বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতি-চর্চার অন্যতম কেন্দ্র ‘ছায়ানট’-এর জন্ম হয়েছিল ১৯৬১ সালে। ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিবছর (একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের বছর ছাড়া) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক কর্মীরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, সে-প্রসঙ্গেও ছায়ানটের নামোল্লেখ দরকার।
১৪০৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে রমনায় এক ভয়াবহ বোমা-হামলা হয়েছিল। ওই ঘটনার পর মন্থন পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গিয়ে কথা বলেছিলাম। সেই সাক্ষাৎকার মন্থন সাময়িকীর ২০০১ সালের মে-জুন সংখ্যায় ‘বাংলাদেশ : পয়লা বৈশাখের হামলা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা সেই কথাবার্তার সূত্রটা ধরেই এবার তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। মাঝখানের প্রায় চোদ্দো-পনেরো বছরের অদলবদলকে বুঝতে চেয়েছি। শুধু পরিস্থিতি আর ঘটনার অদলবদল নয়, ভাবনাচিন্তা ও অভিজ্ঞতার বদলকেও বুঝতে চেয়েছি। এবারে আমরা কথা শুরু করেছি হালফিল বাংলাদেশ নিয়ে। বাংলাদেশের ঢাকায় শাহবাগ স্কোয়ারে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে নবীন প্রজন্মের এক জমায়েত শুরু হয়েছিল। তাই কথার শুরুতেই উঠে এল সেই প্রসঙ্গ।
সন্জীদা খাতুন : গণজাগরণ মঞ্চ যখন প্রথম হল, দারুণ একটা স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ঘটল! সবাই ভীষণ আপ্লুত হয়েছিল। তারপর রাজীব নামে ওদের একজনকে ধর্মান্ধরা মেরে দিল ব্লগার বলে। ও নাকি ধর্ম সম্বন্ধে কী লিখেছিল। ওর স্ত্রীও সেটা জানত না। ওকে তো মেরে ফেলল, তারপর ব্লগারদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার নিয়ে অ্যাকশন শুরু করল ধর্মব্যাবসায়ীরা। হেফাজতে ইসলাম বলে একটা দল আন্দোলন করছিল ব্লগারদের বিরুদ্ধে। ধর্ম আর পলিটিক্স একসঙ্গে করলে যে কী হয়, সে সবাই জানে। সরকার জামাতকে ঠেকাতে চাইল হেফাজতকে দিয়ে। সে তো হয় না, ওদের তো নিজেদের ভেতরে ভেতরে আঁতাত। জামাত, হেফাজত, এমনকী বিএনপি — সব একসাথে ওরা। বিএনপিকেও ওরা ধ্বংস করবে, আমরা সবাই জানি। যতদিন স্বার্থোদ্ধারের প্রয়োজন আছে, ওরা বিএনপিকে ব্যবহার করবে। আর বিএনপি যতদিন ক্ষমতার লোভে আছে, ততদিন ওরা জামাতকে, হেফাজতে ইসলামকে ব্যবহার করবে। হাসিনা তো ওদের তুষ্ট করতে চাইলেন। দেখা গেল, ওরা গোপনে বিক্রি হয়েছে বিএনপির কাছে।
মন্থন : ২০১৩ সালের কলকাতা বইমেলাতে জড়ো হয়েছিল বাংলাদেশের কিছু ছেলেমেয়ে। ওরা ইন্ডিয়াতে পড়াশুনা করে। শাহবাগ স্কোয়ারের জমায়েতের সমর্থনে ওরা এখানে মিছিল করল। ওদের মধ্যে কিছু নাস্তিকও আছে।
সন্জীদা খাতুন : ওখানেও আছে। ওরা সোজাসুজি ধর্মকে শুধু অস্বীকারই করে না, ওরা এবং ওদের বিরুদ্ধে ধর্মের পক্ষে যারা লেখে, তাদের প্রতি অ্যাগ্রেসিভ। গালাগাল দিয়ে লেখে … ওই করতে গিয়েই রাজীব মারা পড়ল। বড়ো ভালো ছেলে ছিল।
মন্থন : আসিফ মহিউদ্দিনকেও ওরা প্রায় মেরে ফেলেছিল।
সন্জীদা খাতুন : শুধু ওকে না, আরও কয়েকজনকে। হেফাজতকে প্লিজ করবার জন্য আমাদের সরকার খুব চেষ্টা করেছিল। তারপর হেফাজত আসল রূপটা প্রকাশ করল, ঢাকায় এসে পথে ঘাটে ভাঙচুর করে হাসিনাকে হতভম্ব করে ফেলল। অতঃপর হাসিনা হেফাজতের বিরুদ্ধে গেলেন। আর গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরে যে কত কী ঘটেছে! তবে ওদের যে ছেলেটি এখন চালাচ্ছে, ইমরান, ও নাকি একসময়কার ছাত্রলীগ। আমি এদের কাউকে প্রত্যক্ষভাবে চিনি না। একবার — এই বছরের আগের বছরের পয়লা বৈশাখে — আমাকে ওরা বারবার করে বলেছিল, আপনি আমাদের এখানে আসুন। আমি যাইনি, তার কারণ আমার একটা অভিযোগ আছে, এদেশের যারা আন্দোলন করে তাদের সম্পর্কে। আন্দোলনটা তো অল্প সময়ের। করে আর শেষ করে। তুষ্ট হয়ে যায় নিজেরা! একটা ইস্যু দুটো ইস্যু। কিন্তু দেশের ভিতরে যে পুরোটা অসচেতন-অন্ধকারাচ্ছন্ন, সেখানে কোনো যে কাজ করবার আছে, একজনও ভাবে না। এই নিয়ে আমি কয়েকবার বলেছি বিভিন্ন জায়গায়। ওদের আমি লক্ষ্য করি, কেবল প্রোগ্রাম নেয়। আমার নাতনিও ওদের সাথে চলে। ও আবার আমায় বলল, ‘না, ওরা অনেক কাজও করে।’ কিছুদিন আগে এই যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলো হল, অবশ্য দাঙ্গা একে বলে না, একপক্ষ থেকে খালি হিন্দুদের ওপর নির্যাতন, বাড়ি-ঘরদোর পুড়িয়ে দেওয়া। সেই সময় আমার নাতনিরা আটজন ওইসব জায়গায় ঘুরে দেখে এল সত্যি সত্যি কী হয়েছে। ওরা একটা আলাদা সংগঠন করে, ‘আমরা’ নাম দিয়ে। সেখান থেকে ফিরে আসার পরে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কী দেখলে, বলো’। ওরা খবর দিল, যশোরের অভয়নগর না কী এক জায়গায়, আমি নাম মনে রাখতে পারি না, সেখানে গিয়ে দেখেছে, আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন পেয়ে এক হিন্দু ভদ্রলোক ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিলেন, এখন আওয়ামী লীগের এক মুসলিম সদস্য অত্যাচার করে, ঘর জ্বালানো-পোড়ানো এইসব করে, ওঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করলেন। এঁকে হেনস্তা করতে হিন্দুদের ঘর জ্বালিয়ে-টালিয়ে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা, এমনকী হিন্দু ভদ্রলোকটির বাড়িও অ্যাটাক করল। তবে গণজাগরণ মঞ্চ ওখান থেকে এসে নাকি জানায়, ওখানে কিচ্ছু হয়নি!
মন্থন : এই যে গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগ আন্দোলন, এটা কি আওয়ামী লীগের ইন্ধনে হয়েছিল না স্বতঃস্ফূর্ত?
