২৭ এপ্রিল ২০১৫ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ‘শান্তিপুর সাংস্কৃতিক’-এর মহলাকক্ষে ‘থিয়েটারের স্বাধীন পরিসর’ বিষয়ে একটি আলোচনা হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন শান্তিপুরের থিয়েটার-কর্মী এবং থিয়েটার অনুরাগী কয়েকজন মানুষ। শমিত আচার্য সভার সূচনা করেন। তিনি বলেন, মন্থনের পাতায় তৃতীয় পরিসরের যে খোঁজ চলছে, তাকে স্পষ্ট করে তোলার জন্যই আজকের আলোচনা। থিয়েটারের জগতে এই স্বাধীন অবস্থানকে আমরা বুঝতে চাইছি। উপস্থিত ছিলেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, রাত্রি চট্টোপাধ্যায়, বাবলা বসাক, পার্থ চক্রবর্তী, গুরুপ্রসাদ বিশ্বাস, জিতেন নন্দী, শমিত আচার্য, বাপী (রজত দাস), আবু সোলাইমান দারানি, অনিন্দ্য মোদক, তাপস কীর্তনীয়া, অসিত প্রামাণিক, নীলিমা বিশ্বাস, অমিত মাহাত। স্বাধীন বা মুক্ত পরিসরের খোঁজের প্রেক্ষিত থেকে হলেও আলোচনায় অনেকগুলো আলাদা আলাদা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, যেমন, থিয়েটার নিজেই এক স্বাধীন কর্মকাণ্ড; নাট্য আন্দোলনের নানা ধারাপ্রবাহ; থিয়েটারে সংলাপের ভূমিকা; থিয়েটারে মেধা ও প্রতিভার ভূমিকা; থিয়েটারের মতো সক্রিয়তার বিন্দুগুলো সম্মিলিত হওয়া; প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্বের প্রশ্ন; সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-অনুদান ও পুরস্কারের প্রভাব এবং সর্বোপরি স্বাধীন পরিসরে অবস্থানরত ব্যক্তি-মানুষের আত্মোপলব্ধি। একটা বিষয়কে ঘিরে এতগুলো আলাদা আলাদা পয়েন্ট পরস্পর-সম্পর্কিত হয়েছে পারস্পরিক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে। সেদিনের সন্ধ্যার সংলাপের সূত্র ধরে পরে অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন তাঁদের বক্তব্যে সামান্য সংযোজন ও বিয়োজন করেছেন। সম্পূর্ণ আলোচনাটি সামান্য সম্পাদনা করে এখানে প্রকাশ করা হল।
জিতেন নন্দী : থিয়েটারের স্বাধীন পরিসরকে আপনারা কেমন দেখছেন? কেমন দেখছেন এর অদল-বদলকে? পত্র-পত্রিকার জগতে নানারকম আছে, তার মধ্যে একটা ধরন লিট্ল ম্যাগাজিন। লিট্ল ম্যাগাজিনকে যদি আমি প্রকাশনার জগতের একটা স্বাধীন পরিসর ধরে নিই, তাহলে থিয়েটারে এরকম কোনো স্বাধীন পরিসর আছে কি? আমরা অতীতে লিট্ল থিয়েটার, থার্ড থিয়েটার ইত্যাদির কথা শুনেছি।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : আমার মনে হয়, থিয়েটার নামক কাণ্ডটাই একটা স্বাধীন পরিসর। থিয়েটার তো খুব বেশি লোক করে না। খুব কম সংখ্যক লোকই করে। হাতে গুনে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গে হয়তো পাঁচ হাজার দল আছে, সেটা অন্য কথা। কিন্তু আপামর মানুষের কাছে থিয়েটার তো অপরিহার্য কিছু নয়। তাদের কাছে ক্রিকেট খেলা দেখা যতটা অপরিহার্য, থিয়েটার ততটা নয়। এইবার কেউ একটা দল বানালো, সবকিছু জোগাড়যন্ত্র করে নাটকের শো করল, সেটা থিয়েটারের মতো দেখতে ঠিকই, অথচ স্বাধীন পরিসরের চরিত্রটা তাতে আছে কিনা সেটা কী করে বুঝব? এটা নিয়ে কথা হতে পারে। আর একটা কথা হতে পারে, যে থিয়েটার চলছে সেটাকে মেইনস্ট্রীম ধরে নিয়ে তার মধ্যে বাদলবাবুরা যেমন থার্ড থিয়েটার বলেছিলেন, সেইসব ধারার বিচার। সেখানে আমরা যেটা প্রাথমিকভাবে বুঝেছিলাম তা এইরকম : আমাদের প্রাচীন লোকনাট্য তাকে ফার্স্ট থিয়েটার ধরে নিয়ে — তার বিষয়বস্তু পিছিয়ে পড়া, সামন্ততান্ত্রিক বিষয়, দেবদেবীর উপাখ্যান, কিন্তু তার জায়গাটা ছিল খোলামেলা মানুষের মধ্যেই — সেখান থেকে এল প্রসেনিয়াম বা নগরনাট্য। তার ফর্মটা খুব জটিল, ক্রমশ মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে গেল। এই দুটোকে সংশ্লেষ করে একটা থার্ড থিয়েটারের কথা ভাবা হল, যেটা খুব সহজে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, ফর্মটা সহজ কিন্তু বিষয়টা সেকেন্ড থিয়েটারের মতো থাকল, জীবনকে তার জটিলতায় দেখা, আধুনিকতা সেটা থাকল। প্রাথমিকভাবে আমার সেরকমই মনে হয়। আমার মনে হয় বাপী এটা ভালো বলতে পারবে। থার্ড থিয়েটার অর্থাৎ অঙ্গনে আমরা যেটা করি, সেক্ষেত্রে মঞ্চের খরচটা কমে এসেছে। কিন্তু আমি যদি খুব কম খরচে মঞ্চে করতে পারি, তাহলে? বিপরীতে, আমি অঙ্গনেও এমন একটা নাটক তৈরি করলাম যেটা করতে প্রচুর টাকা লাগে, প্রচুর মেকানিজম লাগে, টেকনোলজি লাগে, সেটা থার্ড থিয়েটার বা স্বাধীন পরিসর থাকবে কি? আমার মনে হয়, এটা চিহ্নিত করা মুশকিল, কথা বলতে বলতে হয়তো এটা স্পষ্ট হবে। আমার মনে হচ্ছে, হয়তো চিন্তার ক্ষেত্রে এটা অনেক সত্যি, সেটা যে ফর্মেই হোক, আমি কোন জায়গা থেকে কাজটা করছি। যে ছেলেমেয়েরা আমাদের দেশে থিয়েটার করতে আসে, সেই করতে চাওয়াটাই একটা স্বাধীন কর্মকাণ্ডের সূচনা করে।
বাপী : আমার থেকে ছোটো আমার এক বন্ধু, সে এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার নিয়ে পড়াশুনা করে। আমরা একসঙ্গে হালিশহরে তীর্থদার (তীর্থঙ্কর চন্দ) বাড়িতে একটা কাজ করি, মাসে দুদিন থিয়েটার নিয়ে চর্চা করি। ঠিক হল, আমরা ভারতীয় নাটকের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করব। কোথা থেকে শুরু করব? সেই বন্ধু বলল, লেবেডফ থেকে শুরু হোক। আমার মনে হল, ওর যে শিক্ষার জগত, সেটা ওকে এভাবে শিখিয়েছে। আমার মনে প্রশ্ন এল, লেবেডফের আগে অর্থাৎ দুশো বছর আগেকার যে ইতিহাস তার এক্ষেত্রে কোনো মূল্য নেই? অথচ আমরা এটাও জানি যে পৃথিবীর নাট্য ইতিহাসে সবচেয়ে পুরোনো যে নথিটা পাওয়া গেছে, সেটা ভারতীয় এবং তা দু-হাজার বছরেরও বেশি আগের। তার কিছু নিদর্শনও পাওয়া গেছে, মঞ্চ ধারণা, মঞ্চ পরিকল্পনা ইত্যাদি। তাহলে হাজার হাজার বছর ধরে নাট্যশাস্ত্রের চর্চা আছে। এটা ক্লাসিকাল থিয়েটারের সময়কাল। তাহলে আমরা এটাও কি ধরে নিতে পারি না যে তারও আগে সাধারণ মানুষের থিয়েটার ছিল, ফোক থিয়েটার। অথচ প্রতিষ্ঠিত মত, ব্রিটিশ পিরিয়ডকেই মান্যতা দিচ্ছে।
এই তর্কগুলো আছে আমাদের মধ্যে, যারা থিয়েটার নিয়ে পড়াশুনা করছি। এর বাইরে আরও বৃহত্তর জগতে এমন মানুষজন আছে, যাদের এইসব নিয়ে কিছু আসে যায় না। তারা দিব্যি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজ করছে, যেমন আজই লেটোর কথা আলোচনা হচ্ছিল, হরবাবুর কথা। সেটা তো অন্ততপক্ষে সাত-আটশো বছর ধরে চলছে। তারা হয়তো শিক্ষা, আধুনিকতা ইত্যাদির দ্বারা আলোকিত হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু সেটা চলেছে। সেই ফোক থিয়েটারে মানুষের জীবনযন্ত্রণার চিত্র উঠে এসেছে। জীবনের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে এই থিয়েটার।
