অরূপ রায়চৌধুরী। দমদম। ১০ জানুয়ারি, ২০২১।#
দশটা বেজে গিয়েছিল সরবেড়িয়া পৌঁছাতে। সাথে পূর্ণেন্দুদা। শ্রমজীবী হাসপাতালের দস্তুর মেনে প্রথমেই জল খাবার – গরম রুটি, তরকারি আর পরিবেশনকারীর শাসন পেট ভরে খেতে হল। আমরা ট্রলি টাইমস পত্রিকার প্রথম সংখ্যা নিয়ে গিয়েছিলাম সরবেড়িয়া শ্রমজীবী হাসপাতাল এবং আশেপাশের চাষিদের জন্য। ইচ্ছে ছিল যদি কিছু কথাবার্তার আদানপ্রদান করা যায়, কিছু শোনা যায় এলাকার চাষিদের কথা। সংলগ্ন বাগানে পেল্লাই সাইজের ফুলকপি ফলেছে, বক ফুল, ডাগর ডাগর গাজর গাছ, লাল শাক। শ্রমজীবীর একজন সদস্য কোদাল হাতে পরিচর্যা করছেন। গন্ধে মালুম হল সদ্য খোল আর গোবর সার পড়েছে। জিগ্যেস করতে হাসলেন, বললেন – পুরো অর্গানিক কিন্তু। কপির সাইজ দেখেছেন? অরুনদার হাঁকডাকে গুটিগুটি জনা পনেরো কুড়ি মানুষ জড়ো হলেন হলঘরে। কেউ নির্মীয়মান নতুন ঘরটার জন্য কাজ করছিলেন, কেউ বাগান থেকে, কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী, কেউ বা ফার্মেসি থেকে। শুধু ডাক্তারবাবু আসতে পারেননি। আউটডোরে রুগী দেখছিলেন। কথা শুরু করলেন অরুনদা। প্রথমেই বোঝা গেল যে এই অঞ্চলের শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের কাছে নতুন কৃষি আইন ও তার প্রতিবাদে উত্তর ভারত জুড়ে গত দেড় মাস ব্যাপী কৃষকদের আন্দোলন, অবরোধ, যাত্রা ও ৬০ জনের শহীদ হওয়ার কোনো খবরই পৌঁছায়নি। তাই খানিকটা বলতে হল সেই সব কথা। অরুনদা ও মাস্টারমশাই খেই ধরলেন। মজুতদারি, নীল চাষ, দুর্ভিক্ষ, ন্যূনতম দাম, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, শব্দগুলো নানা প্রতিশব্দ সমেত ঘুরে ফিরে এল আলোচনায়। চুক্তি চাষের কথা উঠতে জানা গেল গত বছর এলাকার কয়েকজন চুক্তিতে মুরগির চাষ করে কীরকম ফেঁসেছেন। কোম্পানি মুরগির বরাত দিয়ে যায়। মুরগির লালন পালন শুরু হলে মাঝপথে মরে যায় কয়েকটা। কখনো মড়ক লাগে। কোম্পানির লোক মুরগি নেওয়ার সময় ওজন করে দাম দেয়। মরা মুরগির জন্য পয়সা নেই। চাষির লাভের ধন পিঁপড়েয় খায়। জানা গেল সারের ব্যবহারে কীভাবে জমির উর্বরতায় ভাটার টান। সরকারি বাবুরা এসে মিটিং, সেমিনার করেছেন। জৈব সার ব্যবহার করতে বলেন। আর সব শেষে বলেন যে ফলন তো ভালো করতে হবে। একটু আধটু রাসায়নিকও ব্যবহার করো। অর্থাৎ রাসায়নিক ছাড়া কিন্তু গতি নেই। অনেকটা অশ্বথামা হত, ইতি গজ টাইপের। চেপে ধরলে সেই সব কৃষি সচিব, কৃষি বিজ্ঞানীরা তুতলে যান। কিন্তু চেপে আর ধরে কে? অথচ জৈব সার দিয়ে সম পরিমাণ শস্যের গল্প শুনলাম গল্পের ছলে। রবি মরসুমে কোন পুরনো বীজধান ব্যবহারে উপকার পাওয়া গেছে। কথায় কথায় কথা বাড়ে। হারিয়ে যাচ্ছে বীজতলা। চাষি আর বীজ জমিয়ে রাখেনা। দোকানে যায় বীজ কিনতে। সেখানে অনেক ফলন, অনেক লাভের হাতছানি। সেই বীজের চরিত্রের হদিস জানা নেই কৃষকের। বীজ কোম্পানি, সার কোম্পানি, কীটনাশক কোম্পানির মাতব্বরির খপ্পরে পড়ে জগদ্দলের ওজন বাড়ে চাষির ঘাড়ে। এবারে বাজারে আলুর দাম উঠেছিল কেজি প্রতি চল্লিশ পঞ্চাশ। অথচ চাষি পায় পাঁচ বা ছয় টাকা। জানা গেল এই সব। চাষির ছেলে কেন চাষি হতে চায় না, তার হিসেব নিকেশ খুঁটিনাটি। কথায় কথায় মিলে যায় কৃষি আইন, কর্পোরেট-থাবার বইয়ের তত্ত্ব। চলমান আন্দোলনের কথা ওঠে। সেইসব বীরগাথার কথায় চোখগুলো একটু যেন চকচক করে। এমনটা হওয়া দরকার, এখানেও দরকার, কিন্তু কীভাবে – তার ঠিক হদিস নেই কারো কাছে। তবু ট্রলি টাইমসের ছোট ছোট গল্পগুলো আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে গেলে একটু বেশি আলো যেন ভরে যায় ঘরে। যারা ছিলেন প্রত্যেকেই মনে হল বাংলা পড়তে পারেন। হাতে হাতে বিলি হয়ে গেল পত্রিকা। কথা দিতে হল পরের সংখ্যা নিয়ে আবার আসতে হবে, দুপুর দুটোর পরে আলোচনায় বসলে আরো অনেকে, বিশেষত চাষের সাথে যুক্ত আরো মানুষ থাকতে পারবেন আলোচনায়। হয়তো আরো কিছু নতুন কথা শোনা যাবে তখন।
Leave a Reply