সন্জীদা খাতুন : আমরা যতদূর বুঝি, গণজাগরণ মঞ্চ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। কিন্তু মঞ্চ দখল করার জন্য আওয়ামী লীগ ছুটে আসে। মঞ্চে ওরা উঠবার চেষ্টা করে, প্রথমদিকে বাধাও পেয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। আর জামাতের হাত এত লম্বা, কেউ কল্পনা করতে পারে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরির মামলার রায়ের কপি আগের দিনই বেরিয়ে গেল, রায়ের কিছুটা অংশ। কী করে হল, কী করে হল, তাই নিয়ে চেঁচামেচি, রায় যখন পড়া হচ্ছে তখন আসামীর বউ চিৎকার করছেন, এটা তো কালকেই আমরা ফেসবুকে পেয়েছি। এসমস্ত হবার পরে এনকোয়ারি হল, দেখা গেল, একটি নতুন লোককে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছিল, সে কম্পিউটার বোঝে, সেখান থেকে ওটাকে আউট করে দিয়েছে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরির ফ্যামিলির কাছে। এবং ওটা ফেসবুকে চলে গেছে। এটা হওয়ার পরে রায়ের কী মূল্য থাকে? সমস্তটা একটা ঘোঁট পাকিয়ে উলটোপালটা হচ্ছে। সাংঘাতিক! ওরা কীভাবে যে একেবারে ভেতরে ঢোকে। এক সময়ে ওদের প্রশ্রয় দিয়েছেন হাসিনাও, ওদের সঙ্গে সরকার গড়েছেন। এখন ওদেরকে ফেলে দিয়েছেন। এখন বিএনপি বলে, কী রে তোরা কী করেছিলি? আমরা জোট বেঁধেছি, ঠিক করেছি।
মন্থন : ২০০১ সালে আপনি আমাদের বলেছিলেন, আমরা আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট দিচ্ছি।
সন্জীদা খাতুন : ব্যাপার হচ্ছে, সাপোর্ট দেওয়া মানে কী? বাঙালি সংস্কৃতির কথা যিনি বলেছেন, আমি এক ব্যক্তির কথাই বলব, তিনি শেখ মুজিব। এখন তো কেউ সংস্কৃতি বোঝে না। কোনো পলিটিকাল পার্টি কোনো সংস্কৃতি বোঝে না। তারা ওই ধুমধাড়াক্কা ব্যান্ড বোঝে আর এই সমস্ত আজেবাজে ইয়ের সাথে কোমর দুলিয়ে নাচা বোঝে। কোনো কালচার নেই। এখন আমরা পুরোনো যারা আছি, আমাদের এত মনঃকষ্ট কী বলব!
সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা কামাল, আনিসুজ্জমান, ডাঃ সারওয়ার আলী, তারেক আলী, এমন অনেকেই আছে; ওরা শহর থেকে বেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বক্তৃতা করে বেড়ায়। এবং এই কাজটা ওরা নিজেরা খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করছে। আনিস নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েও করে যাচ্ছে। ডাঃ সারওয়ার আলী বড়ো বড়ো চাকরি করেছে। এখন আমাদের কাজটা খুব মন দিয়ে করে। আমরা কী চাই, সারওয়ার সেটা বোঝে। আমি ছায়ানটের সাধারণ সভায় গতবার বলেছি, ‘দেখো, শুধু বক্তৃতা দিয়ে কিছু হবে না। যেটা করা দরকার, সেটা আমি একটা কাহিনি দিয়ে বলছি। লিবারেশনের পরে পরে, আমাদের প্রফেসর আনিসুর রহমান এবং আরও নামী কারা কারা, নানা জায়গায় গিয়ে অনেক অনেক বক্তৃতা করতেন। রাষ্ট্র, অর্থনীতি, ইত্যাদি বহু বিষয়ে। সামনে মানুষেরা বসে থাকত, শূন্যদৃষ্টি নিয়ে। কী যে হত, ওরা নিজেরাই বুঝত না। সেইসময় পিছনে বসে থাকা একজন মাইকে দাঁড়িয়ে জাদুমন্ত্রে যেন সমস্ত বক্তব্য তুলে ধরল। মহম্মদ শাহ বাঙ্গালি নাম নিয়ে সে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রেডিওতে গান গাইত। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কথা বলছি। সে বসেছিল মঞ্চের পিছনে, বক্তৃতা শেষ হলে পরে উঠে দাঁড়াল। উঠে গান গেয়ে তার ভাষাতে মূল কথাটা যখন বলল, তখন মানুষের চোখ চকচক করে উঠল, তারা সব বুঝল।’ এই যে সংগীতের দৌত্য, এটা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ — তোমাদের ওই জায়গাটায় যেতে হবে, পারফর্মেন্সে যেতে হবে।
এখন আমাদের যে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ আছে, তাতে আমরা একটা পাঠচক্র করছি। এখন এর ৮২টা শাখা হয়েছে।
মন্থন : ২০০১ সালে বলেছিলেন ৪৫টা শাখা —
সন্জীদা খাতুন : এখন বেড়েছে। আমাদের কারও কারও মতে এ তো সংখ্যায় বৃদ্ধি, কোয়ালিটিতে বাড়তে হবে। নানারকম লোক নিয়ে তো কাজ করতে হয়। আমি বলেছি, দেখো চারদিকে তোমাদের শাখা আছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করে দেখো, রবীন্দ্রনাথের বানান লিখবে হ্রস্ব-ইকার দিয়ে। কারণ সবাই সংস্কৃতিতে অশিক্ষিত। আগে নিজেরাই শিক্ষিত হও, তারপর অন্যকে …
মন্থন : একটা লোক দেখানো ব্যাপার —
সন্জীদা খাতুন : তাই না? ক-দিন মঞ্চ সাজিয়ে খুব গান-বাজনা আলো-টালো হল। এর কী মানে আছে?
মন্থন : কতটা কমিউনিকেটেড হল, কতটা গেল?
সন্জীদা খাতুন : তাতে কতটা গেল বলতে লোকের আনন্দ হল চলে গেল। বিনোদন হল। এগুলো নিয়ে আমি খুব চেঁচাই। তবে আমি খুব পাবলিক জায়গায় যাই না। আমি ছায়ানটের সাধারণ সভায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সভায় এগুলো বলি। পরিষদে ওদের বলা হয়েছে, নিজেদের লেখাপড়া করতে হবে। আবার এটাও জানি, তারা নিজেরা লেখাপড়া করে কিছু বুঝবে না, অনেককিছু লাগে। এখন সেজন্য রীতিমতো পড়ানো আরম্ভ করেছি। পাঠচক্র হয়েছে। কিন্তু এই বিরাশি বছর বয়সে আমি তো একলা পারব না। ঘুরে ঘুরে পারি না। আমি টিম তৈরি করার চেষ্টা করছি। বিশেষ করে পারফর্মারদের টিম।
মন্থন : পাঠচক্রের পাঠক্রমে কী আছে?
সন্জীদা খাতুন : পাঠক্রমের মধ্যে অনেককিছু আছে। আমরা এখন যেটা করি, গ্রামের মানুষের মধ্যে যাবার জন্যে সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি, তারপরে মেয়েদের ওপর অত্যাচার নিয়ে জসীমউদ্দীনের একটা ভারী মজার গল্প আছে। এরকম অনেককিছু রেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে অনেক কবিতা আছে। এগুলো পড়া হয়। আমার তো বিষয়টা রবীন্দ্রনাথ। আমি তো পড়িয়েছি বহুদিন। রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে, ‘পত্রপুট’ কাব্যের ১৫ নম্বর কবিতা। তাতে উনি বলছেন, এতদিন ভেবেছি, যাঁকে সবাই পূজা দিয়ে এসেছে, আমিও বোধহয় তাঁকেই পূজা দিয়ে এসেছি। আজকে জেনেছি, আমি তাঁর পূজা করিনি। আমার পূজা মন্দিরের দুয়ারের ভিতরে যায় না। বদ্ধ একটা জায়গায় আমার পূজা যায় না। বাউলদের মতো আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন। আমার পূজা চলে গেছে, ওই যে বিরাট রাস্তাটা ধরে সেই চৌমাথায়, যেখানে দিনের পর দিন মহাপুরুষরা এসেছেন বাতি নিয়ে, তাঁদের বাণী নিয়ে, ওইখানে গিয়ে আমার পূজা সম্পন্ন হবে। আমার পূজা, আকাশে যখন আলোটা ফোটে, সর্বত্র নিজেকে বিস্তৃত করে দেয়, সেই আলোর দিকে তাকিয়ে সম্পন্ন হয়। কবিতাটা একদিন আমি পড়লাম। একটু বুঝিয়ে দিতে হয়। … পড়াতে গিয়ে তো মাস্টার হতে হয়। এছাড়া, রবীন্দ্রনাথের যে নাটকগুলো, রক্তকরবী বা কালের যাত্রা বা মুক্তধারা, এগুলোর মধ্যে দিয়ে যে বাণী এসেছে, সেগুলো ধরতে হবে তো, সেগুলো আমি এদের বলি।
মন্থন : এই পাঠচক্র কি শহরে হয়?
