তনুশ্রী। কৃষ্ণনগর। ১ মার্চ, ২০২১।#
স্কুলের বিশাল সবুজ গেটটা খোলেনি বহুদিন। তারপর যখন খুলল তখন তার নাম হল কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। বন্দীশালা যেন। কিংবা তার চেয়েও ভয়ানক কিছু। এক দুই করে এগারোটা মাস কেটে গেল। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলাতে বদলাতে গোটা ক্যালেন্ডারটাই বদলে গেল একদিন। মাসে মাসে চাল ডাল আলু ছোলা সাবানের আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়ে যোগাযোগ টিঁকে আছে ওদের সঙ্গে। ওরা কোভিডের সঙ্গে ঘর করতে শিখেছে। আমরাও। ওরা মাস্ক জানে,কিন্তু মানতে ভুলে যায়। আমরা সাবধান করি বারবার। বলি এগুলো নিতে স্কুলে আসা তোদের কিন্তু বারণ,জানিস না? মা-বাবা বা বাড়ির বড় কাউকে পাঠাবি পরেরবার। নইলে দেবেনা কিন্তু। কিন্তু ভয় দেখানো সার হয়৷ সাইকেল নিয়ে পরের মাসে আবার হাজির হয় সবকটা দাঁত মেলে- – কেন রে, তোদের মাস্ক দেয়নি? – আছে তো ম্যাম, বাড়িতে। – বাড়িতে থাকলে হবে? – ভুলে গেছি ম্যাম। হাসিটি অমলিন। কতদিন দেখিনি। এরপর আবার কতদিন দেখব না। এরচেয়ে বেশি কঠিন হওয়া মুশকিল। আর হলেও ওই বড়জোর পকেটে করে এনে হাজির হবে। হাসিমুখে সামনে দাঁড়িয়েই পরে নেবে। মাঠ না পেরোতেই ফের পকেটে চালান যাবে। এভাবেই তো কেটে গেল একটা গোটা বছর।
– বাড়িতে সব ভালো তো রে?
– হ্যাঁ, ম্যাম।
– দাদা ফিরেছিল?
– হ্যাঁ, ম্যাম। ইস্কুলে ছিল তো দু’সপ্তা। মা আর আমি খাবার নিয়ে আসতুম।
এরপর প্রশ্ন করার সাহস হয় না। কোথাকার জল কোথায় যে গড়িয়েছে কেমন করে জানা যাবে এ দুর্দিনে? অন্যদিকে নিয়ে যাই নিজেকে
– দিদি তো এবার এই স্কুলে আসবে ইলেভেনে? খুব মজা তো তোর! – … – কী রে চুপ কেন? ভয় পাস দিদিকে?
– দিদির বিয়ে হয়ে গেছে ম্যাম। ও পড়তে আসবে না আর।
সই করতে করতে হাত কেঁপে যায়। ক্লাস টেন! গত কয়েক বছরে ইলেভেনে শাঁখা পলা পরা হাতের সংখ্যা দর্শনীয় শতাংশে কমে গেছে তো। তাহলে? থেমে যাওয়া হাত আর হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উত্তর দেয়- – ঘরে বসে বাবা আর পড়াতে পারবেনা বলল। বাবা তো ফিরে এসেছে কাজ ছেড়ে। তাই… চাল,আলু,ছোলা,সাবান আর ওষুধের ঝোলা নিয়ে সাইকেলে চাপে ক্লাস সেভেন। ফাইভ থেকেই আমার সঙ্গে ও বেশী স্বচ্ছন্দ ছিল কোনো কারণে। তাই হয়তো এত কিছু বলল। নইলে জানার উপায় নেই। আরো কিছু জায়গায় খোঁজ করতেই বেরতে লাগল আশ্চর্য সব তথ্য। কিংবা আশ্চর্য নয়, স্বাভাবিক, বাস্তব তথ্য। লকডাউনের শেষের দিক থেকেই অল্পবয়সী ছেলেরা কাজের জন্য পাড়ি জমাচ্ছে ভিন রাজ্যে। সাধারণত যে প্রবণতা স্কুল পাস করে বেরনোর পর দেখা যেত। হয়তো পারিবারিক ইনকাম কমে আসার কারণেই তারা পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে জীবন-জীবিকার টানে ছুটছে। গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ বাবা-মা’ই স্কুলের উপর নির্ভর করে থাকেন সন্তানের দুপুরের খাবার বা সারাদিনের দেখভালের জন্য। পড়াশোনা করুক বা না করুক, এই যে একটা গন্ডির মধ্যে কাটানো সময়, কিছুটা হলেও শৃঙখলা -এগুলো যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল