অমিতা নন্দী
মন্থন সাময়িকীর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৪ সংখ্যার একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ১ মার্চ ২০১৫ তারিখে ঢাকুরিয়ার সেলিমপুর অঞ্চলে একটি বাড়ির ছাদে। সভায় উপস্থিত ছিলেন ১৮-১৯ জন মানুষ। পত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যাটির বিষয় ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন — একজন ছাত্রীর হেনস্থা এবং তা থেকে উদ্ভূত ‘হোক কলরব’ আন্দোলন ইত্যাদি। এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে ওই বিশেষ সংখ্যাটির অতিথি সম্পাদক ছিলেন চূর্ণী ভৌমিক, যিনি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রাক্তন ছাত্রী এবং এই আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। আরও উল্লেখ্য যে সংখ্যাটিতে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের অনেকেই যাদবপুরসহ প্রেসিডেন্সি, মৌলানা আজাদ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং কিছু প্রাক্তনীও। লেখকদের অনেকেই এই সভায় উপস্থিত থাকতে না পারলেও তাদের এবং কিছু পাঠকের মতামত সংগ্রহ করে সভায় তা পেশ করা হয়।
প্রথমে চূর্ণী ভৌমিক তাঁর সংগ্রহ করা মতামত জানালেন :
• মণিদীপা সিংহ বলেছেন তাঁর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক ‘কলরবের আগে’ লেখার মধ্যে, যে ছেলেটির ব্যাগ চেক করা হয় তার নাম উল্লেখ না করলেই ভালো হত।
• ঋতম জানিয়েছেন, কলরব নিয়ে এই সংখ্যায় যে সিরিয়াস কাজ করা হয়েছে সেটা তাঁর ভালো লেগেছে।
• দীপ্যমানের মূল ইংরেজি লেখার অনুবাদে সম্পাদনা করার সময় চূর্ণী যেভাবে কিছু কিছু শব্দকে পালটেছেন সেটা প্রথমে ওঁর ভালো লাগেনি। লেখাটা যাতে ভারী না হয় সেজন্য চূর্ণী ওঁর কড়া ধাতের লেখার কিছু কিছু পরিবর্তন করেছেন, পরে ভেবে দেখে দীপ্যমানের মনে হয়েছে সেটা ঠিকই হয়েছে।
• অনেক পাঠকই বলেছে যে ছন্দকের লেখা তাদের ভালো লাগেনি। অন্য দিকে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর ছাত্রী মৈত্রেয়ী হালদারের লেখা ‘বড়ো হয়ে গেলাম হঠাৎই’ প্রায় সবারই খুব ভালো লেগেছে। মৌলানা আজাদের ছাত্রী সেবন্তীও সেটা জানিয়েছেন।
• তমাল ভৌমিকের পুরোনো কিছু বন্ধুর তমাল এবং অমিতার লেখা ভালো লেগেছে। বিশাখা গাইডলাইনের লেখাটাও খুব জরুরি বলে তাদের মনে হয়েছে।
• দেবজ্যোতি মণ্ডল জানিয়েছেন যে শমীক সরকারের লেখায় বিশ্লেষণের অভাব রয়েছে। শমীকের কাছে তাঁর প্রত্যাশা অন্যরকম ছিল।
চূর্ণীর এই রিপোর্টিংয়ের সময় শমীক জানতে চান যে দেবজ্যোতি নিজে কি কিছু লিখতে চান? চূর্ণী বলেন যে ওঁর লেখার মতো সময় নেই, তবে বলতে পারেন।
চূর্ণী আরও জানালেন যে মণিদীপার সাক্ষাৎকার নিয়ে হিন্দোলের প্রবল আপত্তি আছে, কারণ ওরা নেশা করছিল, ওদের কাছে গাঁজা পাওয়া গেছে ইত্যাদি।
