প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য
ফিল্মের একটা স্বাধীন পরিসর তৈরি হচ্ছে। ডিজিটাল রেভলিউশনের ফলে কিছু বদল এসেছে, যেমন, ছোটো ক্যামেরা এসেছে। আগে যেমন সেলুলয়েড ক্যামেরা ছিল, টেকনিকালিটিজ-এর জন্য অনেকে ফিল্ম করতে চাইত, সেটা পেরে উঠত না, তাতে অনেক খরচ হত, জটিলতা ছিল অনেক। তার ফিল্মের রোল, তার ক্যামেরা জোগাড় করতে হবে। ক্যামেরাটা ঠিক মতো চালাতে জানতে হবে। তার জন্য অনেকটা শিখতে হবে। অনেক লোক লাগবে, আলো লাগবে, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু লাগবে। সেটাকে প্রিন্ট করে আনতে হবে এডিট করে। আবার গিয়ে নেগেটিভ বার করতে হবে। মানে, অনেক রকমের ঝঞ্ঝাট ছিল ফিল্ম তৈরির। এক মিনিটের ফিল্ম বানালেও ঝঞ্ঝাট অনেকটাই। এখন যেটা হয়েছে, ছোটো ক্যামেরা, দাম কম। এখন মোবাইলেও ছবি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ভালো মোবাইল, চার-পাঁচ হাজার টাকা দামের মোবাইলেও একটা ছবি করে ফেলা যায়। সেটা একটা স্বাধীনভাবে তোলা ছবি। আমি তার কোয়ালিটি নিয়ে বলছি না। সেটা বাড়িতে বসে একটা কম্পিউটারে এডিট করে দেওয়া যায়। সেটা তো একটা কবিতা লেখার মতোই। তিনজনে মিলে হয়তো ভাবল যে একটা ছবি করবে। একজনের হয়তো একটা ভালো মোবাইল আছে। আর একজনের একটা কম্পিউটার আছে। আর দরকার কিছু টাকার। শুটিং করবে, কোথাও যাবে, গাড়িভাড়া খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি, সবাই দু-পাঁচশো টাকা করে চাঁদা দিল। এইভাবে একটা ছবি তৈরি করে ফেলা যায়।
ক্যামেরার কতগুলো স্টেজ আছে। আগেকার মতো ওরকম নয় যে একটা ক্যামেরার দামই দেড়-দু কোটি টাকা। সবসময় দশ হাজার টাকা ভাড়া লাগে। কিংবা একটা দশ মিনিটের স্টক বা ফুটেজ তুলব, তার জন্য প্রিন্ট নিয়ে দশ-পনেরো হাজার টাকা খরচ হবে। এখন তো সেই ঝামেলাটা নেই। আমরা যে ছবিগুলো দেখে অভ্যস্ত, এটা তো গুলিয়ে যায়, কোনটা স্বাধীন, কোনটা কমার্শিয়াল, তাই আমি যখন সুযোগ পেলাম তো একটা হিন্দি সিনেমার মতো বানানোর চেষ্টা করলাম। তখন আমার মনে হয়, ব্যাপারটা আর স্বাধীন ছবি তোলা বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মেকিং থাকছে না। এটাও তৈরি হচ্ছে, অনেকে সেরকমও ভাবছে, গ্রুপ তৈরি করছে।
আগে স্বাধীন উদ্যোগে ফিল্ম তৈরির ব্যাপারটা শুধু কলকাতা-কেন্দ্রিক ছিল। সবাইকে কলকাতাতেই আসতে হত শর্ট ফিল্ম বা নিজের মতো কাজ করতে। এটা এখন বিভিন্ন জেলাতে, আমাদের মুর্শিদাবাদে, কৃষ্ণনগর, নদিয়াতেও হচ্ছে। সবাই চেষ্টা করছে। গ্রামে, শহরে টুকটুক করে চেষ্টা চলছে। উত্তরবঙ্গে অনেকটাই হয়ে গেছে। ওখানে ঠিক স্বাধীন নয়, যেমন, রাজবংশী ছবির মার্কেটও আছে। নিজেরাই ছবি তৈরি করে, নিজেরাই ডিস্ট্রিবিউশন করে প্রফিট করে। লোকাল ভিডিও হল যেগুলো ছিল, এখন ওরা রাজবংশী