কলকাতা সাইকেল সমাজের আহ্বায়ক রঘু জানা, ২১ ফেব্রুয়ারি#
আগের রাতে ২ টা পর্যন্ত সাইকেল র্যালির জন্য প্ল্যাকার্ড তৈরি করে ঘুমোতে গেলাম। হাল্কা ঘুমে কয়েক ঘন্টা গেল। সকাল ৬-৩০, তৈরি হয়ে বেরোচ্ছি, সৌমিকের ফোন। প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌমিক সাইকেল র্যালিতে যোগ দেবে কিন্তু ওর সাইকেল নেই। ওকে একটা সাইকেল জোগাড় করে দেবো বলেছিলাম। পাঠালাম হেদুয়ায়, তুষারদা ওর জন্য একটা সাইকেল ব্যবস্থা করে দিলেন।
ক্লাবে পৌঁছে দেখি রাসবিহারী থেকে কিষানলাল গাঙ্গুলী এসে গেছেন। ওনার বয়স ষাট। সঙ্গে একশ’ বছরের পুরনো সাইকেল। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। ওনাকে বড়ো রাস্তায় সাইকেল চালানোর জন্য বেশ কয়েকটা থানা জরিমানা করেছিল। থানার স্ট্যাম্প মারা সেই কাগজ সাঁটা আর নিজের লেখা সাইকেল কমিবা নিয়ে একখানা প্ল্যাকার্ড ওনার সাইকেলে বাঁধা।
এসে পড়ল দীপ, খিদিরপুর থেকে। সঙ্গে চারজন সাইক্লিস্ট বন্ধু। এবার এল এইবারের র্যালির সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্র সাড়ে আট বছরের শঙ্খদীপ। ক্লাস থ্রির ছাত্র। বাবার সাইকেলের সাথে নিজের ছোটো সাইকেলটিও ট্যাক্সিতে চাপিয়ে নিয়ে এসেছে। ওর বাবা সম্রাট ঘোষ বেহালা থেকে রোজ সাইকেলে চেপে ফোর্ট উইলিয়ামে অফিস করেন। শঙ্খদীপ সারা র্যালিতে কেতা করে সাইকেল চালিয়েছে। বড়োরা ওকে নিয়ে তটস্থ। ট্রাম লাইন, বাস রাস্তা কোনো ভয়ডর নেই ওর। একহাতে লিফলেট পর্যন্ত বিলি করেছে। ওই গরমে দুপুর ২টা বেজে গেছে। র্যালি শেষে বড়োরা ক্লান্ত। ছোটো ছেলেটি কিন্তু মধ্যাহ্ন ভোজনে খাবার টেবিলে সবার পাতে নুন, লেবুজল দিয়েছে।
বাগমারি থেকে দশ বছরের ছেলে অক্ষয়কে নিয়ে এসেছিলেন তার বাবা নারায়ণ দত্ত। সাইকেলে চাপিয়ে। মাঝে কিছু রাস্তা ছেলেকে চালাতে দিয়েছিলেন। সাইকেল নিয়ে পড় গিয়ে ছেলের কান্না। তাই বাবার পেছনে বসে বাকি পথ।
ছন্দকের মাধ্যমে প্রথম আলাপেই রুবিয়া বলেছিল, ও র্যালিতে সাইকেল চালাবে। ‘তুমি কি আগে কখনো এত পথ সাইকেল চালিয়েছো?’ জবাবে জানলাম, ও বর্ধমানের মেয়ে। সাইকেল চালিয়ে স্কুল, কলেজ করেছে। প্রেসিডেন্সি থেকে এমএসসি করে এখন ফিজিওলজিতে ডক্টরেট করছে। কলকাতায় পিকনিক গার্ডেন থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ আসতে রিক্সা, অটো, বাস করে ওর সময়ও খরচা দুটোই বেশি পরে। কিন্তু বাড়ির লোকের ভয় কলকাতার রাস্তায় সাইকেল চালানো নিয়ে। আরে! তোমাকে শুধু র্যালি কেন, সাইকেল আন্দোলনেই তো চাই। ও তো এক কথায় রাজি।