এরপর প্রত্যুষা জানা বললেন যে তাঁর কাছেও বেশ কিছু মতামত এসেছে। দীপ্যমানের মূল ইংরেজি লেখাটা অনেকটা অ্যাকাডেমিক জার্নালের মতো, সমস্ত পাঠকের কাছে তা বোধগম্য হত না। তাই ওটার সম্পাদনা করা ঠিকই হয়েছে। মৈত্রেয়ীর লেখাটা অন্য অনেকের এবং প্রত্যুষার নিজেরও খুব ভালো লেগেছে। কারণ ওটায় ব্যক্তির চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে, এই অ্যাপ্রোচটা ভালো। মৈত্রেয়ীর মূল ইংরেজি লেখাটায় যে আবেগ বা ইমোশন ছিল বাংলায় তা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। যেমন শেষ শব্দটা ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ — ঠিক ভালো লাগেনি। হস্টেলজীবন নিয়ে শমীকের লেখাটাও খুব ভালো হয়েছে। ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের স্লোগানের অ্যানালিসিস কেন করা হয়নি সে প্রশ্ন কেউ কেউ তুলেছে। বিভিন্ন দিক থেকে যে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা প্রত্যুষার নিজের এবং আরও অনেকের বেশ ভালো লেগেছে।
গৌতম গাঙ্গুলি মনে করালেন যে এই পর্যালোচনাটা আরও আগে হওয়া দরকার ছিল। এতদিন বাদে অনেক কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। প্রধান যে ইস্যুটা নিয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত, কেন মেয়েরা এভাবে treated হয় সেটা ভিসি-কে তাড়ানোর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মিডিয়ার সাঙ্ঘাতিক ভূমিকা ছিল। পুরুষশাসিত সমাজে যেভাবে প্রশ্নগুলো আসে এবং আসল বিষয়টা চাপা পড়ে যায় — অনেকটা তেমনিভাবে অভিমুখটা উপাচার্যকে তাড়ানোর দিকে চলে যায়। আমাদের এই আলোচনাও এত দেরিতে হওয়ার ফলে মিডিয়ার হস্তক্ষেপে আসল ঘটনার অনুরণন মিইয়ে গেল।
বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে গৌতম গাঙ্গুলি ১৯৭৩ সালের এক ছাত্র আন্দোলনের কথা আমাদের জানান যা তাঁর মতে অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ছিল :
রসায়ন বিভাগের প্রধান শ্রী এ কে দে বরাবরই একটু গোলমেলে লোক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের নানা অভিযোগ ছিল। তিনি ইন্দ্রাণী নামে একজন ছাত্রীকে ছাত্র সম্মিলনীর নির্বাচন থেকে নাম তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেবার পরে ব্যাপারটা একটা flashpoint–এ পৌঁছোয়। ক্ষোভ থাকলেও তা নিয়ে আন্দোলন করা বা সাধারণভাবে বলতে গেলে কোনো প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাজ করা তখন সহজ ছিল না। কিন্তু সেই বিপরীত সময়েও আমরা ব্যাপক সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীকে সমবেত করে এ কে দে-কে প্রশাসনিক পদ থেকে অপসারিত করার জন্য ময়দানে নামি। আমরা প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনটি করি। একটি পদক্ষেপ ভুল হলে কংগ্রেসি গুণ্ডাবাহিনী আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু দাবাখেলার মতো প্রত্যেক দানে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করে ও তাদের ভুলপথে চালিত করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে আমরা এগিয়ে যাই। সেন্ট্রাল অফিসে সাতদিন চলে আমাদের অবস্থান। এবং সেই অবস্থানে যে সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীরা, বিশেষত ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে তা আমরা অন্তত আগে কখনোই দেখিনি। উপাচার্য প্রতুল গুপ্ত এই অবস্থান ভেঙে বেরিয়ে আসার কোনো চেষ্টা করেননি, পুলিশও ডাকেননি, কিন্তু আমাদের দাবি মেনেও নেননি সহজে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পরে আমাদের দাবি মানা হয়। সেদিন সন্ধ্যায় যে বিজয় মিছিলটি বের হয় তার তুল্য মিছিল শান্তিনিকেতনে খুব বেশি হয়নি।
গৌতম গাঙ্গুলির কথায় যেহেতু সক্রিয়তার কথা এল, মিডিয়া ঠিক করে দিতে চাইছে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কী হবে, জিতেন নন্দী তার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, মন্থনের মতো ছোটো পত্রিকা কি বড়ো মিডিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই দ্রুততায় হস্তক্ষেপ করতে পারে? তার জন্য একটা শক্তি গড়ে তোলা দরকার। তা একটা অন্য ধরনের পত্রিকাও হতে পারে বা অন্য কোনো ফোরাম। দ্বিতীয়ত, মন্থনের যে পরিধি — ৫০০ থেকে ৭০০ পাঠক — তার পক্ষে মনে হয় না খুব দেরি হয়ে গেছে।
গৌতমদা বলেন যে তিনি দেরির কথা বলেননি, এবিষয়ে দ্বিতীয় আর একটি সংখ্যার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
জিতেনের মতে, এখনও ফলো-আপ করা যায়। এই যে মিডিয়ার প্রজেকশন, মোদি যেটা বলেছেন — জটায়ু পাখির মতো মেয়েদের রক্ষা করব, এটা তো সবাই বলছে, মোদি মিডিয়া অরবিন্দ কেজরিওয়াল — ‘আমরা মেয়েদের প্রোটেকশন দেব’। আমরা কারা? শেষ পর্যন্ত সেই স্টেট, পুরুষশাসিত সমাজ। এই অক্ষে যে জিনিসটা যাচ্ছে, টেকনোলজিকে ব্যবহার করা, মেয়েদের জন্য আলাদা ফোর্স দেওয়া, কত লক্ষ সিসিটিভি আরও দেওয়া যায়, ইত্যাদি … এর বাইরে আমাদের একটা পরিসর রয়েছে, সেখানে ধারাবাহিকভাবেই মেয়েদের বিষয়টাকে তুলে আনা দরকার। সেখানে মেয়েদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা দরকার।
শমীক সরকার বলেন, আমরা আর মেয়েরা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ। মন্থনের কাজ হচ্ছে মেয়েদের এই সেলফ্টার সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স তৈরি করা। এখন গোটা জিনিসটাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে — যৌন হেনস্থা হচ্ছে, মেয়েদের প্রোটেকশন দিতে হবে। সে যেখানে যাবে সেখানে একটা সিসিটিভি তাকে ফলো করবে …। অর্থাৎ মেয়েদের অবজেক্টিফাই করা হচ্ছে। মেয়েরা আর সাবজেক্ট থাকল কোথায়? মেয়েরা রাস্তায় বেরিয়েছে বলেই তো হামলা হয়েছে। ঘরে থাকলে ঘরের মতো হেনস্থা হত। এরকম জানাজানিও হত না। কেউ কেউ তো এরকম পর্যন্ত বলেছে, ‘এত বাইরে বেরোনোর কী আছে?’ এর মধ্যে যে স্পিরিটটা আছে — ‘ঠিক আছে, তাহলে রাস্তাটাকেই আমরা ঘর বানিয়ে নেব।’ আমি চাই বা না চাই, মেয়েদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আছে, এটা বাস্তব। তার সঙ্গে আমাদের অ্যালায়েন্স করতে হবে।
