পুষ্পল ঘোষ। শান্তিপুর। ৫ নভেম্বর, ২০২০।#
শরতের শুরুতে মাথা নুইয়ে পড়া দুধসাদা কাশবনে হঠাৎই চোখে পড়লো ছোট্ট একটা লাল টুকটুকে পাখি আপন মনে ডেকে চলেছে। অপূর্ব তার সৌন্দর্য। ভালো করে দেখার জন্য এক পা এগোতেই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল ঝোপের মধ্যে। গলায় ঝোলানো ক্যামেরাতে হাত দেওয়ার সময় পেলাম না। ছবি তোলা তো দূর অস্ত। এই অপূর্ব সুন্দর পাখিটির ছবি ইন্টারনেটে অনেক দেখেছি। সেই থেকেই ইচ্ছে ছিল পাখিটিকে ক্যামেরাবন্দী করা। আচমকা সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঠিক হাতছাড়া বলব না, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই আবার দেখতে পাব, প্রায় ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে দেওয়ার পরও কিছু দেখতে পেলাম না। বিষন্ন মনে ফিরে এলাম, ঠিক করলাম আবার আসব। পরের দুদিনও হতাশা নিয়ে ফিরলাম। অবশেষে তৃতীয় দিনে আমি তাকে ফ্রেমবন্দী করতে পারলাম। সেই ছবি কথাই আজকে সংবাদমন্থনের পাতায়।
ছোট্ট সুন্দর এই পাখিটি লালমুনিয়া। আমাদের দেশে দেখতে পাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির মুনিয়া পাখির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও অপেক্ষাকৃত বিরল প্রজাতির পাখি লালমুনিয়া। ইংরেজি নাম Red Avadavat, Red munia বা Strawberry Finch। বৈজ্ঞানিক নাম Amandava Amandava। অন্য প্রজাতির মুনিয়ার দেখা মিললেও এই বিরল প্রজাতির পাখিটিকে প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় দেখতে পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। এরা সংখ্যায় অন্যদের তুলনায় অনেক কম। নিরীহ, ভীত ও চতুর এই পাখিটি সাধারণত ঝোপের মধ্যে থাকতে বেশি পছন্দ করে। সাধারণত জলাজমির পাশে ঘাসবন, আশেপাশের ঝোপঝাড় কাশবনে এদের দেখা যায়। দৈর্ঘ্য খুব কম। ১০ সেন্টিমিটার। আর ওজন মাত্র ৯ গ্রাম। প্রজননকালে পুরুষ পাখিটিকে দেখতে হয় চোখধাঁধানো সুন্দর। তখন পুরুষ পাখিটির গায়ের রঙ থাকে টকটকে লাল। তবে চোখের পাশে, তলপেট ও লেজের প্রান্তভাগ কালো। সারা শরীরে বিশেষ করে বুক, ডানা ও পার্শ্বদেশে সাদা ফোঁটা থাকায় একে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগে। তবে মেয়ে পাখিটি পুরুষটির চেয়ে কম সুন্দরী। এদের মাথা, পিঠ ও ডানার উপরটা বাদামি। চোখ এবং ঠোঁট লাল। পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। তবুও পক্ষীপ্রেমীদের কাছে স্ত্রী পুরুষ উভয়ই খুব আকর্ষণীয়।
এই বিরল আবাসিক পাখিটির সংখ্যা বর্তমানে ক্রমশ কমছে। জলাশয়ের পাশে ঘাসজমির অভাব, পতিত জমি কমে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে এদের আবাসস্থল আজ সংকটে। ফলে আমরা হারিয়ে ফেলতে চলেছি প্রকৃতির এই সৃষ্টিগুলিকে। বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন পাখির অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, লালমুনিয়াও এর ব্যতিক্রমী নয়। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ নিজের ভোগ বিলাসিতার জন্য প্রকৃতির উপর যে নির্মম আঘাত হানছে তাতে যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, সঙ্গে বন্যপ্রাণী, পক্ষীকুলের অস্তিত্ব রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। যদি দ্রুত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা না হয় তাহলে একদিন হয়তো আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলবো এদেরকে যা খুবই দুঃখের এবং বেদনার, প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষের কাছে।
Leave a Reply