কলকাতার রাস্তায় সাইকেল চালানোর অসুবিধার কথা অভিজিৎ-ও বলেছিল। অভিজিৎ ও মহুয়া দু’জনেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের আর্ট টিচার। প্রথমবার সাইকেল র্যালির সময় ওর ছেলে তিকান তখন বালিগঞ্জ পাঠভবনে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। শিয়ালদার শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পেছনে ওদের বাড়ি। রুটের বাসে করে যেতে ওর ছেলের অসুবিধার কথা ও জানিয়েছিল। নিরাপদে সাইকেল চালানোর যদি ব্যবস্থা থাকতো, তবে ও ছেলেকে সাইকেলেই পাঠাতো। মহুয়া বলেছিল, ও যখন আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, পয়সা জমিয়ে সাইকেল কিনেছিল। কিন্তু এবারে ও সাইকেল চালাতে পারেনি। বলল, পরেরবার চালাবে। সোহিনী আর রিষার-ও খুব আপশোষ ছিল, পরের বার ওরাও ঠিকঠাক শিখে নিয়ে চালানোর ব্যাপারে কথা দিল। মহুয়া র্যালির জন্য নিজের খরচে ছবি সমেত ‘এনজয় সাইক্লিং’ লেখা ব্যানার করে নিয়ে এসেছিল।
এরকম নানা ছোটো ছোটো সামর্থ্য ও কথা দিয়ে আমরা র্যালিটা সত্যিই এনজয় করেছি। যাতায়াতের পথে পাড়ার চায়ের দোকানে কয়েকজন পরিচিত আড্ডা মারে। র্যালির কয়েকদিন আগে ওদের হাতে ছাপানো লিফলেট দিলাম। আগের দিন বিকালে ফোন এল মি: ভিক্টর অ্যাসবেট-এর কাছ থেকে, যিনি এই আড্ডায় ছিলেন। এই পঁচাত্তর বছর বয়সের বাংলাভাষী খ্রীষ্টান মানুষটি জানালেন, তিনি তার বন্ধুর মেয়ের সাইকেলটি জোগাড় করেছেন। এই র্যালিতে যোগ দেবেন বলে। স্বাগত জানালাম, কিন্তু মনে সংশয় হলো। প্রায় চল্লিশ বিয়াল্লিশ কিমি পথ — এতটা তিনি পারবেন কি?
ফেসবুক দেখে র্যালির সপ্তাহখানেক আগে যোগাযোগ করেছিলেন দিলীপ বাসভা। কলকাতায় দু-বছর হলো এসেছেন। থাকেন বাঁশদ্রোণীতে। চাকরি কর্পোরেট অফিসে। একদিন সাউথ সিটি মলে সিনেমা দেখতে গিয়ে সাইকেল পার্কিং এর জন্য যে টাকা খরচ হয়েছিল, তা ওর সিনেমার টিকিটের দামের থেকে বেশি। হল-এ ম্যানেজারের সাথে বাকবিতণ্ডা। ওর প্রশ্ন, কেন হল-এ সাইকেল স্ট্যান্ডের ব্যবস্থা নেই। খুবই সাধারণ এবং প্রয়োজনীয় দাবি। আমার কাছ থেকে এই র্যালি ও আন্দোলন সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। প্রস্তাব দিলেন, র্যালিটির জন্য টিশার্ট বা টুপির ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু আমাদের র্যালি তো নিছকই একটা র্যালি নয়। কলকাতার রাস্তায় নিরাপদে ও নির্ভয়ে সাইকেল চালানোর অধিকারের জন্য ২০০৯ সাল থেকে আমাদের এই আন্দোলন। স্পনসরশিপের ছটায় এই আন্দোলনের তাৎপর্য কি হারিয়ে যাবে না? স্পনসরশিপ নেওয়ার আমাদের এই সমস্যার কথা উনি শুনলেন। হয়তো হতাশ হলেন। ফোনে আর কথা এগোলো না। শুক্রবার ১৯ ফেব্রুয়ারি ওনার ফোন। জানালেন, শনিবার অফিস ছুটি। হাজার টাকার মধ্যে গোটা চল্লিশেক টুপি উনি নিজের খরচে কিনে দেবেন। যদি আমাদের কোনো লোক ওনার সাথে থাকেন, ভালো হয়। টালিগঞ্জের মহাবীরতলায় থাকেন রঞ্জন সাধুখাঁ। উনি রাজি হলেন সঙ্গ দিতে।