সন্জীদা খাতুন : ৮২টা শাখা তো নানান জায়গায় ছড়িয়ে আছে। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে আছে। ওদের আমরা বলি, তোমরা নিজেরা পড়ে তারপরে এগুলো ছড়াও, পারফর্ম করো। ছোটো ছোটো নাটক। হুমায়ুন আহমেদের একটা গল্প বন্যা নিয়ে। একজন প্রতিমন্ত্রী ত্রাণ বিতরণ করতে গেছেন, কী তাঁর কাণ্ডকারখানা, সেটা নিয়ে এমন একটা গল্প, সাঙ্ঘাতিক! হুমায়ুন আহমেদের লেখার আমি ভক্ত নই। কিন্তু এই গল্পটা যখন একজন মুখস্থ বলে যাচ্ছে … কতকগুলো আবৃত্তি প্রতিষ্ঠান আছে, ওদের আমি সব খোঁজ পেয়েছি। ওদের আমি নিয়ে আসি। ওদের দিয়ে করাই। যারা শোনে, বলে, গল্পটা পড়েছি কিন্তু এরকম করে তো অনুধাবন করিনি। অনুধাবন করানো যাচ্ছে। এরা শুনুক, তারপর এরা এই জিনিসগুলো নিয়ে অন্যদের কাছে যাবে।
কী বলব! এইভাবে তো আগে ভাবিনি। আর আমার তো এখন অচল অবস্থা প্রায়।
মন্থন : বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের অনেক ব্লগ রয়েছে। প্রচুর লেখাপত্র ব্লগে বেরোচ্ছে। এই প্রজন্মের মধ্যে আপনাদের কাজ কীরকম? এরকম সংগঠক কি আছে, ধরুন যার বয়স কুড়ি বা পঁচিশ।
সন্জীদা খাতুন : আমার নাতনির বয়স আটাশ। ওর সঙ্গে যারা, তারা সব কাছাকাছি বয়সের। ওরা ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়ায় কোথায় কী বিপর্যয় হচ্ছে। টাকা তোলে, দিয়েও আসে দুঃস্থদের। এরকম সব অনেকেই করে। এমন করুণ অবস্থা বলে … এরা নিজের নিজের মতো এটা শুরু করেছে। এরাও বলছিল যে আমরা এই লেখাপড়াগুলো করতে চাই। যাক। বক্তৃতাও করুক। কিন্তু পারফর্ম করতে হবে, মানুষের ভিতরে ঢুকে। এটা আমার এখনকার কথা।
মন্থন : যেমন, আমরা ব্লগে দেখেছি, রানা প্লাজায় …
সন্জীদা খাতুন : তখনও এই মানুষগুলো ছুটে গেছে। দিনরাত পড়ে থেকে …
মন্থন : অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা গেছে। ওরা ব্লগে লিখেছিল, আমরা আগে কিন্তু এরকম কাজ করিনি।
সন্জীদা খাতুন : কেউ করেনি। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়েছিল। জাহানারা ইমামের বইটার কথা তো জানা আছে। সেই বইতে যে ‘রুমি’, ও তো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। ওর তো বিদেশ যাওয়ার কথা, আমেরিকায় পড়তে যাবে। ওর মা তো রুমির মুক্তিযুদ্ধকে নিতে পারছেন না প্রথমে। ছেলে যখন গেরিলা হয়ে গেল, প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছে তাঁর। এর আগে তারা কী করে এসেছে? ইংরেজি গান শুনেছে, ইংরেজি কবিতা পড়েছে। এই প্রতিরোধ সংস্কৃতির সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি এটা আগে ভালো করে লক্ষ্য করিনি। অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটির ছেলেমেয়ে এরা। দেশভাবনার কোনো প্রস্তুতি নেই। কিন্তু যখন এসে পড়ল ঘাড়ে, সব অস্ত্র হাতে তুলে নিল এইসব তরুণ ছেলেপুলেরা। মরল। কীভাবে যে ওরা গেরিলা ওয়ারফেয়ারটা টেনে নিয়ে গেছে! সাংঘাতিক ব্যাপার! এইরকমই বোধহয় রানা প্লাজার সময় হল, গণজাগরণ মঞ্চের সময়ও হল। ওদের ধরে রেখে কাজ করানো খুব যে একটা হচ্ছে তা দেখছি না। ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হচ্ছে। যেমন আমার নাতনি, ওরা দল বেঁধে একটা জায়গায় রানা প্লাজার শ্রমিকদের সেলাইয়ের কল টল দিয়ে সাহায্য করেছে। ওরা চেষ্টা করে, যায়। গিয়ে দরকারে টাকা দিয়ে আসে। এইরকম বিচ্ছিন্নভাবে কিন্তু অনেকেই করছে। এটা একটা শুভলক্ষণ।
আমি তো আগের সাক্ষাৎকারে অমিতাকে বলেছিলাম, সংস্কৃতি আন্দোলন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। রাজনীতি ইত্যাদি হয়তো পাশাপাশি ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তারা কি বুঝে করেছে? যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, মরতে মরতে, তখন ওরা ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করেছে। যদিও বলা হয় একটা জাগরণ হয়েছিল। কিচ্ছু হয়নি। তাতেই না এত দ্রুত সব মিলিয়ে গেল। কী দেখলাম ওই স্বাধীনতার পর!
আমারই একটা অভিজ্ঞতা আছে। আমি একদিন রেডিওতে গান গাইতে গেছি। গান গেয়ে বেরিয়ে আসতেই একটি মেয়ে আমাকে বলছে, সেও কিন্তু বাংলার অধ্যাপিকা, রবীন্দ্রসংগীত গান কেন? নজরুল গাইতে পারেন না? আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম। অল্পবয়সি মেয়ে, কী সাহস! আমি কিছু বললাম না, চলে এলাম। লিবারেশন ওয়ারের পরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় গেছেন, সেই মঞ্চে আমরা কেউ উঠছি না। আর ওই মেয়েটি গান গাইছে, কারণ তার স্বামীকে মেরে ফেলেছে পাকিস্তান আর্মি। সেই রবীন্দ্রসংগীতই গাইছে, জঘন্য গাইছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে সুবিধা গ্রহণ করছে। একটা বই, ‘আমার সোনার বাংলা’ আমি তাতে লিখেছি … রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে গেছেন, স্বাধীনতা কাকে বলে।
তুমি দেশ জুড়ে সবাইকে অশিক্ষিত রেখে দেবে। সব জায়গায় অসাম্য রেখে দেবে। তুমি খালি ভাগ করবে, ভাগ করবে। তারপরে তুমি স্বাধীন বলবে নিজেকে? বলতে পারবে? তুমি পরাধীন। দেশের ওইসমস্ত লোকেরা যতদিন পরাধীন, তুমিও পরাধীন।
মন্থন : আগেও আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম যেবার পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের ওপর বোমা হামলা হয়েছিল —
সন্জীদা খাতুন : তখন আমি রীতিমতো অসুস্থ ছিলাম, বিপর্যস্ত। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
মন্থন : আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। যেমন শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে বেশ খানিকটা কথা হয়েছিল। একটা প্রশ্ন আমরা বারবার জিজ্ঞেস করেছি, বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ, তার তো বেশিরভাগটা গ্রাম। সেই গ্রামের মানুষের কী হচ্ছে? গণজাগরণ মঞ্চই বলি বা …
সন্জীদা খাতুন : কিচ্ছু হচ্ছে না। গ্রামের মানুষকে জামাত বোঝাচ্ছে, এরা সব ধর্মবিরোধী, এরা নাস্তিক। আর দেখো, চাঁদের মধ্যে সাঈদীর মুখ, এই তো বুঝছে গ্রামের লোক! ওরা সমস্ত দেশের ভিতরে ভিতরে ছড়িয়ে গেছে। ওরা পেরেছে, আমরা পারিনি। আমার তো এখন কথা, সংস্কৃতি-কর্মীরও এই কাজ। রাজনীতিবিদরা কিচ্ছু করবে না, খালি পাওয়ারে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। আওয়ামী লীগের কত সুযোগ ছিল। কী করল! আর বিএনপি তো একেবারেই অন্য, উত্তরপাড়া বলি আমরা। ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট শহরের উত্তরে। ওরা তো একেবারে পাকিস্তানি, মনে-প্রাণে। কিন্তু আমার দুঃখ হয়, আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তত …! ওই যে ‘তিনি’ বলে গেলেন যে বাঙালি হিসেবে আমরা দাঁড়াব। কে বাঙালি হল? সেই একজন শুধু বলেছিলেন, কিন্তু সেটাকে ধরে রাখা হয়নি। কেউ সেটাকে ভেতরে নিল না। বরং কেউ কেউ গর্ব করে বলে, এই রাজনীতিবিদরাই, আমি নাম করব না, ‘আরে আমার ভাইই তো প্রথম ফিউশন মিউজিক শুরু করেছে’। ওই সবই বোঝে! কাকে বলে ফিউশন, কাকে বলে বাঙালি সংস্কৃতি, কীভাবে কালচারটা গড়ে ওঠে এবং কালচার কাকে বলে, তার ভেতরের জিনিসটা বোঝার সাধ্য কারও নাই। প্রজ্ঞা নাই সংস্কৃতিবোধও নাই। যে জাতির, যে রাজনীতিবিদের সংস্কৃতিবোধ নাই সে দেশটাকে কী দিয়ে বোঝাবে, কী দিয়ে জাগাবে?
