মেটেবুরুজের হাটের খবর [২]
জিতেন নন্দী। মেটিয়াবুরুজ। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০।#
আজ গিয়েছিলাম মেটিয়াবুরুজের হাটে। তখন শেষ দুপুরের পর ভাঙা হাট। জনতা হাটে নিজামুদ্দিন মণ্ডলের স্টলের সামনে গিয়ে দেখি ওঁর মালপত্র গোছানো চলছে। পাশে সুরাজ নামে এক যুবকের স্টল। ওরা বসে রয়েছে খদ্দেরের আশায়। তার পাশের স্টলে একজন সামনে মাল খোলা রেখেই শুয়ে পড়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। ভোর চারটে থেকে হাটে ওস্তাগর আর খদ্দেরদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।
নিজামুদ্দিন বললেন, আজ বিক্রিবাটা তেমন নেই। বিহারের কাস্টমার এসেছিল। ওরা বাসে বাসে আসছে। আবার মাল নিয়ে বাসেই ফিরছে। লকডাউনের পর যেদিন থেকে হাট শুরু হল, এখনও আগের ৫০% কেনাবেচাও হচ্ছে না। কারও কারও তো বউনিটাও হয়নি। সুরাজের বউনিটুকু কোনোমতে হয়েছে।
নিজামুদ্দিনের বাড়ি মাকালহাটি ঠুঁটোর কলের কাছে। ভোরবেলায় ফজরের নামাজ পড়ে ভ্যানে মাল তুলে সকাল ছ-টার মধ্যেই হাটে চলে এসেছেন। এখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছেন হোটেলে। দিনের শেষে ক্লান্ত অবসন্ন, তবে মনে স্বস্তি নেই। বাচ্চাদের বাবাস্যুট ওপরে হ্যাঙারে তখনও ঝুলছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওগুলো ২৮০ টাকার মতো রেট। পাশেই সুরাজের স্টলে ঝুলছে মেয়েদের রঙিন ফ্রকগুলো। আমরা সামনের ফাঁকা স্টলটার চাতালে বসে কথা বলছিলাম। সামনে দিয়ে একজন হেঁকে হেঁকে যাছে, ‘লাট মাল হবে, লাট মাল’।
লাট মাল মানে আমার জানা ছিল, খারাপ হয়ে যাওয়া খুঁতো মাল বা জামাকাপড়। কিন্তু নিজামুদ্দিন বললেন, তা নয়। যে ডিজাইনগুলো আর চলে না, নতুন ডিজাইন বাজারে চলে আসে, তখন তৈরি মালগুলো লাটে বিক্রি করে দিতে হয়। একশো টাকার মাল চল্লিশ টাকায় বেচে দিতে হয়। প্রথম লকডাউনের চার মাস পর বেশ কিছু মাল লাটে বিক্রি করে দিতে হয়েছে নিজামুদ্দিনকে, সুরাজেরও তাই হয়েছে। তাতে ওদের মালের তৈরির খরচটাও ওঠেনি। ছেঁড়া-ফাটা-কাটা মাল লাটে চলে না। সুরাজ আগে অন্য ওস্তাগরের দলিজে কাজ করত। বছর দশেক হল নিজের কারবার চালু করেছে।
এই জনতা হাট বসে রবিবার। জব্বার হাট বসে শনি-রবি দুদিনই। গতকাল শনিবার নিজামুদ্দিনের ছেলে বসেছিল এবিএম হাটে। বউনিটাও হয়নি। জনতা হাটে নিজামুদ্দিন আর তিনজন ওস্তাগর মিলে একটা জায়গা ভাড়া নিয়েছে হাটের মালিকের কাছ থেকে। বছরে চারজন মিলে ছ-হাজার টাকা, তার ওপর মাসে বা হপ্তায় কিছু কিছু দিতে হয়। এখানে হাটে অনেকে স্টলভাড়া নিয়ে নিজে না বসে আবার অন্যকে ভাড়া দিয়ে দেয়। জনতা, জব্বার, ভিআইপি, মোতি, এবিএম, আরও কত শত হাট। এতগুলো হাটকে ঘিরে লক্ষাধিক মানুষের আনাগোনা এখানে। কত কিসিমের রোজগার, ধান্দা, হকারি। হাটের বাইরে রাস্তার দু-ধারে ভ্যানের ওপর মাল রেখেও বিক্রি হচ্ছে; কেউ অত ভিড়ের মধ্যেও চার-ছ ফুট জায়গা বার করে নিয়ে মাল বিছিয়ে দিয়েছে ফুটপাতের ওপর। এমনকী, সাইকেল, মোটরবাইকের ওপরও স্টল তৈরি হয়ে গেছে। নিজামুদ্দিন বললেন, ‘আপনি জানেন? চলুন আপনাকে দেখিয়ে আনি। এবিএম হাটের পাশে ডাস্টবিনের জঞ্জালের স্তূপের সামনেও মাল বেচাকেনা চলছে। আরে, লোকে পাঁচ-দশ হাজার যা পারে পুঁজি নিয়ে কারবারে নেমে যাচ্ছে। কী করবে?’