ভাষাতেই ছবি তৈরি করে ওখানেই চালাচ্ছে। সেনসর-টেনসরের ব্যাপার নেই। ধরা যাক, সাতদিন চালাল, পঞ্চাশ টাকা করে টিকিট রাখল। পুরুলিয়াতেও আছে, ছবি তৈরি করে সিডি বিক্রি করছে। উত্তরবঙ্গ এব্যাপারে অনেক সংগঠিত। একটা সেট-আপও রয়েছে, যেমন, লাইট ক্যামেরা ইত্যাদি। শর্ট ফিল্ম বানাচ্ছে। ওখানে ফিল্ম ক্লাব আগেও ছিল। আমাদের ওখানে নদিয়া কৃষ্ণনগর মুর্শিদাবাদ-বহরমপুরে অনেকে এখন শর্ট ফিল্ম বানাচ্ছে। কিছু ছেলে এসেছিল বর্ধমান থেকে। ছোট্ট একটা ছবি ওরা করেছে। খুব সুন্দর ছবি, একটা থিম নিয়ে, পশুপাখিরা কারোর ক্ষতি করে না। ফোটোগ্রাফি, সাউন্ড খুবই সুন্দর, ওরা নিজেরাই বাড়িতেই করেছে।
আমাদের ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবিটা দেখে একটা ছবি হয়েছিল নিউ ব্যারাকপুরে, আর একটা করেছিল মেদিনীপুরের বেলদার দুটো ছেলে। শর্ট ফিল্ম, তারা সব বাড়িতে শুটিং করেছে, এডিট করেছে, সেটা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল। কিছু কিছু অ্যামেচার হলেও ভাবনাচিন্তাটা পরিষ্কার।
এবারে এই ফিল্মের দর্শক সমাজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, সেই অর্থে তা নেই। কিন্তু আছে। ইন্টারনেটের আগের যুগে যেটা ছিল, শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভাল এইসব ছবি দেখানোর একমাত্র জায়গা ছিল। সব ছবি তো দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সিলেক্টেড হলে আমার ছবি দেখানো হবে। টাইম, বিষয়বস্তু, কোয়ালিটি ইত্যাদি দেখে সিলেকশন হবে। এখন শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভালের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ইন্টারনেট, মূলত ইউটিউব। ছবি দেখানোর একটা বড়ো জায়গা এটা। যারা ছবি বানাচ্ছে, তারাও ভাবছে আমার ছবিটা ইউটিউবে তোলা হবে। এখন আর একসঙ্গে ছবি দেখার মজাটা এতে থাকছে না। সেটা তো একটা মজাও বটে। আমরা তাই কিছুদিন ধরে একটা জিনিস করার চেষ্টা করছি। আমাদের বন্ধু-বান্ধব মিলে একটা গ্রুপ করেছি। যারা ছবি বানিয়ে ইউটিউবে দেয়, তাদের কাছে ছবি চাই। তারা নেটে তাদের ছবিটা আমাদের কাছে পাঠাল। আমরা মাসে বা দু-মাসে একটা করে শো করছি। গাঙ্গুলিপুকুরে নান্দীমুখ-এর ওখানে একটা জায়গা পেয়েছি দেখানোর। এক মাস আগে ঠিক হয়ে যায় দিনটা। আমরা ফেসবুক, মেল, ফোন করে সকলকে বলতে থাকি। ওখানে একশোজন আঁটে। ত্রিশ-চল্লিশজন কমন দর্শক হয়। তারা আসে। আমরা পাঁচ-ছটা শো করেছি। এরপর অনেকে শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভাল করতে চায়। যেমন, বাঁশবেড়িয়াতে হল। তেহট্টেও সামনে আছে। বহরমপুরে পুজোর সময় একটা করে এসেছি। আমাদের গ্রুপের নাম ‘কলকাতা শর্ট’। আগে নাম দিয়েছিলাম ‘নো হোয়ার ফিল্মস’। আমাদের তো কোনো শক্তি নেই, সংগঠনও ছিল না। নেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করছিলাম ছবি-নির্মাতাদের সঙ্গে। এখন যেটা করেছি, ফোন নাম্বার দিয়েছি যোগাযোগের জন্য। পোস্টার দিচ্ছি কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে, তাছাড়া মুখে মুখেও বলছি। এরকম করে যারা ফিল্ম বানায়, কিছু লোক জেনে গেছে। তারাও উদ্যোগী হয়ে পাঠাচ্ছে।