বাদল সরকার থার্ড থিয়েটারের কথা বললেন বলেই তার জন্ম হল, এমনটা বোধহয় নয়। কেউ না কেউ নিশ্চয় ভেবেছেন যে কীভাবে দুটোকে মিলিয়ে দেওয়া যায়। মানে, আমরা যে আটপৌরে ভাষায় কথা বলি, সেভাবে সব মানুষের জন্য থিয়েটার হবে, অথচ আধুনিকভাবেই হবে। অনেক আগে থেকেই যে এই চর্চা চলছে তার কিছু চিহ্ন আমরা দেখতে পাই। চৈতন্য, লালনের মধ্যে দেখেছি।
এরকম একটা স্পেস বা পরিসর আছে বলেই আমাদের মনে হয়। আমরা নিজেরা তো সেভাবেই করার চেষ্টা করি। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, যারা প্রসেনিয়ামে করছে, তারাও স্বাধীন পরিসরে আছে বলে মনে হয়। যেমন, আজ চৌদ্দ বছর ধরে ‘শিশু কিশোর বিকাশ মেলা’র একটা নিয়মিত চর্চা চলছে। বছরে সাতদিন, হয়তো তা সামান্য সময়, কিন্তু সেই সাতদিন একশো-দেড়শো মানুষ বাচ্চা সহ থিয়েটার প্রস্তুতির একটা চর্চার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে স্বাধীন বা প্রতিষ্ঠিত থিয়েটারের ভাগাভাগি নেই, সব ধরনের থিয়েটারের লোক আছে, থিয়েটারের বাইরের লোকও আছে। কিন্তু এখানকার চর্চাটা কিন্তু একটা স্বাধীন চর্চা। সেখানে সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত কী কী কাজ সকলে করবে, তা ওই দেড়শোজন মানুষই ঠিক করে। একজন পাঁচ বছরের বাচ্চার স্বর আর একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির স্বরের কোনো ফারাক করা হচ্ছে না। বাইরে থেকে কোনো চাপ বা প্রভাব এই সাতদিনে খাটানো হচ্ছে না।
এই যে বাইরের চাপ, সামাজিক চাপ বা রাষ্ট্রের চাপ … আমার মনে হয় রাষ্ট্র থিয়েটারকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। আর আমরা যারা থিয়েটার করি, তারা কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে একটা স্পেস পাওয়ার জায়গায় নিজেদের নিয়ে আসি। সে সুযোগও প্রচুর পরিমাণে আসে। যেমন, কলকাতায় যদি কোনো দল থিয়েটার করতে চায়, তাহলে তার সামনে কতকগুলো বাধা উপস্থিত হবে। কলকাতায় থিয়েটার করার মঞ্চ সীমিত, দশ-বারোটা হবে। এই হলগুলো মোটামুটি একই ধরনের। এখন একটা নাটকের দল প্রথমেই স্থির করল যে আমি এই দশটা হলের বাইরে প্রধানত থিয়েটারটা করব। কলকাতার বাইরে নির্দিষ্ট কিছু হলে সে থিয়েটার করতে পারবে। তাহলে থিয়েটার করার জন্য তার পরিসরটা নির্দিষ্ট হয়ে গেল, এর বাইরে তার থিয়েটারটা নেই। এটা একটা দিক। দু-নম্বর হচ্ছে, থিয়েটার করার কতকগুলো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে, সেগুলো ব্রিটিশরাই আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে। ফলে তাদের জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে যে প্যাটার্ন উঠে এসেছে, আমাদের থিয়েটার সেরকমই রয়ে গেল। আমাদের ক্লাসিকাল থিয়েটার কিন্তু ভারতীয় মাটি, ভারতীয় জলবায়ু, ভারতীয় ভূগোল ইত্যাদির সঙ্গে অনেকখানি সম্পৃক্ত। আমাদের গ্রামে যখন রামগান হয়, যে উঠোনটায় হবে তার মাঝখানে হয়তো কেউ গানটা গাইছে, চারপাশ দিয়ে লোকে বসে পড়ল। সেই থিয়েটারে দর্শকের সঙ্গে অভিনেতার সম্পর্কটা ওইভাবেই গড়ে উঠেছে। প্রসেনিয়ামে তো তা হয় না, সেখানে অন্য প্যাটার্ন। আমরা যারা মূল ধারার থিয়েটার করি, তারা ওটাকে মেনে নিই। ফলে সেখানে আমার স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব হয়। আমি যে থিয়েটার করলাম, সেটা বেশ উপভোগ্যই হল, কিন্তু স্বাধীন থিয়েটার হল কিনা, সেটা একটা বড়ো প্রশ্নই রয়ে গেল।
এখন এর বাইরে অনেক কাজ হচ্ছে। কলকাতাতেই অনেকে প্রসেনিয়ামে করেও নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, শুধু ওই দশটা হলের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রাখছে না। তারা ঠিকই করছে যে আমরা আরও বড়ো জায়গায় যাব। ফলে তাদের থিয়েটারের ব্যাকরণ-প্রকরণ প্রথম থেকেই বদলাতে হচ্ছে। যেমন, শান্তিপুর সাংস্কৃতিক-ই এধরনের থিয়েটার করেছে। ওদের ‘পরী’ নাটকটা যে কোনো জায়গায় করা সম্ভব। উদাহরণ আরও দেওয়া যায়।
শান্তিপুরের স্কুলগুলো নিয়ে এখানকার বিভিন্ন দল একত্রিত হয়ে একটা কাজ করে। সেখানেও এইসব বাধ্যবাধকতার শর্তগুলোর বাইরে গিয়েই কাজটা হচ্ছে। ফলে স্বাধীন পরিসর নানাভাবে তৈরি হচ্ছে। এটা শুধু আজকেই হচ্ছে এমনটা নয়, অনেক আগে থেকেই হয়েছে।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : আসলে স্বাধীন পরিসর কথাটার প্রাসঙ্গিকতা তখনই আসে, যখন সেখানে একটা ‘হয়ে ওঠা’র জায়গা থাকে। স্বাধীন আমাকে হয়ে উঠতে হবে কেন? কারণ আমার বাতাবরণে কোথাও পরাধীনতা আছে। প্রকৃতি তো মানুষকে পরাধীন করে রাখেনি। সে তো বলেনি যে তোমার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন আছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ জল আছে … সেই প্রকৃতিরই একটা অংশ মানুষ। সেই মানুষই প্রকৃতির দেওয়া স্বাধীনতাকে একটা খাঁচায় বন্দি করেছে। সেই গুহামানব থেকে যাত্রা করে আমরা প্রকৃতি থেকে নিজেদের আলাদা করে নিয়ে তাকে বাঁটোয়ারা করতে শুরু করেছি। ভাগ করতে গিয়ে, লুঠ করতে গিয়ে আমি লুঠের স্বার্থে নানান স্ট্রাকচার তৈরি করতে শুরু করেছি। সেই স্ট্রাকচার দিয়ে আমি বাঁধি বিভিন্ন ধরনের মানুষকে, তাদের নানান সক্রিয়তাকে। যত মানুষ প্রকৃতির কাছাকাছি যায়, ততই এই বন্ধনটা কম জোরালো হতে থাকে।
বাপী লেবেডফের থিয়েটারের কথা বলল, ভরতের নাট্যশাস্ত্রের কথা বলল, প্রসঙ্গত নাট্য শব্দটা সংস্কৃত শব্দ নয়, উৎপত্তির দিক থেকে এটা একটা ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষার অন্তর্গত। ফলে যেখান থেকে নাট্যশাস্ত্র আসছে, লোকনাটক থেকে, সেই চর্যা আরও কত হাজার বছরের পুরোনো। ফলে মানুষ যেখানে প্রকৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করল, একটা অংশের মানুষ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠল এবং সে প্রকৃতিকে অনেকগুলো সিস্টেম দিয়ে বাঁধল, মানুষকেও বাঁধল, আহত ক্ষতবিক্ষত করল … যে জাহাজটার ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের এতকিছু কর্মকাণ্ড, সেই জাহাজটা ভয়ঙ্করভাবে ফুটো হয়ে গেছে … আমার মূল প্রশ্ন ওই জায়গাটায়, যে পরাধীনতার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তার বাইরে যে স্বাধীনতা আমরা চাইছি, সেটা নাটকের ক্ষেত্রে আর পাঁচটা বিষয় থেকে একদমই আলাদা নয়। তিনটে দিক দেখা যেতে পারে। এক, শাসকের বা ব্যবস্থার তৈরি করে দেওয়া একটা চাপ। দুই, আমরা যারা নাটক করি, নাটক প্রকাশের একটা মাধ্যম, কীভাবে আমরা প্রকাশ করব, তার