আমরাও যে কিছুই করতে পারিনি, সে আমি বুঝি। আমি সেদিন আর একটা কথা বলছিলাম। ছায়ানট করবার ফলে আমাকে যখন রংপুরে ট্রান্সফার করে দিল, আমি তখন সরকারি চাকরি করতাম। সেটা পাকিস্তান আমল। একা একা যখন রংপুরে যাই, সে দীর্ঘ পথ, আট ঘণ্টা ট্রেনে, আমি সব মানুষগুলোর মুখ দেখি, তাদের কথাবার্তা শুনি, আর বোকা হয়ে যাই। আমরা যে কোন স্বর্গে আছি, এত তফাত! আমরা মনে করছি আমরা কী সাঙ্ঘাতিক দেশের কাজ করছি! দেশ কোথায়! তখনই আমি বুঝেছি জিনিসটা। পরস্পর গল্প করছে, একজন বলছে, ‘শোন মালিকেরটাই তো খাবি, রেখে খা। সব খেয়ে বসলে যাবি কোথায় পরে?’ এখন এইসব কথা কিছুই না, তখন কীরকম শকিং হয়েছিল। ট্রেনে আমি তখন দেখেছি। আমার অসুবিধা কী, আমার জন্ম ঢাকায়, আমার মা কলকাতার মেয়ে, অধ্যাপক বাবা ফরিদপুরের, একেবারে অন্যরকমভাবে বড়ো হয়েছি।
মন্থন : ছায়ানটে গ্রাম থেকে কিছু ছেলেমেয়ে উঠে আসে না?
সন্জীদা খাতুন : মাঝে মাঝে আসে। আমি আর একটা গল্প বলব? গ্রাম থেকে উঠে-আসাদের প্রসঙ্গে। আজকের কথা বলছি না, আমি ১৯৫২-তে ভর্তি হলাম ইউনিভার্সিটিতে। সেইসময় দেখেছি, মানে চকচকে জুতো পরে, সে-রকম পোশাক-আশাক পরে যারা চলে, তারা হচ্ছে ছাত্র ইউনিয়ন, মানে তারা প্রগতিশীল। আর গ্রাম থেকে হয়তো একজন এসেছে, গাঁইয়া তো! ভূত! তাকে প্রগতিশীলরা কোনো পাত্তা দেয় না। পাত্তা দেয় কারা? ‘জামাত-শিবির’। ‘ছাত্রসংঘ’ নাম ছিল ওদের। তরিকুল আলম নামে একজন জার্নালিস্ট ছিল আমাদের। একদিন হঠাৎ বলল, জানেন আমি যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, গ্রাম থেকে এসেছি, গরিবের ছেলে, আমার টিউশন দরকার। তখন আমায় নিয়ে সব ব্যবস্থা করল ওরা। ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে টিউশনি এনে দিল, টাকাপয়সা দিল। ফলত তরিকুল ওদের দলে চলে গেল। তরিকুল মনের দিক থেকে প্রগ্রেসিভ এলিমেন্ট, কিন্তু প্রগ্রেসিভরা ওকে টানেনি। সেইজন্য তরিকুল ওখানে চলে গেছে। পরিণত বয়সে তার দুঃখ হচ্ছে, আমি মনে-প্রাণে প্রগ্রেসিভ, কিন্তু আমি হয়ে গেলাম ওই দলের। যারা প্রগতির পলিটিক্স করে, তাদের চকচকে জুতো, পোশাক-আশাক আর মনের মধ্যে অহংকার। ওরা মানুষের সঙ্গে মিশতে আসেনি। যে যার স্বার্থ উদ্ধার করে। আমি তো ছাত্র ইউনিয়ন বহুত দেখেছি। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করিনি। তখনকার দিনে মেয়েদের প্রতিষ্ঠান আলাদা বলে ছাত্রী সংসদ করেছি আমি। ছাত্র ইউনিয়নই করে দিয়েছিল। তখন আমি বুঝতাম না। দিনে দিনে সব দেখছি। আমি তো পলিটিক্স কিছুই করিনি। আমার মনে হয় সংস্কৃতি করাটাই একটা পলিটিক্স। অন্যধরনের বোধ আয়ত্ত করে ভেতর থেকে নিজের আলোকিত হওয়া দরকার।
এখন তো ধরো, ছায়ানটও এত বড়ো হয়ে গেছে, প্রায় হাজার চারেক ছাত্রছাত্রী। যারা আসে, তারা তো মনে করে পয়সা দিয়ে গান শিখছি। আগে ছিল বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ। তবে পোশাক নিয়ে এখনও বলি আমি। আসলে একটা দিন মেয়েরা শাড়ি পরে আসে, ছেলেরা পাঞ্জাবী পরবে, বলা আছে। এটা না করলে আমি শাসন করি। প্রথমদিকে আমার ছেলে বলত, তুমি এরকম করো কেন? এরকম করলে ওরা আর আসবে না। আমি বলি, না আসলে কী হবে? আমরা মরে যাব একদম? একটি পয়সাও তো ছিল না, এতদিন ধরে কীভাবে আমরা ছায়ানট করেছি। এখন ওই ছাত্রছাত্রীর সূত্রে পয়সা আসে। এখন আমরা বেতন দিয়ে দপ্তরের কাজগুলো করাচ্ছি। লোক রাখি এবং ভালোরকম বেতন দিতে হয়। নাহলে তো চলে না। তবে আমাদের যে লোকেরা কাজ করে, তারা খুব আন্তরিক। বেশিরভাগ ছায়ানটেরই ছাত্রছাত্রী। একজন তবলায় পাশ করেছে, সে সমস্ত সঙ্গীতবিদ্যায়তনের দায়িত্বে। একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে পাশ করেছে, সে আর্কাইভ দেখছে। আর একজন বেশ কিছুদিন গান শিখেছিল, সে অনুষ্ঠানগুলো দেখছে। সাহায্য করতে হয়, সব সময় দেখতে হয় কী করছে। কিছু কিছু এমন লোকও পেয়েছি, যারা বাইরে থেকে এসে খুব মিশে গেছে, সিনসিয়ারলি কাজ করে।
মন্থন : এদের মধ্যে গ্রামের কীরকম আছে?