এই রঞ্জনদার দায়িত্ব ছিল টালিগঞ্জ থেকে যে দলটি র্যালিতে অংশ নেবে তাদের জড়ো করার। এই মানুষটির সাথে আলাপ হয়েছিল আকস্মিক। গতবছর এপ্রিল মাসে আমার ফোনে ওনার একটা ফোন কল আসে। উনি নম্বরটা টুকে রেখেছিলেন। গত র্যালির পোস্টার থেকে। বড়ো রাস্তায় সাইকেল চালানোর জন্য টালিগঞ্জ থানা ওনাকে ধরেছিল। পাকা রশিদ ছাড়া উনি ফাইন দেবেন না। তাই পুলিশ ওনাকে কোর্টে পাঠায়। পরের দিন কোর্টে আমি আর শমীক দেখা করলাম। সেদিন থেকে উনি আমাদের সাথে। ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আগোছালো। র্যালির অবস্থাটা আমার মতোই হয়ে পড়েছিল। কেউ কেউ পিছিয়ে পড়ছিলেন। পড়ে গেছেন, চোট পেয়েছেন। অথবা সাইকেল বিকল। সিগন্যাল ক্রশিং-এও কেউ কেউ আটকে গেছেন। কিন্তু র্যালির লাস্ট ডিফেন্স রঞ্জনদা। পুরো সাইকেল র্যালিতে ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়েছেন। র্যালির সবচেয়ে পেছনের মানুষটিকে খেয়াল রেখেছেন। যত্ন নিয়েছেন। প্রয়োজনে আমাকে ফোন করেছেন, র্যালিটিকে দাঁড় করানোর জন্য। এই দায়িত্বের কথা ওনাকে কেউ বলে দেয়নি। এটা হলো নিজস্ব বিচারবুদ্ধি ও ভালোবাসার কাজ।
উনি আমাদেরকে বড়ো বিপদের থেকে বাঁচিয়েছেন। রাণিকুঠি থেকে গান্ধিকলোনি হয়ে আমাদের র্যালিটা বাঘাযতীনের মোড় থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে যাবে। ওই রাস্তায় ভিক্টরদার সাথে সাথে কিছু পথ চালিয়ে আবার সামনের দিকে এগিয়ে গেছিলাম। র্যালিটাকে যেতে দিয়ে ওনার জন্য অপেক্ষা করলাম। দশ-বারো মিনিট দাঁড়িয়ে, কিন্তু ওনার দেখা নেই, চিন্তায় ফোন করে জানলাম। ভিক্টরদা একটু অসুস্থ বোধ করাতে উনি ওনাকে বিশ্রামে রেখেছেন। ফিরে গিয়ে ওনাকে দেখে আমি শঙ্কিত, ছায়ায় একটি বসে আর কোল্ড ড্রিঙ্কস পান করে ভিক্টরদা আমাদের অভয় দিয়ে বললেন, উনি ফিট। যাদবপুর থেকে উনি বাকি পথ ম্যাটাডোরের সামনে বসে এসেছেন। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির চার নম্বর গেটে ওখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কিছু ছাত্র টিফিনের ব্যবস্থা করেছিল। মৌনাক, অরিত্র, অভিজিৎ, দেবজ্যোতি, অভীকরা ছিল। এক সন্ধ্যায় ওদের সাথে রাণিকুঠি-টালিগঞ্জ এলাকায় পোস্টারও মেরে এসেছিলাম।