একটা বাধ্যবাধকতা আছে। তিন, আর একটা চাপ বা বাধ্যবাধকতা আছে, সেটা হল, এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে হাজার হাজার নাট্যদল কাজ করছে, তারা সবাই ওই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার স্বাদ পাচ্ছে না। কতিপয় দল পাচ্ছে, হিসেব করলে হয়তো ৫% হবে না। বাকি ৯৫% যারা নাটক করছে, তাদের মধ্যে একটা পরাধীনতার জায়গা আছে। ধরা যাক, শান্তিপুর বা কাঁচরাপাড়ায় একটা দল নাটক করছে, সেখানে যে মানুষেরা এসে যুক্ত হচ্ছে, নাটক কিন্তু আর যুথবদ্ধ শিল্প থাকছে না। নাটক হয়ে উঠছে একটা পেইন্টিংয়ের মতো। একজন পেইন্টার যেমন তার ছবির মধ্যে নিজের কাছে জীবন কেমন প্রতিভাত হচ্ছে তা প্রকাশ করছে, এই নাটকেও প্রায় খানিকটা তাই হচ্ছে। একজন বা দুজন মানুষ, তার মেধা বা জ্ঞানের প্রকাশ ঘটাচ্ছে, সে আলোকপ্রাপ্ত হিসেবে এবং এগিয়ে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই নাটকের মধ্য দিয়ে তার কথাটা বলছে। সে-ই দল বানিয়েছে। যাদের সে জুটিয়েছে, যারা এসে জুটেছে, তাদের দলবদ্ধ প্রকাশটা আর নাটকে হয়ে উঠছে না। সেই মানুষগুলো ওই মেধা বা জ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তা হতেই হবে। এই প্রভাবিত হওয়ার কারণে মেধা মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে। মেধা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে যোগাযোগ তৈরি করছে, সেটা দল বুঝতে পারছে না। দল বৌদ্ধিকভাবে সেই মেধার ওপর নির্ভরশীল। এটা আরেকটা পরাধীনতার জায়গা। এই তিন পরাধীনতার বাইরে বেরিয়ে আসা — আপনি প্রশ্ন করতে পারেন লোকনাট্যে কি এটা নেই, নাচে কি এটা নেই? কিন্তু একটা উচ্চাঙ্গের নাচ আর একটা নাটক, এই দুইয়ের উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা বড়ো পার্থক্য আছে। যেখান থেকে পেইন্টিং বা কবিতার মতো ব্যক্তিগত শিল্প অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মানুষ থেকে।
আমার মনে হয়, ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার দিকে ধাবিত, দুইয়ে মিলে একটাই পরিসর। এর বাইরে রয়েছে স্বাধীন পরিসর। আজকে যে ছেলেরা আমাদের সঙ্গে নাটক করতে আসছে, তাদের সঙ্গে আমাদের তফাত হল, আমরা পড়াশুনার বাইরে অনেকরকম কাণ্ডের মধ্যে ছিলাম, শুধু নাটক করিনি আমরা। আমার নিজের আজ মনে হয়, আমি আমার অর্জিত জ্ঞানের অনেকটাই পেয়েছি পড়াশুনার বাইরে এই বিচিত্র কর্মকাণ্ডের মধ্য থেকে। আজকের সময়ে এই বিচিত্র কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতির ফলে নাটকের একটা বিশেষ খাঁচা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নাটকের ভিতরের এ এক অচলায়তন। যে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নাটক করতে আসছে, তার মধ্যে বাপীদের ‘দৃশ্যান্তর’-এর ছেলেরা অনেক আলোকপ্রাপ্ত, কিন্তু আমাদের মফস্সলের হাজার হাজার গ্রুপে যে ছেলেমেয়েরা আসছে, আমাদের ব্যবস্থার কারণে তাদের পরিসর এতটাই সংকীর্ণ যে তারা আর সক্রিয় কাজে আনন্দ পাচ্ছে না। সেটা হয়তো আমাদের ব্যর্থতা। ফলে প্রতিটা নাটকের দলে একটা বোধের অভাব দেখা যাচ্ছে, নাট্যকর্মীরা একজন বা দুজনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকছে। নাটক যেহেতু একটা যুথবদ্ধ শিল্প, দলটা গুরুত্বপূর্ণ, একটা দল হিসেবে তা স্বাধীন হয়ে উঠতে পারছে না।
জিতেন নন্দী : পরাধীনতা আমাদের গ্রাস করছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে স্বাধীনতার ইঙ্গিতগুলো আমরা বুঝতে চাইছি। সর্বক্ষেত্রেই স্বাধীন পরিসরের গড়ে ওঠা অভিনব এবং তা সৃষ্টিশীল। আমার উপলব্ধিতে আমি ক্ষমতার বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসছি — থিয়েটারের ক্ষেত্রে এই বেরিয়ে আসার ইঙ্গিতগুলো কী?
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : আমি একটু যোগ করি। এই চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার বাইরে প্রচুর দল কাজ করছে।
নীলিমা বিশ্বাস : নেপালের ভূমিকম্প যখন আমাকে বিচলিত করছে, তখন ভোটের হিংসা আমাকে দেখতে হচ্ছে, হজম করতে হচ্ছে দিনরাত। আন্তর্জাতিক, দেশীয় বা রাজ্যস্তরে একটা চাপ রয়েছে আমাদের মনের ওপর। আমি চাই আমাদের আগামী প্রজন্ম একটা যৌথ কাজে ব্রতী হোক, কিন্তু তার কানের কাছে মাইকে বাজছে, ‘পরাণ জ্বলিয়া যায়’! চাপটা এইরকম। তার বাইরে বেরোনোর স্বপ্ন আমরা দেখি। যখন অনেক ছেলে বা মেয়ে কলেজে অ্যাডমিশন পায় না টাকার অভাবে, কিংবা কোনো রাজনৈতিক দাদাকে ধরতে পারে না বলে, তখন একটা যন্ত্রণা হয়। কিন্তু সেটা নাটকে প্রকাশ করতে পারি না। এটা আমাদের ব্যর্থতা। তাও কেন থিয়েটার করি? বেরিয়ে আসাটা কোথায়?
আমাদের সময়ে আমরা সব কিছুতে থাকতাম। আজ সহজে কেউ আসতে চায় না, এখন কিন্তু অনেককেই পাওয়া যায় না। তবে আশার কথা, প্রত্যেক বছর স্কুলের কয়েকশো ছেলেমেয়েকে নিয়ে শান্তিপুরে আমরা অনেকগুলো নাটকের দল যে কাজ করছি, সেটাও একটা বেরিয়ে আসা। এমন ঘটনাও ঘটেছে, প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে নাটক করেছি, সেই স্কুলের শিশুরা আমাদের অনুপস্থিতিতে নাটক করে দেখাচ্ছে, সেই নাটক শিক্ষকেরা দেখছেন, আবেগ-আপ্লুত হচ্ছেন, কাঁদছেন।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : আসলে থিয়েটারটাই একটা স্বাধীন পরিসর। একটা সময় থিয়েটারে মেয়েরা আসত না, ছেলেরাও আসত না, এখন আসছে, তার অনেক ভালো ও মন্দ দুই আছে। কিন্তু যখন তারা আসত না, লোকে অবজ্ঞা করত, নাটক করে! ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়! তখন একটা কথা চালু ছিল, আমরা যারা কিছুই পারি না, তারা থিয়েটার করতে আসি। সেই ব্যাপারটা আজও আছে। ক্লাসের ভালো ছেলেমেয়েরা থিয়েটারে আসে না, লাস্ট বেঞ্চের ছেলেমেয়েরাই আসে। যতটা জানি, থিয়েটারের দলগুলো সেই চেষ্টাই করে যাতে পিছনের সারির ছেলেমেয়েরা দুটো কথা বলতে পারে। আর সত্যিই তারাই ভালো পারে। সেদিক থেকে তো থিয়েটারটাই তৃতীয় সারি।
জিতেন নন্দী : যারা ক্ষমতাহীন, যারা কোনো দিক থেকেই ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, তারা এখানে আসছে, একত্রিত হচ্ছে। এটাই তো আপনি বলছেন। কিন্তু জয়ন্ত বলছেন, যখন নেতৃত্বের প্রশ্নটা আসছে, তখন একটা হায়ারার্কি (ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাজন) তৈরি হচ্ছে; তখন একটা দক্ষতা তৈরি হচ্ছে, একটা ক্ষমতার জন্ম হচ্ছে। বিপরীত দিক থেকে প্রশ্ন উঠবে, তাহলে কি থিয়েটারে নেতৃত্বের কোনো প্রয়োজন নেই, পরিচালনার কোনো দরকার নেই? এই বিরোধের মীমাংসা কোথায়?