এবারে একটা প্রতিযোগিতা করব। একশো টাকা করে ফি নিচ্ছি। এতদিন আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে করছিলাম। দর্শকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া মুশকিল। সিলেকশন হলে ছবিটা ফেস্টিভালে দেখানো হবে কম্পিটিশনের জন্য। সিলেকশন না হলে পরেরদিন বা পরের সপ্তাহে ওগুলো দেখানো হবে। কম্পিটিশন হলে যারা সত্যিই আগ্রহী তারাই ছবি পাঠায়। এমনও আছে, যেমন, একজন থাইল্যান্ডে বেড়াতে গেছে, সেটা পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের সমস্তটাই দেখে নিতে হয়। এগুলো ত্রিশ সেকেন্ড থেকে আধঘণ্টা পর্যন্ত সময়ের ফিল্ম।
সরকারি ফিল্ম ফেস্টিভাল হয়। আবার কোলাবরেশনও হয়, যেমন, নন্দনের সঙ্গে। আমাদের সেসব ব্যাপার নেই। আনুষ্ঠানিকতাও নেই। খুব বেশি টাকার দরকার নেই আমাদের। আগে যেমন ছবি দেখানোরও অনেক খরচ ছিল। এখন সেটাও কমে গেছে। আমরা সরকারের কাছে যাচ্ছি না, কারও স্পনসরের জন্যও যাচ্ছি না। নান্দীমুখের ওখানে মাত্র দুশো টাকা লাগে জায়গাটার জন্য। খুবই কমে হয়।
এরকম আছে যে দশজনের একটা গ্রুপ স্টেশনে আড্ডা মারে, তারা নিজেরা ঘরে বা একটা জায়গায় ফিল্ম দেখল। মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গা নিয়ে বেশ কিছু ভালো ছবি হয়েছে। যেমন, মিঠুন প্রামাণিক বেদান্ত বা নিয়ামগিরির প্রতিরোধ নিয়ে ছবি করছে। এগুলো ডকুমেন্টারি। এখন মূলত দু-তিন ধরনের ডকুমেন্টারি ফিল্ম হচ্ছে। এক, কর্পোরেট বা বিদেশি ফান্ডের ডকুমেন্টারি। বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলো বিভিন্ন জায়গায় আসে, যেমন, এসআরএফটিআই-এ বা ম্যাক্সমুলার ভবনে। ডকেজ বলে একটা ব্যাপার আছে। ওদের কাছে পরিচালকরা গিয়ে তার বিষয় নিয়ে বলে। কারো পছন্দ হলে সে বলে বিষয়টা এমনি করে দেখাও, ওমনি করে দেখাও। বিরাট ফান্ডিং পাওয়া যায়। সত্তর-আশি লক্ষ টাকা থেকে শুরু, এক-দেড় কোটি পর্যন্ত পাওয়া যায়। দুই, পিএসবিটি, ফিল্ম ডিভিসন ভারতবর্ষে বিষয়ভিত্তিক কিছু ছবি করায়। বাজেট অনেক কম থাকে। তবে পরিচালককে অতখানি নির্দেশ দিয়ে দেয় না। এই দুটো হল ফান্ডিং-ওরিয়েন্টেড ডকুমেন্টারি, যেখানে আমাকে বিষয়টা পেশ করতে হবে। আরেকটা ধরন হল, এনজিও ফিল্ম। ডকুমেন্টারি, কিন্তু একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ফিল্ম। সেখানে এনজিও পরিচালককে একটা ফান্ড দিচ্ছে।
