শমীক সরকার, ৪ মে#
২ মে সোমবার অরুনাচল প্রদেশের তাওয়াং-এ পুলিশের গুলিতে দুই প্রতিবাদী যুবকের মৃত্যু হয়েছে। একজনের নাম নিমা ওয়াংদি (২১), আরেকজন সেরিং টেম্পা (৩১)। নিমা ওয়াংদি তাওয়াং গুম্ফার একজন সন্ন্যাসী। এনাকে দু-বার গুলি করা হয়। সেরিং টেম্পা জাংদা গ্রামের যুবক, সদ্য বিবাহিত। একে গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। দু-জনেই ঘটনাস্থলে মারা যায়। আহত জনা দশেক। অরুনাচল প্রদেশে বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধী একজন জননেতাকে পুলিশি হেফাজত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ স্টেশনে প্রায় দেড় হাজার মানুষ জড়ো হলে সেখানে পুলিশ গুলি চালায়।
অরুনাচল প্রদেশের মন এলাকায় পাহাড়ি নদীগুলির ওপর বাঁধ দিয়ে ভারত সরকারের তরফে বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করার চেষ্টা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। তা আটকাতে স্থানীয় মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে ‘সেভ মন রিজিওন ফাউন্ডেশন’ বা ‘মন এলাকা বাঁচাও ফাউন্ডেশন’। এই সংগঠনের সেক্রেটারি একজন লামা লোবসাং গিয়াৎসো। লোবসাং গিয়াৎসো-কে গত সপ্তাহে দু-বার গ্রেপ্তার করা হয়।
গত ৭ এপ্রিল ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনাল (পরিবেশ বিষয়ক ভারতের সর্বোচ্চ আদালত) জেমিথাং-এর নিয়ামজাং ছু বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প (৭৮০ মেগাওয়াটের)-র পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল করে দেয়। এনজিটি-তে এই আবেদন করেছিল লোবসাং গিয়াৎসোর নেতৃত্বাধীন ‘মন এলাকা বাঁচাও ফাউন্ডেশন’। তাওয়াং তথা অরুনাচল প্রদেশ তথা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে ধ্বংস করে বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বানানোর কর্পোরেট ও কেন্দ্রীয় সরকারী পরিকল্পনার ওপর বড়ো আঘাত। তাদের স্থানীয় এজেন্টদের কাছেও ধাক্কা। একই সাথে বাঁধ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের বড়ো জয়।
মঙ্গলবার ২৬ এপ্রিল গিয়াৎসোকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয় গংখার গ্রামে ৬ মেগাওয়াটের ‘মুক্ত শাকাংচু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’র বিরুদ্ধে একটি মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। এই ছোটো প্রকল্পের বাঁধ থেকে জল উপচে পড়লে তা নদীতে ফেলে দেওয়ার জন্য যে ‘স্পিলওয়ে’ তা পুনর্গঠন করার কাজে বাধা দিচ্ছিল গ্রামবাসীরা। এই স্পিলওয়েটি খারাপ মালমশলা দিয়ে বানানো হচ্ছিল বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। স্থানীয় এমএলএ পেমা খান্দুর অভিযোগের ভিত্তিতে এই গ্রেপ্তারি হয়, অবশ্য পরে গিয়াৎসো জামিন পান।
প্রথমবার গ্রেপ্তারের পর ছাড়া হলেও, দ্বিতীয়বার তিনি গ্রেপ্তার হন বৃহস্পতিবার ২৮ এপ্রিল। তাওয়াং গুম্ফার প্রধান সন্ন্যাসী গুরু রিনপোচের জাতিসত্ত্বা নিয়ে কথা বলে ধর্মীয় ভাবাবেগ-এ আঘাত করেছে গিয়াৎসো, এই অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছিল?