এরপর উপাচার্য সরানোর ইস্যুটা নিয়ে কিছুটা কথোপকথন চলে গৌতম গাঙ্গুলি, রামরতন চ্যাটার্জি, শমীক ও চূর্ণীর মধ্যে।
শমীক ও চূর্ণী বলেন যে উপাচার্য সরানোর দাবির মধ্যে এটাও আছে যে অভিভাবকের প্রতীক হচ্ছেন ভিসি। ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।’ ছাত্ররা কিন্তু আর একজন ভালো ভিসি আসুক কোনোদিন বলেনি। ওগুলো টিচাররা বলেছে।
সিসিটিভির বিষয়ে বর্ণালী বলেন, ‘স্কুলের টিচাররা হেডমাস্টারের ঘরে গিয়ে বলছে সিসিটিভি বসাতে। কেন? না, ছাত্র-ছাত্রীরা যে একসঙ্গে বসে থাকে, ওটা বন্ধ করা দরকার। তখন বুঝলাম। কী সংকট এটা একটা। এতে যে নিজেদের স্বাধীনতা বিপন্ন হয় সেটাই বুঝতে পারছে না। শাহিনা পারভীন মন্থন সাময়িকীর একজন নতুন পাঠক। তিনি বলেন যে ‘সাধারণের শঙ্কা’ লেখাটিতে ববিতার কথা ওঁর সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। স্বাধীনতার মানেও কিন্তু আপেক্ষিক। স্বাধীনতা মানে কিন্তু একটা দায়িত্ব। মেয়েরা বোঝে — স্বাধীনতা মানে নিজেকে এক্সপোজ করা, মডার্ন হওয়া, ইংরেজিতে কথা বলা। স্বাধীনতা মানে যে সামাজিক দায়িত্ব সেটা আমরা নষ্ট করে ফেলছি। … আমি ববিতাদির কথাটা এইজন্য তুললাম, উনি কিছুটা হলেও এই দিকটা ধরানোর চেষ্টা করেছেন।
মৈত্রেয়ীর ‘হঠাৎই বড়ো হয়ে গেলাম’ লেখাটা ধরেই শমীক এই জায়গায় একটা প্রশ্ন তুলতে চাইলেন। আমাদের সমাজে একজন মেয়ে যখন বড়ো হচ্ছে, কলেজে যাচ্ছে, সে তো ছোটো হয়ে বড়ো হচ্ছে। তাকে তো সমাজে ছোটো হিসেবে ভাবা হচ্ছে। ন্যায়-অন্যায় বা দায়িত্বের ধারণাগুলো তো তার কাছে নেই। স্বাধীনতা তার কাছে তখন ‘র’ একটা জিনিস। সে যেভাবে টিভি দেখেছে, একটু আদুরে মেয়ে হলে তাকে যেভাবে রাখা হয়েছে, যেভাবে শেলটার্ড হয়ে সে বড়ো হচ্ছে তাতে দায়িত্ববোধ কী জিনিস সেটা সে শেখেইনি। এখানে ববিতাদির সঙ্গে একটা তফাৎ হচ্ছে। আঠারো বছর বয়সের মধ্যেই ববিতাদি অনেক কিছু শিখে গেছেন।
শাহিনার মতে, সেটা ঠিকই, কিন্তু ওই এক্সপোজড হওয়ার জায়গা থেকেই তো মেয়েটির হেনস্থা হয়েছে।
জিতেনের প্রশ্ন, সে কীভাবে চলবে তার তরিকা কৌশল কি মেয়েটির দিক থেকে আসবে, নাকি তার অভিভাবকের দিক থেকে?
শাহিনার জবাব, সেটা তো কারও ব্যক্তিগত না। তার শিক্ষক, সমাজ, মিডিয়া … নানানদিক থেকে ভূমিকা আছে। আসলে এখানে সকলে খুব প্রফেশনাল হয়ে গেছে। মা-বাবারাও বাচ্চাদের সেভাবে সময় দিতে পারছে না। আমাদের মুসলমান সমাজে এদিক থেকে অনেক সমস্যা আছে।
শমীক এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাধীনতা না থাকলে তার উলটোদিকই বেশি হয়। ধরো, আমাকে বলা হল যে তুমি এই চৌহদ্দিটার ভিতরে ঘোরাফেরা করবে, এর বাইরে বেরোবে না। এটা যদি আমার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন আমি বুঝতে পারব না যে ওই চৌহদ্দিটা কেন। হয়তো তার খুবই গ্রহণযোগ্য কারণ আছে। কিন্তু আমি না সেটা ভেবে দেখব, না সেটা বুঝতে পারব। আমার প্রথম ঝোঁক থাকবে যে আমি ওই চৌহদ্দিটা ভাঙি। সম্পর্কটা তখন দাঁড়ায় ক্ষমতার সঙ্গে লড়াইয়ের।