এরপর হল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডকুমেন্টারি অর্থাৎ ক্যামেরা এডিট পয়সা জোগাড় করে নিজেরাই করা। কোনো ফান্ডিংয়ের ব্যাপার নেই। পরিচালক নিজেই চাঁদা তুলছে, পয়সা জোগাড় করছে।
পূর্ণেন্দু পত্রী, ঋত্বিক ঘটকদের সময় তাঁদের ফিল্ম দেখানো বা নিজেদের মতো করে চেষ্টা করার একটা ব্যাপার ছিল। লাতিন আমেরিকায় মিগুয়েল লিতিন-এর ছবি দেখানো, পালিয়ে বেড়ানো ইত্যাদি একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। এখন লোকে ডকুমেন্টারি করতে চায় না, যারা ফান্ড দিচ্ছে, তাদের এতটাই চাপ থাকে, ফিল্ম-মেকারের নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। যে ছবিটা সে বানাতে চাইছে সেটা কখনোই ফান্ড নিয়ে স্বাধীনভাবে বানানো যায় না। কারও কাছ থেকে টাকা নিলে, বিশেষত বিদেশি চ্যানেল ইত্যাদিদের কাছ থেকে টাকা নিলে, ছবিটা একদম অন্যরকম হয়ে যায়।
যেমন, আনন্দ পট্টবর্ধন করেন, নিজের মতো একটা ছবি বানিয়ে নিয়ে তারপর দূরদর্শন বা কোথাও দেখালেন। ওঁরা ছবির ডিভিডি বিক্রি করেন। আমি ওঁর শেষ ছবিটা দেখেছি, ‘জয় ভীম কমরেড’, দেখে মনে হয় না যে উনি কোনো প্রতিষ্ঠানের লোক। আমি তো ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত নই, ছবিগুলোই দেখেছি। তাতে মনে হয় উনি একজন স্বাধীন ফিল্ম-মেকার। এরকম লোক কমই আছে। অনেকেই দেখি কোথাও না কোথাও একটা গ্রাস হয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকে, কিংবা কিছু একটা এড়িয়ে গেলেন ছবিতে। আনন্দ পট্টবর্ধনের ছবিগুলো দেখলে সিনেমা মনে হয়। কিছু কিছু ছবি থাকে, সেটা কেবল অ্যাক্টিভিস্টদেরই আকৃষ্ট করে। ওঁর ছবিগুলো সাধারণ দর্শককেও আকৃষ্ট করে, আবার অ্যাক্টিভিস্টদেরও ভালো লাগে। আমি এই ধরনটাকে পছন্দ করি। আসলে অনেকের সমস্যাটা হল, তারা মনে করে যে করে খেতে হবে, এবার দুটোই যদি একসাথে হয়! তখন একটা ভেক ধরতে হয়। রোজগার করতে হবে, আবার আমি আমার মতো করে একটা ছবি বানাব, এটা খুব সমস্যা হয়। খাওয়াদাওয়ার সংস্থান হল, এবার আমি টাকাপয়সা জমিয়ে আমার মতো একটা ছবি বানালাম। কিন্তু আমি টাকাও করব, নামও করব, আবার ভালো ছবি করব, সেটা বেশ মুশকিল! আমি নিজে ডকুমেন্টারি এইজন্য পছন্দ করি না। ধরুন আমি কাউকে নিয়ে একটা ছবি করলাম। সেটা দর্শকদের বেশ স্পর্শ করল। আমি আর সেই মানুষটার কাছে ফিরেই যাচ্ছি না, সম্পর্কই নেই তাঁর সাথে। আমি হয়তো ছবি করার জন্য পনেরোদিন তাঁর বাড়িতে খেলাম, থাকলাম। তারপর আর তাঁর কাছে যাওয়াই হল না। জাস্ট রিলেশনটাকে এক্সপ্লয়েট করা ডকুমেন্টারি ফিল্মের জন্য, করে ওটাকে বাতিল করে দেওয়া। ধরা যাক, আমি একটা ফিল্ম করছি এক কোটি টাকার। যাঁকে নিয়ে বানাচ্ছি, তিনি কিন্তু সেটা জানেন না। এবারে আমি তাঁর সঙ্গে একবছর কাটালাম, তারপর চলে এলাম। হয়ে গেল!