সন্জীদা খাতুন : গ্রাম থেকেও আসে। এসে চকচকে হয়ে যায় বলছি না। একজন এল, গ্রামের ছেলে, বেশ গ্রাম-গ্রাম ভাব দেখাল, গলায় গামছা ঝুলান। সেটা আবার ফ্যাশান। অনেক মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। আমরা একটা অন্য ক্লাসও খুলেছি, ‘শিকড়’ নাম। তাদের মা-বাবাদের ইচ্ছে হয় যে ছেলেমেয়ে বাংলা গান শিখুক, বাঙালি সংস্কৃতি জানুক। তাদের জন্য একটা ক্লাস, সপ্তাহে একদিন। আমি অনেকদিন যেতে পারিনি, প্রায়ই অসুস্থ থাকি তো। এখন ছায়ানটের ভবন হয়ে গেছে এখন তো অনেককিছু ছায়ানটে করাতে পারি। আরেক বিষয় আছে ‘ভাষা-সংস্কৃতির আলাপ’। সেখানে বাংলাভাষার উচ্চারণ, বানান আর সংস্কৃতি বিষয়ে পড়ানো হয়। সাধারণ কতকগুলো জিনিস, তারপরে বাচনভঙ্গি। সাহিত্য, শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, সব রকমের আলাপ রয়েছে। ‘শিকড়’-এর একটা অনুষ্ঠানে খুব ধরল, আপনি আসুন। গিয়েই দেখলাম, কপালে এত বড়ো করে টিকা দেওয়া আর গালে রঙ। নবীনবরণ অনুষ্ঠান। আরেক কথা বলে নিই, পয়লা বৈশাখেও এসব চলছে এখন। গালে বাউলের একতারা আঁকল, ফ্ল্যাগ আঁকল। কী কালচার! মানে যাচ্ছেতাই। ‘শিকড়’-এ গিয়ে এটা দেখে প্রথমেই আমার খারাপ লাগল। তারপর দোতলায় উঠে যখন অডিটোরিয়ামে যাব, দেখি কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো। কী কালচার! এমনি ফুল দিয়ে তুমি সাজাও, কত সুন্দর। ফলে দেখা গেল অনেক গোলমাল এদের। মঞ্চে দেখলাম, গান গাইছে বাচ্চারা। ছোটো ছোটো মেয়েরা কেউ শাড়ি পরেছে, মজার লাগছে দেখতে। কেউ পাজামা ওড়না, একজন আবার মাথায় গামছা বেঁধে গামছা পরে, তার কারণ হল, ওখানে কিছু স্বেচ্ছাকর্মী আসে, কাজ করে, তারা কেউ কেউ গামছা পরে আসে, শুনলাম এ রকম তৈরি-পোষাক আজকাল পাওয়া যায় কিনতে। আসলে আমি তো কোথাও যাই-টাইও না। তো আমি কালচারটা ‘দেখলাম’, দেখে বোকা হয়ে গেলাম। একটা ছোট্ট ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখাল। তার মধ্যে একটা বাজে গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত হল। গীটারে ‘সোনার বাংলা’ বাজছে টাং টাং করে। ‘সোনার বাংলা’, তার কথাগুলো তুমি গাইবে না কেন? এটা নিয়েও আমরা খুব আপত্তি করি। কারণ, টেলিভিশন আর রেডিও বাংলাদেশ হওয়ার পরে এ গানের বাণীটা প্রচার করত না। তার কারণ, ওদের মনে হত যে রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করা হয়ে যাবে! সেইজন্য ওরা কেবল মিউজিক বাজাবে। এই যদি ‘শিকড়’-এ এসে ছেলেমেয়েরা শেখে, তাহলে কী শিখবে? আমি তো কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে এলাম। বাংলাদেশে একজন চিত্রশিল্পী আছেন, সাহাবুদ্দিন নামে, বিদেশে থাকেন, মুক্তিযোদ্ধা। আমি বেরিয়ে আসছি, দেখি সাহাবুদ্দিন ঢুকছেন। আমাকে বললেন, কাল রাত্রে দুজন জার্মান ভদ্রলোককে রবীন্দ্রনাথের কথা বললাম, তাই ভাবলাম ওদের নিয়ে আসি ছায়ানট দেখাতে। আমি বললাম, সাহাবুদ্দিন, খুব দুর্বল ব্যাপার হচ্ছে মঞ্চে। আমি বেরিয়ে এলাম। কী করব? আমার তো তখন আর করার কিছু নেই! একদিন ডাকলাম সবাইকে, ছায়ানটের ইতিহাসটা বললাম। আমরা কীসের ভেতর দিয়ে এখানে এসেছি। কেনই বা। উপলব্ধি করল যা হোক।
আর একটা হচ্ছে পয়লা বৈশাখের দিনে পান্তা-ইলিশ খাওয়া। এগুলো সব ফ্যাশন। এগুলো বোঝালাম। গামছা ফ্যাশনটাও বোঝালাম। যখন বললাম, একদম চুপ করে বসে সব শুনল। আসলে এই যে দেখতে হয়, যেতে হয়, বলতে হয়, এই না করলেই ব্যস নষ্ট। পটভূমিটা হারিয়ে যায়। সেটার মধ্যে দিয়েই তো তোমরা এখানে এসেছ, সেটা জানো। লিখেছি, অনেক লেখায় আছে, পড়ে কে! কাজেই বলতে হয়। তবে বলার পরে এত ভালো বুঝেছে যে আমি অবাক হয়েছি। যতদিন বেঁচে আছি, তার পরে কী হবে?
মন্থন : হ্যাঁ, যারা বুঝল তারা কিছুটা অ্যাক্ট করবে।
সন্জীদা খাতুন : এরা কিছুদিন অ্যাক্ট করবে। কিন্তু তারপরে তো ভুলতে পারে। ভেতরে তো থাকে না। তবে আমি জানি কর্মীরা কেউ কেউ করবে।
মন্থন : লোকে ভুলে যায়।
সন্জীদা খাতুন : ভুলে যায়। ভুল লোককে বিশ্বাস করে। আদর্শের ব্যাপারে এরকম খামতি আছে।
মন্থন : যারা খুব ধর্মপ্রাণ, ইসলামে বিশ্বাস করে, এদের মধ্যেও তো ভালো মানুষ আছে। সবাই যে খুব খল …
সন্জীদা খাতুন : অনেক আছে। তারা ধর্মকেই বিশ্বাস করে।
মন্থন : কোনো কারণে সে বিশ্বাস করে, যেরকম আপনি বললেন যে তরিকুলকে টেনে নিল। ওকে টিউশনি জোগাড় করে দিল, সেটা যে সবসময় বদমায়েসি করার জন্য করেছে, তা নাও হতে পারে। মানবিক বোধ থেকেও করে।
সন্জীদা খাতুন : মানবিক বোধ থেকে শুধু না, এটা ওদের নীতি। এটা কিন্তু ওইভাবে করে। আমি আরেকটা কথা বলি, আগের আমলে নিজামি বলে যে লোকটা কৃষিমন্ত্রী না কী হয়েছিল; সেই লোকটি যে কৃষিঋণ দিয়েছে, অনেকসময় কৃষকের বাসায় পৌঁছে দিয়েছে লোক দিয়ে। আর সচরাচর যেটা হয়, কৃষিঋণ নিতে গেলে প্রচুর ঘুষ দিয়ে সামান্য কিছু নিয়ে বাড়ি যেতে হয়। এটা ওদের কৌশল। আমি একটা কথা বলি, যারা ঘোষিত নাস্তিক তাদেরকেও বলি। যেমন, আমার বড়ো মেয়ে — মারা গেছে। ওরই ইচ্ছায়, বডি হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, ধর্ম হচ্ছে ঠিক কাজ করা। আমাদের ধর্মটা কী? সেটা আমাদের ধারণ করে রাখে, ধরে রাখে। তো এটা আমি বলে বেড়াই না। এটা আমি একেবারেই প্রচার করি না। এটা নিয়ে কেউ যদি কিছু কথা বলে, আমি প্রতিবাদ করতে যাই না। কারণ তাতে আমার কাজের অসুবিধা হবে। এই যে ব্লগে ওরা বলে, এটার কিন্তু একটা ক্ষতিকর দিক আছে। ওরা অ্যাগ্রেসিভ, এটা ঠিক না।
মন্থন : প্রথম যাকে মেরে দিল …
সন্জীদা খাতুন : ওর স্ত্রী ছায়ানটের ছাত্রী, ছায়ানটে কাজও করে।
মন্থন : এই যে ধর্মপ্রাণ ভালো মানুষ, তাদের সঙ্গে কি আপনাদের একটা সংযোগ আছে?