অরুনাচল টাইমসের একটি রিপোর্ট মোতাবেক, প্রথমবার গিয়াৎসোকে গ্রেপ্তার করার পর গিয়াৎসোর অনুগামী, যা কি না সংখ্যায় অনেক, তারা চটে ছিল। সেই উত্তেজনা প্রশমন করার পরিবর্তে প্রশাসন জেলা পরিষদের একটি মিটিং-এর অনুমতি দেয় ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার। জেলা পরিষদ মিটিং-এ উন্নয়নমূলক বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু সেটাকে গিয়াৎসো বিরোধী মিটিং-এ বদলে দেওয়া হয়। মিটিং-এ একটি অডিও টেপ চালানো হয়, যাতে শোনা যায়, গিয়াৎসো তাওয়াং গুম্ফার প্রধান রিনপোচেকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, রিনপোচে তাওয়াং-এর মানুষ নন। তিনি যেন এখানকার প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে না ঢোকেন। এটা শোনানোর পর জেলা পরিষদ মিটিং-এর চেয়ারম্যান মিটিং-এ উপস্থিত সবাইকে উত্তেজিত করতে থাকে একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য। এবং মিটিং এর পরিণতিতেই লামা লোবসাং গিয়াৎসোর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়।
বৃহস্পতিবারে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলেও শুক্রবারেও তিনি জামিন পাননি। ২৯ এপ্রিল শুক্রবার সকাল এগারোটায় জামিনের আবেদন জানানো হলেও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছুটিতে থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন এক ম্যাজিস্ট্রেট রাত সাড়ে আটটায় জামিনের আবেদনের শুনানি শুরু করেন এবং তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের রিপোর্ট অসম্পূর্ণ থাকায় গিয়াৎসোর জামিন হয়নি। ২ মে সোমবার শুনানি ফের শুরু হলেও ওই ম্যাজিস্ট্রেট বুধবার ৪ মে অবধি শুনানি স্থগিত রাখেন। তদন্তকারী পুলিশ অফিসার গিয়াৎসোর ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজত চান। এসব ঘটনা যখন ঘটছে, তখন বাইরে গিয়াৎসোর হাজার সমর্থক। যে রাস্তা দিয়ে গিয়াৎসোকে আদালতে নিয়ে আসা হয়েছিল, অন্য রাস্তা দিয়ে তাকে থানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। এতে আরো চটে যায় লোকে। তখনই শুরু হয় জনতার মারমুখী প্রতিবাদ। পুলিশ গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি চালায়।
সোমবার বিকেলে মারমুখী প্রতিবাদ ও তাতে পুলিশের গুলির পরে গিয়াৎসো-কে মুক্তি দেয় প্রশাসন। তবে মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপাল, কেউই এই গুলি চালনার নিন্দা করেনি।
বিখ্যাত তাওয়াং গুম্ফার জন্য একটি বিশাল ফান্ডের ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। এদিকে তাওয়াং গুম্ফার প্রধান সন্ন্যাসী গুরু তুল্কু রিনপোচে দলাই লামার মনোনীত। এবং তাওয়াং এলাকার মানুষের খুব শ্রদ্ধেয়। অভিযোগ, যেহেতু সরকার ফান্ডের ব্যবস্থা করেছে, তাই তাওয়াং গুম্ফার প্রধান সন্ন্যাসীকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সমর্থনে ব্যবহার করতে চাইছে রাজ্য সরকার।
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের আরেক শরিক, ‘ফোরাম ফর সিয়াং ডায়ালগ’-এর বিজয় তারাম এই ঘটনার নিন্দা করেছেন। বলেছেন, তাওয়াং-এর মতো বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সংবেদনশীল একটি জায়গায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক নেতার মুক্তির দাবিতে জমায়েত করছিল মানুষ। সেখানে এই পুলিশি বলপ্রয়োগ।
Jiten Nandi says
আমি (এবং আমার স্ত্রী অমিতা) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন তাওয়াঙে গিয়েছিলাম, আমাদের সঙ্গে লোবসাঙ গিয়াৎসোর দেখা হয়েছিল। ড্যাম বিরোধী আন্দোলন নিয়ে জানার উদ্দেশ্যে আমরা ওঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছিলাম। একটা দোকানে গিয়ে একজনকে গিয়াৎসোর কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি আমাদের গিয়াৎসোর পরিচিত একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ঠিক সেই সময়ই রাস্তা দিয়ে গিয়াৎসো আসছিলেন, ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। দু-একটা