গুরুপ্রসাদ বিশ্বাস : থিয়েটার তো নিজেই একটা স্বাধীন কর্মকাণ্ড বুঝলাম। কিন্তু থিয়েটারের মধ্যে স্বাধীন অবস্থানের বিষয়টা কীভাবে আসছে? ‘সাংস্কৃতিক’-এ আমি প্রথমদিকে ছিলাম না, পরে এসে শুনেছি, আগে থিয়েটার করতে যাব, শুধু চা খেতে দিলেই সন্তুষ্ট; নাটক করতে যাবে, চারটে ব্যাটারি দিলেই নাটকটা হয়ে যাবে। আর কিছু চাই না। এখান থেকে আস্তে আস্তে শুরু হয় কম্পিটিশন, প্রাইজ, ম্যাটাডর। এখন যারা কম্পিটিশনে আসে, তাদের প্রোডাকশন কস্ট দিতে হবে। এখান থেকে নিজেদের পিঠ চাপড়ে চাপড়ে আমরা এতদূরে এসেছি। মফস্সল থেকে কলকাতা, ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাটেগরি বাড়তে থাকে। চাপটা আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। আবার কোথাও সুবোধদা উড়িষ্যায় গ্রামের লোকেদের নিয়ে নাট্যচর্চা করছেন। সেটাও কিন্তু হচ্ছে।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : আমার একটা জিনিস জানার আছে, সুবোধ পট্টনায়েক উড়িষ্যায় গ্রামের মধ্যে যে চর্চাটা করছেন, সেটাকে তুই কোন ক্যাটেগরির মধ্যে ফেলছিস? শহর থেকে অনেকটা দূরে একটা নাট্যগ্রাম তৈরি করে সেখানকার আদিবাসী মানুষের মধ্যে কাজ হচ্ছে। অনেকগুলো বিষয় আছে ওখানে। কেউ নেশা করে না, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চায় ওরা, নাটক বানিয়ে সাইকেলে করে দল বেরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিনয় করে। এরকম একটা জায়গা থেকে শুরু হয়েছিল, আমি নিজে ওখানে যাইনি।
গুরুপ্রসাদ বিশ্বাস : ওই প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও ক্যাটেগরিগুলো আছে। যখন বিশজন ছেলেমেয়ে সাইকেল নিয়ে গ্রামে গ্রামে থিয়েটার করতে যাচ্ছে, চাল-ডাল সংগ্রহ করছে, গ্রামের মানুষেরা যা খেতে দিচ্ছে খাচ্ছে, গাছতলায় বা ক্লাবঘরে শুচ্ছে, একটা স্বাধীন পরিসর। তারাই আবার যখন অন্যত্র যাচ্ছে …
নীলিমা বিশ্বাস : সুবোধদার কাজটা আমি একটু জানি। সুবোধদা যখন প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যাচ্ছেন সাইকেল-থিয়েটার নিয়ে, তখন একরকম। কিন্তু যখন সেই নাটকের প্রস্তুতি চলছে, বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিজেদের কাজ ফেলে ওই নাট্যগ্রামে এসে সমবেত হচ্ছে নাটক তৈরির জন্য, সেই কুড়ি-পঁচিশজন মানুষের থাকা-খাওয়া আর সমস্ত পরিকাঠামো চালাতে হয় একমাস ধরে। সেই খরচটা কিন্তু ওই স্বাধীন পরিসর থেকে উঠে আসে না। ওটার জন্য তাঁকে একবছর আগে থেকে পরিকল্পনা করে দেশ হোক বিদেশ হোক আবেদন করে অর্থসংগ্রহ করতে হয়।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : এটাকেও একটু বোঝা দরকার। কিছুদিন আগে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন সুবোধ পট্টনায়েক। এই অবস্থানে তিনি পাঁচ-ছয় বছর আগে ছিলেন না, আবার এখনও নেই। এখানেও ওঁর যাত্রাটা দেখা দরকার।
শান্তিপুরে প্রথম যে নাটকটা আমাদের মানুষের কাছে বেশি করে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা ছিল ‘সি’ নামে একটা নাটক। ওই নাটকের শোয়ের জন্য আমাদের কোনো চাহিদা ছিল না। আমাদের কাছে তখন একমাত্র বিষয় ছিল মানুষের কাছে নাটকটা নিয়ে যাওয়া। আমি সুবোধদার নাট্য-সফরকেও একইভাবে দেখছি। এই যে স্বাধীন পরিসর বারবার তৈরি হচ্ছে —
গুরুপ্রসাদ বিশ্বাস : এবং ভাঙতে ভাঙতে চলেছে —
জিতেন নন্দী : তা চলুক, কিন্তু সেটা একটা আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠছে কিনা, নতুন উদ্যোগের জন্ম দিচ্ছে কিনা, সেখানে আমরা কী দেখছি? স্বাধীন থিয়েটার আন্দোলন বলে কিছু আছে কি?
রাত্রি চট্টোপাধ্যায় : এতক্ষণ কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয়, এখনকার যে পরিবেশ-পরিস্থিতি, সেখানে একা-মানুষ নিজে পরাধীন। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমরা থিয়েটার নামে একটা বস্তু নিয়ে আছি। আমার ঘর থেকে বেরোলেই প্রতিবেশীর কাছ থেকে যে প্রশ্ন প্রথম আসে, ‘রান্না হয়ে গেছে?’। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘শ্বাশুড়িকে খেতে দিয়েছ?’ এরপর শেষে আসে, ‘তুমি নাটক করো?’ এটা আমার পরাধীনতা। আমাকে সারাদিনে অনেকবার বোঝাতে হয়, আমি রান্না করি, থিয়েটারও করি। প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের নিজের পরিসরে চূড়ান্ত রকম পরাধীন, চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
এই অবস্থায় যার যেরকম পরিস্থিতি সে যেভাবে পারে থিয়েটার করবে। আমি তাকে লাইন বেঁধে দিতে পারি না যে তুমি এইভাবে থিয়েটার করো। আমি যেমনভাবে আমাকে প্রকাশ করতে পারছি, তেমনভাবেই করব। কারো একটা নাটক পছন্দ হল, সে যদি মনে করে যে এই নাটকটা করতে আমার পাঁচ হাজার টাকা খরচ হবে, সেই টাকা সে যেমনভাবে পারবে জোগাড় করে থিয়েটারটা করবে। কারো মনে হল, আমার পাঁচ পয়সা খরচ নেই, সে সেইভাবেই করবে। নান্দীকারের এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে, ‘শান্তিপুর সাংস্কৃতিক’ বা ‘রঙ্গপীঠ’-এর পাঁচ পয়সা খরচ হয়েছে, এটা বেঁধে দেওয়ার জায়গায় আমি নেই। যে নাটকটা আমি নির্বাচন করেছি, নাটকটাই বলে দেবে এটা কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে তৈরি হবে। ফর্ম বা যা কিছু সমস্ত ওইটার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে।
আমি বাদল সরকারের ‘মিছিল’ নাটকটা দেখতে গিয়েছিলাম, আমার একটুও ভালো লাগেনি। এই কথাটা আমি কেন বলতে পারব না? উনি বাদল সরকার বলে? এইটা আমার পরাধীনতা। ‘চাঁদবণিকের পালা’ পড়ার পরে আমার যে ধরনের আবেগ এসেছিল, পথসেনা-র থিয়েটার দেখে আমার চূড়ান্ত খারাপ লেগেছে। ওদের রক্তকরবী দেখে যখন সবাই এক জায়গায় বসল কথা বলতে, সবার প্রশ্ন শোনার পর শেষে অনেকগুলো উত্তর না দেওয়ার পর বাদল সরকার প্রচণ্ড অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা কি বোঝা গেছে?’ আমার তো ভালো লাগেনি, যার লেগেছে তার লেগেছে।
আমার ছেলেকে একটু অন্যভাবে মানুষ করব বলে তন্তুবায় স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। স্কুলটা পশ্চাদপদ বলে পরিচিত। শান্তিপুরের নিম্ন মধ্যবিত্তের চেয়েও নিচের পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়াশুনা করতে আসে। এখন মুসলিম পরিবার থেকেও যায়। সব মিলিয়ে স্কুলের পরিবেশ ভালো। সেখানে যখন থিয়েটার করতে গেলাম, একজন মুসলিম মেয়ে এল, নাটক করতে তার ভয়, কিন্তু একবছর পর সে সুন্দর করে সেজে মঞ্চে পাঁচশো লোকের সামনে দাঁড়াল। এটা আমি মনে করি থিয়েটারের জয়। মেয়েটা দেখতে যেমনই হোক, ওর কথাটা স্টেজে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছে। থিয়েটার তাকে স্বাধীনভাবে কথা বলার একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।
আমাদের সঞ্জীবদা আছেন ঝাড়গ্রামে। ওখানে স্বল্প আয়াসে অদ্ভুত একটা নাটক দেখলাম। প্লাস্টিকের মধ্যে কাগজ কেটে চোখ মুখ নাক তৈরি করে দিয়েছেন আর বলের মধ্যে একটা পাপেট তৈরি করেছেন। গল্প আর গান দিয়ে একটা নাটক তৈরি করেছেন যে প্লাস্টিকের জন্য আমাদের সমুদ্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের দিয়ে একটা সুন্দর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। আমার দারুণ লেগেছে। শান্তিপুরে এসে তন্তুবায় স্কুলে পঁচিশটা ছেলেমেয়েকে নিয়ে করলাম। যেই ওরা বসল, প্রত্যেকে বল জোগাড় করে প্লাস্টিকের মধ্যে চোখ মুখ নাক লাগিয়ে পাপেটটা বানাল। তারপর একটা সম্পূর্ণ নাটক তৈরি করল এই ছেলেমেয়েরা। সেটা পাবলিক লাইব্রেরি হলে দেখানো হল। জানি না দেখে কার কী হল। কিন্তু কোনো একটা বাচ্চার যদি ওটা করার পর মনে হয়, সত্যিই তো সমুদ্র খারাপ হয়ে যাচ্ছে প্লাস্টিকের জন্য, ছোটো অর্থে ব্যাপারটা দারুণ বলেই আমার মনে হয়।