শাহিনা একটা উদাহরণ দেন। ‘আমার এক ছাত্রী, তার বাড়ি থেকে বলছে যে তাকে বোরখা পরে বা মাথায় কাপড় দিয়ে বেরোতে হবে। আমি তাকে বলেছিলাম যে বোরখা কেন? আমি বোরখা পরেও বেরিয়ে অন্যায় কাজ করে আসতে পারি। তোমাকে ভেতর থেকে নিজেকে ভালো থাকতে হবে। তখন তুমি যদি বোরখা নাও পরো, তোমার সব বজায় থাকবে। কিছুদিন পরে ও আমার কাছ থেকে অনুমতি নিতে এসেছে, ‘আমি কি মাথায় কাপড় দেব?’ এটা সম্পূর্ণ তোমার সিদ্ধান্ত। আমি কেন বলব তুমি কী করবে? আমায় যদি কেউ বলেও আমি দেব না। আমার কাছে মাথায় কাপড় দেওয়ার কারণটা খুবই স্পষ্ট। মেয়েদের আর ছেলেদের পোশাকের ভিতর কিছু তফাত আছে। আমি জানি সেটা দরকার। সেটা তো মেয়েদের আসল লজ্জা, সেটা এক্সপোজ করার নয়। আমি এমন কোনো অস্বাভাবিকভাবে রাস্তায় বেরোই না যে আমাকে কেউ অন্যভাবে নেবে। বোরখাটা আসলে ঢিলেঢালা হয় যাতে মেয়েদের ফিগারটা প্রমিনেন্ট না হয়। কিন্তু এখন দর্জির কাছে গিয়ে বোরখার মাপ দেওয়া হয় সালোয়ার-কামিজের মতো। এমনকী সালোয়ার-কামিজ তো নিচের দিকটায় ঢিলে, কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু বোরখা এখন নিচ পর্যন্ত ফিটিংস। তার মানে ফিগারটা আরও প্রমিনেন্ট হচ্ছে। বোরখার মানেটাই তো পালটে গেল। আমি ওকে বাধা দিইনি। কারণ তাহলে ও ভেবে বসতে পারে যে আমি মুসলিম-বিরোধী কথা বলছি।
বঙ্কিম জানালেন, এই সংখ্যাটা দেখে একজন পাঠক তাঁকে বলেছেন ‘এবার একটা ভালো কাজ হয়েছে’। কলরব আন্দোলনের ছেলেমেয়েগুলোর পেছনে কিছু লোক আছে যারা নানারকম উসকানি দিয়েছে। শমীকের লেখা নিয়ে অন্যরকম প্রত্যাশা ছিল। তবে সব মিলিয়ে অনেক দিন পর এই সংখ্যাটা খুব ভালো লেগেছে। যারা নতুন পেয়েছে পড়ার সময় কারো খেয়াল পড়ছে না যে মন্থন সময়-অনুযায়ী পিছিয়ে পড়ছে, দেরিতে বেরোচ্ছে। মন্থন বন্ধ হয়ে যাবে শুনে অনেকেই বলেছে, ‘তুই বা চূর্ণী তো দায়িত্ব নিয়ে এটা চালাতে পারিস?’
শমীক জানালেন, তিন-চার বছর আগেও ধর্ষণের মতো বিষয় নিয়ে লেখালিখিতে আমার বা বঙ্কিমের আপত্তি ছিল। কারণ মিডিয়াতে যৌন হেনস্থার খবর যেভাবে রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করা হয় তা ভালো লাগে না।
বঙ্কিম বলেন, কামদুনির ঘটনার পরে ওখানে গ্রামে গিয়ে দেখেছি যে এইরকম ঘটনা সবাই ভুলে যেতে চায়, কাজল মুখার্জি মনে করালেন, সত্তর দশকে কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার শিকার হয়েছিল যেসব পরিবার তারাও পরে আর তা মনে রাখতে চায়নি। এছাড়া তাঁর মনে হয়েছে, যাদবপুরের মূল আন্দোলন যে বিষয়টা নিয়ে সেই ইস্যুটা পরে সরে গেল, ভিসির পদত্যাগের বিষয়টা বড়ো হয়ে গেল এবং তাঁর সরে যাওয়ার পর বিরাট জয় উদ্যাপন হল। পঞ্চাদ্রির মনে হয়েছে, এই মিছিলটায় লোক অনেক কম ছিল। প্রত্যুষা এই সময় বলেন, ভিসি যখন সরে গেলেন, তখন দেখেছি অনেকের ভেতরেই মূল ইস্যুটা ছিল, বিজয় উৎসবের পরে আবার পেছনে ফিরে দেখাটা শুরু হয়।