কথা বলার পর আমরা ওঁর সঙ্গে বিশদে কথা বলব বলে সন্ধ্যায় দেখা করব স্থির হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আসতে পারেননি। কোনো গ্রামে মিটিং করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন। তাওয়াঙে ওঁকে লোকে বলে আন্না লামা। আন্না হাজারের আন্দোলনের একটা প্রভাব ছিল সেই সময়। তাওয়াঙের অধিকাংশ মানুষই ড্যাম বিরোধী আন্দোলন সম্বন্ধে কমবেশি ওয়াকিবহাল। ২০১৩ সালে ওখানে তৈরি হয়েছিল ‘সেভ মন রিজিয়ন ফেডারেশন’। মন রিজিয়ন হল অরুণাচলের মনপা সমাজের মানুষের বসবাসের এলাকা। এদের দীর্ঘকাল ধরে স্বশাসনের জন্য একটা সামাজিক আন্দোলন ছিল। যদিও মনপা ছাড়াও ওখানে আরও সাতটা ট্রাইবের কথা শুনেছি। বড়ো ড্যামের বিপদটা মন-এলাকার মানুষকে দলীয়তার বাইরে এনে একতাবদ্ধ করেছে। তাওয়াঙে স্থানীয় মানুষের কাছে আমরা জানতে পারি, এখানে বেশ কিছু ছোটো ড্যাম ছিল। সেগুলোর অধিকাংশ অকেজো হয়ে রয়েছে। জল আর বিদ্যুতের বেহাল অবস্থা এখানে। সন্ধ্যাবেলা টিমটিম করে আলো, লোডশেডিংও হয়। পাহাড়ে জলের অন্যতম উৎস হল অসংখ্য উষ্ণ প্রস্রবণ। সেই জল যেমন উষ্ণ-গরম, তেমনি তা পানের উপযোগীও বটে। সাধারণ গরিব মানুষের বোতলের জল কিনে খাওয়ার ক্ষমতা নেই। বড়ো ড্যাম করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটানো হচ্ছে। তাতে পাহাড় ধসপ্রবণ হয়ে উঠছে আর ওই উষ্ণ প্রস্রবণগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নতুন বড়ো ড্যামের যে প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে, প্রাইভেট কোম্পানিগুলো সেই বিদ্যুৎ বাইরে বিক্রি করে। যেমন, গিয়াৎসো বলেছেন, ভিলওয়ারা এনার্জি লিমিটেড যে বিদ্যুৎ তৈরি করছে, সেই বিদ্যুৎ তারা নিয়ে যাবে রাজস্থানের ভিলওয়ারা টেক্সটাইল ফ্যাকট্রিগুলোতে। নতুন বড়ো ড্যামের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। মনপাদের জমির ওপর এক ধরনের সমাজগত অধিকার আছে, অন্য কোনো জাতের মানুষ সেই জমি কেনাবেচা করতে পারে না। আমরা তাওয়াঙে বাঙালি ব্যবসায়ীও পেয়েছি। তাদের নিজস্ব জমি নেই। এই পাহাড়ি জেলার অর্ধেক জমি মিলিটারি আর সরকারি প্রশাসনের জন্য চলে গেছে। ফলে মনপা এবং স্থানীয়দের মধ্যে একটা বিপন্নতা বোধ বেড়ে উঠেছে। পাহাড়ের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার প্রশ্নটাও রয়েছে। সর্বত্র রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। কারণ ইদানীং গাড়ির সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। সরকারি কর্মচারীদের গাড়ির জন্য ঢালাও ঋণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ফলে সাধারণ আয়ের সরকারি কর্মচারীরা গাড়ি, মোটরবাইক কিনে নিয়েছে। বড়ো ড্যাম, রাস্তা অতিরিক্ত চওড়া করার প্রকল্প এবং পাহাড় ফাটিয়ে পাথর বোঝাই করে ব্যবসা তাওয়াঙে যাওয়ার পথে চাক্ষুষ দেখেছি। কোম্পানিগুলো ড্যাম তৈরির জন্য সমস্ত দলের নেতাদের টাকা খাইয়েছে। তাই দলীয়তার বাইরে গিয়ে মনপা সমাজ পাহাড়কে বাঁচাতে উদ্যোগী হয়েছে।
এই গুলি চালনার ঘটনা শুনে আন্দাজ করতে পারছি, পাহাড় কতখানি বিপন্ন, পাহাড়ি সমাজও কতখানি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সেই চঞ্চলতাকে স্তব্ধ করতে নেমে এসেছে দমন।
Jiten Nandi says
আমরা অরুণাচল প্রদেশে গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে, ২০১৪ সালে নয়। আর ‘সেভ মন রিজিয়ন ফেডারেশন’ তৈরি হয় তার এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে।
ড্যাম বিরোধী আন্দোলন অহিংস উপায়ে (অনশন) করতে গিয়ে লোবসাং গিয়াৎসো তাওয়াং-এর সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন ‘আন্না লামা’।স্থানীয় মানুষ তাঁর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। বড়ো ড্যাম প্রজেক্টের মালিকেরা দলমত-নির্বিশেষে সমস্ত নেতাদের টাকা খাইয়ে দেয়, কিন্তু লোবসাং-কে তারা ওপথে জব্দ করতে পারেনি। আন্দোলনকারী মানুষের সামনে নাকি তিনি গুম্ফায় গিয়ে কসম খেয়েছেন, আন্দোলনের প্রতি বেইমানি করবেন না।
অমিতা
০৫.০৫.১৬