সন্জীদা খাতুন : ধর্মচর্চা করো, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এটা সবাই বোঝে। এটা জানে যে ধার্মিকদের আমরা অচ্ছুত মনে করি না। আমাদের মুশকিল হচ্ছে, আমাদের বিরুদ্ধে এত বেশি প্রচার, যেমন কিছু শিল্পী আছে গান-টান গায়, ওরা মাঝেমাঝে ছায়ানটের ঘর ভাড়া নিয়ে একটু রিহার্সাল করায়, এটা-ওটা করায়। ওরা জানে যে ছায়ানট প্রথাগত ধর্ম নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। ওরা বলে, ‘হ্যাঁ, এটা কীরকম? একটা নামাজের ঘর করতে পারল না? সিঁড়ির এই জায়গাটায় বসে আমাদের নামাজ পড়তে হচ্ছে।’ এইরকম বলবে, এইরকম প্রচার করে বেড়াবে। আবার যারা পছন্দ করে আমাদেরকে, তারা বলবে, ‘ইস্, ছায়ানটে গিয়ে মনে হল মন্দিরে প্রবেশ করলাম। একথাটাও তো মুশকিলের। যেন হিন্দুদের জায়গা! আরেকটা জিনিস আছে, বলি। এবার পয়লা বৈশাখে একজন এসে বলছে, ‘আপনাকে আমি প্রণাম করব’। — ‘তুমি আমাকে প্রণাম করবে কেন বলো তো?’ আমি সরাসরি বললাম। ওয়াহিদুল হক, যাঁকে আমি বিয়ে করেছিলাম, এঁদের একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছি আমি। আমি হিন্দু, আমি ভারতীয়, শাঁখা পরব, সিঁদুর পরব। এটাকে মনে করে বাঙালির সংস্কৃতি।
মন্থন : গুলিয়ে ফেলা …
সন্জীদা খাতুন : গুলিয়ে ফেলছে। ওই যে বললাম না, কপালে টিকা এবং গালে রঙ মাখছে। এগুলোর মধ্যে যে কালচার নেই, এটা বোঝে না। ওরা মনে করছে, এই যে হিন্দুয়ানি ভাবটা, প্রণাম করব কথাটা, এতে নিজের একটা অন্যরকম উদার আইডেনটিটি প্রকাশ পাচ্ছে।
মন্থন : প্রগ্রেসিভ …
সন্জীদা খাতুন : প্রগ্রেসিভ। আমরা মানুষকে কি আঘাত করব? আমাদের কাজ করতে হয় তো ওদের নিয়েই। এবং ওদের যদি আঘাত করে এইসব করে ফিরিয়ে দিই, ওগুলো কি সত্যি সত্যি মূল্যবান কিছু? আমাদের সামনে একটা ছেলে আছে, ব্রাহ্মণ। ও তো আগুন হয়ে যায়, যখন কেউ এসব কথা বলে। অনেক মেয়ে দেখা যাবে, সিঁদুর পরছে। আমি যে টিপ পরি, মনে নেই সেটা নিয়ে বোধহয় গতবার বলেছি। টিপ পরতে ভালো লাগে। আমি তো আর কিছু সাজি না। একসময় অল্প বয়সে চোখে কাজলও দিতাম অবশ্য।
মন্থন : শ্যামলীদিও (শ্যামলী খাস্তগীর) পরত।
সন্জীদা খাতুন : হ্যাঁ, শ্যামলী আমি …
মন্থন : শ্যামলীদি বেশ বড়ো টিপ পরত।
সন্জীদা খাতুন : অনেক সময় ও সিঁদুর দিয়েও পরত। পাকিস্তান আমলের একটা হাস্যকর গল্প বলি। একজন মহিলা ছিলেন, আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। তাঁর আবার খুব সরকারি মহলে ঘোরাফেরা, অনেকে পারে তো! মোনেম খাঁ একবার নেমন্তন্ন করেছেন শিক্ষকদের। তিনি ওখানে গেছেন, এত বড়ো করে টিপ পরেছেন। ওই টিপটা দেখে এক সাহেব বলে উঠলেন, কপালে ওটা কী? মোনেম খাঁ বললেন, মানে এরা তো বোঝে না, ঠোঁটে লাগাবার রঙ লাগায় কপালে! পাকিস্তান আমলে টিপ পরা মানেই হিন্দু। ওরা দেখলে বলে টিকা পরে। টিভিতে গান গাইতে গেলে বলত, আপনারা টিপ দেবেন? আমি বলতাম, হ্যাঁ ওটা থাকবে। কোনোদিন আমার টিপ খোলাতে পারেনি। সেই টিপটা, সেই বিদ্রোহটা আমি ধরে রেখেছি, আমার ভালোও লাগে। আমি গয়না পরি না, একটা টিপ পরি। ঠোঁটে লিপস্টিক আমি দেব না, ওটাকে আমার বিজাতীয় সাজ মনে হয়।
মন্থন : প্রগ্রেসিভের সিম্বল নয় ওটা।
সন্জীদা খাতুন : হ্যাঁ। আসলে অনেকে ভাব দেয় ‘আমি হিন্দু’, ‘আমি ভারতীয়’, ‘আসলে এপার ওপার মিলে আমাদের দেশটা এক’। আরে বাবা, এখন কি বলে লাভ আছে যে আমাদের দেশটা এক? উপমহাদেশটা এক, এখন বললে … কোথায় পাকিস্তান, কোথায় ইন্ডিয়া, আর কোথায় বাংলাদেশ! আর বাংলাদেশটাকে অস্বীকার করার জন্যই তো এত কাণ্ড।
মন্থন : একজনের সঙ্গে পরশুদিন দেখা হল ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে। উনি রংপুর থেকে চিকিৎসা করতে এসেছেন। ক্যানসার হয়েছে। ওঁকে নিয়ে যিনি এসেছেন, ইন্ডিয়াতে থাকেন, দিনাজপুরের দিকে বাড়ি, উর্দুভাষী। আমি একটু পরিচয় করলাম। যিনি দিনাজপুরের, তাঁর সঙ্গে প্রথমে কথা হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি বাংলাদেশে থাকেন?’ উনি উর্দুতে বললেন, ‘না, আমি দিনাজপুরে থাকি। আমার রিস্তেদার মুসলিম-বাঙালে থাকেন’। চার-পাঁচবার বললেন, ‘মুসলিম-বাঙাল’ শব্দটা। মানে বাংলাদেশ হচ্ছে মুসলিম-বাঙাল আর পশ্চিমবঙ্গ হিন্দু-বাঙাল!
সন্জীদা খাতুন : আমার মনে পড়ছে, যখন লিবারেশন ওয়ারের সময় পালিয়ে এলাম, গৌরীদির বাসায় গেলাম। গৌরী আইয়ুব। গৌরীদি মহা চিন্তিত, তাঁরা একটা সভায় যাচ্ছেন। তখন বিপদে পড়ে …। মাসুদ সাহেব, গৌরীদি, আইয়ুব, মৈত্রেয়ী দেবী, এঁরা সব তখন একটা সভায় বসছেন, কারণ, ওখানকার মুসলমানরা খেপে গেছে, আমাদের একটা জায়গা ছিল, এরা সব নষ্ট করে দিচ্ছে! ভারতকে দিয়ে দিচ্ছে? ওরা খেপে গেছে, এমনকী ভাবছে ওরা আক্রমণ করবে, বাংলাদেশ থেকে যারা গেছে তাদেরকে। আমার মনে পড়ে, এই যে জিনিসটা এপারের মুসলমানদের মধ্যে এটা আছে। এটা আমাদের একটা অভিযোগের জায়গা। ঢাকার যারা হিন্দু, তাদেরকে ওরা বলে, ‘নিজেদের দেশে যাও, এখানে কেন আছ? এগুলো ছেড়েছুড়ে চলে যাও।’ একই অ্যাটিচুড এদেরও।
মন্থন : সেটা তো ইন্ডিয়ান স্টেট বা নরেন্দ্র মোদিও বলছেন, ওরা হচ্ছে শরণার্থী। মুসলমান কেউ এপারে এলে অনুপ্রবেশকারী আর হিন্দু এলে শরণার্থী। দুটো আলাদা ক্যাটেগরি।
সন্জীদা খাতুন : হ্যাঁ। এইটাই তো চলছে, চলে যাচ্ছে। এখানকার অবস্থা কী হবে আমি জানি না, খুব একটা মাথাও ঘামাই না, এখানে কাগজ-টাগজ তেমন পড়ি না।
মন্থন : এই ভুলে যাওয়া ব্যাপারটা। যেমন ধরুন বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। ২০০২-এ হল গুজরাতের ঘটনা। লোকে কিন্তু আজ ওই ঘটনাগুলোকে আর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
সন্জীদা খাতুন : তাই তো দেখছি। আমাদের দেশেও তো তাই। কৃষককে মেরে ফেলল বিএনপি আমলে।
মন্থন : লোকে মনে করালেও আর মনে করতে চায় না।
সন্জীদা খাতুন : দেখছি তো। আর মনে করায়ও না রাজনীতিবিদরা। ওরা কী কারণে এরকম চুপ করে থাকে, আমি জানি না। মনে করিয়ে দেখত, একটু বেশি বেশি বলত। আর খালি পরস্পরকে গালি দেয়। মানে পজিটিভ কোনো কথাবার্তা নয়। দুদলই ডানপন্থী। এবং ওদের উদ্দেশ্য খালি ক্ষমতা ধরে রাখা, গালিগালাজ করে-টরে ভোগ করে। এবারে তো আওয়ামী লীগের যা চেহারা হয়েছে। ওরে বাপ! যা খুশি করে যাচ্ছে। বেপরোয়া। বিএনপি যেটা করেছে, সেটাই এরাও করে যাচ্ছে। ওরা করেছে, অতএব এবার আমরাও করব। হাসিনার সাধ্য নাই এগুলোকে কন্ট্রোল করা। ওরাই আবার ক্ষমতা ধরে রাখবার জন্যে অস্ত্র ধরবে, তার জন্য ওদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। মাঝখান থেকে মরব আমরা, বুঝতে পারি।
মন্থন : ‘বারোমাস’ পত্রিকার ২০১৩ সংখ্যায় আবুল মোমেনের একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, ‘চরৈবেতি, বাংলাদেশি স্টাইল’। আবুল মোমেন ‘বারোমাস’-এ লিখেছেন, বাংলাদেশে দুটো ধারা আছে মুসলিমদের মধ্যে। একটা হল স্বাতন্ত্র্যবাদী ধারা, একটু কট্টর। আর একটা সমন্বয়ধর্মী ধারা, সুফি, গানবাজনা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে যারা চলেছে। সেইটা আপনাকে জিজ্ঞেস করি।
সন্জীদা খাতুন : এইটা খুব ব্রড একটা হিসেবের মধ্যে চলে গেছে। এত ব্রডলি বললে ঠিক নির্দিষ্ট কিছু বোঝায় না। আমার তো তাই মনে হয়।
মন্থন : ধরুন যারা খুব ধার্মিক বা স্বাতন্ত্র্যবাদী, তাদের মধ্যে কি গানবাজনা ইত্যাদি আছে?
