তমাল ভৌমিক
১৮৬৭ সালে কার্ল মার্ক্সের লেখা ‘ক্যাপিটাল’ বা পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার প্রায় দেড়শো বছর পর ২০১৪ সালে টমাস পিকেটি-র লেখা ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বা একুশ শতকের পুঁজি প্রকাশিত হয়েছে। এই দেড়শো বছরে পুঁজি নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। হওয়ার কথাও। কারণ, পুঁজি যেমন পৃথিবী জুড়ে বিশাল আকার নিয়েছে এবং তার গতি-প্রকৃতি যেভাবে পালটেছে তাতে দেশে দেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনও হয়েছে ব্যাপকভাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা তাতে অসাম্য কমেনি। শিল্পপুঁজির বিকাশের গোড়ার দিকে মার্ক্স দেখেছিলেন শিল্পশ্রমিকদের দুর্দশা — মালিক আর শ্রমিকদের ভয়ানক অসাম্য তাঁকে পুঁজি নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছিল। দেড়শো বছর পরে এসে পিকেটি দেখেছেন সেই অসাম্য — গত একশো বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখছেন আয় ও বিত্তের অসাম্যের মাত্রা সমাজের ওপরের সামান্য অংশের সঙ্গে নিচের বেশিরভাগ অংশের তুলনায় অনেক বেশি এবং গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই অসাম্য বেড়েই চলেছে। তাই পুঁজি নিয়ে তাঁর চিন্তা ৬৮৫ পৃষ্ঠার এক বিশাল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে — যা আসলে পুঁজির অর্থনৈতিক ইতিহাস। ঠিকভাবে বিচার করলে বইটার পৃষ্ঠা সংখ্যা আরও অনেক বেশি — মূল লেখার সঙ্গে যে ৭৭ পৃষ্ঠার নোট দেওয়া হয়েছে সেই নোটেও বেশিরভাগ জায়গায় ‘অনলাইন টেকনিকাল রিপোর্ট’ অর্থাৎ ইন্টারনেট দেখতে বলা হয়েছে। আসলে এই বইয়ে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য সাজানো হয়েছে তা পিকেটি ও তাঁর সহযোগী অর্থনীতিবিদদের দেড়-দুই দশকের কাজের ফল। এবং তাতেও উদ্বেগ প্রশমিত হয়নি। অসাম্যের বিপদ সম্বন্ধে, সম্ভাব্য সমাধান সম্বন্ধে অনেক কথা বলেও পিকেটি কিন্তু কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সাজানো-রাস্তার সন্ধান দেননি। দিতে চাননি না পারেননি তা এখানে আলোচ্য নয়। তাই তিনি ভূমিকায় এই সমীক্ষার ফলাফলের ওপর দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘আরও বলতে গেলে, অসাম্যের শক্তিগুলোর যে স্থায়ী চেহারা চারিদিকে দেখা যায়, সেগুলোকে অচল করা ও ঠেকানোর কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নেই।’ (পৃষ্ঠা ২১)
মার্ক্সের কাছে পুঁজি ছিল এক (শোষণমূলক) সামাজিক সম্পর্ক। পিকেটি যদিও এক জায়গায় বলেছেন, ‘পুঁজি কোনো অপরিবর্তনীয় ধারণা নয় : এর মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয় প্রতিটা সমাজের বিকাশের অবস্থা এবং সেই সমাজে বিরাজমান সামাজিক সম্পর্কগুলো’ (পৃ. ৪৭) কিন্তু তাঁর এই লেখায় পুঁজিকে তিনি ‘মানুষ বাদে অন্যান্য সম্পত্তির (অ্যাসেট) মোট পরিমাণ হিসাবে দেখেছেন যে সম্পত্তির মালিক হওয়া যায় এবং যা বাজারে বিনিময়যোগ্য।’ (পৃ. ৪৬) এবং ‘এই সম্পত্তি পুঞ্জীভূত হয়েছে আগের বছরগুলোতে মোট যা সম্পদ অধিকার ও সঞ্চয় করা হয়েছে তা যোগ করে’ (পৃ. ৫০)। তাঁর মতে পুঁজি ও শ্রম এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে পুঁজির বিকাশকে না দেখে পুঁজি/আয় (r/g) অনুপাতের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাকে দেখা উচিত। কারণ ‘অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে পুঁজি ও শ্রমের থেকে আলাদা আলাদা আয়ের পরিমাণের চেয়েও বেশি নিখুঁত তথ্য পাওয়া যায় পুঁজির সঞ্চয়ের।’ (পৃ. ২০৪) পুঁজি থেকে বার্ষিক আয়কে r এবং জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারকে g ধরে নিয়ে পিকেটির ফর্মুলা r>g দেখিয়েছে যে r সবসময় g-এর চেয়ে বেশি এবং তার ফলে সম্পদ বাস্তবে সমাজের ওপরের অংশের হাতে আরও বেশি ঘনীভূত হওয়াটাই সুনিশ্চিত। পুঁজিবাদ যে স্বাভাবিকভাবে পিতৃতন্ত্রের রাজত্বকেই সমর্থন করে, তার উদাহরণ হিসেবে পিকেটি দেখিয়েছেন, ‘ফরাসি প্রসাধন শিল্পের দৈত্য ‘এল ওরিল’-এর উত্তরাধিকারিণী লিলিয়ান বেটেনকোর্ট, যিনি জীবনে কোনোদিন কোনো কাজ না করেই দেখেছেন যে তাঁর সৌভাগ্য সেই দ্রুততায় পরিবর্তিত হচ্ছে, যে দ্রুততায় উচ্চপ্রযুক্তির পথিকৃৎ বিল গেট্সের সৌভাগ্য পরিবর্তিত হচ্ছে। বিল গেট্সের সম্পদও ঘটনাক্রমে তিনি কাজ ছেড়ে দেওয়ার পরও একই গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে।’ (পৃ. ৪৪০) এর থেকে স্পষ্ট যে পুঁজি থেকে পুঁজি বৃদ্ধি পায় পুঁজিপতির বিনা পরিশ্রমেও। যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরেকটা উদাহরণে পিকেটি দেখিয়েছেন, যার মূল রসদ যত বেশি তাদের আয়ও তত বেশি। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রসদ ১০ কোটি ডলারের কম, তাদের বার্ষিক আয়ের হার ৬.২ শতাংশ আর যাদের ১০০ কোটি ডলার, তাদের ৮.৮% এবং সবচেয়ে ওপরে হার্ভার্ডের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, ১০.২%। তার মানে যাদের ধনসম্পদ যত বেশি, তাদের আয় অন্যদের চেয়ে বেশি এবং অন্যদের থেকে তাদের ফারাকও বেশি বেশি। (পৃ. ৪৪৮) সর্বব্যাপী এই ফারাক আর তার ফলেই আজ আমেরিকায় ‘আমরা ৯৯%, তোমরা ১%’-এর শ্লোগান তুলে অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট আন্দোলন। এই বর্ণনা সত্ত্বেও পিকেটির আলোচনায় মার্ক্সের মতো শ্রেণী তথা পুঁজিপতি ও শ্রমিকশ্রেণীর প্রশ্ন পুঁজির সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসেনি। যদিও পিকেটি উপার্জনকারী জনসমষ্টির ওপরের ১০ শতাংশকে ‘উচ্চ শ্রেণী’ এবং উচ্চতম ১ শতাংশকে ‘আধিপত্যকারী শ্রেণী’ বলেছেন।
উচ্চতম ১ শতাংশ সম্বন্ধে পিকেটির পর্যবেক্ষণ হল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এদের আয় অন্যান্য ধনী দেশগুলোর তুলনায় আরও বেশি হারে বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ওপরের অংশের সাথে তলার অংশের আয়ের ফারাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেন খুব একটা পিছিয়ে নেই এই ব্যাপারে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশ নিজেদের ঘরে তুলে নিয়ে যায়, যা ১৯৭০ সালের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। ১৯৭৭ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে পরিবার পিছু মোট আয়ের যে বৃদ্ধি হয়েছে তার ৬০ শতাংশ গেছে সবচেয়ে ওপরের তলার ওই ১ শতাংশের হাতে। তার অর্ধেক অংশই আবার কুক্ষিগত করেছে সর্বোচ্চ ০.১%। তুলনা করলে দেখা যায় যে দরিদ্রতম ৯০ শতাংশের আয় বৃদ্ধির হার ‘বছরে ০.৫ শতাংশেরও কম’।