মন্থন সাময়িকীর একজন দীর্ঘদিনের পাঠক অলকানন্দা গুহ সভায় একটু দেরিতে হাজির হন এবং সভার মিনিট্স তাঁকে পড়ে শোনানো হয়। তিনি বলেন, এই সংখ্যার লেখাগুলোয় কথা বলার ভাষা বেশ প্রিডমিনেন্ট। বহুস্বরের কলরব, একটা ইনফর্মাল ব্যাপার আছে, ফর্মালি গুছিয়ে পেশ করা নয়, তাই বেশ জ্যান্ত লাগছে। চূর্ণীর সম্পাদনায় হয়েছে বলে বিশেষভাবে ভালো লেগেছে। ও নতুন। আন্দোলনের ভিতরে আছে এমন একজন কাজটা করছে। ভিতরে যে থাকে সে তো সবসময় সবটা দেখতে পায় না। কিন্তু এই যে সবটা দেখার চেষ্টা, এটা সুন্দরভাবে হয়েছে। এই সংখ্যাটার জোরের দিক, এটা একজনের সম্পাদনা বলে মনে হয় না। খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যে এটা একটা যৌথ কাজ। মন্থনে সাধারণত যেরকম থাকে, এখানে সম্পাদকের ভূমিকাটা একটু অন্যরকম। এই সংখ্যার একটা বাড়তি ইতিবাচক দিক এটা। শেষ মিছিলটা … মিডিয়াকে অত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে সজাগ থাকা দরকার। আন্দোলনটার মধ্যে কিছু ইতিবাচক দিক সত্যিই আছে যেটা মিডিয়ার কলকাঠি নাড়াকে ছাপিয়ে গেছে। এই সংখ্যাটা আমার দুটো দিক থেকে ইন্টারেস্টিং লেগেছে। এক, আন্দোলনটাকে বোঝার দিক থেকে — তার কত দিক আছে, কত ডাইমেনশন আছে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের মতটা বোঝার চেষ্টা করা — মন্থন এই কাজটা করেছে। অনেক সময় অনেক পত্রিকা ইতিহাসে এটা করেছে, দুভাবে কাজ করে। একটা হচ্ছে মুখপত্র হিসেবে কাজ করে। কোনো একটা ঘটনা ঘটল, তাদের প্রতিনিধিদের বক্তব্য সেখানে প্রকাশ পেল। আরেকটা হচ্ছে যে বাইরে থেকে কিছু অবজার্ভার ঘটনাটা দেখছে, সে বিষয়ে কিছু আলোচনা প্রকাশ পেল। এটা ছাড়া আর একটা ভূমিকাও হতে পারে, মন্থনের মধ্যে সে সম্ভাবনাটা রয়েছে যেটা জিতেন বলছিল … অনেকগুলো সম্ভাবনাই এই সংখ্যাটার মধ্যে আছে, যেগুলো এখনও ফুটে বেরোয়নি। একটা প্রসেসের মধ্যে রয়েছে। এই পত্রিকাটা কোথাও একটা এইসব সম্ভাবনাকে এক জায়গায় করে একটা ফর্ম দেওয়ার কাজ করছে। সেখানে এটা এই আন্দোলনকে প্রায় উসকে দেওয়ার ভূমিকা পালন করতে পারে, যদি সেই ইশারাটা কেউ নেয়। … মৈত্রেয়ী ওর লেখাটা ইংরেজিতে লিখেছে … এটা এই জেনারেশনের একটা সমস্যা।
শমীক জানতে চান, ‘তুমি এটা এই জেনারেশনের একটা ফিচার বলছ না?’
অলকানন্দা মনে করেন, এটা একটা অসুখ। এটা তার দোষ নয়, এটা একটা সমস্যা। মন্থনে এই সবকিছু সমেতই এসেছে ব্যাপারটা। যে যেভাবে পারছে, যে পারছে না আক্ষেপ করছে, সেভাবেই অথেন্টিকভাবেই এসেছে। নারী নির্যাতন, রেপ নিয়ে শমীক আর বঙ্কিম যেকথা বলল, যারা ভিকটিম তারা ভুলে যেতে চায়, এটা সত্যি। প্রতি যুগে দেখা গেছে। ইলা মিত্রকে যে ধর্ষণ করা হয়েছিল, উইমেন্স স্টাডিজ থেকে অনেক বছর পর যে ইন্টারভিউ করতে যাওয়া হয়েছিল, উনি বলেছিলেন, আমি সব ভুলে গেছি।
— তাহলে আপনি পঞ্চাশ বছর আগে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন?