ধরা যাক, এখন পশ্চিমবঙ্গে কী কী নিয়ে ছবি করা যায়? ফিল্ম-মেকার হিসেবে আমি খুঁজছি। এক হিন্দু-মুসলিম, দুই আদিবাসী, তিন জমি আন্দোলন, চার নারী আন্দোলন, পাঁচ বিকল্প জীবনযাত্রা, এরকম ধরা যাক সাতটা লিস্ট করলাম আমি রাত্রিবেলা বসে বসে। এটা এনজিওতে হতে পারে, কিন্তু ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম-মেকারদের ক্ষেত্রেও যদি এটা হতে থাকে, তাহলে তো সমস্যা। যেমন হয়েছিল একটা ডকুমেন্টারিতে, একজন বয়স্ক বাউল সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন, ওঁর পক্ষে একবারই নামা সম্ভব, তারপর বিশ্রাম নিতে হবে। তিনি প্রায় নেমে এসেছেন, তখন ওঁকে বলা হল, আর একবার নিতে হবে শটটা। এভাবে তো ডকুমেন্টশনও থাকছে না, এনঅ্যাক্টমেন্ট। এটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে। এত জটিলতার জন্য আমি ডকুমেন্টারিতে যাই না। যারা করছে, তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। ডকুমেন্টারি ফিল্ম তো দেখারও কোনো জায়গা নেই যে দশ টাকা দিয়ে আমি ফিল্মটা দেখতে যাব। কী করবে তারা? এইজন্য ডকুমেন্টারি ফিল্ম-মেকারকে বিভিন্ন রকম পন্থা অবলম্বন করতে হয়। তাকে পপুলার ইস্যু খুঁজতে হয়। অ্যাওয়ার্ডের কথা ভাবতে হয়। এটা শুধু ডকুমেন্টারি নয়, ফিকশন ফিল্মেও এটা আছে। কোনো একটা অ্যাওয়ার্ডে ধরা যাক, আমি জানি এই বিষয়টা গুরুত্ব পাবে। আমি তখন সেটা ধরছি।
দুটো বিষয় — ফান্ডি আর অ্যাওয়ার্ড। আমি যখন ইন্সটিট্যুট থেকে বেরিয়েছি, আমার একজন সিনিয়র আমাকে বলল, ‘তুমি একটা কাজ করো, এখন পাশ করে বেরিয়েই তুমি একটা রাজবংশী ছবি বানাও। তাহলে তুমি একটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাবে।’ কারণ তখন একটাই রাজবংশী ছবি হবে, ওইটাই অ্যাওয়ার্ড পাবে। এরকম আমার চেনাশোনা লোক পেয়েছেন। তার জন্যই তো এত মারামারি। প্রচণ্ড মেনস্ট্রিমের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওখানেও এখন আর জায়গা থাকছে না। আর ওই স্পেসটা থাকছে না, ব্যাপারগুলো মেনস্ট্রিমে চলে যাচ্ছে। ফলত, যেটা ছিল ইন্টারনেট, সেখানেও এখন নেট নিউট্রালিটির কথা আসছে। দেখতে গেলে টাকা দিতে হবে, সেই কেব্ল চ্যানেলের মতো। ওরকম হয়ে গেলে তো আরও জায়গাটা কমে যাবে। এখন তো আমরা ফ্রিতে দেখাতে পারছি। তাও সবার কাছে ইন্টারনেট নেই। আর যাদের কাছে আছে, তাদের কাছেও আর সহজে পৌঁছানো যাবে না। যে ছবিটা আমার কাছে নেই, দূর থেকে কেউ নেটের মাধ্যমে আমাকে পাঠাতে পারছে। সেটাও করা যাবে না। এখন আমি কাউকে লিঙ্ক পাঠালেই সে দেখে নিতে পারে। সেই ব্যবস্থাটা যদি বন্ধ হয়, রেস্ট্রিক্টেড হয়ে যায়, তখন আমি ভাবব যে এমন ছবি বানাব যাতে যার আনুকূল্য পাওয়া যায় তাকে খুশি করা যায়। তখন নিজের টাকা দিয়ে বানালেও ওরকম ছবি বানাব। লেখার সময় তো ছবির আসল ছাঁচটা তৈরি হয়ে যায়। সেই স্বাধীন পছন্দটাই চলে যাবে। স্ক্রিপ্ট লেখার সময় ওইসব হিসেব মাথায় আসবে আর সব অন্যরকম হয়ে যাবে।
