নিত্যানন্দ জয়রামন, ১৮ নভেম্বর, মূল প্রবন্ধ স্ক্রোল ডট ইন-এ ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে। বাংলা অনুবাদ শমীক সরকার#
মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা বলেছেন, কী আর করা যাবে, এত বৃষ্টি হলে কিছু করার নেই। এখন দ্রুত উদ্ধার ও ত্রাণকার্য করাই ভালো প্রশাসনের নিদর্শন।
প্রতিটি বর্ষায় যখন শহরগুলি জলমগ্ন হয়ে যায়, তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে দোষ দেওয়া হয় অতিবৃষ্টিকে। উন্নয়ন থেকে বিপর্যয়কে বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু চেন্নাই-তে অভূতপূর্ব বৃষ্টিপাত নতুন নয়। বঙ্গোপসাগর অভিমুখী ঢেউ-আছড়ে-পড়া সৈকত শহর হিসেবে চেন্নাইতে বৃষ্টিপাত বা সাইক্লোনিক ঝড় নতুন কিছু ব্যাপার নয়। প্রতি দশ বছরেই একবার করে হয় মোটামুটি। ১৯৬৯, ১৯৭৬, ১৯৮৫, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ২০০৫, ২০১৫।
বাস্তবত, গত সপ্তাহে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে — ২৩৫ মিমি, তা খুব একটা বড়ো কিছু নয়। নুঙ্গমবক্কম বৃষ্টিমাপকের রেকর্ডে ২০০৫ সালের ২৭ অক্টোবর রেকর্ড করেছিল ২৭০ মিমি। ১৯৬৯ সালে ২৮০ মিমি। ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে ৪৫০ মিমি।
১৯৭৬ সালে আদিয়ার নদী ছাপিয়ে বন্যা হয়েছিল। একতলা বাড়ি সব ডুবে গেছিল। কিন্তু তখন তো চেন্নাই একটা বড়ো গ্রাম ছিল বলা যায়। যে বড়ো শহর হয়ে উঠতে চাইছে।
আজ চেন্নাইতে অনেক বড়ো বড়ো পরিকাঠামো রয়েছে। বলা হচ্ছে, মেক ইন চেন্নাই। আদিয়ার নদীর বানভাসি এলাকায় নতুন এয়ারপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। বন্যাসঙ্কুল কয়ামবেডু-তে তৈরি হচ্ছে বাস টার্মিনাস। বাকিংহাম ক্যানেলের এবং পাল্লিকারানাই জলাভূমির একেবারে ওপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মাস র্যাপিড ট্র্যান্সিট সিস্টেম। বাইপাস এবং এক্সপ্রেসওয়ে বানানো হয়েছে কোনদিকে জল বয়ে যেতে পারে, তার কথা চিন্তা না করেই। একটা আইটি করিডর এবং একটি নলেজ করিডর তৈরি করা হয়েছে জলাশয়গুলি বুঁজিয়ে। গাড়ি, টেলিকম এবং আবাসন প্রকল্পগুলি তৈরি হয়েছে নিকাশির এলাকাগুলির ও জল বয়ে যাওয়ার জায়গার ওপর দিয়ে।
মেক ইন চেন্নাই আওয়াজের মধ্যেই চেন্নাই খসে পড়ছে আজ। বড়ো বাণিজ্যিক পরিকাঠামো প্রতিস্থাপিত করেছে বড়ো বিপর্যয় সয়ে নেওয়ার পরিকাঠামোগুলি।
তাই ২০১৫ চেন্নাই বিপর্যয় কেবল এড়ানোই যেত না, এটা তিলে তিলে তৈরি করা হয়েছে বড়ো পুঁজির পক্ষে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে দিয়ে, যাতে সায় দিয়েছে শহরের সমস্ত অতীত ও বর্তমানের মাথারা।
পাল্লিকারানাই জলাভূমির কথাই ধরা যাক। আড়াইশো বর্গ কিলোমিটার এলাকার জল বয়ে যেত এটাতে। চেন্নাই-এর দক্ষিণে এটা ছিল ৫০ বর্গ কিলোমিটারের একটি জলাভূমি। বেশি দিন আগের কথা নয়। কিন্তু এখন এটা ৪.৩ বর্গ কিলোমিটার মাত্র। মূলের এক দশমাংশও নয়। সেটুকুরও উত্তরে ময়লা জমে পাহাড় হয়ে আছে। জলাভূমির ওপর দিয়ে গেছে দুটো বড়ো বড়ো রাস্তা। যেগুলির মধ্যে রয়েছে কয়েকটি ছোট্ট ছোট্ট কালভার্ট, যার জল নিকাশি ক্ষমতা সামান্য। ধারের থকে খেয়ে নিচ্ছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ওসিয়ান টেকনোলজি। এই ইন্সটিটিউটটি আবার বিভিন্ন প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যাপারে এক বিশেষজ্ঞ, যার মধ্যে রয়েছে জলাভূমির ওপর নির্মাণের পরিবেশ গত প্রভাব-ও। ভাবা যায়!