নীলিমা, আমি যখন থিয়েটারে এলাম, আমাদের সময়ে মোবাইল ছিল না। আমাদের জীবনে অবসর কাটানোর আর কোনো বিকল্প ছিল না। যেহেতু ওই পথটা দিয়ে আমি হেঁটে এসেছি, তাই হয়তো মোবাইল আমাকে নিতে পারেনি। গড় থেকে হেঁটে এসে, প্রায় চার কিলোমিটার হবে, কলেজ করেছি, বাড়ি গেছি, আবার থিয়েটার করতে এসেছি। অন্তত দশ-বারো কিলোমিটার রোজ হেঁটেছি। মনে আছে, সকালবেলা বাচ্চাদের থিয়েটার হত রবিবারে, আমি আর নীলিমা চলে আসতাম, আজকে ঘরটাকে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সকাল দশটায় এসেছি, দুপুর তিনটেয় অর্ধেক কাপড় ভেজা, সেই অবস্থায় গড়ে গেলাম, স্নান-টান করে খেয়েদেয়ে আবার সন্ধেবেলায় থিয়েটার করতে চলে এসেছি। এইরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি। আজকের ছেলেমেয়েরা এটা করার মধ্যে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার জন্য আমি তাদের দায়ী করতে পারি না। আজকের ছেলেমেয়েরা খালি সরে সরে যায়। আমার ছেলেকেও দেখি, মনঃসংযোগ করতে পারে না। অন্য জগৎ ওকে সারাক্ষণ টানে, যে কারণে ও পাগলের মতো করে। এই অবস্থার মধ্যে একজন মানুষ প্রতিনিয়ত পরাধীন। তার মধ্যে আমি থিয়েটার করছি, আমি মনে করি সেটাই আমার স্বাধীনতা।
আমার বিশ্বাস মেধার যে প্রসঙ্গটা উঠেছে, এটার গুরুত্ব কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না। কোনো একজন মানুষ একটা বিষয়ে সবসময় একটু বেশি চিন্তা করে, একটু বেশি পড়াশুনা করে। আমি যা দেব, আমি তাই পাব। আমাদের যে ছেলেরা থিয়েটার করতে আসে, এখানে তো এত বই আছে, লাইব্রেরি আছে, ক-জন সেসব পড়ে? তারা মনে করে, থিয়েটার মানে তো মঞ্চে উঠে ডায়ালগ বলা, পড়ে কী হবে। সোহিনী সেনগুপ্ত, রুদ্রবাবু, গৌতম হালদার প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ হারমোনিয়াম ধরে বাজিয়েই যাচ্ছেন চারঘণ্টা ধরে। গলা সেধেই যাচ্ছেন ওঁরা। আমি সেটা করলাম না আর ওঁদের অবজ্ঞা করব, সেটা কীরকম? তুমি তো চেষ্টাই করোনি।
এখন ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, একদম ছোটো পরিসরে ছোটো ছোটো কাজ, এটা করতে পারি। বড়ো একটা পরিসরে আমি এই পৃথিবীটাকে বদলে দিতে পারব না। বৃক্ষরোপণ উৎসব করে যা হবে, দুটো ছোটো গাছ নিজের হাতে লাগানো তার চেয়ে ভালো।
জিতেন নন্দী : ব্যক্তিগতভাবে এইসব ছোটো ছোটো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তো আমার মেধাচর্চা ব্যাহত হবে? আসলে থিয়েটার হোক বা অন্য শিল্পচর্চা হোক, আমি যখন করতে করতে একটা সাফল্য পাই, আমার একটা দক্ষতা জন্মায় সেই বিষয়ে। দক্ষতার ওপর দাঁড়িয়ে আমি আরও বড়ো হয়ে উঠি, একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠি …
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : তাতে খারাপটা কী? রাত্রি যেটা বলতে চাইছে, আমার ব্যক্তিগত জীবনযাপনে আমি যেটুকু কাজ করতে পারি। সবাই বলছে, পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আমার ক্ষমতা ছিল একটা গাছের চারা জোগাড় করা, সেটা লাগানো এবং সারা বছর তাতে জল দেওয়া। আমি পঞ্চাশটা পারছি না, একটাই পারব।
জিতেন নন্দী : ব্যক্তিগতভাবে ‘শিশু কিশোর বিকাশ মেলা’ বা শান্তিপুরের স্কুলের কাজ করতে গেলে তো সোহিনী সেনগুপ্তের মতো চারঘণ্টা রেওয়াজ করা হয়ে উঠবে না।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : আমি তো একাই দশটা স্কুলে কাজ করব না। আমি একটা স্কুলে শনিবার দু-ঘণ্টা কাজ করছি। আমার সারা সপ্তাহ সময় রয়েছে। চারঘণ্টা না পারলেও পনেরো মিনিট তো গলা সাধতে পারতাম।
বাপী : এটাও তো সত্যি যে চারঘণ্টা রেওয়াজ তো অনেকেই করে। কিন্তু সবাই তো গৌতম হালদার হতে পারবে না।
রাত্রি চট্টোপাধ্যায় : আমার কি তবে কষ্ট থেকে যাচ্ছে, গৌতম হালদার হইনি বলে?
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : বাপী বলছে, চারঘণ্টা শ্রম দিলেই হবে, এর কোনো গ্যারান্টি নেই। আরও অনেকগুলো ফ্যাক্টর রয়েছে। সেইসময় নান্দীকারের মতো গ্রুপ থাকা দরকার। গৌতমদার মতো চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসার সাহস থাকা দরকার।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : নান্দীকারে বহু মানুষ থিয়েটার করে, আমরা কিন্তু সামনে দেখি গৌতম হালদারকে। তিনি প্রতিভাবান এনিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম কথা হচ্ছে, যিনি মেধা অর্জন করেছেন, তিনি সভ্যতাকে কোনোভাবে ক্ষতি করেননি। তিনি একটা জ্ঞানের ভাণ্ডার সমাজের জন্য রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু এটাই একমাত্র মেধা নয়। এইটাই মেধা, এটা দিয়েই পৃথিবীটা চলবে তা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কারগুলো বই পড়ে হয়নি। আগুন বা চাকার আবিষ্কার বই পড়ে হয়নি।
প্রতিনিয়ত কি নাটকের দলে আমরা অনুভব করি না যে আমাদের ছেলেরা কেন আরও উন্নত হয়ে উঠছে না? কেন আমার ওপর এত চাপ পড়ছে, কেন আমাকেই সব ভাবতে হচ্ছে? এটা আমরা সকলেই অনুভব করি। পারা আর না-পারা কে ঠিক করবে? যে কৃষকেরা বিরাশি হাজার ধানের প্রজাতি তৈরি করেছিল, তাদের কি মেধা ছিল না? আমরা কি মেধাকে একটু ছোটো অর্থে দেখছি? আমাদের আলোচনাটা মেধা-যুক্ত আর মেধাহীন মানুষ নিয়ে নয়। আমাদের আলোচনা একটা স্বাধীন পরিসরের। সেই পরিসরে এই মেধা-অর্জন একটা বাধা হিসেবে এসেছে কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন।
রাত্রি তো জানে যে এই ডিজিটাল যুগে জন্মেও মোবাইল ফোনের একটা ভালো ব্যবহার হতে পারে। ওর ছেলে উজানই তো চেষ্টা করছে।
আবু সোলেইমান দারানি : আমরা যে থিয়েটার করি, আমি এইরকম দলকে দেখেছি, যারা মনে করছে যে এই তিনটে পয়েন্ট থাকলেই আমি থার্ড থিয়েটার হয়ে যাব।
জিতেন নন্দী : স্বাধীনতার এরকম কোনো সংজ্ঞা নেই যে সেগুলো পূরণ করলেই আমি স্বাধীন আর তা না করলে আমি পরাধীন।
আবু সোলেইমান দারানি : আর একটা কথা হল, দু-একজন দলকে পরিচালনা করছে মানেই নয় যে তারা ওপর থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। একটা উদাহরণ দিই, ‘বাঘারে’ বলে একটা নাটক করে ‘চেনা আধুলি’ গ্রুপটা। সুন্দরবনে গ্রাম পরিক্রমায় গিয়ে আমি নাটকটা দেখছিলাম। অন্যত্র যেভাবে হয় সেভাবে না করে একজন অভিনেতা শঙ্খদীপ ওখানে কিছুটা বদল করলেন। তাতে পরিচালকও বাধা দিলেন না। এটা সেই অভিনেতার একটা স্বাধীনতা যা নিয়ন্ত্রিত হল না।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : আবু যেটা বলতে চাইছে, সেটা মনে হয় এরকম। আমার কাছে একটা মোবাইল আছে। আমি তাতে ছবি তুলছি। মোবাইলে আমি অন্য কিছু করতে পারি। আমি মোবাইলে একটা ডকুমেন্টেশন করে ইউটিউবে আপলোড করে পাঠিয়ে দিতে পারি। এটা আমার একটা স্বাধীন কার্যকলাপ। তাহলে মোবাইল ভালো না খারাপ সেটা বিষয় হচ্ছে না। সেটা নিয়ে কী করব, তা আমার পছন্দের ব্যাপার। এবার মোবাইল কেউ ব্যবহার নাও করতে পারে। সেটা আর একটা পছন্দ।
সুধীর চক্রবর্তী যখন ‘ধ্রুবপদ’ বার করলেন, তিনি তার আগে পঞ্চাশজনের একটা তালিকা করে সবাইকে বললেন যে তোমরা আমাকে এক হাজার করে টাকা দাও। সেই টাকা পেয়ে তিনি ‘ধ্রুবপদ’-এর বারোটা সংখ্যা বার করলেন। প্রত্যেকটা সংখ্যা বিক্রি করে টাকাটা উঠে এল। পঞ্চাশজনের টাকাও শোধ হয়ে গেল। তাহলে এই কাজের জন্য তিনি রাষ্ট্রের কাছে গেলেন না, কোনো স্পনসরারের কাছে গেলেন না, বিজ্ঞাপন চাইলেন না। এইভাবে নিজের স্ট্র্যাটেজিটা সাজালেন। কিন্তু এই সংখ্যাগুলোতে যে লেখাগুলো ছাপানো হল, সেগুলো আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এবার আর একজন হয়তো একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একইরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন। আমাদের কোথাও বলা হয় যে ওখান থেকে টাকাটা নিও না। যদি নাও তাহলে তুমি নষ্ট হয়ে গেলে। তুমি প্রসেনিয়ামে কোরো না, অঙ্গনমঞ্চই তোমার একমাত্র পথ। আবু বলতে চাইছে, প্রসেনিয়ামের বদলে অঙ্গনমঞ্চে করলেই সেটা স্বাধীন পরিসর, তা নয়।