সন্জীদা খাতুন : হ্যাঁ তাদের মধ্যেও আছে। ধর্মও করে, গানও শোনে। আবার আজকাল কী অদ্ভুত দেখছি, আমাদের একজন অত্যন্ত ভালো ছাত্রী, গানের শিক্ষকও হয়েছিল। ওকে বিয়ে করল একজন, ছেলেটির বাবা-মা ছায়ানটের অনুষ্ঠানে এখনও আসেন। ওরা থাকে নিউজিল্যান্ডে, স্বামী-স্ত্রী। আজকাল তো সমস্ত বিশ্বে এই জিনিসটা ছড়িয়ে গেছে। সেই ছেলেটি কীভাবে পাল্লায় পড়ে সারাক্ষণ মসজিদে থাকে। স্ত্রীকে দেখে না, বাচ্চাকেও দেখে না। মেয়েটি বাধ্য সেখানে স্বামীর ঘরে থাকতে। শুধু আমাকে বলল, বেড়াতে এসেছিল মাঝখানে, ‘ওখানে আমি ভালোই থাকি, ও মসজিদে থাকে থাকুক, আমি আমার মতো থাকি।’ কিন্তু যাবার দিন হাউমাউ করে কাঁদল। ‘এটা আমার কী জীবন হল, গানও গাইতে পারি না, কিছুই করতে পারি না।’ সেদিন আমি দেখলাম, ফ্র্যাঙ্কলি মেয়েটা সব প্রকাশ করল। ছেলেটির মা-বাবা একদিন ছায়ানটে এসেছিলেন। আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা বলুন তো এটা কী? — আমরা তো এখনও এভাবে চলছি, আমরা এখনও গানের পাগল, সংস্কৃতির পাগল, আমার ছেলের এটা কী হল?’ কীভাবে যে এইরকম ব্রেনওয়াশ করে আমি জানি না।
মন্থন : একটা আইডিনটিটি ক্রাইসিস থেকে হতে পারে। একটা বাঙালি আইডিনটিটির চেয়ে মুসলিম আইডিনটিটিটা নিরাপদ …
সন্জীদা খাতুন : এখানে ধর্মটা তার প্রধান অবলম্বন হয়ে যাচ্ছে।
মন্থন : ও একটা আশ্রয় মনে করছে।
সন্জিদা খাতুন : হ্যাঁ,যারা অন্ধভাবে ধর্মকর্ম করে তারা তো আশ্রয় মনে করেই করে।
মন্থন : আমি নিজে যেটুকু ভাবতে পারি, সেটা হল, এই দুইয়ের মধ্যে যদি একটা সেতু থাকে, একটা আসা-যাওয়া থাকে, একটা সংলাপ থাকে …
সন্জীদা খাতুন : আমি দেখি, ছায়ানটের মধ্যে অনেকে আছে, এই যে আমি যেটা বললাম, ধর্ম করছ, সেটা তোমার ব্যাপার। এবং এটার সঙ্গে তো সংস্কৃতির কোনো বিরোধ নাই। এটা সারওয়ারও বলে। কিন্তু অনেকে ফট করে একটা গুবলেট করে বসে থাকে। ধার্মিক যে, তাকে এটা ওটা বলে বসে। এতে যে বিরোধটা বাড়ে।
মন্থন : ‘মাটির ময়না’ সিনেমাতেও দেখেছি, আমাদের ওই ধরনের গানবাজনার একটা অতীত ছিল, একটা ধারা, গোটা বাংলা জুড়েই যদি বলি, আজকে যে ছায়ানটের মতো চেষ্টাগুলো, সেটা কি ওর ধারাবাহিকতাতেই আসছে না আলাদা একটা ধারা?
সন্জীদা খাতুন : এইটা বলা কঠিন। যদি ভেতর থেকে এসে থাকে, জানি না।
মন্থন : রবীন্দ্রনাথের যেমন গগন হরকরা বা লালন ফকির, একটা লিঙ্ক ছিল।
সন্জীদা খাতুন : তা তো বটেই। রবীন্দ্রনাথের তো পরিষ্কারই লিঙ্ক ছিল। আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়ে যেটুকু পেয়েছি সেইভাবে করি, বোধহয়। আমরা প্রচণ্ডভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবাধীন। রবীন্দ্রনাথের স্বাধীনতার ধারণাটা আমাদের কাছে বিশাল তাৎপর্যময় মনে হয়। ‘দোয়েল’-এর ‘আমার সোনার বাংলা’ বইটা আমি পুরো বাংলাদেশের ইতিহাস ধরে লিখেছি। রাষ্ট্রভাষা দিয়ে শুরু হল, ভোট কাকে বলে — বাচ্চাদের জন্য লেখা তো, বুঝিয়ে বুঝিয়ে — শেষে গিয়ে একেবারে জাহানারা ইমাম, তাঁর ছেলের মৃত্যু। আলতাফ মাহমুদের ওই যে রাষ্ট্রভাষা গানটা, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’। আলতাফকে কীভাবে ওরা অত্যাচার করল, ওর একটা চোখ ঝুলে বেরিয়েছিল, হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে … আমার এক ছাত্র ছিল জেলে, ও দেখেছে, ওটাই শেষ দেখা। পরদিনই ওকে নিয়ে চলে গেছে, মেরেছে। অনেকে জানে না এটা, উলটোপালটা বলে। যাই হোক, আমি শেষে বলেছি, মুজিবকেও এভাবে মেরে ফেলল। কেন আমাদের স্বাধীনতাটা থাকল না, এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছু বলেছিলেন, শেষে সেই কথাটা বলেছি। যারা পড়েছে, তাদের পছন্দ হয়েছে। আমরা কিন্তু ওই ধারাটা বাঁচিয়ে রেখেছি।
মন্থন : বাউল বা অন্য ধারাগুলোর সঙ্গে আপনাদের কোনো সংলাপ নেই?
সন্জীদা খাতুন : আমাদের সেইভাবে নেই। তবে আমাদের এখানে ফোক সঙ শেখানো হচ্ছে, ভালো চর্চা হচ্ছে। পালাগান এটা সেটা গ্রাম থেকে নিয়ে এসে পারফর্ম করিয়ে ছেলেমেয়েদের দেখানো হচ্ছে। আমাদের একটা ফোক ফেস্টিভাল হয়, ‘দেশঘরের গান’ নাম দিয়ে। এই গানগুলো একেবারে গ্রাম থেকে আনার চেষ্টা করা হয়। যদিও … মৌসুমি ভৌমিক আমাকে নাম দিয়ে এল, ফরিদপুরে ভালো কীর্তন গায়কের। ওঁকে আনালাম, দেখা গেল, ওখানকার স্থানীয় চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের, তারা ওই দলে ছিল, এসে তারাই গান-টানগুলো গাইতে থাকল। আসল কীর্তনিয়ার ভূমিকাই থাকল না কোনো! কতভাবে যে নষ্ট করে। যাই হোক, আমরা করি, মাঝেমাঝে খারাপও আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের যাদের বলা হয় পার্বত্য জাতি, ওদের কালচার নিয়ে এসে দেখলাম, হিন্দি সুরে গান গাইছে! খাঁটি জিনিস পাওয়া যায় না। তবু এটা আমরা কেন করেছিলাম? ওয়াহিদুল হক কতকগুলো ভালো কথা বলেছেন, সেই আদর্শগুলো আমরা ধরে রাখার চেষ্টা করি। ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তাঁর ওই কথা বা আদর্শের কোনো যোগ নাই। তিনি বলেছিলেন, ‘শোনো, যদি আরও বাড়তে হয়, জানতে হয়, তাহলে ফোক কালচারটাকে এখানে এনে সেটার সাথে পরিচিত হতে হবে। কিন্তু কী দেখি জানো? ফোক সঙের যারা শিক্ষক, তারাও সবাই যায় না অনুষ্ঠানে। যারা আগ্রহী ভিড় করে এসে গান শোনে, সাধারণ পথের মানুষ বা ধরো, ইউনিভার্সিটি এলাকায় হচ্ছে, সেখানকার ছাত্ররা এসে শুনল।
তবে আমাদের একটা স্কুল আছে নালন্দা স্কুল বলে। এই স্কুলটা আমাদের ভবনে আর ধরছে না। ওদের অনেক ক্লাসঘর লাগে, আমাদেরও অনেক লাগে। আমাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যারা ওদের দেখতে পারে না। ওরা কেন এর মধ্যে আসবে? ছায়ানটের পয়লা বৈশাখের সভায় বোমা বিস্ফোরণের পরে নালন্দা স্কুল করা হয়। এখন আমরা যেটা করছি, কেরানিগঞ্জে ঢাকার পরেই একটা ব্রিজ হয়ে গেছে, রাস্তাটা আর একটু ভালো হলে ছায়ানট ভবন থেকে কুড়ি মিনিটে সেখানে পৌঁছানো যায়। ওটা গ্রাম, তবে উপজেলা। সেইখানে আমার বড়ো মেয়ের একটা জমি ছিল। আমার মেয়ের মৃত্যুর পরে এক বিঘা জমি ওর পরিবারকে বলে কয়ে আমরা নিলাম ছায়ানট থেকে। ওখানে আমরা আমার বড়ো মেয়ের নাম অপালা, ‘অপালা-ভবন’ নামে বাড়ি তৈরি করে নালন্দা স্কুল নিয়ে যাব। হচ্ছে কী জানো, গ্রামের লোকগুলো পাগল হয়ে যাচ্ছে খুশিতে, ছায়ানটের মতো এরকম একটা জিনিস আমাদের এখানে হবে। আমরাও খুশি, ওদের সঙ্গে আদান-প্রদানটা হবে।
মন্থন : ওরাও কি কিছু পারফর্ম করছে, সৃষ্টি করছে?