পুঁজি ও আয়ের অনুপাত, যা কমার মধ্য দিয়ে অসাম্য কমার বিষয়টিকে দেখতে চেয়েছেন পিকেটি, তা একমাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪) পর থেকে ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কিছুটা চোখে পড়ে। এই পর্যায়ে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির প্রতিপত্তিও কমে এবং চলমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে বিরাট ধাক্কা খায় তার কারণ দুটো ধ্বংসাত্মক বিশ্বযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব, ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের উদ্ভব। উচ্চ আয়ের ওপর ভারী কর চাপানো, যুদ্ধ ও মন্দায় বহু সম্পত্তি ধ্বংস হওয়া, খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলনের চাপে মজুরি ও অন্যান্য সামাজিক সুযোগ দিতে সরকার ও মালিকদের বাধ্য হওয়া — এসবের ফলে এই সময়ে অসাম্য অনেকটা কমে আসে। (পৃ. ২৭৫)
এই পর্যায়ে প্রায় ছয় দশকের অসাম্য কমে আসার সময়ে একটা বড়ো অংশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়, যার মধ্যে আছে বিভিন্ন পেশাজীবী, সরকারি চাকুরে ও সংগঠিত শ্রমিকেরা — এরা অনেক সম্পদের মালিক না হলেও এদের যা আয় তাতে খাওয়া-পরা ও নিত্যদিনের খরচের পরেও বেশ অনেকটা টাকা হাতে জমে যায়, যার মূল চেহারা স্থাবর সম্পত্তি অর্থাৎ নিজ বাড়ি বানানোর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। ধনী দেশগুলোর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই মধ্যবিত্তদের উত্থান বড়ো প্রভাব ফেলেছে, কারণ উচ্চবিত্ত ছাড়াও সমাজে উপস্থিত এই বাড়িওয়ালা মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেদের সম্পদের মূল্য রক্ষা করা এবং পারলে তাকে বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত। (পৃ. ২৬১) এই সময়ের গল্প-উপন্যাসেও সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ফারাক করা হয়েছে কর্ম-দক্ষতা ও আয়ের উঁচু নিচু শ্রেণীবিভাগের মধ্য দিয়ে, বাপকেলে সম্পত্তি কার কত বেশি আছে তা দিয়ে নয়। সমকালীন আমেরিকায় টিভি সিরিয়ালেও নায়ক-নায়িকাদের দেখানো হয়েছে উঁচু উঁচু ডিগ্রিধারী ও উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন হিসেবে (যেমন, ‘হাউস’, ‘বোন্স’, ‘ওয়েস্ট উইন্ড’ ইত্যাদি)। (পৃ. ৪১৪)
এর সঙ্গেই উত্থান ঘটেছে বড়ো বড়ো কর্পোরেশনগুলোর ‘সুপার ম্যানেজার’-দের, যাদের মাইনে শুধু বিশাল নয়, তারা এত ক্ষমতাশালী যে নিজেদের মাইনে তারা নিজেরাই ঠিক করতে পারে। এইরকম একজন সুপার ম্যানেজারের উল্লেখ করেছেন পিকেটি বইটির প্রথম পরিচ্ছেদে — যেখানে দেখা গেছে জোহানেসবার্গে মারিকানা প্ল্যাটিনাম খনির একজন ম্যানেজারের মাইনে বছরে ১০ লক্ষ ইউরো, যা ওই খনির ২০০ জন শ্রমিকের মাইনের সমান। (পৃ. ৫৮৩, নোট নং ৪) এই সুপার ম্যানেজারের মতো বুদ্ধিজীবীদের আয় বাড়তে বাড়তে দেখা গেল ১৯১০ সালে সমাজের উঁচুতলার সঙ্গে নিচুতলার মানুষের যে আয়ের অসাম্য ছিল, ২০১০ সালে, একশো বছর পরে এসেও সেই অসাম্য একই পরিমাণে দাঁড়িয়ে গেছে। তফাৎ এটাই যে একশো বছর আগে অসাম্যের মূল কারণ ছিল, ওপরতলার হাতে প্রচুর সম্পত্তি, যার মূল অংশ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আর বর্তমানে তার সঙ্গে অসাম্যের আরেকটা কারণ যুক্ত হয়েছে, সেটা হল, সুপার ম্যানেজার বা ‘উচ্চমেধাতান্ত্রিক’ সমাজের উদ্ভব, যাকে ‘সুপারস্টারদের সমাজ’ও বলা হয়ে থাকে। (পৃ. ২৬৪)