রাত্রি চট্টোপাধ্যায় : আর একটা কথাও আবু বলেছে, ‘বাঘারে’র পরিচালনা করেছে বাপী। কিন্তু শঙ্খজিৎ তার অভিনয়ে যে পরিবর্তনটা করল, সেটা ওর স্বাধীন পরিসর। বাপী কিন্তু ওকে বলে দেয়নি যে তুই এভাবেই করবি।
বাপী : কৌশিকদা বলেছেন যে থিয়েটার নিজেই একটা স্বাধীন পরিসর। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, যারা ক্ষমতার পরিসরে থাকে, সে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যেই হোক, তারা থিয়েটারকে বাঁধতে চায়। যার ফলে গণনাট্য ভেঙে যায়। থিয়েটার ক্ষমতার পরিসরে ঢুকে পড়ে।
রাত্রিদি প্লাস্টিক নিয়ে যে নাটকটার কথা বললেন, একই অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে। নৈহাটিতে যারা এটা করে, তারা প্রথম যখন শুরু করল, তখন খুবই সাদামাটা শুরু হল। কয়েকজন বাচ্চা একমুঠো চাল আর একটা আলু নিয়ে এল। ওইটা দিয়ে খাওয়াদাওয়া হবে, সারাদিন রিহার্সাল হবে, একটা প্লাস্টিক আর কিছু কাগজ। সারাদিনের পর সন্ধ্যাবেলায় একটা দারুণ নাটক হল। পরের বছর এটা দেখে অনেকেই উৎসাহিত হল। কয়েকজন ছেলেমেয়ে ছিল, সংখ্যাটা বেড়ে গেল। এলআইসি কিংবা কোনো ব্যাঙ্ক বলল, ঠিক আছে, তোমাদের খাওয়ার খরচটা আমরা দিয়ে দেব। এইভাবে কয়েক বছর চলল। এখন সেখানে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, যার টিকিটের দাম ৩০০ টাকা। এটা একটা যাত্রা। যেমন, সুবোধ পট্টনায়েক একটা স্বাধীন পরিসর থেকেই যাত্রা শুরু করেছিলেন। নিজে একজন স্কলার হয়েও সমস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সরে এসে ফিল্মের হাতছানি থেকে সরে অনেক ছোটো বয়সে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে একটা থিয়েটার-প্রসেস গড়ে তোলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়তেই হয়েছে। আমার সঙ্গে ওঁর ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু আমি জানি যে উনি আর স্বাধীন পরিসরে নেই।
বাদল সরকার যখন থার্ড থিয়েটার করেছিলেন, তখন একটা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেই থিয়েটারের। কিন্তু আমার নিজের অভিজ্ঞতা হল, এই তৃতীয় থিয়েটারের আন্দোলনের মধ্যে কোথাও প্রথম বা দ্বিতীয় পরিসর ঢুকতে শুরু করে দিয়েছে।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : ঢুকতে শুরু করে দিয়েছে যে তুই বলছিস, সেটা কীভাবে হচ্ছে? যেমন, ব্যাঙ্ক টাকা দিল …
বাপী : আরও অনেক ব্যাপার আছে। যেমন, প্রতিষ্ঠা, স্বীকৃতি। যেমন, শতাব্দী, পথসেনা এই দুটো দল থার্ড থিয়েটারের জনক। কিন্তু নন্দীগ্রামের জনবিদ্রোহের পর যখন সেখানে গিয়ে নাটক করার কথা উঠল, শতাব্দী বা পথসেনা সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। তারা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিশ্বাসী। দলের সকলে একমত নয়, অতএব … ২০০৮ সালে গড়ে উঠল ‘দৃশ্যান্তর’, ২০০৯ সালে ‘চেনা আধুলি’। এই নতুন দলগুলো সময়ের চাহিদাকে পূরণ করতে চাইল। বাদল সরকার নিজেও কিন্তু থেমে যাননি। তাঁর বাড়ির ছাদে আমরা ‘ভুল রাস্তা’ অভিনয় করেছি। ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ বিরোধী জমায়েতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। বয়সের ভার, অসুস্থতা তাঁকে বিদ্রোহের আবেদনে সাড়া দিতে দ্বিধাগ্রস্ত করেনি।
থিয়েটারের প্রধান বিষয় হল ডায়ালগ। সে চরিত্রের সঙ্গে চরিত্রের ডায়ালগ, দর্শকের সঙ্গে অভিনেতার ডায়ালগ। এমনকী যিনি পরিচালনা করছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে অভিনেতার ডায়ালগ। যতক্ষণ এই ডায়ালগটা আছে, ততক্ষণ থিয়েটার স্বাধীন পরিসর হিসেবে থাকতে পারছে। আমি বিশ্বাস করি না যে কৌশিকদা আমার চেয়ে অনেক উচ্চতায় বসে আছেন বলে আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জিতেন নন্দী : কৌশিকদার সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে কিনা।
রাত্রি চট্টোপাধ্যায় : এইটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বাপী : আমি প্রসেনিয়ামে করছি না অঙ্গনমঞ্চে করছি, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আমি ডায়ালগ বা সংলাপ জারি রাখতে পারছি কিনা। জয়ন্তদা বলছিলেন যে আমাদের দলের ছেলেরা অনেক আলোকপ্রাপ্ত, হ্যাঁ সেভাবে দেখলে তারা শিক্ষিতও বটে। সে তো কলকাতার নামকরা দলেও অনেক আলোকপ্রাপ্ত আর শিক্ষিত অভিনেতা রয়েছে। কিন্তু সেখানে জীবন্ত সংলাপের বড়ো অভাব। সেটা ছাড়া সত্যিকারের শিক্ষিত হয়ে ওঠা যায় না, আলোকপ্রাপ্তিও ঘটে না। থিয়েটার-প্রসেসটা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
অনিন্দ্য মোদক : থিয়েটার সংক্রান্ত বিষয়ে আমার জানা নেই। মূলস্রোতের থিয়েটারের বাইরে একটা তৃতীয় বা স্বাধীন পরিসরের খোঁজ করা হচ্ছে। আমার ভাবনাটা স্বাধীন না আমার ফর্মটা? ফর্মটাকে স্বাধীন রেখে আমার ভাবনাটা একই থাকবে, মূলস্রোতের ভাবনাই থাকবে? স্বাধীনতা মানে তো একটা নিশ্ছিদ্র সততা। সে জায়গায় আমরা কতটা পৌঁছোতে পারছি? রাত্রিদি বলছিলেন, প্রতিদিন আমরা এতরকম পরাধীনতার মধ্যে আটকে আছি, তার মাঝে ভাবনাটাকে আমরা কতটা স্বাধীন রাখতে পারছি? নাটকের আগে কৌশিকদাকে একটা মুখবন্ধ পড়তে হচ্ছে, ওটাই তাঁর মুক্ত পরিসর, আমরা যে কথা বলছি এখন, এটাই একটা মুক্ত পরিসর হতে পারে, ক-দিন আগে ট্রেনে যেতে যেতে অসাধারণ কিছু ‘মনসাগান’ শুনলাম, যা আগে কখনো শুনিনি, গায়ক দুটো কথাও বললেন সাথে, আবার গানও গাইলেন। এই যে ডায়ালগের কথা হচ্ছিল, যেন কোথায় মিলে গেল অনুভূতিটা। স্বাধীনতার এই অনুভূতি স্থিতিশীল কিছু নয়, কোথাও বাঁধা অনুচিত হবে। তাৎক্ষণিকতার যে স্বাধীন প্রকাশ, তাকে কোনো সময় দিয়ে বাঁধা যাবে না, কোনো নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে বাঁধা যাবে না।
তাপস কীর্তনীয়া : থিয়েটার একটা স্বাধীন পরিসর বলেই আমার মনে হয়। পরিচালক কী নির্দেশ দিলেন, সেটা তাঁর ব্যাপার। আমি, যে ক্যারেক্টার, সে কীভাবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকের কাছে নিজেকে উপস্থিত করবে, সেটাই আসল। সেখানে সে স্বাধীন।
অসিত প্রামাণিক : মহলায় যেমন কৌশিক থাকলে আমার ভয় করে, কিন্তু শোয়ের সময় তা হয় না।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : অভিনয়ের সময় অনেক মানুষের সামনে দাঁড়ালে ব্যক্তি-মানুষের ভার কমে যায়, সেই ব্যক্তি-মানুষ তখন অনেক মানুষের অংশ হয়ে যায়। মহলাকক্ষে একটা মানুষকে ফেস করার মধ্যে যে জড়তা তৈরি হয়, অনেক মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে তা কেটে যায়।
আমাদের মূল প্রসঙ্গে আসি। প্রথম যখন একটা বই প্রকাশ করব কিংবা নাটক করব, আমার টাকা দরকার, সেটা নিতে হবে। পরবর্তীকালে যেটা হয়, টাকা পাচ্ছি, কী জন্য নিচ্ছি সেটা গৌণ হয়ে যায়। একটা গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়। তখন টাকার ফাঁদে পড়ে যাই আমি। এক বছরে চারটে প্রোডাকশন করার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু আমি চারটে প্রোডাকশনের প্রজেক্ট রেডি করে ফেলছি, কারণ চারটে প্রোডাকশনের টাকা আমায় দেবে —
জিতেন নন্দী : এই ফাঁদটা তো অদৃশ্য। পরাধীনতার জায়গায় যদি আমি রাষ্ট্র শব্দটা বসাই, তাহলে সেটা তো আছে নিজের মনের মধ্যেই।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : — এর ফলে হয় কি, একটা গ্লানি তৈরি হয় আমাদের মধ্যে।