সত্যিই তাই। ভিড় ঠেলেঠুলে গিয়ে দেখি, দু-পাশে পাঁচিলে ঘেরা বড়ো গারবেজ-বিন। তার পিছনে জামাকাপড়ের ফেলে দেওয়া কার্ডবোর্ডের বাক্সগুলো সাজানো, সামনে স্তূপীকৃত আঁখের ছিবড়ে, আরও কত জঞ্জাল। তারই সামনে একটা সরু কাঠের বেঞ্চির ওপর মাল সাজিয়ে বিক্রি করছেন একজন। পিছনে আরও মালের বোঝা রয়েছে।
— আপনি কোথা থেকে আসছেন? এখানেই বাড়ি?
— না ডায়মণ্ডহারবারে।
— কীভাবে এলেন? ট্রেন তো চলছে না।
— একটা হাতি-গাড়িতে এসেছি।
— ক-টার সময়?
— ভোর সাড়ে তিনটেয় এখানে ঢুকেছি।
— আজ কেমন হল বিক্রি?
— মোটেই ভালো নয়। গত রবিবার তো একদম মার খেয়ে গেছি। তার আগে শুক্রবার লকডাউন ছিল।
— আসতে যেতে কীরকম খরচ হচ্ছে?
— একটা হাতি-গাড়িতে দশ-বারোজন আসে। দেড় হাজার টাকা গাড়ির ভাড়া। ফেরার সময়ও ওই।
— আপনি কি নিজে ওস্তাগর? নিজের ব্যাবসা?
— হ্যাঁ। আমি কাঁচা কাপড় এখান থেকে কিনে নিয়ে যাই। নিজেরাই ঘরে কাটিং করে, সেলাই করে এখানে এনে বিক্রি করি।
শুনলাম, সকালে নাকি ওই আঁখের ছিবড়ের স্তূপের ওপরও দোকান বসে গিয়েছিল। এবিএম হাটে সিকিউরিটির কাজ করছেন সালিমুল্লা। বজবজের চিংড়িপোতা থেকে সাইকেল চালিয়ে এসে ডিউটি। ডে আর নাইট পালটা ডিউটি, আটটা থেকে আটটা বারো ঘণ্টা। সলিমুল্লা আগে চিংড়িপোতাতেই নিজে ওস্তাগরি করতেন। কারিগর দিয়ে জিনসের প্যান্ট তৈরি করিয়ে নিয়ে হাওড়ায় মঙ্গলাহাটে বসতেন। এখন সেটা বন্ধ। অগত্যা সিকিউরিটির কাজ জুটেছে।
নিজামুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলাম, অনলাইনে তো শুনলাম ভালোই কারবার চলছে। ফেসবুকে ওস্তাগররা নিজেদের পেজ তৈরি করে হোয়াট্স অ্যাপের মাধ্যমে মালের ছবি দিয়ে কেনাবেচা করছে। নিজামুদ্দিন বললেন, ‘না। ওখানেও অবস্থা তেমন নয়। আমি আমার এক বন্ধুকে ধরে মাসখানেক আগে আমার মালের ছবি ওখানে দিয়েছিলাম। আজ পর্যন্ত একটাও অর্ডার পাইনি। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দর্জি-কারিগরদের। সংসার চালাতে না পেরে নিজের সেলাইয়ের মেশিনটা পর্যন্ত কেউ কেউ বেচে দিয়েছে। কেউ বউয়ের গয়না বন্ধক দিয়ে খাচ্ছে। যে যেভাবে পারছে যে কোনো কাজে চলে যাচ্ছে। আমার দলিজে বসিরহাটের কারিগর ছিল, সে চাষের কাজে চলে গেছে। কী করব? মালের বিক্রিবাটা নেই, আমিও তো কাজ দিতে পারছি না।’
— মঙ্গলাহাটের ব্যাপারটা কী বলুন তো?
— শনিবারে রাতে মঙ্গলাহাট চালু করলে এখানকার হাট খুব মার খেয়ে যাবে। একই দিনে মেটিয়াবুরুজ আর হাওড়া দু-জায়গায় হাট বসলে খদ্দের তো দু-জায়গায় যাবে না। এখন কাস্টমাররা অত ঘুরতে চাইছে না, কোনোরকমে কেনাকাটা সারছে। মঙ্গলাহাট মঙ্গলবারেই চালু রাখতে হবে। এছাড়া হরিশাহহাট, বাঁকড়াহাট, আরও কত নতুন হাট হয়েছে বলুন তো। মার্কেটটা কই?
Leave a Reply