এই অবস্থাটা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দেখা গেছে। তবে কম্যুনিস্ট শাসিত দেশগুলোর তথ্য পাওয়া যায় না — ওইসব দেশগুলো সম্পর্কে জানা যায় যে বেশিরভাগ পুঁজি সরকারের হাতে — যা থেকে বোঝা যায় না যে তলার ৫০% মানুষের হাতে জাতীয় আয়ের ২০% বা ৩০% আছে কিনা। চীন-ভারতের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে পিকেটির পর্যবেক্ষণ হল এই দেশগুলোও ধনী দেশগুলোর মতো অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। যদিও জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উচ্চ হার এই দেশগুলোতে ধনী দেশগুলোর মতো সম্পদ পুঞ্জীভবনের সমস্যা অতটা বাড়িয়ে তোলেনি। যেমন, চীনে ১৯৮০-র পর উদারীকরণের ফলে অসাম্য বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ১৯৯০-২০০০ সালে তা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তার ফলে পিকেটির হিসেবে সেখানে ওপরের ১ শতাংশের হাতে জাতীয় আয়ের ১০-১১% জমা হয়েছিল, যা ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার (১২-১৪%, যা ব্রিটেন ও কানাডার কাছাকাছি) তুলনায় কম এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ও আর্জেন্টিনার (১৬-১৮%, যা প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সমান) তুলনায় অনেক কম। (পৃ. ৩২৭)
দেশে দেশে পুঁজির চেহারা, তজ্জনিত অসাম্য, আয়ের ও খরচের রকমারি ইত্যাদি খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বিচিত্র যে সব তথ্য উঠে এসেছে, তা এই বইয়ের আসল সম্পদ। আমরা এর কয়েকটা উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি। যেমন : ‘১৯৬০-এর দশকে দেখা যাচ্ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফ্রান্সের তুলনায় সাম্য বেশি, অন্তত সাদা চামড়ার নাগরিকদের মধ্যে — পিকেটির এই মন্তব্যের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষের অসাম্যের কথা লুকিয়ে আছে। (পৃ. ২৯৪) কর ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারে পিকেটি লিখছেন, ‘মজুরি থেকে যে আয় হয়, তার তুলনায় বিনিয়োগ থেকে আয় লুকিয়ে রাখা সোজা; যেমন বিদেশি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে করদাতা নিজের দেশে আয়কর ফাঁকি দিতে পারে, যেহেতু বিদেশি ব্যাঙ্ক করদাতার দেশকে এই তথ্য জানিয়ে সহায়তা না করতে পারে।’ (পৃ. ২৮১) শিক্ষা খাতে খরচ বিষয়ে পিকেটি বলছেন, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে গণতন্ত্রীকরণ শিক্ষা ক্ষেত্রের অসাম্যকে দূর করতে পারেনি এবং ফলত মজুরির অসাম্য কমেনি … বহু মানুষ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতে পারেনি, কারণ তাদের পরিবার লেখাপড়া শেখানোর বিরাট খরচ জোগাড় করতে পারেনি।’ (পৃ. ৩০৬) যুক্তরাষ্ট্রে হাউস বা সংসদের ৫৩৫ জন সদস্যের গড় সম্পদ ‘মাত্র’ ১ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার। যেখানে চীনা গণপরিষদের ৩০০০ সদস্যের মধ্যে ৭০টি সাম্মানিক পদে অধিষ্ঠিত ধনী সদস্যদের সম্পত্তি গড়ে ১০০০ কোটি ডলারেরও বেশি। (পৃ. ৬৪৬) এর থেকে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী দেশের অবস্থা বোঝা যায়। কখনও বলছেন, ‘বিশ শতকে উন্নত দেশগুলোতে দিনমজুরির বদলে যে মাসিক মাইনের ব্যবস্থা হয়েছিল, তা প্রত্যেকের স্বার্থ সিদ্ধি করেছিল — কর্মচুক্তিতে ‘মজুরি বিমা চালু হল’ — এই হিসেবে। আবার কখনও বলছেন, চিকিৎসক, উকিল ইত্যাদিরা শুধু বুদ্ধি বেচে খায় না, তাদের পুঁজিও আছে, কিছু নিজস্ব যন্ত্রপাতি টুকটাক ব্যবস্থার সে মালিক — এদের একটা মিশ্রবর্গ হিসেবে দেখা দরকার, এটাই পিকেটির দাবি। কখনও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চালু হওয়া বা রাষ্ট্রের সীমার বাইরে সকলের জন্য একই ধরনের মুদ্রা ইউরো চালু হওয়ায় তিনি খুশি — এই তো দেশে দেশে সহযোগিতার শুরু হচ্ছে যার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রস্তাবিত পুঁজির ওপর বিশ্ব কর চালু করার ব্যবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। আবার কখনও তিনি হতাশার সঙ্গে জানাচ্ছেন — ইতালি ও স্পেনে পুঁজির ওপর উঁচু হারে কর চাপিয়ে জনপরিষেবায় কিছু বেশি খরচ করার চেষ্টা কেমন কঠিন বাধায় পড়ে গেছে। আর সবসময়ই তিনি চিন্তিত পুঁজিবাদের মধ্যেই সংস্কারের পথে কোনো অহিংস উপায় খুঁজে না পাওয়ায় অসাম্য বেড়েই চলেছে। পিকেটি বলছেন, অসাম্য কি আদৌ থাকা উচিত? এই প্রশ্নই এই বইটি লেখার অন্যতম চালিকাশক্তি।
বহু লেখচিত্র, সারণি ও তথ্যভাণ্ডারে সমৃদ্ধ এই লেখায় কোনো তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা করেননি পিকেটি। বরং তথ্যের স্বপক্ষেই তাঁর লেখা শেষ করেছেন এই বলে যে ‘সংখ্যা বা তথ্য নিয়ে কাজ করাকে অবহেলা করলে তা, যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ, তাদের স্বার্থ রক্ষায় তেমন কোনো সহায়তাই করে না।’ আমরা তাই পিকেটির তথ্যভাণ্ডার থেকে প্রধান কয়েকটা কথা তুলে ধরার দিকেই মনোযোগ দেব। ১৯৯০-২০১০ সালের মধ্যে বিল গেট্স ও লিলিয়ান বেটেনকোর্টের যে উদাহরণ আমরা এই লেখায় প্রথম দিকে দেখেছি, সেটাই পিকেটির মতে সাধারণ চিত্র — অর্থাৎ সাধারণত উত্তরাধিকারী তার পুঁজি খাটিয়ে যে পরিমাণ আয় করে, তার থেকে কম হারে সুদ পাওয়া যায় উপার্জন থেকে খরচ বাঁচিয়ে যে সঞ্চয় করা যায় তার ওপরে। পিকেটি দেখিয়েছেন যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পুঁজির দাপট একুশ শতকে আবার ফিরে আসছে এবং তা বড়ো মাত্রায় ইউরোপে এবং তার থেকে একটু ছোটো মাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রে পরের দশকগুলোতেও দেখা যাবে।
পুঁজি আকারে বড়ো হলে কেমন ক্ষমতাশালী হয়, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে পিকেটি বলছেন : ‘ধনীরা প্রতিনিয়ত নতুন আইনে সুসজ্জিত হয়ে উঠছে যাতে তাদের সম্পদ অটুট থাকে। তারা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য ‘ট্রাস্ট ফান্ড’, ‘ফাউন্ডেশন’ ইত্যাদি নাম দিয়ে নানা সংগঠন গড়ে তুলছে।’ (পৃ. ৪৫১-৪৫৩) ‘মুদ্রাস্ফীতির ফলে যে পুনর্বন্টন হয় তা সবচেয়ে কম ধনীর পক্ষে ক্ষতিকারক এবং সবচেয়ে বেশি ধনীর পক্ষে লাভজনক।’ ‘পুঁজির বিশ্ব জোড়া বন্টনের বিষয়টা একই সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক। তাই দেখা যায়, সৌদি আরব আমেরিকার থেকে ট্রেজারি বন্ড কেনে, যখন অন্যত্র বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ হত; কারণ সৌদি আরব তখন ভয় পেয়েছিল যে ইরাক তাকে আক্রমণ করবে আর সেই আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য আমেরিকাকে তার দরকার।’ (পৃ. ৪৫৫-৪৬১) বিশ্বায়নের ফলে পুঁজির চেহারা সম্বন্ধে তিনি বলছেন, ‘সবচেয়ে বড়ো সম্পত্তিগুলোর রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা অনেকটাই হয়ে গেছে। এই বিচ্ছিন্নতা আবার জাতীয়তার ধারণাকে অনেকটাই বিনষ্ট করেছে। কারণ ধনীতম ব্যক্তিটি তার আদি কৌমের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে টাকাপয়সা নিয়ে অন্য জাতির পরিচয়ে অন্য দেশের মধ্যে গিয়ে বসবাস করতে পারে।’ ‘বেশ কিছু ধনী লোক তাদের সম্পদের অনেকাংশ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অন্য দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে — এদের সম্পদের পরিমাণ এবং তার ওপর কর নির্ধারণ করা কেমন কঠিন বোঝাই যাচ্ছে।’ (৪৫৯-৪৬৭) ‘১৯৮০-র পর থেকে উন্নত দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে বাধ্য করছে তাদের সরকারি খাতে খরচ কমাতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শিল্প ব্যবস্থাগুলোর ওপর কর কমাতে।’ অথচ সরকারি খাতে যদি ১০-১৫% খরচ রাখা হয়, তাহলে পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে খরচের জন্য হাতে আর কিছুই থাকে না। (উদাহরণ, সাব সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও বিশেষত ভারতবর্ষ) (পৃ. ৪৯১)
এহেন অবস্থায় পুঁজির পুঞ্জীভবন ও তার ফলস্বরূপ অসাম্য ঠেকানোর জন্য পিকেটি একটা উপায়ের কথা বলেছেন। সেটা হচ্ছে ‘পুঁজির ওপর বিশ্ব-কর চাপানো’, যা ভাঙলে দাঁড়ায় ‘বিশ্বপুঁজির ওপর উঁচু হারে কর চাপানো এবং এর সঙ্গে এর জন্যই প্রয়োজন উচ্চস্তরের আন্তর্জাতিক আর্থিক স্বচ্ছতা।’ আন্তর্জাতিক আর্থিক স্বচ্ছতার প্রশ্নটা এসেছে যাতে কোন দেশে কার হাতে কত পুঁজি আছে, তা ঠিক ঠিক জেনে তার ওপর কর চাপিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাছাড়া, পুঁজিপতিদের কর ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টা আমরা আগের অনুচ্ছেদে দেখেছি। ‘এই উপায় ধাপে ধাপে প্রথমে অঞ্চল বা দেশগুলোর মধ্যে, তারপর মহাদেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে নেওয়া সম্ভব। এই ধরনের মনোভাবের একটা রূপ দেখতে পাওয়া যায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে ব্যাঙ্কের তথ্য লেনদেনের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বিষয়ে যে কথাবার্তা হয়েছে তার মধ্যে।’ (পৃ. ৫১৬) অবশ্য পুঁজি ছাড়া উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া সম্পত্তি ও আয়ের ওপর করও একই সঙ্গে চাপানো দরকার। (পৃ. ৫২৭) এরকমটাই পিকেটির মত। তাঁর মতে, ‘উৎপাদনের উপায়গুলোর ওপর, জমি ও বাড়ির ওপর মালিকানা, শিল্প-ফিনান্স-ব্যবসায়ী পুঁজির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা তুলে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল, তাতে পুঁজির থেকে ব্যক্তিগত আয়ও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। r>g এই অসাম্য ততদিন একটা খারাপ স্মৃতির মতো থেকে গিয়েছিল, যতদিন না বৃদ্ধি (growth) ও কলাকৌশলের প্রগতির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে সাম্যবাদ দম্ভ প্রকাশ করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যেসব মানুষেরা এই সর্বগ্রাসী পরীক্ষায় আটকা পড়েছিল, তাদের কাছে সমস্যাটা দাঁড়ালো যে ব্যক্তিগত মালিকানা ও বাজার অর্থনীতি, শুধুমাত্র শ্রমশক্তি বিক্রি করা ছাড়া যাদের আর কিছুই নেই, তাদের ওপর পুঁজির আধিপত্য সুনিশ্চিত করাকে সহায়তা করে না, ওগুলো লক্ষ কোটি ব্যক্তির কাজকে সংযোজিত করার কাজে উপযুক্ত ভূমিকা নেয় এবং ওগুলো ছাড়া এই কাজটি করা সহজ নয়। সোভিয়েতের কায়দায় কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা যে মানবিক দুর্যোগ ডেকে নিয়ে এল, সেটাই উদাহরণ হিসেবে এটাকে স্পষ্ট করে।’ এরপরেও পিকেটি একটা যুক্তি সাজিয়েছেন যে, ‘পুঁজির ওপর কর আরোপ করা ব্যক্তিগত পুঁজি ও তার আয়ের শ্বাশ্বত সমস্যার সমাধানে কম হিংস্র ও বেশি কার্যকর একটা উপায়।’ (পৃ. ৫৩১-৫৩২)
উপায় তো একটা ঠিক করেছেন পিকেটি, কিন্তু তা প্রয়োগ করা যে কী কঠিন তা তিনি নিজেই আলোচনা করেছেন নানাভাবে। যেমন, সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট চেয়েছিলেন ছোটো পুঁজির ওপর বেশি কর চাপাতে, বড়ো পুঁজির ওপর বেশি কর চাপালে তারা যদি দেশ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে কী করে দেশ চালাবেন? গ্রীসও একই রকম আর্থিক সংকটে পড়েছিল এবং সেখানেও পুঁজিপতিদের পুঁজি নিয়ে দেশ ছেড়ে পালানো আটকানোর কোনো আইন না থাকায় পুঁজিপতিরাই উল্টে রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব করছিল। বিশ্বায়নের ফলে ছোটো দেশগুলো এইভাবে সংকটে ভোগে এবং সমস্ত ঘটনাগুলো বন্ধ ঘরের বৈঠকে ঠিক হয় বলে সত্যিটা জানা যায় না। ২০১৩ সালের এই ঘটনায় সাইপ্রাসে প্রশাসন প্রাথমিক তথ্যটুকুও জানত না যে কোন পুঁজিপতি কোন ব্যাঙ্কে কত পরিমাণ টাকা রেখেছে। ফলে কোটি কোটি টাকার মালিক রাশিয়ান পুঁজিপতিদের জন্য সেখানকার ব্যাঙ্কে যেটুকু কর, দশ হাজার টাকার মালিকের ওপরও একই পরিমাণ কর। ফলে গণবিক্ষোভ, অর্থনৈতিক সংকট এবং সবচেয়ে খারাপ হল তারপরেও সেখানকার প্রশাসনের হেলদোল খুব কম।
অতএব উপায়টির প্রয়োগ সফল করার জন্য পিকেটির মতে প্রয়োজন, ‘নতুন ধরনের অংশগ্রহণ ও পরিচালনার কায়দা আবিষ্কার করা।’ (পৃ. ৫৬৯) এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলছেন : ‘পুঁজির ওপর গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে গেলে পুঁজির সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক মানুষের কাছে অর্থনৈতিক তথ্যগুলো পৌঁছানো দরকার।’ তা না হওয়ার ফলে, ‘যেসব হিসাবপত্র প্রকাশিত হয়, তাতে লাভ কত অংশ আর মজুরি কত অংশ তা বলা থাকে না। তাই আমরা ধরতেও পারি না যে লাভ ও মজুরির মাঝখানের পথে কতটা জিনিস নষ্ট হল বা কেউ খেয়ে নিল।’ ‘… শ্রমিক ও তাদের প্রতিনিধিদের যথেষ্ট তথ্য না জানালে তারা কোম্পানির পুঁজি কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। ফলে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র থাকবে না। … কর্পোরেট সংস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার সত্যিকারের অধিকার না দেওয়া হলে স্বচ্ছতার কোনো কার্যকারিতাই থাকে না।’ … ‘যদি গণতন্ত্রকে কোনোদিন পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তাহলে তাকে প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে, যে বিশেষ রূপের প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ একসঙ্গে থাকবে, তাকে বারবার পুনরাবিষ্কার করা প্রয়োজন।’ (পৃ. ৬৫৫, নোট ৫৪)