আগে আমরা হয়তো বুঝিনি কখনো। অনলাইন ক্লাস নামক যে বন্দোবস্তের কথা কানে এসেছে মাঝেমধ্যে, তাতে আমাদের মতো গ্রামের স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে, “শোলে” সিনেমার বিখ্যাত ডায়ালগের মতো! “আধে লোগ ইধার, আধে উধার যাও, বাকি মেরে পিছে আও!” পিছন ফিরে দেখা গেছে কেউ নেই। বাড়িতে স্মার্টফোন নেই, থাকলেই রিচার্জের পয়সা আর নেই। কারো আবার বাবা ফেরেনি অন্য রাজ্য থেকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সহায়িকার কাজ করা মা-র কাজ নেই। সন্তান সবজির ভ্যান নিয়ে ঘুরবে, না অনলাইন ক্লাস করবে? অসহায় এবং সবচেয়ে কাছের দর্শক আমরা। রাষ্ট্রীয় নীতি হোক বা বিশ্ব-পুঁজিবাদের গালভরা তত্ত্ব- কচিমানুষগুলোর উপর এর প্রভাব তো এড়ানো যায়নি। ইলেভেন টুয়েলভের প্রজেক্ট জমা দিতে, বা ট্যাব কিনে তার বিল জমা দেওয়ার জন্য নিয়ম-বহির্ভূতভাবেই ওরা স্কুলে এসেছে বারবার। কোনো বাধানিষেধের তোয়াক্কা করেনি কিছুতেই। কিন্তু নিয়মিত ক্লাসের জন্য একে একে এগারোটা মাস চলে গেছে; অপেক্ষায়। তারপর? নাইন থেকে টুয়েলভের ক্লাস শুরু, নিয়মিত স্কুল শুরু। ফিরছে ওরা। বিভিন্ন জেলায় গ্রামের দিকে উঁচু ক্লাসগুলোতে নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সংখ্যা দর্শনীয়ভাবে কম। ব্যক্তিগতভাবে যেটুকু জানা যাচ্ছে মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রবণতা এই বছরে বিগত কয়েকবছরের মধ্যে সর্বাধিক। একটা প্রজন্মের গোটা জীবনটাই কি ভিন্ন খাতে বয়ে গেল এই এগারো মাসের ধাক্কায়? কবে ফিরবে স্বাভাবিক ছন্দ? কবে ফিরবে সমস্ত শিশুর দল দৈত্যের বাগানে? ওরা তো “ট্রেসপাসার” নয়,তবু ওরাই এখনো ব্রাত্য স্কুল প্রাঙ্গনে। শারীরিক সুস্থতার জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয় ছিল এই দূরত্ব বজায় রাখা। তবু ওরা না ফিরলে বসন্তও ফিরবেনা।
অ্যাডামাস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারম্যান শমিত রায়ের বি.টি. রোডের বাড়ির সামনে বিক্ষোভরত অভিভাবকদের ছবি । জানুয়ারি অবধি পেমেন্ট ক্লিয়ার আছে। তারপরেও আমাদের বাচ্চাদের অনলাইন ক্লাসের গ্রুপ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমার বাচ্চা ক্লাস ওয়ানে পড়ে। যে ডে-বোর্ডিং এ আছে, মাসে সাড়ে সাত থেকে আট হাজার টাকা লাগে প্লাস ট্রান্সপোর্টেশন। আমরা পুলিশকে জানিয়েছি, স্কুলকে বলেছি, এসডিও অফিসেও অভিযোগ দিয়েছি। হাইকোর্টে কনটেম্পট অফ কোর্ট মামলাও করেছি। হাইকোর্টের অর্ডার আছে কোনো নন-এসেন্সিয়াল চার্জ নেওয়া যাবে না। ওরা করছে কি, নন-এসেন্সিয়াল চার্জ টিউশন ফি-এর সাথে জুড়ে দিচ্ছে। ওরা খাওয়ার টাকা, বাসের ভাড়া, স্পোর্টসের ফি, ডিজিটালাইজেশন-এইসব উল্টোপাল্টা বলে পয়সা চাইছে। আমাদের একটাই দাবী আপনারা কীভাবে কোর্টের অর্ডার মানছেন, আমাদের জানান। এতবড় যে ইংলিশ মিডিয়াম, ও যদি ভুল বলে, তালে আমাদের বাচ্চাদের কী শেখাবে? আমরা এত চিল্লে চিল্লে বলছি, আমরা যদি ভুল আছি, তো সামনে এসে বলুক। – বেলঘড়িয়া থেকে সুমিত আগরওয়ালের প্রতিবেদন।
Leave a Reply