ফিচার ফিল্মের ক্ষেত্রে আমাদের একটা যুদ্ধ করতে হয়। আমার অত টাকা নেই। অন্যের কাছ থেকে টাকা নিতে হচ্ছে। যখন শর্ট ফিল্ম বানাচ্ছি, তখন কারও কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। যুদ্ধটা হচ্ছে, আমি ফান্ডিং নেব অথচ যেখান থেকে টাকাটা নেব তার কথা মতো চলব না। ছবি বানানোর আগেই এই কথাটা হয়ে যাবে। উনি বলবেন যে তাহলে আমার টাকাটা কীভাবে ফেরত আসবে? এটাই একটা যুদ্ধ। আমার নিজস্ব পদ্ধতি হচ্ছে, টাকাটা যতটা সম্ভব কম নেওয়া। একটা মিড-বাজেটের ফিচার ফিল্মে এখন মার্কেটিং নিয়ে এক কোটি টাকা খরচ হয়। ধরা যাক, সত্তর লক্ষ টাকায় ছবিটা বানানো হল, মার্কেটিং নিয়ে আরও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা লেগে যায়। সেখানে আমি বললাম যে আমি ত্রিশ লক্ষ টাকায় ফিল্মটা বানাব আর মার্কেটিংটা একটু কম মানে দশ লক্ষ টাকায় হবে। এখানে আমি লায়াবিলিটি কিছুটা কমিয়ে দিলাম। প্রোডিউসারকে বলছি, আপনি কনটেন্ট নিয়ে কিছু বলবেন না। এইভাবে কাজ করতে করতে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে হয়। তাও যে তৈরি হয়, তা নয়। একটা ছবি আমি এভাবে করতে পেরেছি। পরের ছবিটা কী হবে, জানি না।
এক্ষেত্রে এনএফডিসি-র একটা ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা আছে ফিচার ফিল্মের জন্য। ওরা ফিল্ম-মেকারের পছন্দ অনুযায়ী করলেও করতে দিতে পারে। সেখানে এই মুহূর্তে যারা সরকারে আছে, তাদের বিরুদ্ধে গেলে পাওয়া মুশকিল।
আরেকটা হল শর্ট ফিল্মের কায়দাতেই একটা বড়ো ফিচার ফিল্ম করা। একটা ক্যামেরা আর বাড়িতেই এডিট হবে, এরকম করেও আমি টেলি-ফিল্ম বানিয়েছি, শর্ট ফিল্মও করেছি। সেটার জন্যও নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা লাগে। এই ছবিগুলোর টেকনিকাল কোয়ালিটি একটু কম থাকে, হলে দেখানোর উপযুক্ত হয় না। এটাও আমি চেষ্টা করছি। সরস্বতী পুজোর মতো, সবার কাছ থেকে চাঁদা নিলাম। দশ বা পনেরো লক্ষ টাকা দিয়ে ফিল্মটা করলাম। সেটা উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ইদানীংকালে ‘লুসিয়া’ বলে একটা ছবি হয়েছিল এইভাবে। জন আব্রাহাম ছিলেন কেরালায়, ওঁরা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে টাকা তুলে ছবি করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় ছবিটা দেখিয়ে দেখিয়ে টাকাটা রিকভার করেছেন।
আমাদের ছবি ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’-তে সিনেমা হল থেকে এক সপ্তাহে বইটা উঠে গেছে। তখন আমরা তেহট্টে তিনটে স্ক্রিনিং করেছিলাম। সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে না গিয়ে নিজেরা করেছি। বাড়িতে বসে টিকিট ছাপিয়ে প্রজেক্টর নিয়ে মাইক নিয়ে চাঁদা তুলে নিজেরাই করেছি। প্রোডিউসারের টাকা স্যাটেলাইট রাইট মানে টিভি স্বত্ব ইত্যাদির মাধ্যমেই উঠে আসে। কোনো ছবি এখন হলে দেখিয়ে টাকা ওঠে না। অনেকটাই ওঠে টিভির মাধ্যমে।
স্বাধীন ছবির ক্ষেত্রে ক্কচিৎ টিভি চ্যানেল কিনবে। কারণ ওখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নামকরা কেউ থাকবে না। এখন সিনেমাগুলোও মেগা সিরিয়াল হয়ে গেছে। সিনেমাগুলো টেলিভিশনের জন্যই তৈরি হচ্ছে। নতুন হয়েছে মাল্টিপ্লেক্স। যারা বড়ো বাজেটের ছবি করছে, তারা সিনেমার মানের কথা ভাবছে না। এটা প্রজেক্ট করছে যে ওইগুলোই আসলে সিনেমা। যারা ছোটো বাজেটে ছবি করছে, তাদেরও লক্ষ্যটা ওইদিকেই। আবার ছোটো বাজেটে ওইগুলো বানানো সম্ভব নয়। সেদিক থেকে স্বাধীন উদ্যোগে একশোটা ছবি হলে তিনটে ভালো ছবি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তিনটে তো হয়েছে। থিয়েটারে একটা টিম গড়ে ওঠে, সিনেমাতে টিমটা পাল্টাতে পাল্টাতে চলে। ফলে কখনোই সংগঠন বলতে সেরকম কিছু গড়ে ওঠে না। খুবই টাকাপয়সার ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। একটা হায়ারার্কির ব্যাপারও থাকে।
mitra chatterjee says
film tairir andor mohol er kotha jana gelo..