— তখনও আমি দিইনি। পার্টি লিখে দিয়েছিল, আমি সই করেছিলাম। তখনও আমার কিছু মনে পড়ছিল না।
আমি এটা কবিতা পাঞ্জাবির সভায় শুনেছি। এটা মিথ্যে কথা নয়, এটা ট্রমার একটা নর্মাল সাইকোলজি। তারা ডিনায়েল মোডে থাকে।
সৌরীন ভট্টাচার্যের বক্তব্য হিসেবে প্রকাশিত ‘সমাজের পৌরুষ-মন’ লেখাটির নামকরণ নিয়ে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য বলেছেন যে ওটা হবে ‘পুরুষ-মন’ — জানালেন অলকানন্দা। তিনি আরও বললেন, পেট্রিয়ার্কি যখন বাবার চেহারা নিয়ে আসে ভালো লাগে, ভাইয়ের চেহারা নিয়ে আসে ভালো লাগে, এমনকী স্বামীর চেহারা নিয়ে এলে ভালো স্বামী হলে ভালো লাগে। কিন্তু যখন আক্রমণকারীর চেহারা নিয়ে আসে, তখন খারাপ লাগে। আমরা খেয়াল করি না যে ওই আক্রমণকারী চেহারার ভিতরের শেকড়বাকড়গুলো ভয়ঙ্কর জটিলভাবে অন্বিত। এটা বিশ্লেষণ করার দরকার আছে। এপ্রসঙ্গে তিনি ‘ভীতু’ ফিল্মটা সবাইকে দেখার পরামর্শ দেন, যেটায় এই প্রথম ধর্ষকের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে একটা ছবি করা হয়েছে। যাদবপুরে এই আন্দোলনটা সত্যিই পেট্রিয়ার্কির বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন। কিন্তু তার মূল থ্রাস্টটা চলে গেছে ‘ভিসি রিজাইন করুক’-এর দিকে। ভিসি রিজাইন করাতে আন্দোলনের জয় হয়েছে — সবটাই সেরকম নয়। সেই জটিলতাগুলো কিন্তু এই সংখ্যায় এসেছে। এই জটিলতাগুলোর মধ্যে কোন সুতোগুলো নিয়ে মন্থন এগোবে, সেটা ঠিক করতে হবে।
মিহির চক্রবর্তী জানালেন, এই সংখ্যাটা ভালো লেগেছে কারণ এর মধ্যে একটা মাল্টিপ্লিসিটি আছে। ওঁর (অলকানন্দা) কথার সঙ্গে একমত। খুব স্বাভাবিকভাবেই এটা ভিসি বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হল। নানা ইন্টারেস্ট নানাভাবে কাজ করবে, ইনক্লুডিং মিডিয়া। কিন্তু আন্দোলনের রাশ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের হাতেই ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত আনন্দিত যে ভিসিকে এভাবে সরানো গেছে। অনেকদিন পরে একটা সেন্স অব ভিক্ট্রি, ছোটো। আমার বয়স সত্তরের কাছে, আমি সেটা অনুভব করেছি। মূল মিছিলটাতে আমি অংশ নিয়েছিলাম। দেশে এবং দেশের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিছিলে আমি অংশগ্রহণ করেছি, এটা তার মধ্যে অন্যতম। এতে অংশ না নিতে পারলে আমার ব্যক্তিগত লস হত বলে আমার মনে হয়।
যোগীন বলেন, ইস্যুটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। কিন্তু ধর্ষণকারী, ধর্ষকাম এদের সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক দিকটা এতে খুব একটা আসেনি। আরও গভীরে যাওয়াটা খুবই দরকার। সত্তরের দশকে নারী আন্দোলন এই ইস্যুটাকে নিয়ে এসেছিল। বাম আন্দোলন এব্যাপারে থাকতে পারেনি … এটা আমাদের একটা অস্বস্তি।
পরিশেষে জিতেন নন্দী প্রস্তাব দেন, এই সংখ্যার একটা ফলো আপ করা যেতে পারে একটা টাইম-ফ্রেম করে। যদি চূর্ণী আর প্রত্যুষা দায়িত্ব নেয়।
সেইসঙ্গে তিনি সভায় উপস্থিত সকলকে পত্রিকার একদম প্রারম্ভিক পর্যায়ের বন্ধু পীযূষ মুখার্জির মৃত্যুসংবাদ জানান। প্রথম সংখ্যায় (মে ১৯৯৮) যে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল ‘কেন মন্থন’ শিরোনামে, সেটি পীযূষ মুখার্জির লেখা এবং তা আবার পাঠ করে শোনানো হয়।
Leave a Reply