সৌরভ প্রকৃতিবাদী, পাঁচলা, ৩ ফেব্রুয়ারি#
গত বছরের শেষের দিক থেকে ছোটরা একটা পিকনিকের কথা বলছিল। গত বর্ষায় গাছ লাগানোর পর থেকেই। গাছ লাগানোর ও সেই গাছের দেখভাল করতে করতে ওরা নিজেদের মতো করে একটা বসার যায়গা, কথা বলার যায়গা খুঁজতেও শুরু করে। বলে আমাদের একটা ক্লাব করতে হবে। পরিবেশ ক্লাব।
যখন জিজ্ঞাসা করি সেই ক্লাবের কাজ কি হবে? নানা নতুন ইনভেটিভ প্রস্তাব আসে। তার মধ্যে একটা ছিল সাইকেলে পরিবেশের ও সমাজের নানা বিষয়ে প্রচার ও কথা বলা। আসে বিকেলের পরিবেশ আড্ডার কথা, আসে পরিবেশ কে মূল বিষয় করে ক্লাবের সারা বছরের এমন নানা কর্মসূচীর পরিকল্পনা। এই ভাবনা মুলত ছিল বছর ১৪-১৫ এর ছাত্র দের মধ্যে। আরেকটু ছোটো, ১২-১৩ এর মধ্যে গাছ লাগানোর ও তার দেখভালের ভাললাগা কে আবার পাওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয়েছিল কেবল।
এই যে সমস্ত ছাত্র দের কথা বলছি ১২-১৫ এরা কেউই ‘পড়াশোনায় ভালো না’। একটা সময় অবধি ডিফল্টার হয়েও ক্লাসে উঠে যায় এবং তার পর ও একই ভাবে মাধ্যমিক অবধি যাবে যদি সম্ভব হয়। অনেকেই মাধ্যমিকের পর ইস্কুল ছাড়বে, বেশির ভাগই উচ্চমাধ্যমিকের পর কাজের খোঁজে হয় জরি অথবা শিল্পাঞ্চলের দৈনিক চুক্তি শ্রমিক হয়ে উঠবে। এদের যা কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবনী ভাবনা, জীবনী শক্তি সে হারিয়ে যাবে খুব দ্রুত। তাই নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যতটা সম্ভব আশু হারিয়ে যাওয়ার সময়টা অন্তত দির্ঘায়িত করা যায় সে চেষ্টা আছে গোড়া থেকেই। তাই অন্তত যেন ডিফল্টার না হয়, সেই ছুতোয় বাড়িথেকে যেন পড়া ছাড়িয়ে দিতে না পারে, নিযের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস এর অভাব না হয় তার জন্য খানিক বই মুখী করার ইচ্ছে থেকে ওদের সাথে এক প্রকার চুক্তিই হয় যে অন্তত রোজকার পড়া মনদিয়ে শুনলে, ক্লাস নোট নিলে সারা বছর আমরা তিন ঋতুতে তিনটে উৎসব করব সবাই মিলে। শীতে সাইকেল র্যালী, পিকনিক ও নাটক দেখা। গ্রীষ্মে নাটক করা। বর্ষায় গাছ লাগানো ও সিনেমা দেখা।
এই শিডিউলের প্রথম টা অনুষ্ঠিত হয় ২৩ জানুয়ারি। ছুটির দিন, আমরা সবাই রানিহাটি খেলাঘর এর সামনে জড় হই সকাল ৭.৩০ টায়। খেলাঘরে অর্ডার দিয়ে ওরাই একটা টুপির বন্দবস্ত করেছিলো সবার জন্য, তাতে লেখা – প্রকৃতিবাদী সমিতি, সাথে একটা ছবি- গাছের নিচে সাইকেল দাঁড়িয়ে। বেশ কিছু পোস্টার লিখেছিল ওরা , সাঁটীয়ে নিয়েছিলো সাইকেলের সামনে , যেমন- যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেললে আমার খারাপ লাগে আমরা এর বদল চাই, প্লাস্টিক ব্যবহার করলে আমার খারাপ লাগে , আমরা এর বদল চাই, জোরে সাউন্ড বক্স বাজলে আমার খারাপ লাগে , আমরা এর বদল চাই, মদ খেয়ে বাড়িতে অশান্তি করলে আমার খারাপ লাগে, আমরা এর বদল চাই, এরকম আরও কিছু।
টুপি আর অল্প কিছু সকালের খাবার ভাগ করে নিয়ে আমাদের ৫৫ টি সাইকেল বেরিয়ে পড়ে। রানিহাটি থেকে জয়নগর বাজার টপকে গঙ্গাধরপুর কলেজের দিকে, গঙ্গাধরপুর কলেজের সামনে প্রথম রেস্ট হয় পরিবেশ বিষয়ে কিছু কথা চলে আমাদের মধ্যে, পথচারি দের সঙ্গে আলাপ ও কথা হয়। এর পর কালিতলা হয়ে দেউলপুর। দেউল্পুরে তখন একটি ক্লাবের নেতাজী বরণ চলছে, সে ক্লাব ছোটদের এমন উদ্যোগ দেখে এগিয়ে আসে, ক্লাবের সদস্য দের সঙ্গে দির্ঘক্ষন ছোটরা কথা বলে। দেউল্পুর থেকে দেওয়ানঘাটা হয়ে পানিহিজলির রাস্তা ধরে সন্ধিপুর সুলাটি গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমাদের সাথে আরও কিছু পড়ুয়া যোগ দেয়। এরপর র্যা্লি আবার রানিহাটির ওপর দিয়ে হাঁকোলা বাজার হয়ে ধামসিয়া দিয়ে আমার বাড়ি কুলাই তে পৌঁছয়। তখন বেলা প্রায় ১২টা। এখানে আগেই আমার প্রাক্তন ছাত্ররা সকলের জন্য দুপুরের খাবার রান্না করে রেখেছিল। খাওয়া দাওয়া রেস্ট এর পর র্যালি ৩ টের সময় কুলাই থেকে এসে পৌঁছয় পাঁচলায়।
পাঁচলায় পরশ নাটক দলের ‘আমার কোন দেশ নাই’ নাটকটি অভিনীত হয়। পরশের কুশীলবরা সকলেই ছোটো, ১২-১৫-র মধ্যে। পার্থ দার এই উদ্যোগ টির মতো করে যদি আমার ছোটো গুলোর সঙ্গে গড়ে তুলতে পারি, এমন একটা ভাবনা আছে। নাটক দেখে ৩০ কিমি-র র্যালি হাকোলা বাজার ধরে আবার খেলা ঘরের সামনে শেষ হয় বিকেল ৫ টা নাগাদ।
পিয়ালি says
এই ছোট্ট ছোট্ট প্রাণগুলি নিজেদের কিছু সাধারন পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রকৃতিতে কি প্রাণের সঞ্চার করল! হায় দেশের শিক্ষাব্যাবস্থা, এদের আমরা recognise বা identify করতে পারিনা।