ভিক্টরদাকে সঙ্গে নিয়ে যখন আমি ও রঞ্জনদা ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম, দেখি সবার হাতে মুখে টিফিন। হাতে গড়া রুটি, কলা, ডিম, সঙ্গে চা। সবুজ পাতাভরা পুকুর পাশে পেয়ে গাছের ছায়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা মানুষগুলোকে দেখে চনমনে হয়ে ওঠলাম। অভিজিৎ করগুপ্তের স্ত্রী শ্রীমতি মাধুরী বললেন, ‘র্যালিতে জানুয়ারি মাসের প্রথমে করলে ভালো হয়।’ একদম ঠিক কথা, এবার র্যালিটা নিয়ে আমার একদমই ইচ্ছে ছিল না। যে-কজন র্যালির ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়, তাদেরও গরজ ততটা ছিল না। কিন্তু ফোন করে অনেকে র্যালির ব্যাপারে উৎসাহ দেখান। শমীকের যুক্তি — গত দুটি র্যালি ছিল হাওয়ার বিরুদ্ধে। আর এবার তো রাজ্য সরকার ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল দিয়ে সাইকেলের হাওয়া তুলে দিয়েছে। আমরাও সেই হাওয়ায় সাইকেল চালাই না কেন? প্রস্তুতিতে তাই দেরি হলো।
যাই হোক, ক্যাম্পাসে পৌঁছে পেটে এল খিদে, খাবার খেয়ে চা নেবো। দেখি সজল আরেকবার চা নিচ্ছে, চা-টা সত্যিই ভালো হয়েছিল। সজল আমার ছোটোবেলার পরিচিত। আগে কাকুঁড়গাছিতে থাকতো। এখন কেষ্টপুর ছাড়িয়ে মহিষবাথানে বাড়ি করে চলে গেছে। এখানে দোকান। আগে বাইক চালাতো, বছর দশেক হলো সাইকেলে করে ১৬-১৭ কিমি রোজ যাতায়াত করে। রবিবারের বিশ্রাম ছেড়ে এতদূর থেকে এসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত র্যালিতে ছিল এটা আমার কাছে খুবই আনন্দের ব্যাপার।
হাবড়া অশোকনগর থেকে সৈকত, পম্পা, মহিদুলরা এসেছিল পাঁচজন। উল্টোডাঙা বস্তির জাহিদ ওদের জন্য পাঁচটা সাইকেল যোগাড় করে দিয়েছিল। এবার আমরা প্রত্যাশা মতো সাইকেল যোগাড় করে উঠতে পারিনি; ফলে বেশ কয়েকজনকে ভাগাভাগি করে চালাতে হয়েছে।
শুভায়ন এসেছিল ওর বন্ধু ফটোগ্রাফারকে নিয়ে। সঙ্গের ছবিগুলো তারই তোলা।
শ্রীমানের সাথে যোগাযোগ করে এসেছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হবিবুল্লা, আবদুর, জসীম ও ওয়াসিম এসেছিল। ওদের জন্য সাইকেল জোগাড় করে এনেছিল শমীক।
অগ্নীশ্বর, ওর ভাই আর প্রবীর পণ্ডা শ্রীরামপুর থেকে ট্রেনে সাইকেল চাপিয়ে এসেছিল।
ম্যাটাডোরে দশটা সাইকেল চাপিয়ে এনেছিল শমীক ও সোহিনী। ওদের সঙ্গে এসেছিল সুপর্ণা, পুরোটা সাইকেল চালালো, তারপর উল্টোডাঙা থেকে ট্রেন ধরে গেল ব্যারাকপুর, ওর ছেলে ওখানে বোর্ডিং-এ থাকে, তাকে দেখতে। সারা সপ্তাহ কাজ করে, রবিবারও দুটো বাড়ি সেরে ছেলেকে দেখতে যায় সুপর্ণা, র্যালির দিন শুধু সকালের কাজগুলো কামাই দিয়েছে।