জিতেন নন্দী : একটা নিঁখুত প্রোডাকশন, সেটা দেখে সকলে মোহিত হয়ে যাচ্ছে, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে। আবার আর একটা প্রযোজনা, যেটা দেখার পর সকলের মধ্যে নতুন একটা কিছু করার স্পৃহা তৈরি হচ্ছে, একটা আন্দোলন সৃষ্টি হচ্ছে।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : ‘শৌভিক সাংস্কৃতিক চক্র’-এর গৌতম মুখার্জি আজ পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে অভিনয় করছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রচুর দল তৈরি হয়েছে গৌতমদার অভিনয় দেখে। গৌতম মুখার্জি সত্তরের দশকে কংগ্রেসিদের হাতে মার খেয়েছেন। গৌতম হালদারও স্বীকার করেন যে গৌতমদার অভিনয় না দেখলে আমি নাটক করতে আসতাম না।
জিতেন নন্দী : সমাজে একটা কম্পন সৃষ্টি করছে।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : সমস্যা কী হয়? আমি এক ধরনের প্র্যাকটিসে যাই, সারাক্ষণ সেই প্র্যাকটিস থেকে বেরোনোর চেষ্টা করি, আমার মধ্যে একটা গ্লানি অনুভব করি, আমাকে তো এটা করতে হচ্ছে। না করলেই হয়। কিন্তু আমার মধ্যে কতকগুলো কৈফিয়ত তৈরি হয়। কতকগুলো দায়ও এসে যায়। আমি একটা গ্রান্ট নিয়েছি আর কয়েকজন ছেলেকে বলেছি, তোমাদের মাসে দু-হাজার টাকা করে দেব। ওই দু-হাজার টাকাটা ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে গ্রান্টের জন্য ছুটে বেড়াতে হয়, না দিলে ওই ছেলেদের টাকাটা বন্ধ হয়ে যাবে। এটা একটা কৈফিয়ত হতে পারে। আরেকটা হতে পারে, দেখো ভাই, আমার কাছে ছিল দিয়েছি, এখন গ্রান্ট নেই, আর দিতে পারছি না। ওরা না করলে আমাকে আবার ছেলে জোগাড় করতে হবে। কারণ আমাকে নাটকটা করতে হবে। তার জন্য আমাকে নানান কিছু অ্যাডজাস্ট করতে হবে।
জিতেন নন্দী : কেউ তো এ অবস্থায় থেমেও যেতে পারে।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : এই থেমে যাওয়াটা কোনো পাপের নয়।
জিতেন নন্দী : থেমে যাওয়াটা র্যাডিকালও হতে পারে।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : একদম। এটাও একটা পদক্ষেপ হতে পারে। আমি তোমার মধ্যে নেই। আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।
আমরা বিশ্ব নাট্যদিবসে নাট্যকোজাগরী বলে একটা উৎসব চৌদ্দ বছর ধরে করে আসছি। সবাই মিলে রাত জাগা হবে। আমরা হাতে পাঁচশো পোস্টকার্ড লিখি। সাংস্কৃতিক-এর বাইরেও কেউ কেউ এই চিঠিটা লেখে। কোনো একজন গৃহবধূ কিছু লিখে দিল। এইভাবে তার একটা অংশগ্রহণ হয়। আমরা কার্ডটা হাতে বানাই। স্মারক তৈরি হয় আট-দশদিন ধরে। তারজন্য কোথায় কী পাওয়া যাবে, খুঁজে আনা হয়। অনেক মানুষ জড়িয়ে যায়। দশজনে মিলেও তো একটা ফেস্টিভাল করে দিতে পারতাম। সেটা না করে আমরা অনেক মানুষকে জুড়তে জুড়তে গেলাম। অনেক মানুষ ওই কোজাগরীর সময় থাকে, আবার এগারো মাস থাকে না। আমরা নিজেরা চাঁদা তুলি। কিন্তু ক্রমশ আমাদের অনুষ্ঠানের আয়তন বাড়তে থাকল। এই করতে করতে এবার এক লক্ষ টাকা বাজেট হয়েছে। আমরা চাঁদা তুলতে পেরেছি ত্রিশ হাজার টাকা, আরও সত্তর হাজার টাকা আমাদের লাগবে। চৌদ্দ বছরের মধ্যে বারো বছর আমরা কোনো গ্রান্ট নিইনি। তেরোতম বছরে আবেদন করে একটা টাকা পেয়েছি। এই গ্রান্ট নেওয়ার পরে কি আমার স্বাধীন পরিসর চলে গেল? এখনও কিন্তু উৎসবের আমেজটা একইরকম আছে। সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চলে আসে। অনেক লোককে চিনি না। সারা রাত কেউ মাঠে বসে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে, কেউ পাঁচটা পত্রিকা এনে বিক্রি করছে, কেউ আচার বিক্রি করছে। এবার স্বাধীন অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ার একটা আশঙ্কা থাকছে। যখন টাকাটা এসে গেল, তখন লোকের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে আমার থাকবে না।
শিশু কিশোর বিকাশ মেলার প্রথম থেকে আমি ছিলাম। প্রথমদিকে আমরা একটা নাটক বানিয়ে সেটা করে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে টাকা তুলতাম। তখন পুজোর সময়। বারোয়ারির প্যান্ডেলে গিয়ে নাটক করছি।
রাত্রি চট্টোপাধ্যায় : সে এক সাঙ্ঘাতিক অভিজ্ঞতা। ষোলো বছর যদি মেলা হয়ে থাকে, অন্তত আট-নবছর তো আমরা ওটা করেছি। সত্যি কথা বলছি, ন-বছরে যখন পাড়ায় থিয়েটার করতে গেলাম, ঢোল বাজিয়েই যাচ্ছি, ক্লান্ত হয়ে গেছি, একটা লোকও থিয়েটার দেখতে আসছে না। তারা মনে করছে যে ওটা দেখতে গেলে আমায় পয়সা দিতে হবে।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : সেটা নাও হতে পারে, লোকের আগ্রহ হচ্ছে না। আর একটা কি, আমাদের বয়স বাড়ছে, সময়ও যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে যে আমার থিয়েটারটা আমি যেখানে সেখানে করব না। ওইভাবে টাকা না তুলে আমি বরং পকেট থেকে পাঁচশো টাকা চাঁদা দিয়ে দেব। একসময় গোড়ার দিকে ওই মেলায় বাচ্চারা চাল আলু নিয়ে আসত। বেশ কয়েক বছর চলার পরে টাকার সমস্যা হয়তো সেভাবে নেই। স্পনসরের টাকা না নিয়েই মেলা হয়। এত মানুষ এসেছে আর এত মানুষ চাঁদা দিয়েছে যে এটা হতে পারছে।
জিতেন নন্দী : আসলে দৃষ্টান্তগুলো এভাবে এলে আমাদের চোখটা একটা স্থিতিশীলতার মধ্যে আটকে যাবে। স্বাধীন পরিসর একটা প্রবাহের মতো, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, উঠছে নামছে, তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। স্বাধীন কর্মকাণ্ডের কোনো মডেল নেই। সৃষ্টিশীলতা আছে, যা নতুন। পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগতেও পারে, নাও লাগতে পারে।
বাবলা বসাক : আমি তো গ্রান্টও নিয়েছি আর পুরস্কারের লোভও আমার যথেষ্ট আছে। কিন্তু আমি খড়গপুরে গিয়েছিলাম, ওখানে ‘আলকাপ’ বলে একটা দল আছে। ওরা সারা বছর নাটক করে। ছোটো মঞ্চে, ছোটো জায়গায় কিছু নির্দিষ্ট মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে যত্ন নিয়ে কাজ করে।
জিতেন নন্দী : গ্রান্ট নেওয়া বা মানুষের লোভ বাস্তব। প্রশ্ন তা নিয়ে নয়। কিন্তু যখন গ্রান্টের জন্যই স্ক্রিপ্টটা লেখা হচ্ছে। সেখানে ক্রিয়েটিভিটি বা সৃষ্টিশীলতার মৃত্যু হল।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : আমি আমার সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি, গ্রান্ট পাচ্ছি বা পাচ্ছি না। তা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে না। আমি আরও ভালোভাবে চর্চা করতে পারলাম, সেটা হয়তো মানুষের সঙ্গে আমার সংযোগকে আরও গভীর করল।
আমার কেমন মনে হয়, এখন কাজ ভালো হচ্ছে, সংলাপ হচ্ছে না। এখন আর কথা হয় না। সরবেড়িয়ায় যখন শিশু কিশোর বিকাশ মেলা হয়েছিল, তখন ডায়ালগ বা সংলাপের বিশাল গুরুত্ব ছিল। আজ নিজের দলের ভিতর পাঁচটা বিষয় নিয়ে কথা হয় কই?
জিতেন নন্দী : আমার এক বন্ধু লিখেছেন, তৃতীয় পরিসরের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : অনেকদিন আমরা স্বাধীন পরিসরের কাজ করেই চলেছি। বারবার আমরা বিন্দু তৈরি করেই চলেছি, বিন্দুগুলো সিন্ধু হচ্ছে না। আপনি তো মানুষের সঙ্গে সংযোগের জন্য পত্রিকা করছেন।
জিতেন নন্দী : না, আমি বাপীর কথায় বলছি, আমি সংলাপের জন্য করছি। যতক্ষণ পারছি করছি, না পারলে থেমে যাচ্ছি।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : সংলাপটা কেন করছেন?
জিতেন নন্দী : উত্তরণের জন্য।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : আমি উত্তরণকেই সিন্ধু হয়ে ওঠা বলছি।
জিতেন নন্দী : সংলাপে উভয়পক্ষ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে, কোনো উঁচু-নিচু নেই। নেতা-ক্যাডার সম্পর্ক নেই। এই লোকটা স্থায়ীভাবে নেতা আর এই লোকটা পাকাপাকিভাবে ক্যাডার! নেতা বা প্রতিনিধি একটা স্থিতিশীল ব্যাপার হয়ে গেল। এরপর আর সংলাপের সুযোগ কোথায়?