সন্জীদা খাতুন : শোনো, একসাথে তো নানা জিনিস করি। আমি ব্রতচারী আন্দোলনও করি। ওই গ্রামে আমরা ব্রতচারীর একটা প্রশিক্ষণ শিবির করেছিলাম। সেটা দেখে তো সব অস্থির হয়ে গেছে। ওরা ব্রতচারী চর্চা করে। এবারে আমাদের একটা কথা হয়েছে, জাতীয় যতগুলো অনুষ্ঠান হবে — ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি — এই তিনটে ঢাকার বাইরে হবে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসকে অগ্রাহ্য করে আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষা দিবস। এই তিনটে আমরা বাইরে গিয়ে করব। গতবারে কেরানিগঞ্জে গিয়ে করা হল। ওদেরকে বলা হল, তোমরা ব্রতচারী করো। ওখানে … গ্রামে আমার বড়ো মেয়ে একটা স্কুল করেছিল, ওরা এসে গান গাইল। সকলের পক্ষ থেকেই করা হয়েছে, তবে আমাদেরই প্রধান ভূমিকা ছিল।
মন্থন : ওইসব জায়গায় নিশ্চয় জামাতেরও প্রভাব আছে?
সন্জীদা খাতুন : খুব আছে, বিএনপিরও আছে। আমার মেয়েটি তো আশ্চর্য কন্যা ছিল। ওখানে ব্রতচারী ক্যাম্প করার সময়ে আওয়ামী লিগ সহযোগিতা করেনি। চাঁদার রসিদের কোনো হিসেবও দেয়নি। তখন ও দেখল যে বিএনপির কয়েকজন সৎ লোক আছে, তাদের ও টেনে নিল। তাই অন্য দল ওর ওপর খুব চটেছে, কিন্তু কিছু বলতে পারেনি। ওখানে বিএনপির একজন পাণ্ডা আছে, এমপি, অবৈধ দখলদার। সে এসেছে ওর অনুষ্ঠানে, বারবার খবর দিচ্ছে, ওনাকে মঞ্চে তুলবেন না? তখন আমার মেয়ে মধু হেসে বলছে, ‘ওমা, আপনাকে তো এই দেশে সবাই চেনে, মঞ্চে উঠতে হবে কেন?’ যা করেছে না ওখানে, আশ্চর্য! প্রতিটা কাজ আমাকে জিজ্ঞেস করত, কিন্তু সাকসেসফুলি করেছিল, সমস্ত গ্রাম ওর নামে একেবারে পাগল। স্কুলটা যদি হয়, আদান-প্রদান হবে, তাহলে গ্রামের উন্নয়ন হবে, আমরাও গ্রামে একটু এক্সপোজড হব।
মন্থন : আপনি বলেছিলেন আওয়ামী লীগ হচ্ছে ছায়ানটের ছায়াবৃক্ষ।
সন্জীদা খাতুন : সেই সময় বলেছিলাম। কেন বলেছিলাম, আমার মনে পড়েছে। ব্যাপার হচ্ছে, যদি বাঙালি সংস্কৃতির জন্য দেশটা স্বাধীন করা হয়ে থাকে — সংস্কৃতি, এছাড়া অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ইত্যাদি আছে — তাহলে ছায়ানট সেই জিনিসটাকে ধরে রেখেছে, লালন করছে, আশ্রয় দিচ্ছে। সেটা এখন আর নেই। সরকারের কথা হচ্ছে, আমরা যেটা করব তার স্বীকৃতি চাই। যেমন ধরো, খালেদা জিয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটিকে অনেকগুলো বাস দিয়েছেন। গাড়ির এধার থেকে ওধার পর্যন্ত বড়ো বড়ো করে লেখা আছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দান ইত্যাদি। এখন ছায়ানটের জায়গাটা তো হাসিনা দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে না হলেও দিয়েছেন বটে। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ২০০০ সালে … এই ভূমি ছায়ানটকে প্রদান করে’, আমাদের বোর্ডে সেটাই লেখা আছে ব্যক্তিনাম নেই।
মন্থন : আপনি এর আগেরবার বলেছিলেন, ‘এর বাইরে দেশটা আছে অনেক বড়ো, অনেক মানুষ আছে যাদের থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন। ওদের চিন্তা আর আমাদের চিন্তা এক নয়। এই ফাঁকটা পূরণ না করতে পারলে এরকম চলবে।’ এখন কী মনে হয়?
সন্জীদা খাতুন : আমাদের ক্ষমতাটা বড্ডো সীমিত। অনেকে বলে ছায়ানট অন্য জায়গায় হয় না কেন, খুলনা বা কুমিল্লায় নেই কেন। আমরা সেটা করি না। আমরা তো কেবল বাঁচতে চাই, আর বাড়তে চাই না। আমরা সংহত থেকে উন্নত হতে চাই। যশোরে দেখো ‘উদীচী’র একটা সচেতন প্রচেষ্টা রয়েছে। উদীচীর একটা ধারণা হয়েছে, সত্যেন সেনের করা প্রতিষ্ঠান তো, এই যে বড়ো বড়ো বক্তৃতা হয়ে গেল, তারপরে সংশ্লিষ্ট গানগুলো হবে। ওঁর নিজের গান ছিল ‘আগুন নিভাইব কে রে, এ আগুন নেভে নেভে নেভে না …’ এইরকম সব। ওই সুর ওই ভাষা। আর এরা তো সব স্মার্ট পোশাকে ঝমাঝম সব বাজিয়ে কী সব পিটায়-টিটায়, আমি নাম-টাম জানি না। তারা তালে তালে ছন্দে ছন্দে কী যে বলছে, গ্রামের লোক বুঝছে কিনা সন্দেহ। আজকাল আর গ্রামদেশ সেরকম আছে মনে হয় না। ওরে বাবা! আমি পরীক্ষার খাতা দেখতে গিয়ে দেখেছিলাম। আজকে না, পাকিস্তান আমলে, গ্রাম নিয়ে রচনা লিখছে এক ছেলে, বেশ লিখছে, ধান খেতের ওপরে বাতাস বয়ে যায় …। মনে হল ‘মেরা মন ডোলে’! আমি বলি, সর্বনাশ! ট্রানজিস্টার শুনে শুনে শুরু হয়েছিল। আর এখন আমাদের দেশে জানো কী হয়? টেলিভিশনে যত এখানকার সিরিয়াল, গ্রামে বাচ্চারা নাকি সে সব শুনে হিন্দি ভাষায় কথা বলে! আমি তো সব সময় বলি, ভারত বাংলাদেশের কালচারকে সব সময় নষ্ট করে। সাংগীতিক দক্ষতা ভারতে খুব ভালো, সেই ট্রেনিংটা ওদের আছে। আমাদের দেশে নেই। তবে সাংগীতিক দক্ষতা দিয়ে যেটা হয়, শুনে মনে হয়, যাহা পাই, তাহা চাই না। সাংগীতিক দক্ষতা দরকার। কিন্তু যা চাই না তা নেব কেন!
Leave a Reply