এই জলাভূমিটির বাকি অংশটি বুঁজিয়ে তৈরি হয়েছে আইটি করিডর। কিন্তু সেখানে কাঁচের দেওয়ালের আড়ালে কাজ করা বুদ্ধিজীবীদের ছাড়েনি জল। ঢুকে পড়েছে, থমকে গেছে মার্কিন ব্যাঙ্কের সফটওয়ার মেইনটেনেন্সের কাজ।
চেন্নাই জুড়ে থাকা বড়ো বড়ো জলাশয়গুলি এখন কেবল আদ্যিকালের রেভেনিউ মানচিত্রেই দেখা যায়। ভ্যাসারপাড়ি নদীর ওপর ষোলোটি ট্যাঙ্ক ছিল। এখন একটাও নেই। আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কার্মেগাম এমনই বললেন। চার নম্বর জাতীয় সড়ক এবং পঁয়তাল্লিশ নম্বর জাতীয় সড়ক জোড়া দেওয়া চেন্নাই বাইপাস পূর্বাভিমুখী ঢাল রূদ্ধ করে দিয়েছে। তাই প্লাবিত হয়েছে আন্না নগর, পরুর, ভানাগারাম, মাদুরাভয়াল, মুগাপ্পাইর, এবং আম্বাতুর। মাদুরাভয়াল হ্রদটি আগে ছিল ১২০ একরের। এখন তা ২৫ একরের। একই কথা প্রযোজ্য আম্বাত্তুর, কদুনাগাইয়ুর, আদামবক্কম জলাধারগুলির ক্ষেত্রেও। কয়ামবেদু ড্রেইন এবং কোরাত্তুর থেকে আম্বাত্তুর জলাধার পর্যন্ত অতিরিক্ত চ্যানেলগুলি আর দেখা যায় না। আদামবক্কম থেকে পাল্লিকারানাই জলাধার সংযোগকারী ভিরাঙ্গল ওড়াই এর অংশগুলি উধাও। আদিয়ার প্রণালী থেকে কোভালাম প্রণালী অবধি দক্ষিণ বাকিংহাম ক্যানেল অনেক জায়গাতেই ২৫ মিটার চওড়া থেকে এসে দাঁড়িয়েছে ১০ মিটারে। কারণ, মাস র্যাপিড ট্র্যানজিট সিস্টেম রেল স্টেশন। ফলে কমেছে এগুলির জল নিষ্কাশনের ক্ষমতা। বন্যার সময় তা আটকানোর জন্য অতিরিক্ত জল ধারণে সক্ষম ভিরুগমবক্কম, পাডি, এবং ভিল্লিবক্কম জলাধারগুলি সরকারিভাবে পরিত্যক্ত হয়েছে।
চেন্নাই হারবার থেকে মাদুরোভয়াল অবধি বিস্তৃত উচ্চ এক্সপ্রেস ফ্রেইট করিডর কউম-এর দক্ষিণ পাড়ের অনেকটা জায়গা খেয়ে নিয়ে নদীটির জলধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এখন অবশ্য প্রকল্পটি দুই দ্রাবিড় পার্টির কোন্দলে বন্ধ আছে।
মজার কথা হলো, ২০১০ সালে চেন্নাই-এর সাম্ভাব্য বন্যা সম্পর্কে এক সেমিনারে এইসমস্ত কারণগুলিই দেখিয়েছিল এক সরকারি বাবু। কিন্তু কথাই সার, কাজ হয়নি। পরবর্তী মাস্টারপ্ল্যানে এনোরের জলাভূমি, জোয়ারের জল আসা এলাকা এবং ম্যানগ্রোভ অরণ্য অঞ্চলকে ‘বিশেষ এবং হ্যাজার্ডাস শিল্পের জন্য’ চিহ্নিত করে কামরাজার পোর্ট লিমিটেডের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে!
চেন্নাই মেট্রোপলিটন এলাকার একটি গ্রামাঞ্চল, পোন্নেরিতে ডেভেলপার রা আবাসন তৈরি করছে, নিকাশি ব্যবস্থা না করেই। গত সপ্তাহে পোন্নেরিতে ৩৭০ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে। চেন্নাই-এর থেকে ১৩৫ মিমি বেশি। বন্যা হয়েছে সেখানেও। কিন্তু প্রাণ বা সম্পদহানি ঘটেনি। পোন্নেরি স্মার্ট সিটি হতে চলেছে। কিন্তু আমাদের মাথামোটা ইঞ্জিনিয়াররা কি স্মার্ট শহর বানাতে পারবে?
Leave a Reply