পুষ্পল ঘোষ। শান্তিপুর। ১১ ডিসেম্বর, ২০২০।#
শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবছর পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী চুপিচরে হাজির হয় হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। আর এই পাখি দেখতেই ভিড় জমায় পাখিপ্রেমী অনেক মানুষ। একদিনের এই নৌকাবিহার ধীরে ধীরে খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এবছর অতিমারি পরিস্থিতি এবং দীর্ঘ লকডাউনে গৃহবন্দি অবস্থায় আমরা অনেকেই ক্লান্ত। বন্দিদশা থেকে কিছুটা মুক্তির আশায় ভাবলাম একদিন ঘুরে আসি চুপিচরে পাখিদের রাজ্যে। বিভিন্ন রকমের পাখিদের ছবি ক্যামেরাবন্দি করাই আমার নেশা। তাই বর্তমান পরিস্থিতির খবর নিতে ফোন করলাম বাবুদাকে, বাবুদা একজন খুব ভালো মনের মানুষ, চুপিচরে নৌকা চালিয়ে এবং মাছ ধরেই তার রুজি রোজগার। নিজের পরিচয় দেন বোটম্যান বাবু শেখ বলে। আসলে এরা শীতকালে পর্যটকদের নৌকা করে পাখি দেখিয়ে এবং অন্যসময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাবুদার মত অনেকেই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। এবছর অতিমারি পরিস্থিতিতে বেশ কষ্টের মধ্যে দিন কেটেছে বা কাটছে তা তাদের কথাতেই স্পষ্ট। ওরা সবাই মনে শঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে আছে এই শীতকালটার দিকে, যদি পর্যটক না আসে তাহলে সংসারটাই হয়তো ভেসে যাবে। আসলে করোনা নামক ভাইরাসের নামে এইরকম কত মানুষের সংসার ভাসিয়ে দিয়েছে তার হিসেব হয়তো সরকারি পরিসংখ্যানে নেই। অবশেষে ট্রেন বাস চলাচল শুরু হওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস তারা ফেলতে পারছেন, কিছু পর্যটক পাবার আশায়। ফোনে আশ্বস্ত হয়ে খুব ভোর ভোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পৌঁছলাম চুপির চরে। পাড়ে নৌকা নিয়ে হাজির বাবুদা।
নৌকায় চড়তেই বলল আজ আমরা প্রথমেই পূর্বস্থলীর কিং, OSPREY দেখব। যাকে আমরা মাছমুরাল বলে চিনি। হালকা শীতের আমেজে সকালের এই শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশে নৌকায় করে যাত্রা শুরু করলাম কিং অফ পূর্বস্থলীর দিকে। সকালে প্রকৃতির এই অপরূপ শোভায় মনটা ভীষণ খুশি হয়ে গেল। এই পাখি সম্পর্কে আমি আগেই জেনেছি এবং অনেক ভিডিও দেখেছি। কিন্তু এবার নিজের চোখে দেখব এবং ক্যামেরাবন্দি করব ভেবেই রোমাঞ্চিত। চর ধরে অনেকদূর এগোনোর পরে মূল গঙ্গায় নৌকা প্রবেশ করতেই বাবুদা ছোট একটা বাইনোকুলারে চোখ রেখে বলল দাদা কিং বসে আছে, ক্যামেরা রেডি করে ফেলুন। আপনাদের কপাল ভালো, গতকালই যাদের নিয়ে এসেছিলাম তাদের ভাগ্যে জোটেনি। সত্যিই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল। রাজার মত বসে আছেন তিনি, এদিক ওদিক চাউনি তার। সে এক অনন্য অনুভূতি। দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় তিন চার ঘন্টা নদীর বুকে ছুটে বেড়ালাম কিছু ভালো ছবি ফ্রেমবন্দী করার জন্য। অনেকদিনের শখ এই শিকারি পাখির শিকার করতে দেখার ছবি ফ্রেমবন্দী করার। তা ষোল আনা পূর্ণ হলো পূর্বস্থলী চুপিচরে এসে। বৃহৎ ডানার ঝাপটে পুরো শরীর নিয়ে জলে মাছের ওপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দৃশ্য সত্যিই রোমাঞ্চকর। উড়ে যেতে যেতে হঠাৎই শিকারের ওপর তার অব্যর্থ আক্রমণ। তীব্র দৃষ্টিশক্তি দিয়ে দূর থেকে শিকারটিকে শনাক্ত করে তার দিকে দ্রুত বেগে ধাওয়ার ছবি, পাখির ছবি যারা তোলে তাদের কাছে স্বপ্নের বিষয়। এদের শিকার ধরার কৌশলও ভীষণ আক্রমণাত্মক ।
মাছমুরাল দিবাচর শিকারি ও মাংসাশী পাখি। এদের দেখার ক্ষমতা প্রখর। সেই সঙ্গে রয়েছে ধারালো নখযুক্ত শক্তিশালী আঙুল ও পা। মাংস ছেঁড়ার জন্য রয়েছে বঁড়শির মতো বাঁকানো ঠোঁট। আমাদের দেশের নদী, বিল প্রভৃতির আশেপাশে এদের দেখতে পাওয়া যায়। এরা সাধারণত ইউরোপের স্কটল্যান্ড বা স্পেন, চীন, জাপান ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে পরিযায়ী হয়ে শীতকালে ভারতে আসে।
শুধু মাছমুরাল বা osprey-ই নয় বিভিন্ন ধরনের সুন্দর সুন্দর পরিযায়ী পাখি এই সময়ে দেখতে পাওয়া যায় এই চুপিচরে। যদি পূর্বস্থলীর এই পাখিরালয়টিকে আরো ভালো করে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় তাহলে গড়ে উঠতে পারে সুন্দর একটা পর্যটন কেন্দ্র, সঙ্গে হতে পারে কিছু মানুষের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম।
Leave a Reply