উত্তরণ একটা জটিল প্রক্রিয়া। সোজা নাক বরাবর এগিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যাপার নয়। অনেকটা দীর্ঘমেয়াদিভাবে দেখতে হচ্ছে কোনটা এগিয়ে থাকা কোনটা পিছিয়ে যাওয়া, কোনটা কতটা ভালো কোনটা কতটা মন্দ।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : এইটাই আশার কথা আমি বিলীন হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কোথাও আবার কেউ তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : কিন্তু আমার অনুভব, এই মুক্ত পরিসর ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : এইটা আমি বলে দিতে পারি না। আমার দলে হয়তো নতুন ছেলেরা তৈরি হচ্ছে না। সে হয়তো অন্য কোথাও তৈরি হচ্ছে।
জিতেন নন্দী : তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা সরলরৈখিক নয়। তৈরি হওয়া মানেই বা কী? শিল্পকলায় আরও দক্ষ আরও নিখুঁত হয়ে ওঠা? নাকি সৃষ্টিশীলতায় উদ্বেল হয়ে ওঠা?
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার যে আমার পুরস্কার পাওয়ার ইচ্ছেটা জোরালো না নাটক করাটা জোরালো?
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : নাটক করার ইচ্ছেটাই জোরালো। কিন্তু নাটক করা তো আমার মধ্যে একটা মোহও তৈরি করে। উচিত কথা হিসেবে, ওটা খারাপ। একটা পুরস্কার পেলে বা কাগজে ছবি বেরোলে তো আমার ভালোই লাগে। কিন্তু সেটাই সব নয়।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : পুরস্কার আমার পেতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু নাটক করাটা যদি আমার কাছে জোরালো হয়, তাহলে আমার যাপনটাই আসল। আর একটা কথা, যে মানুষ খায়-দায় সংসার করে বাড়িতে বসে থাকে, সে কি স্বাধীন পরিসরের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না? নাটক করাটাই গুরুত্বপূর্ণ? অন্যভাবেও তো জীবনযাপন হয়।
আমাদের সিস্টেম প্রতিভা বা ট্যালেন্টের একটা মাপকাঠি তৈরি করে দেয় —
বাপী : রাষ্ট্র যখন আমাকে একটা গ্রান্ট দিচ্ছে, আমি নিজে একটা ফেলোশিপ পেয়েছি। কিন্তু আমি যখন একটা গ্রান্ট নিই, তখন কি আমার স্বাধীন অবস্থানটা রাখা সম্ভব? সংলাপ কি জারি রাখা সম্ভব? আমার মনে হয়, সম্ভব নয়। সরকার কেন গ্রান্ট দেয় বা কীভাবে দেয়, একটু নাড়াঘাঁটা করলেই বোঝা যায়।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : একটু থামালাম বাপী। আমি কি গ্রান্টটাকেই লক্ষ্য করে নিয়েছি? গ্রান্টটা যেনতেনপ্রকারেণ নিতে হবে মনে করছি? গ্রান্ট কার টাকা? সরকারের টাকা কার টাকা? আমি কি গ্রান্টের চক্করে পড়ব নাকি আমার থিয়েটারে অবিচল থাকব?
বাপী : আমাকে যখনই একটা গ্রান্টের দিকে যেতে হয়, আমি যার টাকাই নিই, সেটার জন্য আমাকে একটা প্রজেক্ট দিতে হয়। তখন আমার যে হিসেবনিকেশ তা কখনোই ক্রিয়েটিভ নয়। সরকার সে যে সরকারই হোক, যতই জনসাধারণের সরকার হোক, সে ক্রিয়েটিভ কাজে টাকা দিতে পারে না। ক্রিয়েটিভ ফর্মের জন্য টাকা দিতে পারে না। কিন্তু যখন আমি সাধারণের কাছ থেকে টাকা নিই, তখন আমার ক্রিয়েটিভিটির ওপর সেরকম কোনো শর্ত আরোপ হয় না বলেই মনে হয়।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : তুমি বলছ, রাষ্ট্র কোনো ক্রিয়েটিভ কাজে টাকা দিতে পারে না।
জিতেন নন্দী : রাষ্ট্র তো এজন্যই রাষ্ট্র যে তার কোনো ক্রিয়েটিভিটি নেই। রাষ্ট্র একটা স্থিতিশীল জিনিস, যা চলে আসছে তার ভারসাম্য রক্ষা করে। সিস্টেমটাকে রক্ষা করাই তার কাজ। আমাদের মনের ভিতর যে রাষ্ট্র বসত করে, তারও ওটাই কাজ। ক্রিয়েটিভিটি এই ভারসাম্যকে মানছে না, অস্বীকার করছে। আমি যখন ক্রিয়েট করছি, তার যে আনন্দ আর পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ কখনোই এক হতে পারে না।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : এটা ঠিকই। নতুন কিছু সৃষ্টির আনন্দই আলাদা।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় : গ্রান্টের যে কথাটা বাপী বলছে, সেখানে প্রশ্ন আমি গ্রান্টের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি কিনা।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : হচ্ছি কিনা আমি কী করে বলব? অভ্যাসটা এমন যে ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে যায়। সেখানে আবার ব্যক্তির পছন্দ, সিদ্ধান্ত আর চাওয়ার প্রশ্ন ঘুরে আসবে। আমি থিয়েটারটা কেমনভাবে করতে চাইছি, আমি কেমনভাবে বাঁচতে চাইছি, আমি নিজেকে কতটা স্পেস দেব আর অন্যকে কতটা দেব —
জিতেন নন্দী : আত্মোপলব্ধির ব্যাপার।
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : এইটাকে বাদ দিয়ে যখন আমি শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি, তখন একটা গণ্ডগোলে পড়ি। বাইরে একটা মিছিলে হেঁটে সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক বলে দেওয়া যায়। কিন্তু আমার ভিতরে যে সাম্রাজ্যবাদ আছে তার সঙ্গে লড়াই করাটা শক্ত।
আমরা ভাবি বেশি মানুষের কাছে পৌঁছোব, শুধু কলকাতার দশটা হলে নয়। আমার শান্তিপুরের যে বেশি মানুষ, এত লোক হয়তো থিয়েটার দেখতে আগ্রহী নয়। বেশি মানুষের কাছে রাজনৈতিক নেতা যাচ্ছে, বেশি মানুষের কাছে ধর্ম যাচ্ছে, বাবা যাচ্ছে, আমি উল্টোদিকে যাচ্ছি। কম মানুষের কাছে যাওয়াটাও স্বাধীন পরিসর হতে পারে।
বাপী : বেশি মানুষের কাছে যাওয়ার থেকেও — তুমি যেটা বলতে চাইছ — আমি নিজেকে এমনভাবে রাখছি যাতে সব মানুষ আমার কাছে আসার সুযোগটা পায়। এখন বেশি না কম সেটা কে ঠিক করবে?
পার্থ চক্রবর্তী : আমার মনে হয়, নাটকের সাবজেক্টটা কী, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে মুক্ত পরিসরের প্রথম দরজা খোলার লোক হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ। যেমন, শান্তিপুরের নাটক নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। আমাদের জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশ মুসলমান, আমি একটা মুসলমান পাড়ার কাছে থাকি, একটা মুসলমান পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশছি, তাদের দারিদ্র যেমন রয়েছে, তেমন অদ্ভুত রয়েছে মেয়ে কেনাবেচা। মুসলমান মেয়েরা কীভাবে পণ্য হচ্ছে আজ! এটা একটা জ্বলন্ত বিষয়। আপনাকে ধরেই নিতে হবে যে আপনি ভিমরুলের চাকে ঘা দিয়েছেন। একদিকে ধর্মীয় মৌলবাদ, অন্যদিকে রাজনীতিতে তারা ভোট-পকেট। আমাদের শান্তিপুর বৈষ্ণব সংস্কৃতির জায়গা। ইদানীং আমি চৈতন্যকে নিয়ে পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি। সেখানে একদিন ভাগবত পাঠ শুনতে গেলাম। যিনি ভাগবত পাঠ করছেন, তিনি বলছেন, মহাপ্রভুর মৃত্যু-রহস্য নিয়ে যে কথা বলবে, তার সঙ্গে মিশবে না, তার কাছে যাবে না, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। এ হল এক বৈষ্ণবীয় মৌলবাদ। আমি যেখানে বাস করি, হয় হরিনাম সংকীর্তন চলছে, নাহলে মুসলমানদের জলসা, ঠান্ডাভাবে থাকার জো নেই। শ্যামলী খাস্তগীর একটা কথা বলেছিলেন, আমাদের আর একটা শান্তিনিকেতন দরকার নেই। কিন্তু নিজের চারপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শান্তিনিকেতন গড়ে তুলতে হবে। আমার কথাটা ভালো লেগেছে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনকে ঘিরে এক মুক্ত পরিসর রচনা করতে চেয়েছিলেন। সেই ভাবনাটা রয়ে গেছে। নতুন সৃষ্টি বাধার মুখে পড়বেই।
জিতেন নন্দী : আমার মনে হয় আমাদের কথা আরও চলতেই থাকবে। এ কথা ফুরিয়ে যাবার নয়। যে বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছি, প্রবহমানতাই তার শক্তি। আমরা তো দাঁড়িপাল্লা নিয়ে মাপতে বসিনি যে কে কতটা এই স্বাধীন পরিসরের প্রতিনিধি। বরং স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে স্বাধীন পরিসরের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, কোনো সংজ্ঞা নেই, কোনো স্থির-নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। আমাদের আন্তরিক খোঁজের মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে তার উপলব্ধি, তার বার্তা।
Leave a Reply