আর দশজন ছাত্র শিক্ষক সহ সাইকেলে চাপিয়ে ম্যাটাডোরে এনেছিল অমলেন্দু। পেশায় একজন শিক্ষক, কিন্তু যেকোনো পরিবেশ আন্দোলনে অমলেন্দু একজন উৎসাহী মানুষ। খাওয়া দাওয়ার শেষে ফেরার জন্য একটা ম্যাটাডোরের খোঁজে যেতে যেতে বলল, ‘জানেন এই র্যালিতে কিছু ছেলে র্যালিতে মুখে সিগারেট আর গালাগাল দিতে দিতে যাচ্ছিল। আমি বারণ করাতে নিজেদের মধ্যে আরো জোরে গালাগাল চালাতে লাগলো। দেখুন, এই রকম একটা র্যালির সাথে এটা বেমানান।’ ভাবার চেষ্টা করলাম, ওরা কারা। আমাদের পাড়ার ছেলেরা মাঝে মাঝেই নিজেদের মধ্যে রেস করছিল। র্যালি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। এটা অবধি আমি খেয়াল করছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কাজটা ওরাই করেছে। বকাবকি করাতে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘আমরা তো এভাবেই চালাই’।
এবারের র্যালিতে অংশগ্রহণকারী সর্বকনিষ্ঠের নাম হলো বিয়াস দত্ত। হেরিটেজ স্কুলে ক্লাস ওয়ানের এই ছাত্রীর মা প্রিয়াঙ্কা ফোন করে জানায় যে উনি এই র্যালিতে সাইকেল চালাবেন। সঙ্গে ছোটো মেয়ে ছোট সাইকেলে থাকবেন। কিন্তু ওনার স্বামীকে একটা সামনে বেবিসিট ওয়ালা সাইকেল জোগাড় করে দিতে হবে। কেন না ওইটুকু মেয়ে পুরো পথ সাইকেল চালাতে পারবে না। শ্যামবাজার পর্যন্ত বাচ্চাটি র্যালির সাথে সাইকেল চালিয়েছিল। তারপর বাবার সাথে।
শ্যামবাজার থেকে বিধান সরনী ধরে এগোনোর সময় র্যালির সামনের অংশ ও পেছনের অংশ আলাদা হয়ে গেল। ফিরে গিয়ে দেখি, শ্যামবাজার নেতাজী স্ট্যাচুর নিচে বাবলা আমাদের অনেককে জড়ো করে স্লোগানিং করছে ট্র্যাফিক আটকে। পাঁচমাথার মোড়ে সাইকেল ওয়ালারা চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে আর গাড়ি, বাস দাঁড়িয়ে আছে — দেখতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু আমাদের এ বছর র্যালিটা নিয়ে পুলিশের সমস্যা ছিল। একে চিঠি জমা করতে দেরি হয়েছিল, ওনারা চিঠি নিতে পর্যন্ত চাননি, সেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কলকাতায় একটা প্রোগ্রাম ছিল। র্যালির আগে দু-তিন দিন ধরে বিভিন্ন ট্র্যাফিক পয়েন্ট ও থানা থেকে লালবাজারের নির্দেশে ফোন এসেছিল আমার কাছে। কখন কোন সময়ে কোথা থেকে র্যালি পাস করবে এটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ওনাদের জানাতে হয়েছিল। শেষদিন স্পেশ্যাল ব্র্যাঞ্চ থেকে আমাকে কয়েকবার ফোন করে র্যালিটা বাতিল করার কথা বলেছিল। আমাদের র্যালির রুটের বহু রাস্তায় কিন্তু আইনত সাইকেল নিষেধ। আমাদের দিক থেকে ব্যাপারটা