বিশাল একটা বই এবং তাতে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পিকেটির নানা মন্তব্য আছে যা স্থানাভাবে বিস্তারিত আকারে দেওয়া গেল না। যেমন, পেনশনকে আগাম মজুরি হিসেবে দেখা এবং তা অবসরের সময়ে একেবারে দিয়ে দেওয়াটা তাঁর ভালো মনে হয়েছে; আবার উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া; পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির সন্ধান করা; যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কারিগরি কৌশলকে ঢুকতে দেয় না এবং সমৃদ্ধির পথে বাধা দেয় তাকে সমর্থন না করা; দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রসারই অসাম্য দূর করার প্রধান উপায় হিসেবে ভাবা, ইত্যাদি। উপরোক্ত সবকয়টা বিষয়ই অনেক গভীর আলোচনার দাবি রাখে, যা এই বইতেও যথেষ্ট পরিমাণে নেই।
তাছাড়া এমন বিষয়ও আছে যা এই প্রসঙ্গে আলোচ্য। যেমন পণ্যরতি ও ভোগের প্রশ্ন। সমাজের যে ভোগবাদী চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি আজ তার কতটা সুস্থ এবং তার জন্য উৎপাদনের মাত্রা বাড়িয়ে যাওয়াটাই এগোনোর রাস্তা কি না সে বিষয়ে পিকেটি আলোচনা করেননি, যা অবশ্য প্রত্যাশিত ছিল।
মার্ক্সের পুঁজির সঙ্গে পিকেটির পুঁজির তুলনা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। মার্ক্স সম্বন্ধে পিকেটির সমালোচনা এই যে ‘মার্ক্স তাঁর পূর্বসূরীদের মতো টেঁকসই কারিগরি উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতার ক্রমবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেননি এবং সেগুলো যে পুঁজির সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া ও ব্যক্তিগত পুঁজির ঘনীভবনের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে, তা ভাবেননি। (পৃ. ১০) তারপরে পিকেটি মন্তব্য করছেন, ‘আজকে আমরা জানি যে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির জন্যই দীর্ঘকালীন গঠনগত বৃদ্ধি সম্ভব। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত অন্যরকম থাকায় এবং যথেষ্ট তথ্য না থাকায় মার্ক্সের সময়ে এটা সুনিশ্চিত ছিল না।’ (পৃ. ২২৮) ‘আধুনিককালের বৃদ্ধি যা উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি ও জ্ঞানের প্রসারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা মার্ক্স বর্ণিত পুঁজির ধ্বংস হওয়াকে এড়াতে পেরেছে এবং পুঁজির সঞ্চয়কে সামলাতে পেরেছে। কিন্তু তা পুঁজির মূল গঠনকে পালটাতে পারেনি অথবা কোনোভাবেই প্রকৃত অর্থে অর্থনীতির বৃহৎ ক্ষেত্রে শ্রমের তুলনায় পুঁজির গুরুত্ব কমাতে পারেনি।’ (পৃ. ২৩৪)
এই হচ্ছে পিকেটি, যিনি যুক্তি দিয়ে সমালোচনা করছেন। আবার তাঁর উলটোদিকটা বা সীমাবদ্ধতার কথাও বলছেন। ভালো করে পড়লে দেখা যাবে যে বহু বিষয়েই পিকেটি দুরকম কথা বলছেন, নিঃসংশয় পণ্ডিত দার্শনিকের মতো কোনো সবজান্তা ভঙ্গিমায় অমোঘ সত্যপথ বলার কোনো চেষ্টা নেই তাঁর, তিনি নতুন পথ অনুসন্ধানের কথা বলছেন, যা দেখছেন বুঝছেন তাই বলছেন — তাঁর এই সততা চোখে পড়ার মতো।
Leave a Reply