ্কার করা হল। তবে মনে রাখা দরকার, বক্তব্যগুলো এই সব উদাহরণ সাপেক্ষ নয়। আরও মনে রাখা দরকার, খুব চেনা জানা কিছু উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে, তবে হতেই পারে যে এগুলো ছাড়া আরও অন্যান্য উদাহরণ ব্যবহার করলে বক্তব্যটি আরও পরিষ্কার করা যেত।
Leave a Reply