ছিল, এইসব রাস্তায় সাইকেল চালানোটাই আমাদের প্রতিবাদ ও অ্যাকশন। গত দুটো র্যালি করে আমরা দেখেছি, এতে প্রশাসনের ওপর প্রভাব পড়ে। গত বছর মে দিবসের হোসেয়ারি শ্রমিকদের একটা সভায় একজন শ্রমিক জানিয়েছিলেন, শ্যামবাজারে সাইকেল চালকদের ওপর ধরপাকড়টা কমেছে। আমাদের র্যালিটা ছিল সাধারণ সাইকেলপ্রেমী মানুষদের র্যালি, যারা সারা সপ্তাহ নানা কাজে ভয়ানক ব্যস্ত থাকেন, যাতে অ্যাকটিভিস্টরা যোগ দিয়েছেন। আমরা যারা অ্যাকটিভিস্ট, অনেক সময় এগুলো মনেই থাকে না।
এবারের র্যালিতে কয়েক জোড়া বাবা ও ছেলে যোগ দিয়েছিল। যেমন এন্টালি থেকে আবদুর রশিদ এসেছিলেন ওনার ছোটো ছেলে আবদুলকে নিয়ে। ওই এন্টালি থেকেই বন্ধুবান্ধব সহ যোগ দিল আবু। প্রত্যেকবারই দেয়। ওকে আমার সময়মত বলা হয়নি। ও নিজে থেকেই জিতেনদার মাধ্যমে খবরাখবর নিয়ে পোস্টারের উদ্যোগও নিয়েছিল।
এবারের র্যালিতে কল্লোলের উৎসাহ ছিল বেশি। কলকাতা সাইকেল সমাজের ফেসবুক পেজ খোলা, সেটাকে নিয়মিত আপডেট করা, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর বেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন বা নোয়াম চমস্কিকে সাইকেল র্যালির কথা জানিয়ে তাদের সমর্থন যোগাড় করা — সবই ও নিজে করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লায়েড অপটিক্স বিভাগে অধ্যাপনার ব্যস্ততা সামলে। কল্লোল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করেছে সাইকেলে। এখন পড়াতে যায় সাইকেলে। র্যালির আগের সপ্তাহে কলেজ থেকে সাইকেলে ফেরার পথে কল্লোল রাত দশটায় আমার সাথে দেখা করল। সুন্দর করে ছাপানো ইংরাজি লিফলেট তৈরি করে, ছাপিয়ে আমাকে দিয়ে গেল প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও। পরের দিন ভোর পাঁচটার ফ্লাইটে দেরাদুন যেতে হবে। অপটিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার মিটিং-এ, কল্লোল তার সেক্রেটারি।
র্যালি শেষে কাকুঁড়গাছি অভিযান ক্লাবে লাঞ্চ। সাধারণ খাবার, সেটাই অসাধারণ হয়ে গেল ক্লাবের প্রাক্তন কালচারাল সেক্রেটারি ইন্দ্র যখন একশ’ রসগোল্লার একটা হাঁড়ি নিয়ে এসে রাখল, সবার একটা করে। বহু বছর আগে যখন ক্লাব থেকে দীঘা যাওয়া হয়েছিল, তখন তাতে যাওয়ার ব্যাপারে বাড়ির লোককে রাজি করাতে দু-দিন অনশন করেছিল ইন্দ্র।
র্যালিতে অংশ নিয়েছিল শতাধিক মানুষ। এই মুহুর্তে যাদের কথা মনে পড়ল, তাদের কথা এক নিঃশ্বাসে লিখে ফেললাম।
Rabindranath Banerjee says
KOLKATAR PROTITI RASTATE CYCLE CHALONOR ANUMOTI SARKARKEI DITE HABE, CYCLE CHALAR JONNE RASTA CHAI.